ষড়রিপু সমাচার (৬ষ্ঠ কিস্তি)

ছয়. মাৎসর্য রিপু :

মাৎসর্য হলো ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, বিদ্বেষ, অপকার, হনন ইত্যাদি। মাৎসর্যের কোন প্রকার হিতাহিত বোধ নেই। মাৎসর্য উলঙ্গ, অন্ধ ও বিকৃত অবস্থাকে পূজা করে থাকে। মাৎসর্যান্ধ মানুষ নিজে কোন কাজেই কোনকালে সুখ পায় না। নিজের কোন কিছুর প্রতি যত্নবান হওয়া বা খেয়াল করার সুযোগও তার নেই। তার চোখে বুকে অপরের ভাল কাজের প্রতি প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে। অথচ তার নিজের পক্ষে তা সম্পন্ন করার ক্ষমতাও তার নেই। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়েও সে মাৎসর্যে লিপ্ত হয়। এমনি এ রিপু তাকে ধীরে ধীরে হীন থেকে হীনতর পর্যায়ে নিয়ে যায়। এক সময় সমাজের চোখে সে চিহ্নিত হয়ে যায়। তখন তার কথা ও কাজের কোনই মূল্য থাকে না।

মাৎসর্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পরশ্রীকাতরতা। পরশ্রীকাতরতা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে চরম অশান্তি ডেকে আনে। পরশ্রীকাতরতার তিনটি দিকে রয়েছে। এক, অন্যের ভাল কিছু দেখলে তার গা জ্বলে যাওয়া; দুই, অপর কেউ ভাল কিছু করলে তার বিরোধিতা করা কিংবা ভাল কাজটির নেতিবাচক দিকগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অন্যের সামনে হাযির করা; তিন, বেঁকে বসা (উর্ধ্বতন ও অধস্তনদের বেলায়) অর্থাৎ অমান্য বা অবজ্ঞা করা।

হিংসা মানব মনের কঠিনতম রোগসমূহের অন্যতম। হিংসার জন্যে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়। হিংসুক ব্যক্তি অন্তরাগুনে জ্বলে সর্বদা এবং হিংসাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্যতায় রূপ দান করে। এদের অন্তরে মহাব্যাধি বাসা বেঁধে থাকে এবং মনে করে তাদের এই গোপনীয় বিদ্বেষ কখনও প্রকাশ পাবে না। কিন্তু দেরীতে হলেও হিংসুক ব্যক্তির আসল রূপ উদিত সূর্যের ন্যায় বিকশিত হয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَنْ لَنْ يُخْرِجَ اللهُ أَضْغَانَهُمْ- وَلَوْ نَشَاءُ لَأَرَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُمْ بِسِيْمَاهُمْ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ وَاللهُ يَعْلَمُ أَعْمَالَكُم ‘যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ তাদের হৃদয়ের গোপন বিদ্বেষ কখনোই প্রকাশ করে দেবেন না’? ‘আমরা চাইলে তোমাকে তাদের দেখাতাম। তখন তুমি তাদের চেহারা দেখে চিনতে পারতে এবং তাদের কথার ভঙ্গিতে তুমি তাদের অবশ্যই বুঝে নিতে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তোমাদের কর্মসমূহ সম্যক অবগত’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৯)

 

১. হিংসার সূচনা

গর্ব-অহংকার যেমনি মানব জীবনকে মারাত্মক ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে তেমনি হিংসাও মানুষকে অধঃপতনের গ্লানিতে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে। সৃষ্টির সূচনায় প্রথম পাপ ছিল আদম (আঃ)-এর প্রতি ইবলীসের হিংসার পাপ। যার ফলে ইবলিশ শয়তান হিংসা ও অহংকারের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে মহান রাববুল আলামিনের সামনে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ ‘আর যখন আমি হযরত আদম (আঃ)-কে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখন ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফিরদের অর্ন্তভুক্ত হয়ে গেল’(বাক্বারাহ ২/৩৪)। ইবলীস ঐ সময় নিজের পক্ষে যুক্তি পেশ করে বলল, ‘আমি ওর চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন আর ওকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে’। আল্লাহ বললেন, তুই বের হয়ে যা। তুই অভিশপ্ত, তোর উপরে আমার অভিশাপ রইল পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬-৭৮; আ‘রাফ ৭/১২)

