দো‘আ অর্থ :
দো‘আ (دعاء) অর্থ ডাকা, কিছু চাওয়া, প্রার্থনা করা প্রভৃতি। বিনয়ের সাথে আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করা হ’ল দো‘আ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমার নিকট দো‘আ করো, আমি তোমাদের দো‘আ কবূল করব’ (মুমিন ৪০/৬০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, দো‘আ হ’ল ইবাদত’( আহমাদ, আবূদাঊদ, মিশকাত হা/২২৩০)। দো‘আ হ’ল আল্লাহ্র গুণগান করার মাধ্যমে বান্দা তার প্রভুর নিকট ইবাদতের ভেতরে ও বাহিরে নিজের আবেদন পেশ করে থাকে।
দো‘আর গুরুত্ব :
ইবাদতের ভেতরে ও বাহিরে দো‘আর গুরুত্ব অনেক বেশী। ‘যে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে না, আল্লাহ তার উপর ক্রোধান্বিত হন’(তিরমিযী ৫/৪৫৬, ইবনু মাজাহ ২/১২৫৮)। দো‘আর মাধ্যমে মানুষ ক্ষমা ও কল্যাণ অর্জন করে। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَدْعُو بِدَعْوَةٍ لَيْسَ فِيهَا إِثْمٌ وَلَا قَطِيعَةُ رَحِمٍ إِلَّا أَعْطَاهُ اللهُ بِهَا إِحْدَى ثَلَاثٍ: إِمَّا أَنْ يُعَجِّلَ لَهُ دَعْوَتَهُ وَإِمَّا أَنْ يَدَّخِرَهَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ وَإِمَّا أَنْ يَصْرِفَ عنهُ من السُّوءِ مثلَها قَالُوا: إِذنْ نُكثرُ قَالَ: الله أَكثر. ‘মুসলমান যখন অন্য কোন মুসলমানের জন্য দো‘আ করে, যার মধ্যে কোনরূপ গোনাহ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা থাকে না, আল্লাহ উক্ত দো‘আর বিনিময়ে তাকে তিনটির যেকোন একটি দান করে থাকেন : (১) তার দো‘আ দ্রুত কবূল করেন অথবা (২) তার প্রতিদান আখিরাতে প্রদান করার জন্য রেখে দেন অথবা (৩) তার থেকে অনুরূপ আরেকটি কষ্ট দূর করে দেন। একথা শুনে ছাহাবীগণ বললেন, তাহ’লে আমরা বেশী বেশী দো‘আ করব। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ আরও বেশী দো‘আ কবূলকারী’(আহমাদ, মিশকাত হা/২২৫৯ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭১০)।
দো‘আ তাক্বদীরের পরিবর্তন করে ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لا يَرُدُّ الْقَدَرَ إِلا الدُّعَاءُ، وَلا يَزِيدُ فِي الْعُمُرِ إِلا الْبِرُّ، ‘দো‘আ ব্যতীত কোন কিছুই তাক্বদীরের পরিবর্তন আনতে পারে না এবং সৎ ‘আমল ছাড়া হায়াত বৃদ্ধি করতে পারে না’ (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৩০৪৮৭; হাকিম হা/১৮১৪; ইবনে হিব্বান হা/৮৭২; আহমাদ হা/২২৩৮৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, لا يَرُدُّ الْقَدَرَ إِلا الدُّعَاءُ، وَلا يَزِيدُ فِي الْعُمُرِ إِلا الْبِرُّ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيبُهُ ‘দো‘আ ব্যতীত ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না, পুণ্য ব্যতীত আয়ু বৃদ্ধি পায় না এবং পাপ মানুষকে নির্ধারিত জীবিকা থেকে বঞ্চিত করে’(ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪৯২৫; ছহীহুল জামি‘ হা/১৭৭৩৩)।
দো‘আ ও যিকির কবূলের শর্তাবলী :
দো‘আ হ’ল ইবাদত। আর এই দো‘আ ও যিকির কবূলের মৌলিক চারটি শর্ত রয়েছে। যা নিম্নে আলোচনা করা হ’ল-
১. ইখলাছ বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দো‘আ করা :
দো‘আ কবূলের অন্যতম শর্ত হ’ল ইখলাছ ঠিক রাখা। দো‘আ হ’ল আল্লাহ্র ইবাদত। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, দো‘আ হ’ল ইবাদত’(আহমাদ, আবূদাঊদ, মিশকাত হা/২২৩০)। আর তাই আল্লাহ্র সেই ইবাদতের সাথে অন্য কাউকে শরীক করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا. ‘যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহ্ফ ১৮/১১০)। অত্র আয়াতে বর্ণিত (فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, সে যেন রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী আমল করে এবং (وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য শিরক মুক্ত আমল কওে (তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা কাহফ ১১২নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوْا إِلَّا إِيَّاهُ ‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না’ (বনী ইসরাইল ১৭/২৩)। তিনি আরো বলেন, وَاعْبُدُوْا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا ‘তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না’ (নিসা ৪/৩৬)। তিনি অন্যত্র বলেন,قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا. ‘(হে মুহাম্মাদ!) বলো, তোমরা এসো! তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি কি কি হারাম করেছেন, তা আমি তোমাদেরকে পাঠ করে শুনাব, আর তা এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না’ (আন‘আম ৬/১৫১)।
মুশরিকদের ধ্বংস ও বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ ‘যে আল্লাহ্র সাথে শিরক করে, সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ে, আর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে দূরবর্তী কোন স্থানে নিক্ষেপ করে’ (হজ্জ২২/ ৩১)।
