আক্বীদার জিরক্স কপি নয়, মূলকপি চায়-১

আহলেহাদীস বা সালাফীদের আক্বীদার জিরক্স কপি তৈরী করা উচিৎ নয়। নানা ভাবে সালাফী আক্বীদাকে বিকৃত করে প্রকৃত দ্বীন থেকে সরে যাচ্ছেন হাজারো মুসলিম। এটা মোটেও কাম্য নয় একজন প্রকৃত ঈমানের দাবীদার বান্দার পক্ষে। মানুষ দ্বীনের হুকুমাত প্রতিষ্ঠার অর্থ তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। অথচ যারা এর অর্থ রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম করা বলে মনে করেন। এরা আক্বীদা থেকে বিচ্যুত হয়ে তথাকতিথ পশ্চিমাদের গণতন্ত্র রাজনীতিতে বিশ্বাসী। একজন বক্তা, আলোচক, লেখক কিংবা শিক্ষক যে ব্যক্তিই হোক না কেন, উনাদের কথা, লেখা গ্রহণের পূর্বে জেনে নিন তাদের আক্বীদা কী (?)
আবূ জাহেলের নাম ছিল আবুল হাকাম বা জ্ঞানীর পিতা। কিন্তু এই ব্যক্তি যখন এক আল্লাহতে বিশ্বাস করেও বা কালেমার প্রথম অংশ মেনে নিলেও সে দ্বিতীয় অংশ মেনে নিতে পারলো না। অর্থাৎ- রাসূল (সা.)-কে নবী হিসেবে সাক্ষ্য দিলো না। অথচ সে জানত মুহাম্মাদের নিকট যা আসছে তা চিরন্তন সত্য। অনুরূপ ভাবে আমাদের দেশে বিভিন্ন আক্বীদার মানুষ রয়েছে, যাদের আক্বীদা ভেজালমুক্ত নয়। এদের থেকে সাবধান হওয়া উচিৎ এবং মুমিন হিসেবে প্রথমেই আমাদের আক্বীদা বিশ্বাসকে দৃঢ় ও মজবুত করা উচিৎ। আক্বীদা সম্পর্কে নিচে আলোকপাত করা হলো-

আক্বীদার সংজ্ঞা :

শাব্দিক অর্থ : আক্বীদা শব্দটি আরবী العقد শব্দমূল যার আভিধানিক অর্থ সম্পর্ক স্থাপন করা, দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা, শক্তিশালী হওয়া।

পারিভাষিক অর্থ : মানুষ যার সাথে নিজের অন্তরের সুদৃঢ় যোগাযোগ স্থাপন করে তাকেই আক্বীদা বলা হয়। সাধারণভাবে সেই সুদৃঢ় বিশ্বাস ও অকাট্য কর্মধারাকে আক্বীদা বলা হয় যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তির মনে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আক্বীদা শব্দটি ইসলামী পরিভাষায় আরো কয়েকটি শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়। যেমন- তাওহীদ, সুন্নাত, উছূলুদ্দীন, ফিকহুল আকবার, শরী‘আত, ঈমান ইত্যাদি।

আক্বীদা ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্য :

আক্বীদা শব্দটি প্রায়ই ঈমান ও তাওহীদের সাথে গুলিয়ে যায়। অস্বচ্ছ ধারণার ফলশ্রুতিতে অনেকেই বলে ফেলেন, আক্বীদা আবার কি? আক্বীদা বিশুদ্ধ করারই বা প্রয়োজন কেন? ঈমান থাকলেই যথেষ্ট। ফলশ্রুতিতে দ্বীন সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে এক বড় ধরনের অপূর্ণতা সৃষ্টি হয়, যা প্রায়ই মানুষকে পথভ্রষ্টতার দিকে ঠেলে দেয়। এজন্য ঈমান ও আক্বীদার মধ্যকার সম্পর্ক ও পার্থক্য স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। নিম্নে বিষয়টি উপস্থাপন করা হল:- 

প্রথমত : ঈমান সমগ্র দ্বীনকেই অন্তর্ভুক্ত করে। আর আক্বীদা দ্বীনের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে।

দ্বিতীয়ত : আক্বীদার তুলনায় ঈমান আরো ব্যাপক পরিভাষা। আক্বীদা হল কতিপয় ভিত্তিমূলক বিষয়ের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের নাম। অন্যদিকে ঈমান শুধু বিশ্বাসের নাম নয়; বরং মৌখিক স্বীকৃতি ও কর্মে        বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার বাস্তব প্রতিফলনকে অপরিহার্য করে দেয়। সুতরাং ঈমানের দু’টি অংশ। একটি হল অন্তরে স্বচ্ছ আক্বীদা পোষণ। আরেকটি হল বাহ্যিক তৎপরতায় তার প্রকাশ। এ দু’টি পরস্পরের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত যে কোন একটির অনুপস্থিতি ঈমানকে বিনষ্ট করে দেয়।  

তৃতীয়ত : আক্বীদা হল বিশ্বাসের মাথা এবং ঈমান হল শরীর। অর্থাৎ আক্বীদা হল ঈমানের মূলভিত্তি। আক্বীদা ব্যতীত ঈমানের উপস্থিতি তেমনি অসম্ভব, যেমনভাবে ভিত্তি ব্যতীত কাঠামো কল্পনা করা অসম্ভব। সুতরাং ঈমান হল বাহ্যিক কাঠামো আর আক্বীদা হল ঈমানের আভ্যন্তরীণ ভিত্তি।