ক. আদম (আঃ)-এর প্রতি ইবলীসের হিংসা : সর্বপ্রথম আদমের উচ্চ সম্মান দেখে ইবলীস হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। তাকে আদমের প্রতি সম্মানের সিজদা করতে বলা হলে সে করেনি। ফলে সে জান্নাত থেকে চিরকালের জন্য বিতাড়িত হয়। আদম (আঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা দেখে ইবলীস হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। সে নিজেকে আদমের চাইতে শ্রেষ্ঠ দাবী করে তাঁকে সম্মানের সিজদা করেনি। সে যুক্তি দিয়ে বলেছিল, خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ ‘আল্লাহ তুমি আমাকে আগুন দিয়ে তৈরী করেছ এবং আদমকে তৈরী করেছ মাটি দিয়ে’ (আ‘রাফ ৭/১১-১২)। অতএব আগুন কখনো মাটিকে সিজদা করতে পারে না। তার এই যুক্তির ফলে সে অভিশপ্ত হয় এবং জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়। এভাবে আসমানে প্রথম হিংসা করে ইবলীস এবং সেই-ই প্রথম আদম ও হাওয়াকে বিভ্রান্ত করে। ফলে তারাও জান্নাত থেকে আল্লাহর হুকুমে নেমে যান। আদমের ও তার সন্তানদের প্রতি ইবলীসের উক্ত হিংসা আজও অব্যাহত রয়েছে। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে (আরাফ ৭/১৩-১৫; হিজর ১৫/৩৩-৩৮)।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, الحاسد شبيه بإبليس، وهو في الحقيقة من أتباعه؛ لأنه يطلب ما يحبه الشيطان من فساد الناس وزوال نعم الله عنهم، كما أن إبليس حسد آدم لشرفه وفضله، وأبى أن يسجد له حسدا، فالحاسد من جند إبليس ‘হিংসুক ব্যক্তি ইবলীসের ন্যায়। সে শয়তানের অনুসারী। কেননা সে শয়তানের চাহিদা মতে সমাজে বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় এবং অন্যের উপর আল্লাহর নে‘মতসমূহের ধ্বংস কামনা করে। যেমন ইবলীস আদমের উচ্চ মর্যাদা ও তার শ্রেষ্ঠত্বকে হিংসা করেছিল এবং তাকে সিজদা করতে অস্বীকার করেছিল। অতএব হিংসুক ব্যক্তি ইবলীসের সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত।[1]

খ. হাবীলের প্রতি কাবীলের হিংসা : পৃথিবীতে হিংসা থেকে সর্বপ্রথম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর পুত্রদ্বয়ের মধ্যে। কাবীল হিংসা বশে স্বীয় ভাই হাবীলকে হত্যা করে। কারণ পশুপালক হাবীল ছিল মুত্তাকী পরহেযগার ও শুদ্ধ হৃদয়ের মানুষ। সে আল্লাহকে ভালবাসে তার সর্বোত্তম দুম্বাটি আল্লাহু্র ওয়াস্তে কুরবানীর জন্য পেশ করে। অথচ তার কৃষিজীবী ভাই ক্বাবীল তার ক্ষেতের ফসলের নিকৃষ্ট একটা অংশ কুরবানীর জন্য পেশ করে। ফলে আল্লাহ তারটা কবুল না করে হাবীলের উৎকৃষ্ট কুরবানী কবুল করেন এবং আসমান থেকে আগুন এসে তা উঠিয়ে নিয়ে যায়। এতে ক্বাবীল হিংসায় জ্বলে ওঠে ও হাবীলকে হত্যা করে। অথচ এতে হাবীলের কিছুই করার ছিলনা। এতদসত্ত্বেও কাবীল তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ -لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ ‘(হে নবী!) তুমি লোকদের নিকট আদমের দুই পুত্রের ঘটনা সত্য সহকারে বর্ণনা কর। যখন তারা কুরবানী পেশ করে। অতঃপর একজনের কুরবানী কবুল হয়, কিন্তু অপর জনের কুরবানী কবুল হয়নি। তখন সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। জবাবে সে বলল, আল্লাহ তো কেবল মুত্তাক্বীদের কুরবানী কবুল করে থাকেন’। ‘যদি তুমি আমার দিকে হাত বাড়াও আমাকে হত্যা করার জন্য, আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য তোমার দিকে হাত বাড়াবো না। আমি বিশ্বচরাচরের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৭-২৮)।