বান্দার উপর আল্লাহর হক্ব হ’ল ইবাদত করা এবং আল্লাহ্র উপর বান্দার হক্ব হ’ল শিরক না করা। রাসূল (ছাঃ) মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-কে বলেন, يَا مُعَاذُ، هَلْ تَدْرِى حَقَّ اللهِ عَلَى عِبَادِهِ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللهِ؟ قُلْتُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَعْلَمُ، قَالَ فَإِنَّ حَقَّ اللهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوْهُ وَلاَ يُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا، وَحَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا. ‘হে মু‘আয! তুমি কি জানো বান্দার উপর আল্লাহ্র হক্ব কি এবং আল্লাহ্র উপর বান্দার হক্ব কি? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহ্র হক্ব হ’ল, বান্দা তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর আল্লাহ্র উপর বান্দার হক্ব হ’ল, তাঁর ইবাদতে কাউকে শরীক না করলে আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন না’(বুখারী হা/২৮৫৬; মুসলিম হা/৩০; মিশকাত হা/২৪)।
শিরককারীদের হুশিয়ারী দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَوْ أَشْرَكُوْا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ ‘যদি তারা শিরক করে তবে তারা যা কিছু করেছে, সবই ধ্বংস হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/৮৮)। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই (এ মর্মে) অহী হয়েছে যে, যদি তুমি শিরক করো তবে অবশ্যই তোমার কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৩৯/৬৫)। শিরককারীর প্রতিফল জাহান্নাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ مَاتَ يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে কোন কিছুকে শরীক করে মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’(বুখারী হা/১২৩৮; মুসলিম হা/৯২; মিশকাত হা/৩৮)।
শিরককে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) জঘন্যতম পাপ বলে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহ্র সাথে শিরক করল সে জঘন্য পাপ করল’ (নিসা ৪/৪৮)। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, قُلْتُ يَارَسُوْلَ اللهِ أَىُّ الذَّنْبِ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ؟ قَالَ: أَنْ تَجْعَلَ لِلّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ. ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আল্লাহ্র নিকট জঘন্যতম পাপ কোনটি? জওয়াবে তিনি বললেন, কাউকে আল্লাহ্র সমকক্ষ বানানো (শরীক করা), অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (বুখারী হা/৪২০৭)।
শিরককারী ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِى مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ، فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ بِالْكَوْكَبِ، وَأَمَّا مَنْ قَالَ بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِى وَمُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ. ‘আমার বান্দাদের মধ্যে আমার প্রতি কেউ মুমিন এবং কেউ কাফির হয়ে গেল । যে বলেছে আল্লাহ্র করুণা ও রহমতে আমরা বৃষ্টি লাভ করেছি, সে হ’ল আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী। আর যে বলেছে, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টি আমাদের উপর বৃষ্টিপাত হয়েছে। সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী হয়েছে এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী হয়েছে’ (বুখারী, হা/৮৪৬, ১০৩৮, ৪১৪৭, ৭৫০৩,)।
অথচ শিরক না করে মৃত্যুবরণ করলে ক্বিয়ামত দিবসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিশেষ শাফা‘আত পাওয়া যাবে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لِكُلِّ نَبِىٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ فَتَعَجَّلَ كُلُّ نَبِىٍّ دَعْوَتَهُ وَإِنِّى اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِى شَفَاعَةً لأُمَّتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَهِىَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِى لاَ يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا. ‘প্রত্যেক নবীর জন্য একটি বিশেষ দো‘আ আছে যা কবূল হবে, তন্মধ্যে সকলেই তাদের দো‘আ পৃথিবীতেই করে নিয়েছে। আর আমার দো‘আটি ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত আমার উম্মাতের জন্য গোপন রেখে দিয়েছি। আমার উম্মতের যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে অথচ কোন প্রকার শিরক করেনি, সে ইনশাআল্লাহ আমার এ দো‘আ পাবে’ (মুসলিম হা/১৯৯; মিশকাত হা/২২২৩; ইবনু মাজাহ হা/৪৩০৭; আহমাদ হা/৯৫০০)।
