প্রতিশোধের চেয়ে ক্ষমা শ্রেয়

দুনিয়াতে যুগে যুগে যালেম অত্যাচার করেছে, মযলুম তা সহ্য করেছেন। কিন্তু মযলুম ব্যক্তি যদি প্রতিশোধ না নিয়ে ধৈর্য ধারণ করে, তবে সে সফলকাম। ইউসুফ (আঃ) শত নির্যাতন ও যুলুমের স্বীকার হয়ে এবং প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার ভাইদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে বলেছিলেন,لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন। তিনি মেহেরবানদের চেয়ে অধিক মেহেরবান’ (ইউসুফ ১২/৯২)। 

ইউসুফ আলাইহিস সালাম ভ্রাতাদের নিজেদের অপরাধ স্বীকার ও ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সবাই একযোগে বলল, আল্লাহর কসম, তিনি তোমাকে আমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তুমি এরই যোগ্য ছিলে। আমরা নিজেদের কৃতকর্মে দোষী ছিলাম। আল্লাহ মাফ করুন। উত্তরে ইউসুফ আলাইহিস্ সালাম নবীসুলভ গাম্ভীর্যের সাথে বললেন, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগও নেই। তোমাদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়া তো দূরের কথা। এ হচ্ছে তার পক্ষ থেকে ক্ষমার সুসংবাদ। এটা চরিত্রের উচ্চতম স্তর যে, অত্যাচারীকে শুধু ক্ষমাই করেননি, বরং এ কথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এখন তোমাদেরকে তিরস্কার করা হবে না। অতঃপর আল্লাহর কাছে দোআ করলেন, আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের অন্যায় ক্ষমা করুন। তিনি সব মেহেরবানের চাইতে অধিক মেহেরবান।

নবী করীম (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন এমন লোকদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, যারা ছিল তার প্রাণঘাতি শত্রু। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কারণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা প্রতিশোধ গ্রহণ করা থেকে নিজেকে নিবৃত রাখেন, আকাশের দরজা খুলে ফেরশতা নেমে এসে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে সাহায্য করেন এবং তাদের উপর রহমত বর্ষিত হয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে মাযলূম হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হয়। যেমন আল্লাহ আখেরাত পিয়াসী বান্দাদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, وَالَّذِيْنَ إِذَا أَصَابَهُمُ الْبَغْيُ هُمْ يَنْتَصِرُوْنَ، ‘আর তারা অত্যাচারিত হ’লে প্রতিশোধ গ্রহণ করে’ (শূরা ৪২/৩৯)

অর্থাৎ, তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করতে অপারগ নয়। প্রতিশোধ নিতে চাইলে নিতে পারে। কিন্তু শক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা ক্ষমা করে দেওয়াকে প্রাধান্য দেয়। যেমন, নবী করীম (সাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন এমন লোকদের ব্যাপারে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, যারা ছিল তাঁর রক্তপিপাসু। হুদাইবিয়ার সন্ধির দিন তিনি সেই ৮০ জন লোককে মাফ করে দিয়েছিলেন, যারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। লাবীদ ইবনে আ’স্বাম ইয়াহুদীর কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি, যে তাঁকে যাদু করেছিল। সেই ইয়াহুদী মহিলাকেও তিনি মাফ করে দিয়েছিলেন, যে তাঁর খাদ্যে বিষ মাখিয়ে দিয়েছিল। যার কষ্ট তিনি জীবনের শেষে মরণ-মুহূর্তেও অনুভব করেছিলেন। (ইবনে কাসীর) 

মযলুমের সাহায্যে ফেরেশতা নাযিল হয় :