বলা বাহুল্য, এই মানবেতিহাসের প্রথম হত্যাকান্ডের ঘটনার ফলে ক্বাবীল হত্যাকান্ডের সূচনাকারী হিসেবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত হত্যাকান্ড হবে তার একাংশ তার আমলনামায় লেখা হবে মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত হত্যাকান্ড হবে, তার পাপের একটা অংশ ক্বাবীলের আমলনামায় লেখা হবে। কেননা সেই-ই প্রথম এর সূচনা করেছিল এভাবে আসমানে প্রথম হিংসা করেছিল ইবলীস এবং যমীনে প্রথম হিংসা করেছিল ক্বাবীল। সুতরাং সুন্দরের প্রতি আকর্ষন ও ভালোর প্রতি হিংসা চিরন্তন।[2]

গ. ইউসুফ (আঃ)-এর প্রতি তাঁর ভাইদের হিংসা : নবী ইউসুফ (আঃ)-এর ১০ জন বিমাতা ভাই ছিল। যারা ছিল তার আপন খালার সন্তান। ইউসুফ (আঃ) ও বেনিয়ামীনের মা মারা যাওয়ায় মাতৃহারা দুই শিশুপুত্রের প্রতি পিতা নবী ইয়াকূব (আঃ)-এর পিতৃস্নেহ স্বভাবতই বেশী ছিল। তন্মধ্যে ইউসুফ (আঃ)-এর প্রতিই তাঁর আসক্তি ছিল বেশী তাঁর অলৌকিক গুণাবলীর কারণে। তদুপরি শিশুকালে ইউসুফ (আঃ)-এর দেখা স্বপ্নবৃত্তান্ত শোনার পর পিতা তাঁর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং অজানা আশংকায় তাঁকে সর্বক্ষণ চোখের উপর রাখতেন। ফলে বিমাতা ভাইয়েরা তাঁর প্রতি হিংসায় জ্বলে ওঠে এবং শিশু ইউসুফ (আঃ)-কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। উক্ত বিষয়ে সূরা ইউসুফ নাযিল হয়। যাতে পুরা ঘটনা সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে।

হিংসুকরা ভালোর প্রতি কিভাবে হিংসা করে এবং ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না করুণ পরিণতি ঘটে। যেমন সূরা ইউসুফে মহান আল্লাহ ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করে বলেন, ‘আমি তোমার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছি, যেমতে আমি এ কুরআন তোমার নিকট অবতীর্ণ করেছি। তুমি এর আগে অবশ্যই এ ব্যাপারে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।

যখন ইউসুফ পিতাকে বলল, পিতর! আমি সবপ্নে দেখেছি এগারটি নক্ষত্রকে। সূর্যকে এবং চন্দ্রকে। আমি তাদেরকে আমার উদ্দেশে সেজদা করতে দেখেছি। তিনি বললেন, বৎস! তোমার ভাইদের সামনে এ সবপ্ন বর্ণনা করো না। তাহলে তারা তোমার বিরম্নদ্ধে চক্রাত্ম করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য। এমনিভাবে তোমার পালনকর্তা তোমাকে মনোনীত করবেন এবং তোমাকে বাণীসমূহের নিগূঢ় তত্ত্ব শিক্ষা দেবেন এবং পূর্ণ করবেন সবীয় অনুগ্রহ তোমার প্রতি ও ইয়াকুব পরিবার-পরিজনের প্রতি; যেমন ইতিপূর্বে তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের প্রতি পূর্ণ করেছেন। নিশ্চয় তোমার পালনকর্তা অত্যন্ত জ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। অবশ্য ইউসুফ ও তাঁর ভাইদের কাহিনীতে জিজ্ঞাসুদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।