শিরক মুক্ত ইবাদতসহ জীবন-যাপন করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ শিরককারী জান্নাতে যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ مَاتَ لاَ يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (বুখারী, হা/১২৩৮, ৪৪৯৭, ৬৬৮৩, ‘জানাযা’ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৬৯ ‘ঈমান, অধ্যায়)। তিনি আরোও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক না করে আল্লাহ্র সামনে উপস্থিত হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (মুসলিম হা/১৭১, ‘ঈমান’ অধ্যায়; মিশকাত হা/১৭১)। যিনাকারী ও চোর ব্যক্তি জান্নাতে যাবে যদি সে শিরকের গুণাহ থেকে বেঁচে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَتَانِى آتٍ مِنْ رَبِّى فَأَخْبَرَنِى أَوْ قَالَ بَشَّرَنِى أَنَّهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِى لاَ يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ. قُلْتُ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ قَالَ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ. ‘একজন আগন্তুক (জিব্রীল) আমার প্রতিপালকের নিকট হ’তে এসে আমাকে সুসংবাদ দিলেন, আমার উম্মাতের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সঙ্গে কাউকে শরীক না করা অবস্থায় মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, যদিও সে যিনা করে এবং যদিও সে চুরি করে থাকে? তিনি বললেন, যদিও সে যিনা করে ও চুরি করে’ (বুখারী হা/১২৩৭, ২৩৮৮, ৩২২২, ৫৮২৭, ৬২৬৮, ৬৪৪৩, ৬৪৪৪, ‘জানাযা’ অধ্যায়, মুসলিম হা/১৭৩ ‘ঈমান’ অধ্যায়)।
আসমান যমীন ভর্তি গুণাহ থাকলেও আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন যদি বান্দা তাঁর সাথে শরীক না করেন। ‘আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, قَالَ اللهُ تَعَالَى: يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلاَ أُبَالِيْ يَا ابنَ آدمَ إِنَّك لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ وَلاَ أُبَالِي يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ لَقِيتَنِي بِقُرَابِ الْأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِي لاَ تُشْرِكُ بِيْ شَيْئًا لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مغْفرَة. ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান! যতদিন তুমি আমাকে ডাকবে এবং আমার নিকট ক্ষমার আশা রাখবে আমি তোমাকে ক্ষমা করব, তোমার অবস্থা যাই হোক না কেন। আমি কারো পরওয়া করি না। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশ পর্যন্তও পৌঁছে তবুও তুমি আমার নিকট ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, আমি ক্ষমা করার ব্যাপারে কারও পরওয়া করি না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার দরবারে উপস্থিত হও এবং আমার সাথে কোন শরীক না করে থাক, তবে আমি পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে উপস্থিত হবো’ (তিরমিযী হা/৩৫৪০; মিশকাত হা/২৩৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১২৭)।
ইবনু রজব হাম্বলী (৭৩৬-৭৯৫হি.) (রাহিঃ) বলেন, رَائِحَةُ الْإِخْلاَصِ كَراَئِحَةُ الْبُخُوْرِ الْخَالِصِ، كُلَّمَا قَوِّيٌ سِتْرُهُ بِالثِّيَابِ، فَاَحَ وَعِبْقٌ بِهاَ. ‘ইখলাছের ঘ্রাণ (উপমা) হ’ল খাঁটি বখুরের (একধরনের সুগন্ধি যা আগুনে জালিয়ে ব্যবহার করা হয়) ঘ্রাণের ন্যায়। যখন তা ছড়িয়ে দেয়া হয় (ইখলাছের শক্তিশালী), তখন তা চারিদিকে সুবাস ছড়িয়ে সুশোভিত করে’ (মাজমূঊর রাসায়িল, পৃঃ ৭৫৮)।
২. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যথাযথ অনুসরণে দো‘আ করা :
দো‘আ কবূলের দ্বিতীয় শর্ত হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যথাযথ আনুগত্য করা। রাসূল (ছাঃ) যা আদেশ করেছেন তা পালন করতে হবে এবং যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার করে চলতে হবে। আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا. ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন তা হ’তে বিরত থাকো’ (হাশর ৫৯/৭)। এমন আমল গ্রহণীয় নয়, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ নেই। অবশ্যই তা বর্জনীয় ও পরিত্যাজ্য। রাসূল (ছাঃ) বলেন, .مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’ (মুসলিম হা/১৭১৮)।
রাসূল (ছাঃ)-এর অবাধ্যতা করে হাশরের মাঠে সফল হওয়া যাবে না। তাই তাঁর আনুগত্য জরুরী। এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করলে আল্লাহ্র আনুগত্য করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ. ‘যে মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে আল্লাহ্রই আনুগত্য করল। আর যে মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে আসলে আল্লাহ্রই অবাধ্যতা করল। আর মুহাম্মাদ হ’লেন মানুষের মাঝে পার্থক্যের মাপকাঠি’(বুখারী হা/৭২৮১, ‘কুরআন ও সান্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/১৪৪)।
যারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে অনুসরণ না করে বিদ‘আত করবে তাদেরকে হাশরের দিন তাড়িয়ে দেয়া হবে এবং তারা রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত হবে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَإِنَّهُ سَيُجَاءُ بِرِجَالٍ مِنْ أُمَّتِىْ، فَيُؤْخَذُ بِهِمْ ذَاتَ الشِّمَالِ. فَأَقُولُ يَا رَبِّ أُصَيْحَابِى. فَيَقُولُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِى مَا أَحْدَثُوْا بَعْدَكَ. فَأَقُوْلُ كَمَا قَالَ الْعَبْدُ الصَّالِحُ (وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيْدًا مَا دُمْتُ فِيْهِمْ) إِلَى قَوْلِهِ (الْحَكِيمُ) قَالَ فَيُقَالُ إِنَّهُمْ لَمْ يَزَالُوْا مُرْتَدِّيْنَ عَلَى أَعْقَابِهِمْ. ‘সাবধান হয়ে যাও, আমার উম্মতের কিছু লোককে ধরে আনা হবে তাদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি বলব, হে আমার রব! এরা তো আমার উম্মত। জওয়াবে আমাকে বলা হবে, তুমি জান না তোমার (ওফাতের) পরে এরা কত নতুন (হাদীছ) কথা তৈরী করেছিল। আমি তখন আল্লাহ্র সৎ বান্দা (ঈসার) মত বলব, ‘যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি ছিলাম তাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কিন্তু আমার পরে তুমিই তাদের সাক্ষী। তখন বলা হবে, তুমি এদের কাছ থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর, এরা (তোমার দ্বীন তথা কুরআন-সুন্নাহ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উল্টো পথে চলেছিল’ (বুখারী হা/৪৭৪০; মুসলিম হা/২৮৬০; আহমাদ হা/২০৯৬; ইবনে হিব্বান হা/৭৩৪৭)।
শুধু তাই নয়, ঐ সমস্ত বিদ‘আতী ব্যক্তিরা হাউযে কাওছারের পানি পান করতে পারবে না। সেদিন প্রত্যেক বিদ‘আতীকে হাউযে কাওছারের নিকট থেকে বিতাড়িত হবে এবং তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সাহলি ইবনে সা‘দি (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنِّيْ فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ، مَنْ مَرَّ عَلَىَّ شَرِبَ، وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا، لَيَرِدَنَّ عَلَىَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُوْنِيْ، ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِيْ وَبَيْنَهُمْ فَأَقُوْلُ إِنَّهُمْ مِنِّيْ فَيُقَالُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا أَحْدَثُوْا بَعْدَكَ فَأَقُوْلُ سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِيْ. ‘আমি তোমাদের পূর্বে হাউযে কাওছারের নিকটে পৌঁছে যাবো। যে আমার নিকট দিয়ে অতিক্রম করবে, সে হাউযের পানি পান করবে। আর যে একবার পান করবে সে আর কখনও পিপাসিত হবে না। নিঃসন্দেহে কিছু সম্প্রদায় আমার সামনে (হাউযে) উপস্থিত হবে। আমি তাদেরকে চিনতে পারব, আর তারাও আমাকে চিনতে পারবে। এরপর আমার ও তাদের মাঝে আড়াল করে দেওয়া হবে। আমি তখন বলব, এরাতো আমারই উম্মত। তখন বলা হবে, তুমি জান না তোমার (মৃত্যুর) পরে এরা কি সব নতুন নতুন কথা ও কাজ (বিদ‘আত) সৃষ্টি করেছিল। তখন আমি বলব, দূর হোক, দূর হোক, যারা আমার পরে দ্বীনের ভিতর পরিবর্তন এনেছে’ (বুখারী হা/৬৫৮৩; মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭১)।
দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন করা বিদ‘আত। প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَشَرَّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ. ‘তোমরা প্রত্যেকটি নতুন সৃষ্টি হ‘তে বেঁচে থাকো। কেননা, প্রত্যেকটি নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম’ (নাসাঈ হা/১৫৭৮; ইবনে খুযায়মাহ হা/১৭৮৫)।
৩. হালাল রূযী গ্রহণ করে দো‘আ করা :
ইবাদত কবূলের তৃতীয় শর্তটি হ’ল হালাল রূযী উপার্জন ও ভক্ষণ করা। আল্লাহ নির্দেশ করেন, كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحًا ‘তোমরা হালাল খাও এবং সৎ আমাল করো’ (মুমিনূন ২৩/৫১)। অন্যত্র বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلاَلاً طَيِّبًا. ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা যমীন থেকে হালাল ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণ করো’ (বাক্বারাহ ২/১৬৮)। এর বিপরীত খাদ্য হারাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ. ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, পূজার বেদী, শুভাশুভ নির্ণয়ের তীর, এসবই গর্হিত বিষয় ও শয়তানী কাজ। অতএব তোমরা এসব থেকে দূরে থাক। যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পারো’ (মায়েদাহ ৫/৯০)।
