কুরবানী আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ) ও তদীয় পুত্র হাবিল-কাবীল এবং মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ) ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর সুমহান আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-ভরসা ও জীবনের সর্বস্ব সমর্পণের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সমন্বয়। কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। ঠিক অনুরূপ লোক দেখানোর জন্য বেশ কয়েকটি কুরবানী করাও সুন্নাহর পরিপন্থী। যেহেতু হাদীসানুসারে একটি পরিবারের সকলের তরফ হতে কেবল একটি পশুই যথেষ্ট। সাহাবাদের আমলও অনুরূপ ছিল। গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু’ হল উট, গরু, ছাগল ও ভেড়াকে বুঝানো হয়েছে। এদের উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার অর্থ, এদের যবেহ করা, যা আল্লাহর নাম নিয়েই করা হয়। আর ‘বিদিত দিনগুলি’ বলতে যবেহর দিনগুলি; অর্থাৎ তাশরীকের দিনসমূহকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং যবেহর দিন হল, কুরবানীর দিন (১০ম যুলহজ্জ) ও তার পরের দুই দিন (১১ ও ১২ ই যুলহজ্জ) পর্যন্ত কুরবানী করা যায়।
কুরবানীর ইতিহাস :
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম কুরবানীর ঘটনা ঘটে আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র হাবিল-কাবীলের মাধ্যমে। যারা আল্লাহর জন্য আলাদা আলাদা কুরবানী করেছিলেন। কুরআনুল কারীমে হাবিল-কাবীলের কুরবানীর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَاناً فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ- لَئِنْ بَسَطتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِيْ مَا أَنَاْ بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لَأَقْتُلَكَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِيْنَ-
‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হ’ল এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হ’ল না। সে (কাবীল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন। সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদা ২৭-২৮)।
তৎকালীন সময়ে কুরবানী গৃহীত হওয়ার লক্ষণ ছিল আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানীকে ভস্মিভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেত। যে কুরবানী অগ্নি এসে ভস্মিভূত করত না তাকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হ’ত। হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু পালন করত। সে একটি মোটা তাজা উৎকৃষ্ট দুম্বা কুরবানী করল। কাবীল কৃষি কাজ করত সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কুরবানীর জন্য পেশ করল। অতঃপর নিয়ম অনুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা অবতরণ করে হাবিলের কুরবানিটি ভস্মিভূত করে দিল এবং কাবীলের শস্য কুরবানী যেমনি ছিল তেমনি পড়ে রইল।
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অগ্নি পরীক্ষা নিয়েছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট থেকে। তিনি প্রতিটি পরীক্ষায় হিমাদ্রীসম ধৈর্য ও ত্যাগের মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বাণী, وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيْمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّيْ جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَاماً ‘যখন ইবরাহীম (আঃ)-কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মাবনজাতির নেতা বানিয়ে দিলাম’ (বাক্বারাহ ১২৪)।
ইসমাঈল (আঃ) যখন চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হ’লেন, তখন ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রাণ প্রতীম পুত্রকে কুরবানী করার জন্য স্বপ্নাদিষ্ট হ’লেন। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, নবীগণের স্বপ্নও ‘অহি’। তাই এ স্বপ্নের অর্থ ছিল, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রতি স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে কুরবানী করার নির্দেশ। এ নির্দেশটি সরাসরি কোন ফেরেশতার মাধ্যমেও নাযিল হ’তে পারত। কিন্তু স্বপ্ন দেখানোর তাৎপর্য হ’ল, ইবরাহীম (আঃ)-এর আনুগত্য পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পাওয়া। স্বপ্নে প্রদত্ত আদেশের ভিন্ন অর্থ করার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। কিন্তু ইবরাহীম (আঃ) ভিন্ন অর্থের পথ অবলম্বন করার পরিবর্তে আল্লাহর আদেশের সামনে মাথা নত করে দেন। আত্মসমর্পণকারী ইবরাহীম (আঃ) এই কঠোর পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। তিনি পুত্র ইসমাঈলকে জিজ্ঞেস করলেন, يَا بُنَيَّ إِنِّيْ أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّيْ أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى ‘হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এ বিষয়ে তোমার অভিমত কি’?