যখন তারা বলল, অবশ্যই ইউসুফ ও তাঁর ভাই আমাদের পিতার কাছে আমাদের চাইতে অধিক প্রিয় অথচ আমরা একটা সংহত শক্তি বিশেষ। নিশ্চয় আমাদের পিতা স্পষ্ট ভ্রান্তিতে রয়েছেন। হত্যা কর ইউসুফকে কিংবা ফেলে আস তাকে অন্য কোন স্থানে। এতে শুধু তোমাদের প্রতিই তোমাদের পিতার মনোযোগ নিবিষ্ট হবে এবং এরপর তোমরা যোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকবে। তাদের মধ্য থেকে একজন বলল, তোমরা ইউসুফ কে হত্যা করো না, বরং ফেলে দাও তাকে অন্ধকূপে যাতে কোন পথিক তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়, যদি তোমাদের কিছু করতেই হয়।

তারা বলল, পিতা! ব্যাপার কি, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদেরকে বিশ্বাস করেন না? আমরা তো তার হিতাকাংখী। আগামীকাল তাকে আমাদের সাথে প্রেরণ করুন-তৃপ্তিসহ খাবে এবং খেলাধুলা করবে এবং আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করব।

তিনি বললেন, আমার দুশ্চিন্তা হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশঙ্কা করি যে, ব্যাঘ্র তাঁকে খেয়ে ফেলবে এবং তোমরা তার দিক থেকে গাফেল থাকবে। তারা বলল, আমরা একটি ভারী দল থাকা সত্ত্বেও যদি ব্যাঘ্র তাকে খেয়ে ফেলে, তবে আমরা সবই হারালাম। অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে চলল এবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে একমত হল এবং আমি তাকে ইঙ্গিত করলাম যে, তুমি তাদেরকে তাদের এ কাজের কথা বলবে এমতাবস্থায় যে, তারা তোমাকে চিনবে না। তারা রাতের বেলায় কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এল।

তারা বলল, পিতা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম এবং ইউসুফকে আসবাব-পত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। অতঃপর তাকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী। এবং তারা তার জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে আনল। তিনি বললেন, এটা কখনই নয়; বরং তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা কথা সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এখন ছবর করাই শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করছ, সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ্ই আমার সাহায্যস্থল’ ( ইউসুফ ১২/৩-১৮)

২. যুগে যুগে হিংসা : যুগে যুগে বহু সত্যসেবী আলেম, দ্বীনের দাঈ ও নেতা নির্যাতিত হয়েছেন একমাত্র নিন্দুকের নিন্দা ও কুচক্রীদের হিংসার কারণে। এদের চিনতে হলে কিছু নিদর্শন জেনে রাখা ভাল। এরা সাক্ষাতে সুন্দর কথা বলে এবং আড়ালে নিন্দা করে। কোন কল্যাণ দেখলে চুপ থাকে এবং অকল্যাণ দেখে খুশী হয়। শেষ নবী (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধীরাও হিংসা করেছিল। যদিও নবী-রাসূলগণ নিন্দনীয় বিষয় থেকে পবিত্র ছিলেন।

ক. রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ইহূদী ও নাছারাদের হিংসা : ইহূদী-নাছারা ইসলামের নবীর প্রতি সবচেয়ে বেশী হিংসাকারী। তাদের বংশ বনু ইসহাক থেকে শেষনবী না হয়ে বনু ইসমাঈলের কুরায়েশ বংশ থেকে হওয়ায় তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি হিংসায় অন্ধ ছিল। অথচ তাদের কিতাব তাওরাত-ইনজীলে শেষনবী হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ও তাঁর পূর্ণ পরিচয় আগেই বর্ণিত হয়েছে (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। কিন্তু তারা তাঁর উচ্চ মর্যাদাকে বরদাশত করতে পারেনি। ফলে তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুসারী মুমিনদের চাইতে মক্কার কাফিরদের অধিকতর হেদায়াতপ্রাপ্ত বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। যেমন আল্লাহ বলেন,أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ أُوْتُوْا نَصِيْبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُوْنَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوْتِ وَيَقُوْلُوْنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا هَؤُلاَءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا سَبِيلاً- أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ لَعَنَهُمُ اللهُ وَمَنْ يَلْعَنِ اللهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ نَصِيْرًا- ‘তুমি কি তাদেরকে দেখনি যাদেরকে ইলাহী কিতাবের কিছু অংশ দেওয়া হয়েছে, যারা প্রতিমা ও শয়তানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং কাফিরদের বলে যে, তারাই মুমিনদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’। ‘এদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে অভিসম্পাৎ করেন, তার জন্য তুমি কোন সাহায্যকারী পাবে না’ (নিসা ৪/৫১-৫২)