হারাম ভক্ষণকারীর দো‘আ কবূল হয় না। দো‘আ হ’ল ইবাদত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ ‘দো‘আই ইবাদত’ (তিরমিযী হা/৩৩৭২; আবূদাউদ হা/১৪৭৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৮২৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, أَفْضَلُ الْعِبَادَةِ الدُّعَاءُ ‘উত্তম ইবাদত হচ্ছে দো‘আ’ (ছহীহুল জামে‘ হা/১১২২; ছহীহাহ হা/১৫৭৯)। আল্লাহ নির্দেশ করেন, كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحًا ‘তোমরা হালাল খাও এবং সৎ আমাল করো’ (মুমিনূন ২৩/৫১)। দো‘আ ও যিকিরের অন্যতম শর্ত হচ্ছে জীবিকা হালাল হওয়া। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কোন কিছু গ্রহণ করেননা। তিনি রাসূলদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন একই নির্দেশ মুমিনদের প্রতিও জারী করেছেন। তিনি বলেন, يَاأَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّيْ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ. ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হ’তে আহার কর এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর, সব বিষয়ে আমি অবগত’ (মুমিনূন ২৩/৫১)। তিনি আরও বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমরা তোমাদের যে রূযী দান করেছি, সেখান থেকে পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ কর’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيْلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِّىَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ ‘অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন। যে দীর্ঘ সফর করেছে। যার চুল উষ্কখুষ্ক, কাপড় ধূলিমলিন। সে আকাশ পানে দু’হাত প্রসারিত করে বলে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং হারাম দ্বারা দেহ গঠিত। কাজেই এমন ব্যক্তির দো‘আ কিভাবে কবূল হ’তে পারে’?( মুসলিম হা/৬৫, মুসলিম হা/১০১৫; তিরমিযী হা/২৯৮৯; ছহীহুল জামি‘ হা/২৭৪৪; মিশকাত হা/২৭৬০) অন্যত্র, আবূ বকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِالْحَرَامِ. ‘হারাম খাদ্যে গঠিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/১১৫৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬০৯; মিশকাত হা/২৭৮৭)।
ইবনে রজব (রহঃ) বলেন,فأكل الحرام وشربه ولبسه والتغذي به سبب موجب، ‘হালাল খাওয়া, হালাল পান করা, হালাল পরিধান করা ও হালাল খেয়ে পরিপুষ্ট হওয়া দো‘আ কবূল হওয়ার শর্ত’ (ইবনু রজব আল-হাম্বলী, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১ম খন্ড (বৈরূত : দারুল মারিফাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ), পৃঃ ২৯৩)।
হারাম রূযী ভক্ষণকারীর পরিণতি সম্পর্কে ইবনুল জাওযী (রাহিঃ) বলেন, اَلْحَرَامُ مِنَ القُوْتِ نَارٌ تُذِيْبُ شَحْمَةَ الفِكْرِ، وَتُذْهِبُ لَذَّةَ حَلاَوَةِ الذِّكْرِ، وَتُحَرِّقُ ثِيَابَ إِخْلاَصِ النِّيَّاتِ، وَمِنَ الْحَرَامِ يَتَوَلَّدُ عَمَى الْبَصِيْرَةِ وَظَلاَمِ السَّرِيْرَةِ. ‘হারাম খাদ্য এমন এক আগুন, যা চিন্তা শক্তিকে বিনষ্ট করে দেয়, যিকিরের স্বাদ দূরীভূত করে দেয় এবং নিয়তের পরিশুদ্ধিতার পোষাক জ্বালিয়ে দেয়। আর হারাম খাদ্য গ্রহণের ফলে চোখে ও অন্তরজুড়ে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে’ (বাহরুদ দুমূ‘, পৃষ্ঠা-১৪৬)।
বিখ্যাত সাধক ইবরাহীম বিন আদহাম (রহঃ)-কে বলা হয়, আমরা দো‘আ করি কিন্তু তা কবূল হয় না কেন? উত্তরে বলেন, তার কারণ তোমরা আল্লাহ্কে চিনেও তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলো না। রাসূলকে জেনেও তাঁর সুন্নাহর অনুসরণ করো না। কুরআনকে বুঝেও তদানুযায়ী আমল করো না। আল্লাহ্র নি‘আমত ভোগ করে তাঁর শোকর আদায় করো না। জান্নাত সম্পর্কে জানেও তা তালাশ করো না এবং জাহান্নামের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত থেকেও পলায়ন করো না। শয়তানকে শত্রু হিসাবে জেনেও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো। মৃত্যুকে সত্য জেনেও কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করো না। নিজেদের দোষ-ত্রুটি সংশোধন না করে মানুষের দোষ-ত্রুটি ধরায় ব্যস্ত থাকো। (এজন্য দো‘আ কবূল হয় না) (তাফসীরে কুরতুবী ২/৩০৩ পৃঃ)।
৪. রিয়া প্রদর্শন বা লৌকিকতা পরিহার করে দো‘আ করা :
রিয়া প্রদর্শন করা শিরকে আছগার বা ছোট শিরক বলা হয়। আর আল্লাহ বিচার দিবসে এমন ব্যক্তিদেরকে তাড়িয়ে দিবেন। মাহমূদ বিন লাবীদ বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً. ‘আমি তোমাদের জন্য যা সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হ’ল শিরকে আছগর (ছোট শিরক)। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেসা করলেন ‘হে আল্লাহ্র রাসূল ছোট শিরক কি?’ তিনি জওয়াবে বললেন ‘রিয়া’ লোক দেখানো বা জাহির করা। কারণ নিশ্চয়ই শেষ বিচারের দিনে মানুষ তার পুরস্কার গ্রহণের সময় আল্লাহ বলবেন, ‘বস্তুজগতে যাদের কাছে তুমি নিজেকে জাহির করেছিলে তাদের কাছে যাও এবং দেখ তাদের নিকট হ’তে কোন পুরস্কার পাও কি না’ (আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৫৩৩৪)।