নবী-রাসূলগণের স্বপ্ন নিদ্রাপুরীর কল্পনা বিলাস নয়। এ আদেশ অহি-র অন্তর্ভুক্ত। পুত্র ইসমাঈল (আঃ) পিতার এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বলতে পারতেন এটি একটি নিছক স্বপ্ন বৈ কিছুই নয়। কিন্তু তিনি তা না বলে অত্যন্ত বিনয় ও আনুগত্যের সাথে স্বীয় পিতাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِيْ إِنْ شَاءَ اللهُ مِنَ الصَّابِرِيْنَ ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা পালন করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে ছবরকারীদের মধ্যে পাবেন’ (ছাফফাত ১০২)।
আত্ম নিবেদনের এ কি চমৎকার দৃশ্য! জনমানবহীন মিনা প্রান্তরে ৯৯ বছরের বৃদ্ধ ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানী করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্ত্তত। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে এবং তাঁরই অনুরাগ ও প্রেমলাভ করার দুর্ণিবার আগ্রহে পুত্রকে কুরবানীর মেষের মতই উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। আর কণ্ঠনালীকে কাটার জন্য বার্ধক্যের শেষ শক্তি একত্রিত করে শাণিত ছুরি তুলে ধরলেন। পুত্র ইসমাঈলও শাহাদতের উদগ্র বাসনা নিয়ে নিজের কণ্ঠকে বৃদ্ধ পিতার সুতীক্ষ্ণ ছুরির নিচে স্বেচ্ছায় সঁপে দিলেন। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য! পৃথিবীর জন্ম থেকে এমন দৃশ্য কেউ অবলোকন করেনি। এ দৃশ্য দেখে পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়ায়। পৃথিবীর সকল সৃষ্টি যেন অপলক নেত্রে চেয়ে থাকে এ চরম পরীক্ষার দিকে। সকল সৃষ্টিই যেন নিথর নিস্তব্ধ হয়ে যায় এ দৃশ্য অবলোকনে। কিন্তু না চরম আত্মত্যাগী ইবরাহীম (আঃ)ও চরম আত্মোৎসর্গকারী ইসমাঈল (আঃ) এ কঠিন ও চূড়ান্ত পরীক্ষায়ও কৃতকার্য হ’লেন। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা হ’ল- وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيْمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ- إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلاَءُ الْمُبِيْنُ- وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ- ‘তখন আমি তাঁকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এর পরিবর্তে যবেহ করার জন্য দিলাম এক মহান পশু’ (ছাফফাত ১০৪-১০৭)।
বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রতি সদয় হ’লেন। ইসমাঈলের রক্তের পরিবর্তে তিনি পশুর রক্ত কবুল করলেন। আর ইবরাহীম (আঃ)-এর পরবর্তী সন্তানদের জন্য কুরবানীর সুন্নাতকে জারি রাখলেন। আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণের এই মহান স্মৃতিকে চির জাগ্রত করার জন্যই ১০ যিলহজ্জকে আল্লাহ চির স্মরণীয় ও বরণীয় করেছেন। জন্ম থেকে জীবনের ৯৯টি বছর ধরে একের পর এক পরীক্ষা করে যখন আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রতি সন্তুষ্ট হ’লেন, তখন তাঁর এই সুমহান কীর্তি পৃথিবীর সকল মুসলমানের জন্য ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবিস্মরণীয় ও স্থায়ী করে দিলেন। নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে। وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِيْنَ ‘আমি তাঁর জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য পালনীয় করে রেখেছি’ (ছাফফাত ১০৮)।
আজও আমরা সেই ইবরাহীমী সুন্নাতের অনুসরণেই প্রতি বছর যিলহজ্জ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে পশু কুরবানী করে থাকি। এটি মুসলিম মিল্লাতের অন্যতম একটি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। ক্বিয়ামত উষার উদয়কাল পর্যন্ত এই মহান আত্মত্যাগের ধারাবাহিকতা চলমান থাকবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়ে বলেন,- فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন’ (কাওছার ২)।
ভাগাকুরবানীর দলিল ও এর পর্যালোচনা :
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ فِىْ سَفَرٍ فَحَضَرَ الْأَضْحَى فَاشْتَرَكْنَا فِى الْبَقَرَةِ سَبْعَةٌ وَ فِى الْبَعِيْرِ عَشَرَةٌ رواه الترمذى والنسائى وابن ماجه بإسناد صحيح كما قاله الألبانى-