মুমিনদের প্রতি হিংসা ছাড়াও তারা তাদেরকে ইসলাম ত্যাগ করে ইহূদী-নাছারাদের দলভুক্ত হওয়ার আকাংখা পোষণ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَدَّ كَثِيرٌ مِّنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يَرُدُّونَكُم مِّن بَعْدِ إِيمَانِكُمْ كُفَّاراً حَسَداً مِّنْ عِندِ أَنفُسِهِم مِّن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ فَاعْفُواْ وَاصْفَحُواْ حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরেও অন্তর্নিহিত বিদ্বেষ বশতঃ আহলে কিতাবদের অনেকে তোমাদেরকে ঈমান আনার পরেও কাফির বানাতে চায়। এমতাবস্থায় তোমরা ওদের ক্ষমা কর এবং এড়িয়ে চল আল্লাহর আদেশ না আসা পর্যন্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর উপরে ক্ষমতাবান’ (বাক্বারাহ ২/১০৯)।

ইবনু কাছীর বলেন, অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ আহলে কিতাবদের রীতি-নীতি অনুসরণ করার ব্যাপারে মুমিনদের সাবধান করেছেন। গোপনে ও প্রকাশ্যে তারা যে সর্বদা মুসলমানদের শত্রুতা করবে, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন। মুসলমানদের ও তাদের নবীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা জানা সত্ত্বেও তারা এটা করে থাকে স্রেফ হিংসার বশবর্তী হয়ে’ (ঐ, তাফসীর)। আল্লাহ বলেন,وَلَن تَرْضَى عَنكَ الْيَهُودُ وَلاَ النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ قُلْ إِنَّ هُدَى اللهِ هُوَ الْهُدَى وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءهُم بَعْدَ الَّذِي جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللهِ مِن وَلِيٍّ وَلاَ نَصِيْرٍ ‘ইহূদী ও নাছারাগণ কখনোই তোমার উপরে খুশী হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মের অনুসারী হবে। তুমি বল, নিশ্চয়ই আল্লাহর দেখানো পথই সঠিক পথ। আর যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তোমার নিকটে (অহি-র) জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তবে আল্লাহর কবল থেকে তোমাকে বাঁচাবার মতো কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/১২০)। এখানে শেষনবী (ছাঃ)-কে বলা হ’লেও তা মূলতঃ উম্মতে মুহাম্মাদীকে বলা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর প্রতি ইহূদী-খ্রিষ্টান অপশক্তির অতীত ও বর্তমান আচরণ অত্র আয়াতের বাস্তব প্রমাণ বহন করে।

খ. কুরায়েশ কাফিরদের হিংসা : আল্লাহ স্বীয় নবী মুহাম্মাদকে নবুঅত ও রিসালাত দ্বারা সম্মানিত করেছেন। কিন্তু তাঁর নিজ বংশ কুরায়েশ নেতারা হিংসায় জ্বলে ওঠে তাঁর এই উচ্চ মর্যাদার কারণে। তাদের ধারণা মতে নবুঅতের সম্মান তাদের মত নেতাদের পাওয়া উচিৎ ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, وَقَالُوا لَوْلاَ نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ- أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ؟ ‘আর তারা বলে যে, এই কুরআন কেন নাযিল হলো না দুই জনপদের কোন বড় নেতার উপরে? ‘তবে কি তোমার প্রতিপালকের রহমত তারাই বণ্টন করবে?’ (যুখরুফ ৪৩/৩১-৩২)। উল্লেখ্য, এখানে মক্কার নেতা আবু জাহল অথবা ত্বায়েফের নেতা ওরাওয়া ইবনু মাসঊদের উপর বুঝানো হয়েছে?