মযলুম অত্যাচারিত হওয়ার সময় চুপ থাকলে ফেরেশতাগণ দুনিয়াতে নেমে আসেন এবং মযলুমের পক্ষে যালেমের জবাব দেন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রাঃ) বলেন, ‘একদা রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদের নিয়ে বসে ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে আবুবকর (রাঃ)-কে গালি দিয়ে কষ্ট দিল, কিন্তু আবুবকর (রাঃ) কোন জবাব না দিয়ে চুপ থাকলেন। তারপর লোকটা পুনরায় আবুবকর (রাঃ)-কে কষ্ট দিল। কিন্তু তিনি কোন জবাব না দিয়ে চুপ থাকলেন। তৃতীয়বার লোকটা আবারও আবুবকর (রাঃ)-কে গালি দিয়ে কষ্ট দিল, কিন্তু তিনি এবার লোকটির প্রতিশোধ নিলেন (অর্থাৎ লোকটাকে পাল্টা জবাব দিলেন)। যখন আবুবকর (রাঃ) তার প্রতিশোধ নিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উঠে দাঁড়ালেন। আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, (যখন তুমি চুপ ছিলে) আসমান থেকে একজন ফেরেশতা অবতরণ করে তোমার পক্ষ হয়ে জবাব দিচ্ছিলেন। কিন্তু যখন তুমি তার প্রতিশোধ নিলে, তখন এখানে শয়তান উপস্থিত হ’ল। আর যেখানে শয়তান উপস্থিত হয়, সেখানে আমি বসে থাকতে পারি না’ (আবূদাঊদ হা/৪৮৯৬; শু‘আবুল ঈমান হা/৬২৪২; ছহীহাহ হা/২৩৭৬)।

তারপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন,يَا أَبَا بَكْرٍ ثَلَاثٌ كُلُّهُنَّ حَقٌّ: مَا مِنْ عَبْدٍ ظُلِمَ بِـمَظْلَمَةٍ فَيُغْضِيْ عَنْهَا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، إِلَّا أَعَزَّ اللهُ بِـهَا نَصْرَهُ، وَمَا فَتَحَ رَجُلٌ بَابَ عَطِيَّةٍ، يُرِيدُ بِـهَا صِلَةً، إِلَّا زَادَهُ اللهُ بِهَا كَثْرَةً، وَمَا فَتَحَ رَجُلٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ، يُرِيدُ بِهَا كَثْرَةً، إِلَّا زَادَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ بِـهَا قِلَّةً- ‘হে আবুবকর! তিনটি বিষয় আছে, যেগুলোর প্রত্যেকটি সত্য।

(১) যদি কোন ব্যক্তির উপর যুলুম করা হয়, আর সে যুলুমের প্রতিবাদ না করে চুপ থাকে, তাহ’লে মহান আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন।

(২) যদি কোন ব্যক্তি তার দানের দরজা খুলে দেওয়ার মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ইচ্ছা পোষণ করে, তাহ’লে আল্লাহ অবশ্যই তা বৃদ্ধি করে দিবেন।

(৩) কোন ব্যক্তি ভিক্ষার দরজা খুলে দিলে এবং এর মাধ্যমে তার সম্পদ বৃদ্ধি করতে চাইলে আল্লাহ তার সম্পদ কমিয়ে দিবেন’ (মুসনাদে আহমাদ হা/৯৬২২; মিশকাত হা/৫১০২; ছহীহাহ হা/২২৩১)।

অন্যত্র ওক্ববা ইবনে ‘আমের (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করে তাঁর হাত ধরে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে কতিপয় উৎকৃষ্ট আমলের কথা বলুন! তখন তিনি বললেন,يَا عُقْبَةُ، صِلْ مَنْ قَطَعَكَ، وَأَعْطِ مَنْ حَرَمَكَ، وَأَعْرِضْ عَمَّنْ ظَلَمَكَ وفي رواية: واعْفُ عَمَّنْ ظلَمكَ، ‘হে ওক্ববা! যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখ। যে তোমাকে বঞ্চিত করে তাকে দান করো। যে তোমার প্রতি যুলুম করে তাকে এড়িয়ে চল। অপর বর্ণনায় আছে, যুলুমকারীকে ক্ষমা করে দাও’ (মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৪৮৮; ছহীহাহ হা/৯৮১)।

