লিলবর আল-বারাদী
http://www.tawheederdak.com/article_details/799
জ্ঞানার্জনকারীর মর্যাদা :
আল্লাহ তা‘আলাকে চেনার প্রথম স্তর হ’ল জ্ঞানার্জন করা। আল্লাহর নিকট থেকে যে অহির বিধান এসেছে তা হ’ল কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল অর্থাৎ পবিত্র কুরআন মাজীদ ও রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ। এই দুই কিতাবের জ্ঞানকে দ্বীনী জ্ঞান বা ইলম বলা হয়। এই ইলম অর্জনকারী সম্পর্কে অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহর সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ (মুজাদালা ৫৮/১১)। জ্ঞানী ব্যক্তিরা কেবল আল্লাহর বিধান জেনে বুঝে তাঁকে ভয় করেন। আল্লাহর তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহরকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)।
আর স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সাক্ষ্য দিয়েছেন নিজের প্রতি এবং অনূরূপ সাক্ষ্য প্রদান করেন তারা, ফেরেশতা, যারা নিষ্ঠাবান জ্ঞানী। আল্লাহর তা‘আলা বলেন, شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া সত্যিকার কোন ইলাহ নেই এবং ফেরেশতাগণ ও ন্যায়নীতিতে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানীগণও। তিনি ছাড়া সত্যিকার কোন ইলাহ নেই, তিনি মহাপরাক্রাস্ত, মহাজ্ঞানী’ (আলে ইমরান ৩/১৮)। এসম্পর্কে ইবনুল কাইয়িম বলেন, ‘ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও তাঁর একত্বের সাক্ষ্য দেন। এতে জ্ঞানী ব্যক্তিদের ফযীলত ও মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ফেরেশতাদের পাশাপাশি তাদেরকে উল্লেখ করেছেন। তবে জ্ঞানী বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে, যারা কিতাব ও সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে ধন্য হয়েছেন’ (ফাতহুল ক্বাদীর)।
কিতাব ও হিকমাত তথা অহীর জ্ঞানার্জনকারীর প্রতি আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ রয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, وَأَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا ‘আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমাত নাযিল করেছেন। তুমি যা জানতে না তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং তোমার উপর রয়েছে আল্লাহ অপরিসীম অনুগ্রহ’ (নিসা ৪/১১৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‘এভাবে আমরা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রূহ তথা আমাদের নির্দেশ; তুমিতো জানতেনা কিতাব কি ও ঈমান কি! পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো, যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করি; তুমিতো প্রদর্শন কর শুধু সরল পথই (শূরা ৪২/৫২)? তিনি আরও বলেন, وَمَا كُنْتَ تَرْجُو أَنْ يُلْقَى إِلَيْكَ الْكِتَابُ إِلَّا رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ ‘তুমি আশা করতে না যে, তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হবে। এটা কেবল তোমার পালনকর্তার রহমত’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৬)।
দুনিয়াতে মানবজাতি প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য হ’ল সর্বদা তাঁর ইবাদত বন্দেগী করা। আর ইবাদতের পূর্বে ইলম অর্জন করা ফরয। অজ্ঞতা ও মূর্খতা পরিহার করে জ্ঞাতী সহকারে তাঁকে স্মরণ করা জন্যই সর্বপ্রথমে যে জ্ঞানার্জন প্রয়োজন, সেই ইলম আহরণকারীই হ’ল সর্বোত্তম জ্ঞানী। যারা এমন জ্ঞান অর্জনে ব্যাপৃত থাকে তাদের মর্যাদা নিম্নরূপ-