কুরায়েশ নেতারা কিরূপ শ্রেষ্ঠত্বের কাঙ্গাল ছিল যে, নিজেদের বংশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীকে পেয়েও তারা সর্বদা তাঁকে হত্যার চক্রান্ত করেছে। তারা তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপবাদ দিয়েছে ও যুদ্ধ করেছে কেবল উক্ত মর্যাদা নিজেরা না পাওয়ার হিংসা থেকেই।

গ. মুনাফিকদের হিংসা :  মুনাফিকরা ইসলাম যাহির করে ও কুফরীকে অন্তরে লালন করে। তাদের হৃদয় সর্বদা খাঁটি মুমিনদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ ও কপটতায় পূর্ণ থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيْطٌ ‘তোমাদের কোন কল্যাণ স্পর্শ করলে তারা নাখোশ হয়। আর তোমাদের কোন অমঙ্গল হলে তারা খুশী হয়। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর ও আল্লাহভীরু হও, তাহলে ওদের চক্রান্ত তোমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে, সবই আল্লাহর আয়ত্ত্বাধীনে রয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১২০)।

মক্কায় মূলতঃ কাফির ও মুসলমানদের সংঘর্ষ ছিল। কিন্তু মদীনায় গিয়ে যোগ হয় ইহূদী ও মুনাফিকদের কপটতা। যা ছিল কাফিরদের ষড়যন্ত্রের চাইতে মারাত্মক। ৩য় হিজরীতে ওহোদের যুদ্ধে গমনকারী এক হাযার মুসলিম বাহিনীর মধ্য থেকে সাড়ে তিনশ’ মুনাফিকের পশ্চাদগমন ছিল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে আল্লাহভীরু নেতাদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে অমূল্য উপদেশ ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। অথচ সর্বদা মুনাফিকরা ভাবে যে, তারাই লাভবান। যদিও প্রকৃত অর্থে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ভাবে তাদের চতুরতা কেউ ধরতে পারবে না। অথচ তারাই সবচেয়ে বোকা। কেননা দেরীতে হলেও তাদের কপটতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَنْ لَنْ يُخْرِجَ اللهُ أَضْغَانَهُمْ- وَلَوْ نَشَاءُ لَأَرَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُمْ بِسِيْمَاهُمْ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ وَاللهُ يَعْلَمُ أَعْمَالَكُمْ- وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِيْنَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِيْنَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ ‘যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ তাদের হৃদয়ের গোপন বিদ্বেষ কখনোই প্রকাশ করে দেবেন না’? ‘আমরা চাইলে তোমাকে তাদের দেখাতাম। তখন তুমি তাদের চেহারা দেখে চিনতে পারতে এবং তাদের কথার ভঙ্গিতে তুমি তাদের অবশ্যই বুঝে নিতে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তোমাদের কর্মসমূহ সম্যক অবগত’। ‘আর আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা নেব। যতক্ষণ না আমরা (প্রমাণসহ) জানতে পারব তোমাদের মধ্যে কারা সত্যিকারের মুজাহিদ এবং কারা সত্যিকারের ধৈর্যশীল। বস্ত্ততঃ আমরা তোমাদের অবস্থা সমূহ যাচাই করে থাকি’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৯-৩১)। বস্ত্ততঃ মুনাফিকদের কপটতা মুমিনদের সরলতা ও স্বচ্ছতার প্রতি হিংসা থেকে উদ্ভূত হয়। আর মুমিনদের প্রতি মুনাফিকদের এই হিংসা চিরন্তন।[3]

৩. হিংসা থেকে বেঁচে থাকার উপায় : আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হিংসা বর্জন করা উচিৎ। যখন মানুষ জানবে যে, হিংসায় জাহান্নাম ও তা পরিত্যাগে জান্নাত, তখন সে চিরস্থায়ী জান্নাত পাওয়ার আশায় ক্ষণস্থায়ী তুচ্ছ বস্ত্ত পরিত্যাগ করবে। আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى- فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى ‘আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হ’তে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৪০-৪১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ ‘যা তোমার উপকারে আসবে, সেদিকে তুমি প্রলুব্ধ হও’।[4] 