রিয়া প্রদর্শনকারী আল্লাহ্র সামনে সিজদা করতে পারবে না। তারা রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত ও হাউযে কাওছারের পানি পান করতে পারবে না। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, …. অশেষে মুমিন হোক বা গুনাহগার হোক, এক আল্লাহ্র উপাসক ব্যতীত আর কেউ (ময়দানে) অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আল্লাহ তাদের কাছে এসে বলবেন, সবই তাদের স্ব স্ব উপাস্যের অনুসরণ করে চলে গেছে, আর তোমরা কি কারু অপেক্ষা করছ? তারা বলবে, হে আমাদের প্রভু! যেখানে আমরা বেশি মুখাপেক্ষী ছিলাম, সেই দুনিয়াতে আমরা অপরাপর মানুষ থেকে পৃথক থেকেছি এবং তাদের সঙ্গী হইনি। তখন আল্লাহ বলবেন, আমিই তো তোমাদের প্রভূ। মুমিনরা বলবে, ‘আমরা তোমার থেকে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আল্লাহ্র সঙ্গে আমরা কিছুই শরীক করি না। এই কথা তারা দুই বা তিনবার বলবে। এমন কি কেউ কেউ অবাধ্যতা প্রদর্শনেও অবতীর্ণ হয়ে যাবে। আল্লাহ বলবেন, আচ্ছা, তোমাদের কাছে এমন কোন নিদর্শন আছে যার মাধ্যমে তাকে তোমরা চিনতে পারো? তারা বলবে, অবশ্যই আছে। এরপর ‘সাক’ উন্মোচিত হবে, তখন পৃথিবীতে যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে সিজদা করত, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সিজদা করার অনুমতি দিবেন। আর যারা লোক দেখানো বা লোকভয়ে আল্লাহ্কে সিজদা করত, সে মুহূর্তে তাদের মেরুদন্ড শক্ত ও অনমনীয় করে দেয়া হবে। যখনই তারা সিজদা করতে ইচ্ছা করবে তখনই তারা চিৎ হয়ে পড়ে যাবে। তারপর তারা মাথা তুলবে। ইত্যবসরে তারা আল্লাহ্কে প্রথমে যে আকৃতিতে দেখেছিল তা পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং তিনি তাঁর আসল রূপে আবির্ভূত হবেন এবং বলবেন, আমি তোমাদের রব। তারা বলবে হ্যাঁ, আপনি আমাদের প্রতিপালক। তারপর জাহান্নামের উপর জিস্র (পূল) স্থাপন করা হবে। শাফা‘আতেরও অনুমতি দেয়া হবে। মানুষ বলতে থাকবে, হে আল্লাহ! আমাদের নিরাপত্তা দিন, আমাদের নিরাপত্তা দিন। জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহ্র রাসূল! জিস্র কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘এটি এমন স্থান, যেখানে পা পিছলে যায়। সেখানে আছে নানা প্রকারের লৌহ শলাকা ও কাঁটা, দেখতে নজদের নাদান বৃক্ষের কাঁটার মত।
মুমিনগণের কেউ এ পথ পলকের গতিতে, কেউ বিদ্যুতের গতিতে, কেউ বায়ুর গতিতে, কেউ অশ্বগতিতে, কেউ উষ্ট্রের গতিতে অতিক্রম করবে। কেউ অক্ষত অবস্থায় নাজাত পাবে, আবার কেউ হবে নাজাতপ্রাপ্ত ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায়। আর কতককে কাঁটাবিদ্ধ অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অবশেষে মুমিনগণ জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সে সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, ঐ দিন মুমিনগণ তাদের ঐসব ভাইয়ের স্বার্থে আল্লাহ্র সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবে, যারা জাহান্নামে রয়ে গেছে। যা তোমরা পার্থিব অধিকারের ক্ষেত্রেও এমন বিতর্কে লিপ্ত হও না’ (মুসলিম হা/১৮৩; জামি‘ ছাগীর হা/১২৯৮৭)।
আর এই রিয়া প্রদর্শন করাকে গুপ্ত শিরকও বলা হয়। এই শিরক দাজ্জালের ফেৎনার চেয়েও ভয়াবহ। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন রাসূল (ছাঃ) বের হয়ে এলেন এবং ঘোষণা দিলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِى مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ؟ قَالَ قُلْنَا بَلَى، فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِىُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّى فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ. ‘আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জালের চেয়ে ভয়ংকর একটি বিষয় সম্পর্কে বলব না? আমরা বললাম, জি বলুন। তিনি উত্তর দিলেন, সেটা হ’ল গুপ্ত শিরক। (অর্থাৎ) যখন কেউ ছালাত আদায় করতে উঠে ছালাত সুন্দর করার জন্য চেষ্টা করে এই ভেবে যে লোকেরা তার প্রতি চেয়ে আছে, সেটাই গুপ্ত শিরক’ (ইবনে মাজাহ হা/৪২০৪; মিশকাত হা/৫৩৩৩)। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই বাস্তবতা সম্বন্ধে উল্লেখ করে বলেছিলেন ‘চন্দ্রবিহীন রাত্রে একটা কালো পাথর বেয়ে উঠা একটা কালো পিঁপড়ার চেয়েও গোপন হ’ল শিরক’ (ছহীহুল জামি‘ হা/৩৭৩০)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللَّهُ بِهِ . ‘যে ব্যক্তি জনসম্মুখে প্রচারের ইচ্ছায় নেক আমাল করে আল্লাহ তা’আলাও তার কৃতকর্মের অভিপ্রায়ের কথা লোকেদেরকে জানিয়ে ও শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লৌকিকতার উদ্দেশ্যে কোন নেক কাজ করে, আল্লাহ তা’আলাও তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকেদের মাঝে ফাঁস করে দিবেন’ (বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬; মিশকাত হা/৫৩১৬; আহমাদ হা/২০৪৭০)।
ইবনু রজব হাম্বালী (৭৩৬-৭৯৫হি.) (রহিঃ) বলেন, وَرَائِحَةُ الْرِيَاءِ كَدُخَانِ الْحِطَبِ، يَعِلُوْ إِلَى الْجَو ثُمَّ يَضْمِحَل وَتَبْقِى رَائحته الكَرِيْهَة ‘রিয়া বা লৌকিকতার ঘ্রাণ (উপমা) হ’ল কয়লার ধুঁয়োর ন্যায়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার পর তা নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার দূর্গন্ধ কেবল অবশিষ্ট থাকে’ (মাজমূঊর রাসায়িল, পৃষ্ঠা-৭৫৮)।