ক্ষমাশীলতা আল্লাহর গুণাবলী :

ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- “কেউ কষ্ট দিলে ধৈর্য ধারণ করা, সহ্য করে যাওয়া এবং যুলুম করলেও ক্ষমা করে দেওয়া দুনিয়া-আখিরাতবাসীর গুণাবলীর মাঝে সর্বোত্তম গুণ। এগুলোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি এত মর্যাদা অর্জন করতে পারে, যা ছিয়াম-ক্বিয়ামের মাধ্যমেও সে অর্জন করতে সক্ষম হয় না।” (আস্-স্বরিমুল মাসলূল, পৃ: ২৩৪)।

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন বান্দা অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি অপরাধ করেছি, তুমি তা ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, (হে আমার ফিরিশতাগণ!) আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? (তোমরা সাক্ষী থাক) আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর আল্লাহ যতদিন চাইলেন ততদিন সে অপরাধ না করে থাকল। আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আবার অপরাধ করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর সে অপরাধ না করে থাকল যতদিন আল্লাহ চাইলেন। সে আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আবার আরেক অপরাধ করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। সে যা ইচ্ছা করুক’ (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/২৩৩৩)।

ক্ষমাশীলতা প্রদর্শন করা আল্লাহর আদেশ :

অত্যাচারের প্রতিশোধ না নিয়ে তাদের সাথে কল্যাণকর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করুন এবং একান্ত কোমলতার সাথে তাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের বিষয় বাতলে দেয়া এবং মূৰ্খ লোকদের সাথে ভদ্রোচিত আচরণে প্রভাবিত করে তাদের প্রতি মূর্খজনোচিত রূঢ় ব্যবহারে প্রবৃত্ত না হয়ে ক্ষমা প্রদর্শন করা আল্লাহর আদেশ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তুমি ক্ষমা প্রদর্শন কর এবং ভালো কাজের আদেশ দাও। আর মূর্খদের থেকে বিমুখ থাক’ (আরাফ ৭/১৯৯)।

তাফসীরশাস্ত্রের ইমাম ইবনে-কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, দূরে সরে থাকার অর্থও মন্দের প্রত্যুত্তরে মন্দ ব্যবহার না করা। এর অর্থ এই নয় যে, তাদের হেদায়াত করাও বর্জন করতে হবে। কারণ, এটা রিসালাত ও নবুওয়তের দায়িত্ব এবং মর্যাদার যোগ্য নয়।

এক্ষেত্রে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত একটি ঘটনা রয়েছে যে, উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফত আমলে উয়াইনাহ ইবনে হিসন একবার মদীনায় আসে এবং স্বীয় ভ্রাতুস্পপুত্র হুর ইবন কায়সের মেহমান হয়। হুর ইবনে কায়স ছিলেন সে সমস্ত বিজ্ঞ আলেমদের একজন যারা ফারুকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরামর্শ সভায় অংশগ্রহণ করতেন। উয়াইনাহ স্বীয় ভ্রাতুস্পপুত্র হুরকে বললঃ তুমি তো আমীরুল মু’মীনের একজন অতি ঘনিষ্ঠ লোক; আমার জন্য তার সাথে সাক্ষাতের একটা সময় নিয়ে এসো।

হুর ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট নিবেদন করলেন যে, আমার চাচা উয়াইনাহ আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চান। তখন তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। কিন্তু উয়াইনাহ উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর দরবারে উপস্থিত হয়েই একান্ত অমার্জিত ও ভ্রান্ত কথাবার্তা বলতে লাগল যেঃ আপনি আমাদেরকে না দেন আমাদের ন্যায্য অধিকার, না করেন আমাদের সাথে ন্যায় ও ইনসাফের আচরণ। উমার ফারক রাদিয়াল্লাহু আনহু তার এসব কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে হুর ইবন কায়স নিবেদন করলেনঃ হে আমীরুল মুমিনীন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, “আপনি ক্ষমা করুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলুন” আর এ লোকটিও জাহেলদের একজন। এই আয়াতটি শোনার সাথে সাথে উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সমস্ত রাগ শেষ হয়ে গেল এবং তাকে কোন কিছুই বললেন না। উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিল যে, আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত হুকুমের সামনে তিনি ছিলেন উৎসর্গিত প্ৰাণ। [বুখারী হা/৪৬৪২]