ক. আল্লাহর আদেশ-নিষেধ প্রতিপালন : যত কষ্টই হৌক বা যত কঠিনই হৌক, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে নিয়ে হিংসা থেকে নিবৃত্ত হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ‘আমার রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর। আর যা থেকে নিষেধ করেন, তা বর্জন কর’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি আরো বলেন, وَمَن يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর সেটাই হ’ল মহা সফলতা’ (নিসা ৪/১৩)। কেননা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে তার রহমত লাভ করা পার্থিব সকল কিছুর চাইতে উত্তম। আল্লাহ বলেন, هُنَالِكَ الْوَلاَيَةُ لِلَّهِ الْحَقِّ هُوَ خَيْرٌ ثَوَاباً وَخَيْرٌ عُقْباً ‘সবকিছুর অভিভাবকত্ব আল্লাহর যিনি সত্য। পুরস্কার দানে ও পরিণাম নির্ধারণে তিনিই শ্রেষ্ঠ’ (কাহফ ১৮/৪৪)।

খ. শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করা : হিংসা হ’ল শয়তানী আমল। শয়তান সর্বদা মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে থাকে। তাই তার হাত থেকে বাঁচার জন্য শয়তানের প্রতি তীব্র ঘৃণা থাকা এবং তার বিরুদ্ধে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা আবশ্যক। অতএব যখনই কারো প্রতি হিংসার উদ্রেক হয়, তখনই أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ ‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রজীম’ বলে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করবে এবং বাম দিকে তিনবার থুক মারবে ।[5]  আল্লাহ বলেন, وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘অতঃপর শয়তান যখনই তোমাকে কুমন্ত্রণা দেয়, তখনই তুমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৩৬)।

হিংসুক দ্বীনকে মুন্ডনকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। যুবায়ের ইবুনুল ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمُ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِىَ الْحَالِقَةُ لاَ أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعْرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ- وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَفَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِمَا يُثَبِّتُ ذَاكُمْ لَكُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ ‘তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণের রোগ তোমাদের মধ্যে গোপনে প্রবেশ করবে। আর তা হ’ল হিংসা ও বিদ্বেষ, যা সবকিছুর মুন্ডনকারী। আমি বলছি না, চুল মুন্ডনকারী। বরং তা হবে দ্বীনকে মুন্ডনকারী। যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না ঈমান আনবে। আর তোমরা ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদের খবর দিব না, কোন বস্ত্ত তোমাদের মধ্যে ভালবাসাকে দৃঢ় করবে? তোমরা পরস্পরে বেশী বেশী সালাম কর’।[6]  আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِيَّاكُمْ وَسُوءَ ذَاتِ الْبَيْنِ فَإِنَّهَا الْحَالِقَةُ- قَالَ أَبُو عِيسَى يَعْنِى الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ ‘তোমরা পারস্পরিক বিদ্বেষের মন্দ হ’তে বেঁচে থাক। কেননা এটি দ্বীনের মুন্ডনকারী’।[7]

গ. হিংসা সংবরণে বিনম্রতা : মন্দকে মুকাবিলা করতে হবে উত্তম দ্বারা। মহান আললাহ এমনটাই নির্দেশ দিয়েছেন, وَلاَ تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلاَ السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ ভাল ও মন্দ সমান হ’তে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা। ফলে তোমার সাথে যার শত্রম্নতা আছে, সে হয়ে যাবে অত্মরঙ্গ বন্ধুর মত’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يسِّرُوْا وَلاَ تُعَسِّرُوْا، وَسَكِّنُوْا وَلاَ تُنَفِّرُوْا ‘তোমরা নম্র হও, কঠোর হয়ো না। শান্তি দান কর, বিদ্বেষ সৃষ্টি করো না’।[8] ক্রোধকে সংবরণ করতে হবে বিনম্রতার মাধ্যমে। এসম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُوْنَ ‘মন্দের মুকাবিলা কর যা উত্তম তা দ্বারা; তারা যা বলে আমরা সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত’ (মুমিনূন ২৩/৯৬)