১. জ্ঞান অন্বেষণকারীর চলা পথে ফেরেশতা ডানা বিছিয়ে দেন :
জ্ঞান অন্বেষণকারী যখন ইলম অর্জনের জন্য পথ চলে, তখন সে যেন জান্নাতের পথেই থাকে এবং ফেরেশতাগণ তার চলার পথে ডানা বিছিয়ে দেন। আবূ দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَطْلُبُ فِيْهِ عِلْمًا سَلَكَ اللهُ بِهِ طَرِيْقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ ‘যে ব্যক্তি ইলম হাছিলের জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তা‘আলা তার মাধ্যমে তাকে জান্নাতের পথ সমূহের একটি পথে পৌঁছে দেন এবং ফেরেশতাগণ ইলম তলবকারীর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেন’।[1] অন্যত্র এসেছে, ছফওয়ান ইবনু আসসাল আল-মুরাদী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَا مِنْ خَارِجٍ خَرَجَ مِنْ بَيْتِهِ فِى طَلَبِ الْعِلْمِ إِلاَّ وَضَعَتْ لَهُ الْمَلاَئِكَةُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا بِمَا يَصْنَعُ. ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য ঘর থেকে বের হয়, তার এই সন্তোষজনক উদ্যোগে প্রীত হয়ে ফেরেশতামন্ডলী তার চলার পথে তাদের পাখা বিছিয়ে দেন’।[2]
২. স্বস্তি ও প্রশান্তি নাযিল করা হয় :
আল্লাহ তা‘আলা ইলম অর্জনকারী ব্যক্তিদের প্রতি তাঁর তরফ থেকে স্বস্তি ও প্রশান্তি নাযিল করেন এবং তাকে রহমত দ্বারা ঢেকে দেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِى بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ. ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য পথ চলে, আল্লাহ তা‘আলা এর বিনিময়ে তার জান্নাতে প্রবেশের পথ সহজ করে দেন। যখন কোন দল আল্লাহ কোন ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহ কিতাব তিলাওয়াত করে এবং জ্ঞানচর্চা করে, তাদের ওপর আল্লাহর তরফ থেকে স্বস্তি ও প্রশান্তি নাযিল হ’তে থাকে, আললাহর রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয় এবং ফেরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাগণের নিকট তাদের কথা উল্লেখ করেন। আর যার আমল তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশ তাকে এগিয়ে দিতে পারে না’।[3]
৩. আসমান ও যমীনবাসীর দো‘আ প্রযোজ্য হয় :
জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য আসমান-যমীনের সকল প্রাণী ও বস্ত্ত দো‘আ করেন। আবু দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالْحِيْتَانُ فِيْ جَوْفِ الْمَاءِ. ‘নিশ্চয়ই যারা আলেম তাদের জন্য আসমান ও যমীনে যারা আছে, তারা আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে, এমনকি পানির মধ্যকার মাছ সমূহও’।[4] অন্যত্র এসেছে, আবূ উমামাহ্ আল বাহিলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِى جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ. ‘আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতাগণ এবং আকাশমন্ডলী ও যমীনের অধিবাসীরা, এমনকি গর্তের পিঁপড়া ও পানির মাছ পর্যন্ত ইলম অর্জনকারীর জন্য দো‘আ করে’।[5] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَلْخَلْقُ كُلُّهُمْ يُصَلُّونَ على مُعَلِّمِ الخَيْرِ حَتَّى حِيْتَانِ البَحْرِ ‘মানুষকে কল্যাণের শিক্ষাদানকারীর জন্য সমগ্র সৃষ্টি, এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্তও দো‘আ করে’।[6]