জাহিলদের মুকাবালা না করে তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়া ভালো। আর মন্দ কাজকে ভালো কাজ দ্বারা পরিবর্তন করতে হয়। আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করা হচ্ছে তাদেরকে দান করা। কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি যে তার শাস্তি সম্পর্কে অবহিত নয় তাকে ক্ষমা করে দেয়া। আনাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে পথ চলছিলাম। তাঁর দেহে ছিল মোটা পাড়ের একখানা নাজরানী চাদর, বেদুঈন চাদর ধরে জোরে টান দিল। টানের চোটে নবী (সা.) উক্ত বেদুইনের বক্ষের কাছে এসে পড়লেন। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাঁধের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম, সে জোরে টানার কারণে তার কাঁধে চাদরের ডোরার ছাপ পড়ে গেছে। অতঃপর বেদুঈনটি বলল, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ তা’আলার যে সকল ধন-সম্পদ তোমার কাছে আছে, তা হতে আমাকে কিছু দেয়ার নির্দেশ দাও। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) তার দিকে ফিরে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। এরপর তাকে কিছু দেয়ার নির্দেশ দান করলেন। (বুখারী হা/৩১৪৯, মুসলিম হা/১০৫৭)।

অসামান্য ক্ষমাশীলতার তিনটি ঘটনা :

(এক)  খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয যখন মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন, জানা গেছে তাঁর খাদেম খাদ্যে বিষ মিশিয়ে পরিবেশন করায় তিনি আক্রান্ত হয়েছেন, তিনি উক্ত খাদেমকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন এই হতভাগা ! আমার খাবারে বিষ মিশিয়েছ কেন ?

খাদেম প্রকম্পিত হয়ে ভয়ে ভয়ে তাঁকে বলল: প্রিয় মুনীব,বানু উমাইয়্যার যুবরাজরা আমাকে এক হাজার দীনার দিয়েছেন এবং আমাকে স্বাধীন করে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন এ শর্তে যে এই জঘন্য অপরাধটি আমি….

মহান খলীফা তাকে বললেন,তুমি ঐ এক হাজার দীনার বায়তুল মালে জমা দাও, তুমি এখন থেকে মুক্ত,আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম।

মৃত্যু সন্নিকটে জেনেও খলীফা মুসলমানদের বায়তুল মালের উন্নয়নে চিন্তিত এবং প্রতিশোধ নেয়ার শক্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘাতককে ক্ষমা করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

(দুই)  ইবনুল জাওযী বর্ণনা করেন, একদিন আমরা মন্ত্রী ইবনু হুবায়রার পাশে বসে ছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে হাতকড়া লাগিয়ে তার নিকট নিয়ে এসে বলল, সে  আমার ভাইকে হত্যা করেছে। মন্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তার ভাইকে হত্যা করেছ? সে স্বীকার করল। নিহতের ভাই বলল, সে যেহেতু স্বীকার করেছে, তাকে আমাদের হাতে সোপর্দ করুন, আমরা তাকে হত্যা করব। তিনি আসামীর দিকে তাকিয়ে চিনে ফেললেন যে, এ ব্যক্তি তাঁর গ্রাম আদ-দূরের অধিবাসী। সে মন্ত্রীর সাথে কোন এক সময় খারাপ আচরণ করেছিল। তিনি বললেন, তাকে হত্যা কর না; বরং তাকে ছেড়ে দাও। এ কথা শুনে বাদী বলল, এটা কি করে হয়, সেতো আমার ভাইয়ের হত্যাকারী? মন্ত্রী বললেন, তোমরা তাকে বিক্রি করে দাও। অতঃপর তিনি নিজে ছয়শ’ দীনার দিয়ে তাকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দিলেন এবং বললেন, তুমি এখানে যতদিন ইচ্ছা অবস্থান কর। শুধু তাই নয় মন্ত্রী ইবনু হুবায়রা তাকে ৫০ দীনারও প্রদান করলেন।