(ক) অর্থঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হ’ল। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হ’লাম’। [তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হা/১৪৬৯ সনদ ছহীহ।]
(খ) হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে হজ্জ ও ওমরাহর সফরে সাথী ছিলাম।… তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাতজন করে শরীক হয়েছিলাম’।[মুসলিম (বৈরুতঃ ১৯৮৩) হা/১৩১৮।]
সফরে সাত বা দশজন মিলে একটি পরিবারের ন্যায়। যাতে গরু বা উটের ন্যায় বড় পশু যবহ ও কুটাবাছা এবং গোশত বন্টন সহজ হয়। জমহূর বিদ্বানগণের মতে হজ্জের হাদ্ঈর ন্যায় কুরবানীতেও শরীক হওয়া চলবে।[মির‘আত ২/৩৫৫ পৃঃ; ঐ, ৫/৮৪ পৃঃ।]
(গ) হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জের সফরে মিনায় নিজ হাতে ৭টি উট (অন্য বর্ণনায় এর অধিক) দাঁড়ানো অবস্থায় ‘নহর’ করেছেন এবং মদীনায় (মুক্বীম অবস্থায়) দু’টি সুন্দর শিংওয়ালা ‘খাসি’ কুরবানী করেছেন’। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সফরসঙ্গী স্ত্রী ও পরিবারের পক্ষ হ’তে একটি গরু কুরবানী করেন’।[বুখারী (মীরাট ছাপাঃ ১৩২৮ হিঃ) ১/২৩১ পৃঃ; আলবানী-ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৫৩৯।] অবশ্য মক্কায় (মিনায়) নহরকৃত উটগুলি ছাহাবীগণের পক্ষ থেকেও হ’তে পারে।
সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা:
ইবনু আববাস (রাঃ)-এর হাদীছটি নাসাঈ, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহতে, জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি মুসলিম ও আবুদাঊদে এবং আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি বুখারীতে সংকলিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারীতে যথাক্রমে ‘হজ্জ’ ও ‘মানাসিক’ অধ্যায়ে এবং সুনানে ‘কুরবানী’ অধ্যায়ে হাদীছগুলি এসেছে। যেমন-
(১) তিরমিযী ‘কুরবানীতে শরীক হওয়া’ অধ্যায়ে ইবনু আববাস, জাবির ও আলী (রাঃ) থেকে মোট তিনটি হাদীছ এনেছেন। যার মধ্যে প্রথম দু’টি সফরের কুরবানী ও শেষেরটিতে কোন ব্যাখ্যা নেই।[ তিরমিযী তুহফা সহ, হা/১৫৩৭-৪০, ৫/৮৭-৮৮ পৃঃ।]
(২) ইবনু মাজাহ উক্ত মর্মের শিরোনামে ইবনু আববাস, জাবের, আবু হুরায়রা ও আয়েশা (রাঃ) হ’তে যে পাঁচটি হাদীছ (৩১৩১-৩৪ নং) এনেছেন, তার সবগুলিই সফরে কুরবানী সংক্রান্ত।
(৩) নাসাঈ কেবলমাত্র ইবনু আববাস ও জাবির (রাঃ) থেকে পূর্বের দু’টি হাদীছ (২৩৯৭-৯৮ নং) এনেছেন
(৪) আবুদাঊদ শুধুমাত্র জাবির (রাঃ)-এর পূর্ব বর্ণিত সফরে কুরবানীর হাদীছটি এনেছেন তিনটি ছহীহ সনদে (২৮০৭-৯ নং), যার মধ্যে ২৮০৮ নং হাদীছটিতে اَلْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْجَزُوْرُ عَنْ سَبْعَةٍ) ) কোন ব্যাখ্যা নেই।
উপরোক্ত হাদীছ সমূহে বুঝা যায় যে, সফরে সাতজনে মিলে একটি উট বা গরু কুরবানী করা যায়। যাতে এইসব বড় পশু যবহ ও কুটাবাছা এবং গোশত বিতরণ সহজ হয়। এটি উম্মতের জন্য রহমত স্বরূপ। সেকারণ লায়েছ বিন সা‘দ (রহঃ) উট বা গরুতে শরীকানা কুরবানীর বিষয়টি সফরের সাথে ‘খাছ’ বলেছেন।[মুহাল্লা, মাসআলা ক্রমিক : ৯৮৪, ৬/৪৫]
যদিও জমহূর ওলামায়ে কেরাম হজ্জের সময় উট বা গরুতে শরীকানা কুরবানীর উপর ক্বিয়াস করে বাড়ীতে ও সফরে সর্বাবস্থায় শরীকানা কুরবানী জায়েয বলেছেন। কিন্তু ইমাম মালেক (রহঃ) একে নাজায়েয বলেছেন (মির‘আত ৫/৮৫)। কেননা জাবের (রাঃ) বর্ণিত ‘একটি গরু বা উট সাত জনের পক্ষ হ’তে’।[আবুদাঊদ হা/২৮০৮; মিশকাত হা/১৪৫৮] হাদীছটি মুৎলাক্ব। যেখানে বাড়ীতে বা সফরে বলে কোন ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু একই রাবীর বর্ণিত আবুদাঊদ ২৮০৭ ও ২৮০৯ নম্বর হাদীছে এটি হজ্জ ও হোদায়বিয়ার সফরের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে ব্যাখ্যা এসেছে।
অতএব দলীলের ক্ষেত্রে একই রাবীর বর্ণিত ব্যাখ্যাশূন্য হাদীছের স্থলে ব্যাখ্যা সম্বলিত হাদীছ গ্রহণ করাই মুহাদ্দিছগণের সর্ববাদী সম্মত রীতি।
মুক্বিম অবস্থায় রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণ ভাগা কুরবানী করেছেন বলে আমার জানা নেই। যদি কারু জানা থাকে তবে অবগত করে কৃতার্থ করবেন। যদি না থাকে দলিল তবে মুকিম অবস্থায় ভাগা কুরবানী পরিহার করুন!