৪. জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ :
ইলম অর্জনকারী কুরআনের প্রতিটি বর্ণ পাঠের বিনিময়ে নেকী পাবে। আর সে নেকী আমলের দশগুণ হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لاَ أَقُولُ الم َرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ. ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্্র কিতাবের একটি অক্ষর পাঠ করবে, সে নেকী পাবে। আর নেকী হচ্ছে আমলের দশ গুণ। আমি বলছি না, ‘আলিফ লাম মীম’ একটি অক্ষর। বরং ‘আলিফ’, ‘লাম’ ও ‘মীম’ এক একটি আলাদা অক্ষর’।[7]
কুরআন পাঠকারী ক্বিয়ামতের দিনে যত বেশী পাঠ করতে পারবে, সে তত বেশী জান্নাতের উচ্চ মাকামে পৌঁছাবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِى الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَتَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَأُ بِهَا. ‘কুরআন পাঠকারীকে ক্বিয়ামতের দিন বলা হবে, তুমি কুরআন তিলাওয়াত করতে থাক এবং উপরে উঠতে থাক। সুস্পষ্টভাবে ঠিক সেইভাবে ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করতে থাক, যেভাবে দুনিয়াতে তিলাওয়াত করতে। কারণ তোমার মর্যাদার স্থান ততখানি উঁচু হবে, যেখানে তুমি তিলাওয়াতের আয়াত শেষ করবে’।[8]
কুরআন পাঠে পারদর্শী ব্যক্তি ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهُوَ مَاهِرٌ بِهِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِى يَقْرَؤُهُ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ أَجْرَانِ. ‘কুরআন অধ্যয়নে পারদর্শী ব্যক্তি মর্যাদাবান লিপিকার ফেরেশতাগণের সাথী হবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করে ও আটকে যায় এবং কুরআন তার জন্য কষ্টদায়ক হয়, তাহ’লে তার জন্য দু’টি পুরস্কার’।[9]
জ্ঞান সর্বদা মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে। সমাজে সুশীলতা বিরাজ করবে। দলে দলে মানুষ জ্ঞানের উপকার ভোগ করবে। আবূ মূসা আশ্‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَثَلُ مَا بَعَثَنِى اللَّهُ بِهِ مِنَ الْهُدَى وَالْعِلْمِ كَمَثَلِ الْغَيْثِ الْكَثِيرِ أَصَابَ أَرْضًا ، فَكَانَ مِنْهَا نَقِيَّةٌ قَبِلَتِ الْمَاءَ ، فَأَنْبَتَتِ الْكَلأَ وَالْعُشْبَ الْكَثِيرَ، وَكَانَتْ مِنْهَا أَجَادِبُ أَمْسَكَتِ الْمَاءَ ، فَنَفَعَ اللَّهُ بِهَا النَّاسَ ، فَشَرِبُوا وَسَقَوْا وَزَرَعُوا وَأَصَابَتْ مِنْهَا طَائِفَةً أُخْرَىإِنَّمَا هِىَ قِيعَانٌ لاَ تُمْسِكُ مَاءً وَلاَ تُنْبِتُ كَلأً فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ فَقِهَ فِى دِينِ اللَّهِ وَنَفَعَهُ مَا بَعَثَنِى اللَّهُ بِهِ فَعَلِمَ وَعَلَّمَ وَمَثَلُ مَنْ لَمْ يَرْفَعْ بِذَلِكَ رَأْسًا وَلَمْ يَقْبَلْ هُدَى اللَّهِ الَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ. ‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হিদায়াত ও ইলম দিয়ে পাঠিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত হ’ল যমীনে মুষলধারে বৃষ্টি, যা কোন ভূখন্ডে পড়েছে। সে ভূখন্ডের একাংশ উৎকৃষ্ট, যা বৃষ্টিকে চুষে নিয়েছে এবং প্রচুর উদ্ভিদ, গাছ-গাছালি ও ঘাস জন্ম দিয়েছে। আর অপর অংশ ছিল কঠিন ও গভীর, যা পানি শোষণ না করে আটকিয়ে রেখেছে। যার দ্বারা মানুষেরা উপকৃত হরেছে। লোকেরা তা পান করেছে, অপরকে পান করিয়েছে এবং ক্ষেত-খামারে কৃষি