আল্লাহর ইবাদত থেকে ফিরিয়ে কথিত অন্তর্গুরুর ইবাদতে লিপ্ত করার অভিনব প্রতারণার
নাম হ’ল কোয়ান্টাম মেথড। হাযার
বছর পূর্বে ফেলে আসা হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান পাদ্রী ও যোগী-সন্ন্যাসীদের যোগ-সাধনার
আধুনিক কলা-কৌশলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মেডিটেশন’। হতাশাগ্রস্ত
মানুষকে সাময়িক প্রশান্তির সাগরে ভাসিয়ে এক কল্পিত দেহভ্রমণের নাম দেওয়া হয়েছে Science
of Living বা জীবন-যাপনের বিজ্ঞান। আকর্ষণীয় কথার ফুলঝুরিতে ভুলে টাকাওয়ালা সাধারণ শিক্ষিত মানুষেরা এদের
প্রতারণার ফাঁদে নিজেদেরকে সঁপে দিচ্ছেন অবলীলাক্রমে। ব্যয়
করছেন কথিত ধ্যানের পিছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঢেলে দিচ্ছেন হাযার হাযার
টাকা। অথচ একটা রঙিন স্বপ্ন ছাড়া তাদের ভাগ্যে কিছুই জুটছে না। অন্যদিকে মুসলমান যারা এদের দলে ভিড়ছে, তারা শিরকের মহাপাতকে লিপ্ত হয়ে দুনিয়া ও
আখেরাত দু’টিই হারাচ্ছে। নিম্নে
আমরা এদের আক্বীদা-বিশ্বাস ও কর্মনীতি যাচাই করব।-
সুস্বাস্থ্য,
প্রাচুর্য,
সুখী পরিবার ও ধ্যান। বলা হয়েছে, কোয়ান্টাম
প্রত্যেকের ধর্মবিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে।
সুখী মানুষের সবটুকু
প্রয়োজন পূরণের প্রক্রিয়াই রয়েছে কোয়ান্টামে। তাই
কোয়ান্টামই হচ্ছে নতুন সহস্রাব্দে আধুনিক মানুষের জীবন যাপনের বিজ্ঞান’। অন্যান্য
ডিগ্রীর ন্যায় এখানকার ধ্যান সাধনায় যারা উত্তীর্ণ হয়,
তাদেরকে ‘কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট’ বলে শ্রুতিমধুর একটা ডিগ্রী দেওয়া হয়। তাদের
প্রচার অনুযায়ী বাংলাদেশে ফলিত মনোবিজ্ঞানের পথিকৃৎ এবং আত্মউন্নয়নে ধ্যান পদ্ধতির
প্রবর্তক প্রফেসর এম.ইউ. আহমাদ নাকি ক্লিনিক্যালি ডেড হওয়ার পরেও পুনরায় জীবন লাভ
করেন শুধু ‘তাঁকে বাঁচতে হবে,
তিনি ছাড়া দেশে নির্ভরযোগ্য
মনোচিকিৎসক নেই’ তাঁর
এই দৃঢ় বিশ্বাসের জোরে’ (মহাজাতক, কোয়ান্টাম টেক্সট বুক, জানু. ২০০০, পৃঃ ২২-২৪)।
অর্থাৎ হায়াত-মউতের মালিক
তিনি নিজেই।
প্রথমে বলে রাখি,
মানবরচিত প্রত্যেক ধর্মেই
স্ব স্ব নিয়মে ধ্যান পদ্ধতি আছে।
হিন্দু-বৌদ্ধ
যোগী-সন্ন্যাসীদের সাধন-ভজন সম্বন্ধে আমরা কিছুটা জানি। আল্লাহ
প্রেরিত ঈসায়ী ধর্মে সর্বপ্রথম সন্ন্যাসবাদের উদ্ভব হয়। যে
বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘আর
সন্ন্যাসবাদ, সেটাতো
তারা নিজেরাই প্রবর্তন করেছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। আমরা তাদেরকে এ বিধান দেইনি।
অথচ এটাও তারা যথাযথভাবে
পালন করেনি। তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল,
তাদেরকে আমরা পুরস্কার
দিয়েছিলাম। আর তাদের অধিকাংশ ছিল পাপাচারী’ (হাদীদ
৫৭/২৭)। এখানে আল্লাহ তাদেরকে দুইভাবে নিন্দা করেছেন। ১. তারা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত
অর্থাৎ নতুন রীতির উদ্ভাবন করেছিল।
২. তারা নিজেরা যেটাকে
আল্লাহর নৈকট্য মনে করে আবিষ্কার করেছিল, সেটার উপরেও তারা টিকে থাকতে পারেনি। ইসলামের স্বর্ণযুগের পরে ভ্রষ্টতার যুগে মা‘রেফতের নামে বিদ‘আতী
পীর-ফকীররা নানাবিধ ধ্যান পদ্ধতি আবিষ্কার করে। অতঃপর
কথিত ইশক্বের উচ্চ মার্গে পৌঁছে হুয়া হু করতে করতে যখন চক্ষু ছানাবড়া হয়ে ‘কাশফ’ বা