বিনয় ও নম্রতা মুমিনের গুণাবলীর অন্যতম মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْمُؤْمِنُ غِرٌّ كَرِيْمٌ وَالْفَاجِرُ خِبٌّ لَئِيْمٌ ‘মুমিন ব্যক্তি নম্র ও ভদ্র হয়। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়’।।[9] অন্যত্র বলেন, وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ ‘যে বান্দাহ আল্লাহর জন্য বিনীত হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন’।[10]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, إن الله إذا أحب أهل بيت أدخل عليهم الرفق ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোন গৃহবাসীকে ভালবাসেন, তখন তাদের মাঝে নম্রতা প্রবেশ করান’।[11] অন্যত্র  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ما أعطي أهل بيت الرفق إلا نفعهم ولا منعوه إلا ضرهم ‘আল্লাহ কোন গৃহবাসীকে নম্রতা দান করে তাদেরকে উপকৃতই করেন। আর কারো নিকট থেকে তা উঠিয়ে নিলে তারা ক্ষতিগ্রস্থই হয়’।[12]

শেষ কথা

জীবনে চলার পথে ষড়রিপু প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল। প্রতিটি মূহুর্তে আমাদেরকে ষড়রিপুর মুখোমুখি হতে হয়। মানব জীবনের সাফল্যের জন্য অটুট সংযম, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও কঠোর সাধনার প্রয়োজন। সংযম সাধনার মাধ্যমেই ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সমাজের প্রতিটি মানুষ ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করে চললে সমাজ জীবনে সুখ-শান্তিও অনাবিল আরাম বিরাজ করতে পারে। এই ষড়রিপুর মধ্যে অহংকার এমন একটি রিপু যা অণু পরিমাণ শরীরে বিরাজ করলে তার জন্যে জান্নাত হারাম। আর এই অহংকারী হতে সাহায্য করে হিংসা। হিংসা মানব জীবনের চরম গ্লানীময় রিপু। যার জন্যে মানুষ উৎকৃষ্ট থেকে নিৎকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়। হিংসা জীবনের পরতে পরতে পরজীবির মত লেগে থাকে অন্তরের কোণে। ইবলীস শয়তান সর্বপ্রথম হিংসা পরায়ণ হয় আদম (আঃ)-এর সম্মান লক্ষ্য করে। তারপরেই জবানে প্রষ্ফুটিত হয় অহংকার। সেই ইবলীস আজও মানুষের মনে প্রতিনিয়ত হিংসার কুমন্ত্রণা দিয়ে চলেছে। তাই বেশী বেশী শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় কামনা করা উচিৎ। মহান আল্লাহর নিকটে আমাদেরকে দেহের ষড়রিপু থেকে আশ্রয় কামনা করতে হবে। তিনি আমাদের সহায় হোন- আমীন!

[লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী]

[1]. ইবনল ক্বাইয়িম, বাদায়ে‘উল ফাওয়ায়েদ ২/২৩৪ পৃ.।

[2].  মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, হিংসা ও অহংকার (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ,  ১ম প্রকাশ, ২০১৪ খ্রি.),  পৃ. ২৮-২৯।

[3]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, হিংসা ও অহংকার, প্রাগুক্ত, ৩০-৩২।

[4] . মুসলিম হা/২৬৬৪; মিশকাত হা/৫২৯৮।

[5]. মুসলিম হা/২২০৩; মিশকাত হা/৭৭।

[6]. তিরমিযী হা/২৫১০, মিশকাত হা/৫০৩৯, হাদীছ হাসান।

[7] .তিরমিযী হা/২৫০৮; মিশকাত হা/৫০৪১।

[8]. বুখারী হা/৬১২৫।

[9]. তিরমিযী হা/১৯৬৪; মিশকাত হা/৫০৮৫।

[10]. মুসলিম হা/২৫৮৮।

[11]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৩, ১৭০৩; সিলসিলা ছহীহা ২/৫২৩।

[12]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৪২।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top