ও সেচকার্যও করেছে। অপরদিকে কিছু বৃষ্টি ভূমির সমতল ও কঠিন জায়গায় পড়েছে, যা পানি আটকিয়ে রাখেনি, শোষণ করেনি কিংবা গাছপালাও জন্মায়নি। এটা হ’ল সে ব্যক্তির উদাহরণ যে আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছে এবং যা দিয়ে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন এটা তার কল্যাণ সাধন করেছে। সে তা শিক্ষা করেছে এবং অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে। আর অপর উদাহরণ হ’ল, যে ব্যক্তি এর দিকে মাথা তুলে দেখেনি এবং আল্লাহ তা‘আলার যে হেদায়াতবাণী দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে তা সে কবুলও করেনি’।[10]
৫. সর্বোত্তম ব্যক্তি হিসাবে ঘোষিত :
মানুষের মধ্যে সে-ই উত্তম যে নিজে কুরআনের ইলম শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়। ওছমান ইবনে আফফান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ. ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বোত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে তা শিক্ষা দেয়’।[11]
ইলম অর্জনকারীর মর্যাদা দুনিয়া ও আখিরাতে সবচেয়ে বেশী। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ছাহাবীরা রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মাঝে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, أَتْقَاهُمْ ‘তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে অধিক মুত্তাক্বী। তখন তারা বলল, আমরা তো আপনাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, فَيُوسُفُ نَبِىُّ اللَّهِ ابْنُ نَبِىِّ اللَّهِ ابْنِ نَبِىِّ اللَّهِ ابْنِ خَلِيلِ اللَّهِ . ‘তাহ’লে আল্লাহর নবী ইউসুফ, যিনি আল্লাহর নবী’র পুত্র, আল্লাহর নবী’র পৌত্র এবং আল্লাহর খলীল-এর প্রপৌত্র। তারা বলল, আমরা আপনাকে এ ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, فَعَنْ مَعَادِنِ الْعَرَبِ تَسْأَلُونَ خِيَارُهُمْ فِى الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُهُمْ فِى الإِسْلاَمِ إِذَا فَقُهُوا . ‘তাহ’লে কি তোমরা আরবের মূল্যবান গোত্রসমূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছ? জাহেলী যুগে তাদের মধ্যে যারা সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন, ইসলামেও তারা সর্বোত্তম ব্যক্তি, যদি তারা দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন’।[12]
৬. ইলম অর্জনকারী নবীর ওয়ারিছ :
জ্ঞান অন্বেষণকারীগণ যখন জ্ঞানার্জনের পর নিজের জীবনে তা প্রতিপালন করে বা সে অনুযায়ী আমল করে, তবে তারা আলিম হিসাবে পরিগণিত হয়। আর এসব আলিম বা জ্ঞানীরাই নবীর প্রকৃত ওয়ারিছ। আবু দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلاَ دِرْهَمًا وَرَّثُوْا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ. ‘আলেমগণের মর্যাদা আবেদগণের উপরে ঐরূপ, পূর্ণিমার রাতে চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকাসমূহের উপরে যেরূপ। নিশ্চয়ই আলেমগণ হ’লেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান না। বরং তারা রেখে যান কেবল ইলম। অতএব যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে ব্যক্তি পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’।[13]
৭. সাধারণ আবিদ ব্যক্তির চেয়ে আলিমগণ মর্যাদাবান :