‘হাল’ হয়, তখন
নাকি তাদের আত্মা পরমাত্মার মধ্যে লীন হয়ে যায়। একে
তাদের পরিভাষায় ফানা ফিল্লাহ বা বাক্বা বিল্লাহ বলে। এরাই
ছূফী ও পীর-মাশায়েখ নামে এদেশে পরিচিত।
অথচ এইসব মা‘রেফতী তরীকার কোন অনুমোদন ইসলামে নেই। ধ্যানকে
কোয়ান্টামের পরিভাষায় বলা হয় ‘মেডিটেশন’
(Medetation)। যার প্রথম ধাপ হ’ল
‘শিথিলায়ন’ যা মনের মধ্যে ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি করে। আর
শেষ ধাপ হ’ল মহা চৈতন্য (Super
Consciousness)। যখন তারা বস্ত্তগত সীমা অতিক্রম করে মহা প্রশান্তির মধ্যে
লীন হয়ে যায়। যদিও এর কোন সংজ্ঞা তাদের বইতে সুস্পষ্টভাবে নেই।
এক্ষণে কোয়ান্টামের সাথে
অন্যদের পার্থক্য এই যে, অন্যেরা
স্ব স্ব ধর্মের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করেছে
ও স্ব স্ব ধর্মের নামেই পরিচিতি পেয়েছে। পক্ষান্তরে কোয়ান্টাম মেথড
সকল ধর্ম ও বর্ণের লোকদের নতুন ধ্যানরীতিতে জমা করেছে। খানিকটা
সম্রাট আকবরের দ্বীনে এলাহীর মত।
তখন আবুল ফযল ও ফৈযীর মত
সেকালের সেরা পন্ডিতবর্গের মাধ্যমে সেটা চালু হয়েছিল মূলতঃ রাজনৈতিক কারণে। আর এ যুগে কিছু উচ্চ শিক্ষিত সুচতুর লোকদের মাধ্যমে এটা চালু হয়েছে ইসলাম থেকে
মানুষকে সরিয়ে নেবার জন্যে এবং শিক্ষিত শ্রেণীকে বিশ্বাসে ও কর্মে পুরোপুরি
ধর্মনিরপেক্ষ বানাবার জন্যে।
যাতে ভবিষ্যতে এদেশ তার
ইসলামী পরিচিতি হারিয়ে সেক্যুলার দেশে পরিণত হয়। মুনি-ঋষিরা
ধ্যান করে তাদের ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের জন্য। পক্ষান্তরে কোয়ান্টামে
ধ্যান করা হয় স্ব স্ব ‘অন্তর্গুরু’কে পাওয়ার জন্য।
যেমন বলা হচ্ছে,
‘অন্তর্গুরুকে পাওয়ার আকাংখা যত তীব্র হবে,
তত সহজে আপনি তার দর্শন লাভ
করবেন। এ ব্যাপারে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে কোয়ান্টাম
গ্রাজুয়েটদের‘ (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪৭)।
যেমন একটি ঘটনা বলা হয়েছে,
‘ছেলে কোলকাতায় গিয়েছে। দু’দিন কোন খবর নেই। বাবা
কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট। মাগরিবের নামাজ পড়ে মেডিটেশন কমান্ড
সেন্টারে গিয়ে ছেলের বর্তমান অবস্থা দেখার চেষ্টা করতেই কোলকাতার একটি সিনেমা হলের
গেট ভেসে এল। ছেলে সিনেমা হলের গেটে ঢুকছে। বাবা
ছেলেকে তার উদ্বেগের কথা জানালেন।
বললেন শিগগীর ফোন করতে’ (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪১)। এমনিতরো উদ্ভট বহু গল্প তারা প্রচার করেছেন।
এক্ষণে আমরা দেখব ইসলামের সাথে এর সম্পর্ক :
১. এটি তাওহীদ বিশ্বাসের সাথে সরাসরি
সাংঘর্ষিক এবং পরিষ্কারভাবে শিরক।
তাওহীদ বিশ্বাস
সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ কেন্দ্রিক।
ইসলামের সকল ইবাদতের লক্ষ্য
হ’ল আল্লাহর দাসত্ব ও রাসূল (ছাঃ)-এর
আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা ও পরকালে মুক্তি লাভ করা। পক্ষান্তরে কোয়ান্টামের ধ্যান সাধনার লক্ষ্য হ’ল অন্তর্গুরুকে পাওয়া।
যা আল্লাহ থেকে সরিয়ে
মানুষকে তার প্রবৃত্তির দাসত্বে আবদ্ধ করে। এদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ
বলেন, ‘আপনি কি
দেখেছেন ঐ ব্যক্তিকে, যে
তার প্রবৃত্তিকে ইলাহ বানিয়েছে? আপনি কি তার যিম্মাদার হবেন’? ‘আপনি কি ভেবেছেন ওদের অধিকাংশ শুনে বা বুঝে?