আমরা বললাম, আপনি তো তার সাথে অত্যন্ত সদাচরণ করলেন। মহানুভবতার পরিচয় দিলেন এবং তার প্রতি সর্বোচ্চ ইহসান করলেন। তখন তিনি বললেন, তোমরা কি জান যে, আমি ডান চোখে কিছু দেখতে পাই না? আমরা বললাম, আমাদের তো তা জানা নেই! তিনি বললেন, মূলতঃ আমার ডান চোখ অন্ধ। আর এর জন্য এ ব্যক্তিই দায়ী, যার পক্ষ থেকে আমি মুক্তিপণ আদায় করলাম এবং ইহসান করলাম।

একদিন আমি আদ-দূরের এক রাস্তায় বসেছিলাম, আমার হাতে ফিক্হের একটি কিতাব ছিল, যা পাঠে আমি মশগূল ছিলাম। এ ব্যক্তি একটি ফলের টুকরী নিয়ে এসে বলল, এটা বহন করে আমার সাথে চল। আমি বললাম, আমি ব্যস্ত, অন্য কাউকে ঠিক কর। তখন সে সজোরে আমাকে চড়-ঘুষি মারা শুরু করল। এমনকি সে আমার চোখ উপড়ে ফেলল। অতঃপর সে চলে গেল। এরপর আমি তাকে কোথাও দেখিনি। আমার সাথে তার কৃত আচরণের কথা স্মরণ করে ভাবলাম, আমি সাধ্যমত ভালো কাজের মাধ্যমে তার খারাপ আচরণের প্রতিদান দিব। আমি তাকে এই দুরবস্থায় দেখে প্রতিশোধ না নিয়ে অনুগ্রহ করলাম।

(তিনএকদিন এক তুর্কী সিপাহী ইবনু হুবায়রার কক্ষে প্রবেশ করল। তখন তিনি তাঁর নিরাপত্তারক্ষীদেরকে বললেন, তাকে বিশ দীনার দিয়ে বাহির থেকেই বিদায় করে দাও। সে যেন দ্বিতীয়বার আমার দফতরে প্রবেশ করতে না পারে। অতঃপর তিনি পাশে বসে থাকা লোকদেরকে বললেন, একদা আমার গ্রাম আদ-দূরে এক ব্যক্তি নিহত হ’ল। তখন তুর্কী সিপাহীরা এসে আমাকে সহ গ্রামবাসীকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। এ সিপাহী ঐ ব্যক্তি, আমরা যার নিয়ন্ত্রণে ছিলাম। সে আমাদের হাত পিছনে বেঁধে নিজে ঘোড়ায় আরোহণ করে আমাদেরকে তার আগে চলার নির্দেশ দিল। পথিমধ্যে আমার সাথীরা তাকে টাকা দিতে লাগল। যে টাকা দেয়, সিপাহী তাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমার নিকটে নিজেকে মুক্ত করানোর মত কিছুই ছিল না। সে তখন আমাকে নির্দয়ভাবে প্রহার করতে থাকে। আছরের ছালাতের সময় হয়ে গেল। আমি ছালাতের জন্য অনুমতি চাইলাম। সে অনুমতি না দিয়ে উল্টো আমাকে গালি দিল। আজ তার অবস্থা কিভাবে পরিবর্তন হয়েছে? আল্লাহ আমাকে তার উপরে বিজয়ী করেছেন। আমি চাইলে আজ তার কাছ থেকে বদলা নিতে পারতাম। কিন্তু আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম।(ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ১২/২৫০; ইবনু রজব, কিতাবুল যাইল আলা ত্বাবাকাতিল হানাবেলা ২/১২৭; যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৫/১৭৪)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top