আবু উমামা আল-বাহিলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দুই ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল। তাদের একজন আবিদ বা ইবাদাতকারী, আর অপরজন আলিম বা দ্বীনের জ্ঞানার্থী ছিলেন। তিনি বলেন, فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِى عَلَى أَدْنَاكُمْ. ‘আলিমের মর্যাদা আবিদের ওপর। যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের ওপর’।[14]
ক্বাযী আয়ায বলেন, নক্ষত্রের আলো দ্বারা সে কেবল নিজেই আলোকিত হয়। কিন্তু চাঁদের আলো নিজেকে ছাড়াও অন্যকে আলোকিত করে। অনুরূপভাবে একজন আবিদ ব্যক্তি তার ইবাদত দ্বারা কেবল নিজের আধ্যাত্মিক বিষয়ে উন্নতি ঘটায়। কিন্তু একজন আলিম ব্যক্তি তার ইলম দ্বারা নিজে যেমন উপকৃত হন, তেমনি অন্যকেও উপকৃত করে থাকেন। আর একজন আলিম উক্ত নূর লাভ করেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে। যেমন চন্দ্র জ্যোতি লাভ করে থাকে সূর্য থেকে। আর সূর্য কিরণ লাভ করে মহান আল্লাহর রববুল আলামীন থেকে (মিরক্বাত)। একইভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অহি লাভ করে থাকেন আল্লাহর সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার থেকে। তাই রাসূল (ছাঃ) বলেন, قَصْدٌ فِي عِلْمٍ خَيْرٌ مِنْ فَضْلٍ فِي عِبَادَةٍ ‘অধিক ইবাদত করার চেয়ে অধিক ইলম অর্জন করা উত্তম’।[15]
৮. জিহাদের ছওয়াব অর্জন :
জিহাদের ছওয়াব হাছিল করার অন্যতম মাধ্যম হ’ল দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করা। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ خَرَجَ فِي طَلَبِ العِلْمِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ حَتَّى يَرْجِعَ، ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণে বেরিয়ে পড়ে, সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় আছে বলে গণ্য হবে’।[16]
ইলম অর্জনকারীর সম্মান আল্লাহর পথে জিহাদরত সৈনিকের মত। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ جَاءَ مَسْجِدِي هَذَا، لَمْ يَأْتِهِ إِلَّا لِخَيْرٍ يَتَعَلَّمُهُ أَوْ يُعَلِّمُهُ، فَهُوَ بِمَنْزِلَةِ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَمَنْ جَاءَ لِغَيْرِ ذَلِكَ، فَهُوَ بِمَنْزِلَةِ الرَّجُلِ يَنْظُرُ إِلَى مَتَاعِ غَيْرِهِ ‘যে ব্যক্তি আমার এই মসজিদে জ্ঞান শেখার জন্য অথবা শিক্ষা দেওয়ার জন্য আগমন করে, তার মর্যাদা আল্লাহর পথে জিহাদরত সৈনিকের মত। আর যে ব্যক্তি ভিন্ন উদ্দেশ্যে এখানে আসে, তার উপমা সেই ব্যক্তির মত, যে অপরের সম্পদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে’।[17]
৯. হজ্জের ছওয়াব অর্জন :
ইলম অজর্নের জন্য মসজিদে গমন করলে, তার আমলনামায় পূর্ণ হজ্জের ছওয়াব হয়। আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ غَدَا إِلَى الْمَسْجِدِ لا يُرِيدُ إِلا أَنْ يَتَعَلَّمَ خَيْرًا أَوْ يَعْلَمَهُ، كَانَ لَهُ كَأَجْرِ حَاجٍّ تَامًّا حِجَّتُهُ ‘যে ব্যক্তি কল্যাণমূলক দ্বীন শেখা বা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করে, তার জন্য পূর্ণ হজ্জের সমপরিমাণ নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়’।[18]
১০. চেহারায় চির উজ্জ্বলতা লাভ :
ইলম অর্জনের ফলে জ্ঞানীর চেহারা চির উজ্জ্বলতার বহিঃপ্রকাশ থাকবে। যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ غَيْرَهُ فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لَيْسَ بِفَقِيهٍ. ‘যে ব্যক্তি আমার নিকট থেকে হাদীছ শুনে ও তা মুখস্থ রাখে এবং অন্যের নিকটে তা পৌঁছে দেয়, আল্লাহ তাকে চির উজ্জ্বল করে রাখবেন। জ্ঞানের বাহক, তার চেয়ে অধিক বুঝদার লোকের নিকট তা বহন করে; যদিও জ্ঞানের অনেক বাহক নিজে জ্ঞানী নয়’।[19]