ওরা তো পশুর মত বা তার
চাইতে পথভ্রষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩-৪৪)। মূলতঃ
ঐ অন্তর্গুরুটা হ’ল শয়তান। সে সর্বদা তাকে রঙিন স্বপ্নের মাধ্যমে তার দিকে প্রলুব্ধ করে।
২. তারা বলেন, মনকে প্রশান্ত করার মতো নামাজ যাতে আপনি
পড়তে পারেন সেজন্যই মেডিটেশন দরকার।
কেননা নামাজের জন্য সবচেয়ে
বড় প্রয়োজন হুযুরিল ক্বালব, একাগ্রচিত্ততা। এটা কিভাবে অর্জিত হয়, তা
এখানে এলে শেখা যায়’ (প্রশ্নোত্তর ১৪২৭)।
জবাব : এটার জন্য সর্বোত্তম পন্থা হ’ল ছালাত।
এর বাইরে কোন কিছুর অনুমোদন
ইসলামে নেই। আল্লাহ বলেন, তুমি ছালাত কায়েম কর আমাকে স্মরণ করার
জন্য’ (ত্বোয়াহা
১৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সংকটে পড়তেন তখন ছালাতে রত হ’তেন (আবুদাঊদ হা/১৩১৯)। তিনি
বলেছেন, তোমরা ছালাত
আদায় কর, যেভাবে
আমাকে দেখছ’ (বুখারী
হা/৬৩১)। যারা খুশু-খুযুর সাথে ফরয, নফল ও তাহাজ্জুদ ছালাত নিয়মিতভাবে আদায়
করে, তাদেরকেই
আল্লাহ সফলকাম মুমিন বলেছেন (মুমিনূন ১-২)। আর ছালাতে ধ্যান করা হয় না। বরং একমনে বান্দা তার সৃষ্টিকর্তার সাথে একান্তে আলাপ করে (বুখারী
হা/৫৩১)। সর্বোচ্চ শক্তির কাছে নিজের দুর্বলতা ও নিজের কামনা-বাসনা
পেশ করে সে হৃদয়ে সর্বোচ্চ প্রশান্তি লাভ করে এবং নিশ্চিত আশাবাদী হয়। অথচ মেডিটেশনের কথিত অন্তর্গুরুর কোন ক্ষমতা নেই। তার
সাধনায় নিশ্চিত আশাবাদের কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেননা
ওটা তো স্রেফ কল্পনা মাত্র।
ছালাতে আল্লাহর ইবাদত করা
হয়। পক্ষান্তরে মেডিটেশনে অন্তর্গুরুর ইবাদত করা হয়। একটি তাওহীদ, অপরটি
শিরক। দু’টিকে এক বলা
দিন ও রাতকে এক বলার সমান।
যা চরম ধৃষ্টতার নামান্তর।
৩. তারা বলেন, কোয়ান্টাম মেডিটেশনের জন্য ধর্ম বিশ্বাস
কোন যরূরী বিষয় নয়। ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের সাথে এর কোন বিরোধ নেই। তাদের কার্যাবলীতে এর প্রমাণ রয়েছে। যেমন,
‘এখন কোয়ান্টাম শিশু কাননে রয়েছে ১৫টি
জাতিগোষ্ঠীর চার শতাধিক শিশু।
মুসলিম,
হিন্দু,
বৌদ্ধ,
ক্রামা,
খ্রিষ্টান,
প্রকৃতিপূজারী সকল ধর্মের
শিশুরাই যার যার ধর্ম পালন করছে।
আর এক সাথে গড়ে উঠছে আলোকিত
মানুষ হিসাবে’ (শিশু কানন)।
জবাব : মানুষকে সকল ধর্ম থেকে বের করে এনে
কোয়ান্টামের নতুন ধর্মে দীক্ষা নেবার ও কোয়ান্টাম নেতাদের গোলাম বানানোর চমৎকার
যুক্তি এগুলি। কেননা অন্তর্গুরুর ব্যাখ্যায় তারা বলেছেন,
আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর
হতে গেলে একজন আলোকিত গুরুর কাছে বায়াত বা দীক্ষা নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া আধ্যাত্মিকতার সাধনা এক পিচ্ছিল পথ। যেকোন
সময়ই পা পিছলে পাহাড় থেকে একেবারে গিরিখাদে পড়ে যেতে পারেন’ (টেক্সটবুক, পৃঃ ২৪৭)। অর্থাৎ এরা ‘আলোকিত মানুষ’
বানাচ্ছে না। বরং ইসলামের আলো থেকে বের করে এক অজানা অন্ধকারে বন্দী করছে। যার পরিণাম জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা আল্লাহ বলেন,
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন
তালাশ করবে, তা
কবুল করা হবে না। ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান
৮৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল ও
পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে এসেছি’ (আহমাদ, মিশকাত হা/১৭৭)। অতএব ইসলামের প্রকৃত
অনুসারীরাই কেবল আলোকিত মানুষ।
বাকী সবাই অন্ধকারের
অধিবাসী।
৪. তারা বলেন, বহু আলেম আমাদের মেডিটেশন কোর্সে অংশগ্রহণ
করেন এবং তারা এর সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই বলেছেন।
জবাব : অল্প জ্ঞানী অথবা কপট বিশ্বাসী ও
দুনিয়াপূজারী লোকেরাই চিরকাল ইসলামের ক্ষতি করেছে। আজও
করছে। ওমর (রাঃ) বলেন, ইসলামকে ধ্বংস করে তিনটি বস্ত্ত : (১)
আলেমদের পদস্খলন (২) আল্লাহর কিতাবে মুনাফিকদের ঝগড়া এবং (৩) পথভ্রষ্ট নেতাদের
শাসন’ (দারেমী)। মনে রাখা আবশ্যক যে, রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। অতএব
যা তাঁর ও তাঁর ছাহাবীগণের আমলে দ্বীন হিসাবে গৃহীত ছিল,
কেবলমাত্র সেটাই দ্বীন
হিসাবে গৃহীত হবে। তার বাইরে কোন কিছুই দ্বীন নয়।
৫. মেডিটেশন পদ্ধতি নিজের উপরে তাওয়াক্কুল
করতে বলে এবং শিখানো হয় যে, ‘তুমি
চাইলেই সব করতে পার’। এরা হাতে মূল্যবান ‘কোয়ান্টাম বালা’ পরে ও তার উপরে ভরসা করে।
জবাব : ইসলাম মানুষকে মহাশক্তিধর আল্লাহর উপর
তাওয়াক্কুল করতে শিখায় এবং আল্লাহ যা চান তাই হয়। এর
মাধ্যমে মুমিন নিশ্চিন্ত জীবন লাভ করে ও পূর্ণ আত্মশক্তি ফিরে পায়। আর ইসলামে এ ধরনের ‘বালা’
পরা ও তাবীয ঝুলানো শিরক (ছহীহাহ
হা/৪৯২)।
৬. তারা বলেন, শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে এমন এক
ক্ষমতা তৈরী হয়, যার
দ্বারা সে নিজেই নিজের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারে। এজন্য
একটা গল্প বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক ইঞ্জিনিয়ার সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করার মনছবি দেখতে
লাগল। ফলে সে ডিভি ভিসা পেয়ে গেল। তারপর
সেখানে ভাল একটা চাকুরীর জন্য মনছবি দেখতে লাগল। ফলে
সেখানে যাওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই উন্নতমানের একটা চাকুরী পেয়ে গেল’(টেক্সট বুক পৃঃ
১১৫)। জবাব : ইসলাম মানুষকে
তাকদীরে বিশ্বাস রেখে বৈধভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে বলে। অথচ
কোয়ান্টাম সেখানে আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে কথিত মনছবির পূজা করতে বলে।
৭. কোয়ান্টামের মতে রোগের মূল কারণ হ’ল মানসিক।
তাই সেখানে মনছবি বা ইমেজ
থেরাপি ছাড়াও ‘দেহের ভিতরে ভ্রমণ’
নামক পদ্ধতির মাধ্যমে
শরীরের নানা অঙ্গের মধ্য দিয়ে কাল্পনিক ভ্রমণ করতে বলা হয়। এতে
সে তার সমস্যার স্বরূপ সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে এবং নিজেই কম্যান্ড
সেন্টারের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে।
যেমন,
একজন ক্যান্সার রোগী তার ক্যান্সারের
কোষগুলিকে সরিষার দানা রূপে কল্পনা করে। আর দেখে যে অসংখ্য ছোট ছোট