অতএব একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য সংখ্যা যত বেশীই হৌক না কেন সকলের পক্ষ থেকে একটি পশুই যথেষ্ট। এক পিতার সন্তান হ’লেও পৃথকান্ন হ’লে তারা পৃথক পরিবার হিসাবে গণ্য হবেন। তবে তারা পৃথক কুরবানীর জন্য পিতাকে অর্থ সাহায্য করতে পারেন। উল্লেখ্য যে, সাত ভাগা কুরবানীর হাদীছ সফরের সাথে সংশ্লিষ্ট,মুক্বীম অবস্থায় এটি প্রযোজ্য নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরাম মুক্বীম অবস্থায় কখনো সাত ভাগা কুরবানী করেননি। অনেকে ৩ বা ৫ ভাগে কুরবানী করেন, যা আদৌ শরী‘আতসম্মত নয়। কারণ নিম্নরূপ-
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় মুক্বীম অবস্থায় নিজ পরিবার ও উম্মতের পক্ষ হতে দু’টি করে ‘খাসি’ এবং হজ্জের সফরে গরু ও উট কুরবানী করেছেন (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৫৩)।
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদায় হজ্জে আরাফার দিনে সমবেত জনমন্ডলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে জনমন্ডলী! নিশ্চয়ই প্রতিটি পরিবারের উপরে প্রতি বছর একটি করে কুরবানী’ (সনদ ছহীহ, ছহীহ তিরমিযী হা/১২২৫; ছহীহ আবুদাঊদ হা/২৪২১; ছহীহ নাসাঈ হা/৩৯৪০; ছহীহ ইবনে মাজাহ হা/২৫৩৩; মিশকাত হা/১৪৭৮)।
(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরেও তাঁর সুন্নাত অনুযায়ী ছাহাবীগণের মধ্যে প্রত্যেক পরিবারের পক্ষ থেকে একটা করে কুরবানী করার প্রচলন ছিল। যেমন আতা ইবনু ইয়াসির ছাহাবী আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ)-কে রাসূলের যুগে কেমনভাবে কুরবানী করা হ’ত মর্মে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘একজন লোক একটি বকরী দ্বারা নিজের ও নিজের পরিবারের পক্ষ হ’তে কুরবানী দিত। অতঃপর তা নিজে খেত ও অন্যকে খাওয়াত (ছহীহ তিরমিযী হা/১২১৬ ‘কুরবানী’ অধ্যায়; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৫৩৩ ‘নিজ পরিবারের পক্ষ হতে একটা বকরী কুরবানী করা’ অনুচ্ছেদ, ‘কুরবানী’ অধ্যায়)।
(৪) প্রখ্যাত ছাহাবী আবু সারীহা (রাঃ) বলেন, ‘একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটা অথবা দু’টা করে বকরী কুরবানী করা হ’ত (ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৫৪৭)। ইমাম শাওকানী (রহঃ) উপরোক্ত পরপর তিনটি হাদীছ পেশ করে বলেন, হক কথা হ’ল, একটি পরিবারের পক্ষ হ’তে একটি ছাগলই যথেষ্ট, যদিও সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা শতাধিক হয়’ (নায়লুল আওত্বার ৬/১২১ পৃঃ, ‘একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানী করাই যথেষ্ট’ অনুচ্ছেদ)।