কুরআন দ্বারা হেদায়াত কেবল তারাই পায়, যাদের মধ্যে ঈমানের অনুসন্ধান ও তার প্রতি তীব্র আগ্রহ থাকে। তারা এটাকে হেদায়াত লাভের নিয়তে পড়ে, শোনে এবং চিন্তা-গবেষণা করে। তাই আল্লাহ এদের সাহায্য করেন এবং হেদায়াতের পথ সুগম করে দেন। এই পথের উপরেই এরা অবিচল থাকে। পক্ষান্তরে যারা নিজের চোখ বন্ধ করে নেয় ও কানে ছিপি লাগিয়ে নেয় এবং জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগায় না, তারা হেদায়াত কিভাবে পেতে পারে? আল্লাহ বলেন, قُلْ هُوَ لِلَّذِيْنَ آمَنُوا هُدىً وَّشِفَاءٌ وَالَّذِيْنَ لاَيُؤْمِنُوْنَ فِي آذَانِهِمْ وَقْرٌ وَّهُوَ عَلَيْهِمْ عَمىً اُولَئِكَ يُنَادُوْنَ مِن مَّكَانٍ بَعِيْدٍ ‘বল, বিশ্বাসীদের জন্য এটা পথনির্দেশক ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে এদের জন্য অন্ধকারস্বরূপ। এরা এমন যে, যেন এদের বহু দূর হ’তে আহবান করা হয়’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৪)।
(ক্রমশঃ)
———————————–
[1]. আবুদাঊদ হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/২১২; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; ছহীহুল জামি‘ হা/৬২৯৭।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/২২৬; দারাকুৎনী হা/৭৭৬; ছহীহুল জামি‘ হা/৫৭০২; ছহীহ হাদীছ।
[3]. মুসলিম হা/২৬৯৯;; ইবনু মাজাহ হা/২২৫; মিশকাত হা/২০৪।
[4]. আবূ দাঊদ হা/৩৬৪১; হাসান হাদীছ মিশকাত হা/২১২।
[5]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; দারেমী হা/২৮৯; ছহীহুল জামি‘ হা/৪২১৩ মিশকাত হা/২১৩।
[6]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৮৫২।
[7]. তিরমিযী হা/২৯১০;; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩২৭; হাসান ছহীহ মিশকাত হা/২১৩৭।
[8]. তিরমিযী হা/২৯১৪;; আবূ দাঊদ হা/১৪৬৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২২৪০; ছহীহুল জামি‘ হা/৮১২২; হাসান ছহীহ মিশকাত হা/২১৩৪।
[9]. মুসলিম হা/৭৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৭৭৯; মিশকাত হা/২১১২।
[10]. বুখারী হা/৭৯; মুসলিম হা/২২৮২; ইবনু হিববান হা/৪; মিশকাত হা/১৫০।
[11]. বুখারী হা/৫০২৭; আবূ দাঊদ হা/১৪৫২; তিরমিযী হা/২৯০৭; মিশকাত হা/২১০৯।
[12]. বুখারী হা/৩৩৫৩, ৩৩৮৩; মুসলিম হা/২৩৭৮; মিশকাত হা/২০১; ।
[13]. আবূ দাঊদ হা/৩৬৪১; হাসান হাদীছ মিশকাত হা/২১২;।
[14]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; দারেমী হা/২৮৯; ছহীহুল জামিদ হা/৪২১৩; মিশকাত হা/২১৩;।
[15]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, মিশকাত হা/২৫৫; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭২৭; সনদ ছহীহ।
[16]. ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৮৮; সনদ হাসান লিগায়রিহী (আলবানী); রিয়াযুছ ছলেহীন হা/১৩৯৩; ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীছটি হাসান।
[17]. ইবনু মাজাহ হা/২২৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৪২১৪; সনদ ছহীহ।
[18]. ত্বাবারানী হা/৭৩৪৬; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৮৬; হাসান ছহীহ।
[19]. আহমাদ হা/২৮৬৪; আবুদাঊদ হা/৩৬৬০; তিরমিযী হা/২৬৫৬; সনদ ছহীহ।