রিয়া প্রদর্শনকারী ব্যক্তি সকল জাহান্নামী হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা লোক দেখানে কোন ইবাদত কবূল করেন না। যেমন, আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় সর্বপ্রথম ব্যক্তি কিয়ামতের দিন যার ওপর ফয়সালা করা হবে, সে ব্যক্তি যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আনা হবে, অতঃপর তাকে আল্লাহ্র নি‘আমতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا ‘তুমি এতে কি আমল করেছ?’ সে বলবে, قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ. আপনার জন্য জিহাদ করে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لأَنْ يُقَالَ جَرِىءٌ. فَقَدْ قِيلَ. ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি এ জন্য জিহাদ করেছ যেন তোমাকে বীর বলা হয়, অতএব তা বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আবারও আলিম ব্যক্তিকে আনা হবে, যে ইলম শিখেছে, শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন তিলাওয়াত করেছে। অতঃপর তাকে তার নি‘আমতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا ‘তুমি এতে কি আমল করেছ?’ সে বলবে, تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ. আমি ইলম শিখেছি ও শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ. وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ. فَقَدْ قِيلَ. ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি ইলম শিক্ষা করেছ যেন তোমাকে আলিম বলা হয়। কুরআন তিলাওয়াত করেছ যেন তোমাকে ক্বারী বলা হয়। অতএব তা-ই বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে, তাকে চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
পুনরায় আরও এক ব্যক্তিকে আনা হবে, যাকে আল্লাহ সচ্ছলতান সাথে সকল প্রকার ধন-সম্পদ দান করেছেন। তাকে তার নি‘আমতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا ‘তুমি এতে কী আমল করেছ?’ সে বলবে, مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلاَّ أَنْفَقْتُ فِيهَا আপনি পছন্দ করেন এমন কোন খাত নেই, যেখানে আমি আপনার জন্য দান করিনি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ. فَقَدْ قِيلَ ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি দান করেছ যেন তোমাকে দানশীল বলা হয়। অতএব বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে, তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’ (মুসলিম হা/১৯০৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৫১৮; ছহীহুল জামি হা/২০১৪)।
অতএব নিয়ত পরিশুদ্ধ হ’তে হবে, নতুবা কোন ইবাদত কবূল হবে না। যেমন ওমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، ‘প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১; আবূদাউদ হা/২২০১)। হে মানুষ! ইবাদত করুন খালিছ অন্তরে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। নিয়াত ছহীহ করুন, রিয়ামুক্ত হোন! নিয়াতের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহিমাহুল্লাহ বলেন— رب عمل صغير تعظمه النية، ورب عمل كبير تصغره النية. ‘নিয়াত অনেক ক্ষুদ্র আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। পক্ষান্তরে, নিয়াত অনেক বৃহৎ আমলকেও ক্ষুদ্র আমলে পরিণত করে দেয়’।
দো‘আ করার পদ্ধতি :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَدْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً ‘তোমরা ¯¦ীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি-মিনতি সহকারে গোপনে (আ‘রাফ ৭/৫৫)। (২) এক মনে ভয় ও আকাংখা সহকারে এবং অনুচ্চ শব্দে অথবা মধ্যম স্বরে হওয়া (যুমার ৩৯/৫০-৫৪; ইসরা ১৭/১১০)। (৩) সারগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণ হওয়া (আবূদাঊদ, মিশকাত হা/১৪৮২)।
দৃঢ়তার সাথে চাওয়াকে আল্লাহ পছন্দ করেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَا يَقُولَنَّ أَحَدُكُمُ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي إِنْ شِئْتَ اللَّهُمَّ ارْحَمْنِي إِنْ شِئْتَ لِيَعْزِمِ الْمَسْأَلَةَ فَإِنَّهُ لَا مُكْرِهَ لَهُ. ‘তোমাদের কেউ যেন অবশ্যই এভাবে না বলে, হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে দয়া করুন। বরং সে যেন দৃঢ়ভাবে চায়। কেননা আল্লাহর ওপর জবরদস্তি করার কেউ নেই’ (বুখারী হা/৬৩৩৯; মুসলিম হা/২৬৭৯)।
আল্লাহ্র ভয়ে কেঁদে কেঁদে দো‘আ করা উচিৎ। কারণ আল্লাহ্র ভয়ে নির্গত অশ্রুর ফোঁটা ও আল্লাহ্র পথে নির্গত রক্তের ফোঁটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। আবূ উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, لَيْسَ شَيْءٌ أَحَبَّ إِلَى اللهِ مِنْ قَطْرَتَيْنِ وَأَثَرَيْنِ، قَطْرَةٌ مِنْ دُمُوْعٍ فِيْ خَشْيَةِ اللهِ، وَقَطْرَةُ دَمٍ تُهَرَاقُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ. ‘দু’টি ফোঁটা ও দু’টি চিহ্নের চেয়ে অধিক প্রিয় আল্লাহ্র নিকট অন্য কিছু নেই। (১) আল্লাহ্র ভয়ে নিঃসৃত অশ্রু ফোঁটা (২) আল্লাহ্র পথে (জিহাদে) নির্গত রক্তের ফোঁটা’ (তিরমিযী হা/১৬৬৯; মিশকাত হা/৩৮৩৭, সনদ হাসান)।