(৫) শা’বী বলেন: আমি ইবনু ওমার (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, গরু ও উট সাত জনের পক্ষ হতে (কুরবানীতে) কি যথেষ্ট হবে? ইবনে ওমার (রা:) বললেন: এটা কিভাবে হবে, ওর কি সাতটি আত্মা আছে? আমি বললাম: মুহাম্মাদ (ﷺ) এর ছাহাবী যারা কুফায় রয়েছেন তাঁরা তো আমাকে এই মর্মে ফাৎওয়া দিয়ে বলেছেন যে, হাঁ চলবে। নবী (ﷺ), আবু বাকর ও ওমার (রা:) বলেছেন। এতদশ্রবণে ইবনু ওমার বললেন, আমি তাহলে এটা অনুভব করতে পারিনি। (ইবনু হাযম-এর আল মুহাল্লা গ্রন্থে ইবনু আবী শায়বার সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। দ্র: ফিল উইহিয়্যাহ-পৃ: ৮৮)
ইবনে ওমার (রা:) বললেন, এটা কিভাবে হবে, ওর কি সাতটি আত্মা আছে? ———- এই বর্ণনা বিশুদ্ধ নয় তার প্রমাণ হলো- সে যুগে মুক্বীম অবস্থায় ভাগা কুরবানী ছিল না। কারণ ইবনে ওমর (রা.)-এর মত একজন প্রখ্যাত সাহাবী ভাগা কুরবানীর বিষয়টি জানত না। এমনকি তার পিতা থেকেও তিনি তা দেখেন নাই। তাই তিনি আশ্চর্য হয়েছেন এবং বলেছেন এটা কীভাবে সম্ভব, প্রাণীর কী সাতটি আত্মা আছে?
আদম (আঃ)-এর সময়ে কুরবানী গৃহীত হওয়ার লক্ষণ ছিল আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানীকে ভস্মিভূত হয়ে যেত। অতঃপর নিয়ম অনুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা অবতরণ করে হাবিলের কুরবানিটি ভস্মিভূত করে দিল এবং কাবীলের শস্য কুরবানী যেমনি ছিল তেমনি পড়ে রইল। এখান থেকে আরেকটি দিক নির্দেশনা পেলাম যে, কুরবানী জীবনের বা জীবের মাধ্যমে কবুলযোগ্য। অর্থাৎ- কুরবানী পশু দ্বারা উত্তম। অন্যদিকে ইব্রাহীম (আঃ)-এর সময়েও পশু দ্বারা কুরবানীর প্রচলন মুসলিম উম্মাহর জন্য নির্ধারন হয়। যা আজো চালু রয়েছে। অর্থাৎ- পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কুরবানী করা সুন্নাত সম্মত। আর সফরে ভাগা কুরবানী জায়েজ। যা মুকীম অবস্থায় ভাগা করবানী করা হয়েছে এমন হাদীস, সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফদের আমল বা আসারও নেই যা দলিল হিসেবে পেশ করা যায়। সাহাবীগণ মুক্বীম অবস্থায় উট, গরু কুরবানী করলেও তা ভাগাতে করেননি। কিন্তু ফিক্বহী মতামতে সফরের একটি আম হাদীসকে মুক্বীম অবস্থায় কিয়াস করে দলিল হিসেবে চালু রয়েছে এই ভারতবর্ষে। সুতরাং ভাগা কুরবানী জায়েজ তা শর্ত সাপেক্ষে। শর্ত হলো- সফরে থাকতে হবে।
যেমন অনেকে বলেন, সফরের হাদীছগুলো আম। যদি আম হয় তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ মুক্বীম অবস্থায় ভাগা কুরবানী করতেন মর্মে দলীল কোথায়? ‘উপরন্তু কুরবানী হ’ল পিতা ইবরাহীমের সুন্নাত। আর তা ছিল ইসমাঈলের জীবনের বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ হ’তে পাঠানো একটি পশুর জীবন। অর্থাৎ দুম্বা। এক্ষণে যদি আমরা ভাগা কুরবানী করি, তাহ’লে পশুর হাড়-হাড্ডি ও গোশত ভাগ করতে পারব, কিন্তু তার জীবনটা কার ভাগে পড়বে? অতএব ইবরাহীমী ও মুহাম্মাদী সুন্নাতের অনুসরণে নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হ’তে আল্লাহ্র রাহে একটি জীবন তথা একটি পূর্ণাঙ্গ পশু কুরবানী দেওয়া উচিত, পশুর দেহের কোন খন্ডিত অংশ নয়’। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।