পাখি ঐ সরিষাদানাগুলো খেয়ে নিচ্ছে।
এভাবে
আস্তে আস্তে সর্ষে দানাও
শেষ, তার
ক্যান্সারও শেষ’ (টেক্সট বুক পৃঃ ১৯৪)।
৮. এদের শোষণের একটি হাতিয়ার হ’ল ‘মাটির ব্যাংক’। যে
নিয়তে এখানে টাকা রাখবেন, সে
নিয়ত পূরণ হবে। প্রথমবারে পূরণ না হ’লে
বুঝতে হবে মাটির ব্যাংক এখনো সন্তুষ্ট হয়নি। এভাবে টাকা ফেলতেই থাকবেন। কোন মানত করলে মাটির ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। পূরণ না হলে অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এখানে খাঁটি সোনার চেইন বা
হীরার আংটি দিতে পারেন। ইমিটেশন দিলে মানত পূরণ হবে না (প্রশ্নোত্তর)। এর জন্য একটা গল্প ফাঁদা হয়েছে।
যেমন,
‘মধ্যরাতে উঠে মাটির ব্যাংকে পাঁচশত টাকা
রাখার সাথে সাথে মুমূর্ষু ছেলে সুস্থ হয়ে গেল’ (দুঃসময়ের বন্ধু..)।
প্রিয় পাঠক! বুঝতে পারছেন,
কত সুচতুরভাবে মানুষকে
আল্লাহ থেকে সরিয়ে নিয়ে তাদের কম্যান্ড সেন্টারে আবদ্ধ করা হচ্ছে এবং সেই সাথে
মাটির ব্যাংকে টাকা ও গহনা রাখার ও তা কুড়িয়ে নেবার চমৎকার ফাঁদ পাতা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে রোগ ও তা আরোগ্য দানের মালিক আল্লাহ। আল্লাহর
হুকুম আছে বলেই মুমিন ঔষধ খায়।
ঔষধ আরোগ্যদাতা নয়। বরং আল্লাহ মূল আরোগ্যদাতা।
এই বিশ্বাস তাকে প্রবল
মানসিক শক্তিতে শক্তিমান করে তোলে।
এজন্য তাকে মেডিটেশন বা
কম্যান্ড সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মাটির ব্যাংকে টাকা রাখারও
দরকার হয় না। বরং গরীবকে ছাদাক্বা দিলে তার গোনাহ মাফ হয় (মিশকাত
হা/২৯)।
৯. অন্যান্য বিদ‘আতীদের ন্যায় এরাও কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করেছে
মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে দলে ভিড়ানোর জন্য। যেমন-
(ক) ‘সকল ধর্মই সত্য’ তাদের এই মতবাদের পক্ষে সূরা কাফেরূনের ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া লিয়া দ্বীন’
শেষ আয়াতটি ব্যবহার করেছে। যেন আবু জাহলের দ্বীনও ঠিক, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দ্বীনও ঠিক। এই
অপব্যাখ্যা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকরা ও তাদের পদলেহীরা করে থাকে। কোয়ান্টামের লোকেরাও করছে।
অথচ ইসলামের সারকথা একটি
বাক্যেই বলা হয়েছে, ‘লা
ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ
ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই। একথার
মধ্যে সকল ধর্ম ও মতাদর্শকে
অস্বীকার করা হয়েছে। কোয়ান্টামের অন্তর্গুরু নামক ইলাহটিকেও
বাতিল করা হয়েছে।
(খ) তারা বলেন মেডিটেশন একটি
ইবাদাত। যা রাসূল (ছাঃ) হেরা গুহায় করেছেন’। অথচ
এটি স্রেফ তোহমত বৈ কিছু নয়।
নিঃসঙ্গপ্রিয়তা আর মেডিটেশন
এক নয়। তাছাড়া নবী হওয়ার পরে তিনি কখনো হেরা গুহায় যাননি। ছাহাবায়ে কেরামও কখনো এটি করেননি।
(গ) তারা সূরা জিন-এর ২৬ ও
২৭ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলেছেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা গায়েবের খবর জানাতে পারেন। অতএব যে যা জানতে চায় আল্লাহ তাকে সেই জ্ঞান দিয়ে দেন’ (প্রশ্নোত্তর