দরূদ পাঠ ব্যতীত দো‘আ কবূল হওয়া থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, كُلُّ دُعَاءٍ مَحْجُوبٌ حَتَّى يُصَلِّيَ عَلَى مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. ‘নবী (ছাঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি দরূদ পেশ করা না হ’লে সমস্ত দো‘আ কবূল হওয়া থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে’ (ত্বাবারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত হা/৭২১; ছহীহুল জামি‘ হা/৪৫২৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৩৫; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬৭৫)। অন্যত্র ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, إِنَّ الدُّعَاءَ مَوْقُوفٌ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ لاَ يَصْعَدُ مِنْهُ شَيْءٌ حَتَّى تُصَلِّيَ عَلَى نَبِيِّكَ صلى الله عليه وسلم. ‘আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে দো‘আ ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। তোমারা রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি যতক্ষণ না দরূদ পাঠ করো, ততক্ষণ তার কিছুই উপরে ওঠে না’ (তিরমিযী হা/৪৮৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৫৩)।
দো‘আ করার পূর্বে নিম্নোক্ত পদ্ধতিসমূহ পালন করা যরূরী। (১) দো‘আ করার শুরুতে এবং শেষে হাম্দ ও দরূদ পাঠ করা (২) দো‘আ আল্লাহ্র প্রতি খালিছ আনুগত্য সহকারে হওয়া (৩) দো‘আয় কোন পাপের কথা কিংবা আত্মীয়তা ছিন্ন করার কথা না থাকা (৪) খাদ্য-পানীয় ও পোষাক হালাল ও পবিত্র হওয়া (৫) দো‘আ কবূলের জন্য ব্যস্ত না হওয়া (৬) নিরাশ না হওয়া এবং দো‘আ পরিত্যাগ না করা (৭) উদাসীনভাবে দো‘আ না করা এবং দো‘আ কবূলের ব্যাপারে সর্বদা দৃঢ় আশাবাদী থাকা (মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৫৯, ২২২৭; তিরমিযী, আহমাদ, মিশকাত হা/২২৪১)। তবে আল্লাহ ইচ্ছা করলে যে কোন সময় যে কোন বান্দার এমনকি কাফির-মুশরিকদের দো‘আও কবূল করে থাকেন, যদি সে অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা চায় (ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃষ্ঠা-২৬৮)।
আল্লাহর ভয় :
উমাইয়া খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (রাহিঃ) ইসলামের ইতিহাসে অধিক ক্রন্দনকারী হিসাবে খ্যাত। তাঁর পুণ্যময় জীবনের বিস্ময়কর একটি ঘটনা হচ্ছে, ফাতিমা বিনতে আব্দুল মালিক কেঁদে কেঁদে তাঁর দৃষ্টিশক্তি দুর্বল করে ফেলল। অতঃপর তাঁর ভাই মাসলামা ও হিশাম তাঁর নিকট এসে বলল, কোন জিনিসটি তোমাকে এভাবে কাঁদাচ্ছে? তোমার যদি দুনিয়ার কোন কিছু হারায় তাহ’লে আমাদের সম্পদ ও পরিজন দ্বারা তোমাকে আমরা সাহায্য করব। তাদের জওয়াবে ফাতিমা বললেন, ওমরের কোন কিছুর জন্যে আমি দুঃখ করছি না। কিন্তু আল্লাহর কসম! গত রাত্রে দেখা একটি দৃশ্য আমার ক্রন্দনের কারণ। অতঃপর ফাতিমা বিনতে আব্দুল মালিক বললেন, আমি গত রাত্রে ওমর বিন আব্দুল আযীযকে ছালাতরত অবস্থায় দেখেছি। এরপর তিনি আল্লাহ্র বাণী,يَوْمَ يَكُوْنُ النَّاسُ كَالْفَرَاشِ الْمَبْثُوْثِ، وَتَكُوْنُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوْشِ. ‘যেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মত এবং পর্বতমালা হবে ধুনিত রঙিন পশমের মত’ (ক্বারি‘আহ ১০১/৪-৫) এই আয়াতদ্বয় পাঠ করে চিৎকার করে উঠলেন এবং মাটিতে পড়ে গেলেন। অতঃপর কঠিনভাবে চিৎকার করতে থাকলে আমার মনে হ’ল তাঁর রূহ বের হয়ে যাবে। এরপরে তিনি থেমে গেলেন, আমার মনে হ’ল তিনি হয়ত মারা গেছেন। তিনি চেতনা ফিরে পেয়ে ফরিয়াদ করে বলতে লাগলেন, হায়! মন্দ সকাল! অতঃপর তিনি লাফিয়ে উঠে ঘরের মধ্যে ঘুরতে থাকলেন আর বলতে লাগলেন, ‘হায়! আমার জন্য দুর্ভোগ। সেদিন লোকরা হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মত এবং পর্বতমালা হবে ধুনিত রঙিন পশমের মত’? (জামালুদ্দীন আল-জাওযী, আল-মুনতাযাম ফী তারীখিল উমাম ওয়াল মুলূক, তাহক্বীক : মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির ও মোস্তফা আব্দুল ক্বাদির (বৈরূত : দারুল কুতুবুল ইলমিয়াহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৯২ খ্রীঃ), ৭/৭২)
আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার মত ভয় করো। তিনি সব দেখেন ও জানেন এই চিন্তা মর্মপীড়া তৈরী করলে প্রকৃত ভয় অন্তকরণে ঢুকবে নতুবা নয়। মানুষ সিসি ক্যামেরাতে যেমন ভয় পায় অনুরূপ যদি আল্লাহকে ভয় পেত তবে দুনিয়াটা ন্যায় ও ইনসাফে ভরে উঠত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের অন্তরগুলোকে পরিবর্তন করে হেদায়েতের নূর দ্বারা আলোকিত করুন, আমীন।
(লেখাটি ফযীলতপূর্ণ দো‘আ ও যিকির’ বই থেকে নেয়া)