১৭৫৩)। অথচ উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর মনোনীত রাসূল ছাড়া তাঁর অদৃশ্যের
জ্ঞান কারু নিকট প্রকাশ করেন না।
এ সময় তিনি সামনে ও পিছনে
প্রহরী নিযুক্ত করেন’। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর রাসূলের নিকট ‘অহি’ প্রেরণ
করেন এবং তাকে শয়তান থেকে নিরাপদ রাখেন। এই ‘অহি’–টাই
হ’ল গায়েবের খবর,
যা কুরআন ও হাদীছ আকারে
আমাদের কাছে মওজুদ রয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ‘অহি’–র
আগমন বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব কোয়ান্টামের গুরুরা চাইলেও গায়েবের
খবর জানতে পারবেন না।
(ঘ) তারা সূরা বুরূজ-এর
বুরূজ অর্থ করেন ‘রাশিচক্র’। যাতে
আল্লাহকে বাদ দিয়ে রাশিচক্র অনুযায়ী মানুষের ভাল-মন্দ ও শুভাশুভ নির্ধারণের বিষয়টি
তাদের শিষ্যদের মনে গেঁথে যায়।
অথচ এটি হিন্দু ও তারকা
পূজারীদের শিরকী আক্বীদা মাত্র।
(ঙ) তারা সূরা আলে ইমরানের
১৯১ আয়াতটি তাদের আবিষ্কৃত মেডিটেশনের পক্ষে প্রমাণ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন (প্রশ্নোত্তর
১৭৫৩)। ঐ সাথে একটি জাল হাদীছকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন যে,
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘণ্টার
ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম’ (প্রশ্নোত্তর ১৭২৪)। অথচ
উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর
সৃষ্টি বিষয়ে গভীর গবেষণা তাকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও জাহান্নাম থেকে
মুক্তি প্রার্থনায় উদ্বুদ্ধ করে’। কোয়ান্টামের কথিত অন্তর্গুরুর কাছে যেতে
বলে না। আর হাদীছটি হ’ল
জাল। যা আদৌ রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী নয়। কোন
কোন বর্ণনায় ৬০ বছর ও ১০০০ বছর বলা হয়েছে’ (সিলসিলা যঈফাহ হা/১৭১)।
বলব, কোয়ান্টাম
মেথডের পূরা চিন্তাধারাটাই হ’ল তাওহীদ
বিরোধী এবং শিরক প্রসূত। যা মানুষের মাথা থেকে বেরিয়ে এলেও এর মূল
উদ্গাতা হ’ল শয়তান। মানুষকে
জাহান্নামে নেবার জন্য মানুষের নিকট বিভিন্ন পাপকর্ম শোভনীয় করে পেশ করার ক্ষমতা
আল্লাহ তাকে দিয়েছেন (হিজর ৩৯)।
তবে সে আল্লাহর কোন মুখলেছ
বান্দাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না (হিজর ৪০)।
শয়তান নিজে অথবা কোন
মানুষের মাধ্যমে প্রতারণা করে থাকে।
যেমন হঠাৎ করে শোনা যায়,
অমুক স্থানে অমুকের স্বপ্নে
পাওয়া শিকড়ে বা তাবীযে মানুষের সব রোগ ভাল হয়ে যাচ্ছে। ফলে
দু’পাঁচ মাস যাবত দৈনিক লাখো মানুষের ভিড়
জমিয়ে হাযারো মুসলমানের ঈমান হরণ করে হঠাৎ একদিন ঐ অলৌকিক চিকিৎসক উধাও হয়ে যায়। এদের এই ধোঁকার জালে আবদ্ধ হয়েছিল সর্বপ্রথম নূহ (আঃ)-এর কওম। যারা পরে আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যায়। আমরাও যদি শিরকের মহাপাপ
থেকে দ্রুত তওবা না করি, তাহ’লে আমরাও তাঁর গযবে ধ্বংস হয়ে যাব। অতএব
হে মানুষ! সাবধান হও!!