চতুর্থত : আক্বীদার দৃঢ়তা যত বৃদ্ধি পায় ঈমানও তত বৃদ্ধি পায় ও মজবুত হয়। আক্বীদায় দুর্বলতা সৃষ্টি হলে ঈমানেরও দুর্বলতা সৃষ্টি হয়, আমলের ক্ষেত্রেও সে দুর্বলতার প্রকাশ পায়। যেমনভাবে রাসূল (ছা:) বলেন, মানুষের হৃদয়ের মধ্যে একটি গোশতপিন্ড রয়েছে, যদি তা পরিশুদ্ধ হয় তবে সমস্ত শরীর পরিশুদ্ধ থাকে, যদি তা কদর্যপূর্ণ হয় তবে সমস্ত শরীরই কদর্যপূর্ণ হয়ে যায়। (মুত্তাফাক আলাইহে, মিশকাত ‘ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়’ হা/২৭৬০)  

পঞ্চমত : বিশুদ্ধ আক্বীদা বিশুদ্ধ ঈমানের মাপকাঠি, যা বাহ্যিক আমলকেও বিশুদ্ধ করে দেয়। যখন আক্বীদায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় তখন ঈমানও বিভ্রান্তিপূর্ণ হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের অনুসরণ করা হয় এজন্য যে, তারা যে আক্বীদার অনুসারী ছিলেন তা ছিল বিশুদ্ধ এবং কুরআন ও সুন্নাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এজন্যই তারা ছিলেন খালিছ ঈমানের অধিকারী এবং পৃথিবীর বুকে উত্থিত সর্বোত্তম জাতি। অন্যদিকে মুরজিয়া, খারেজী, কাদরিয়াসহ বিভিন্ন উপদলসমূহ আক্বীদার বিভ্রান্তির কারণে তাদের ঈমান যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তেমনি তাদের কর্মকান্ড নীতিবিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এভাবেই আক্বীদার অবস্থান পরিবর্তনের কারণে ঈমানের অবস্থানও পরিবর্তন হয়ে যায়।

ষষ্ঠত : সকল রাসূলের মূল দা‘ওয়াত ছিল বিশুদ্ধ আক্বীদা তথা তাওহীদের প্রতি আহবান জানানো। এক্ষেত্রে কারো অবস্থান ভিন্ন ছিল না। কিন্তু আমল-আহকাম সমূহ যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি আমলসমূহ পূর্ববর্তী নবীদের যুগে ছিল না অথবা থাকলেও তার বৈশিষ্ট্য ছিল ভিন্নরূপ। সুতরাং ঈমানের দাবীসূচক আমলসমূহ কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হলেও আক্বীদার বিষয়টি সৃষ্টির অনাদিকাল থেকে অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয়।

আক্বীদা হ’ল মুমিনের ঈমানের বা বিশ্বাস সমষ্টির নাম। মূলতঃ ছয়টি বিশ্বাসের প্রতি দৃঢ় ঈমানের ফলে একজন বান্দা মুমিন হয়। পক্ষান্তরে এই বিশ্বাসের বিপরীতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের ফলে মুনাফিক্ব হয়। যাকে আক্বীদাগত মুনাফিক বলে।

আর ঈমানের শাখা-প্রশাখার অন্যতম মুমিনের ছয়টি বিশ্বাসের  ভিত্তি : যথা- أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ. ‘আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম (১) আল্লাহ উপরে (২) তাঁর ফেরেশতাগণের উপরে (৩) তাঁর প্রেরিত কিতাব সমূহের উপরে  (৪) তাঁর রাসূলগণের উপরে  (৫) ক্বিয়ামত দিবসের উপরে  এবং  (৬) আল্লাহ্র পক্ষ হ’তে নির্ধারিত তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে’ (হাদীছে জিব্রীল, মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২ ‘ঈমান’ অধ্যায়)। এ বিষয়ে নিচে তুলে ধরা হলো-

 (১) আল্লাহর উপর ঈমান :

‘ঈমান’ অর্থ নিশ্চিন্ত বিশ্বাস, নিরাপত্তা দেওয়া, যা ভীতির বিপরীত (জাওহারী, আছ-ছিহাহ ৫/২০৭১; ফিরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত, পৃঃ ১১৭৬)। অন্যত্র এসেছে, ‘ঈমান’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো অন্তরে বিশ্বান, মুখে স্বীকৃতি দেয়া, সত্যায়ন করা ইত্যাদি।

রাগেব আল-ইছফাহানী (রহঃ) বলেন, ‘ঈমানের মূল অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি এবং ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাওয়া’ (আল-মুফরাদাত, পৃঃ ৩৫)। সন্তান যেমন পিতা-মাতার কোলে নিশ্চিন্ত হয়, মুমিন তেমনি আল্লাহর উপরে ভরসা করে নিশ্চিন্ত হয়।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ ও আমলের মাধ্যমে (আছ-ছারিম আল-মাসলূল, পৃঃ ৫১৯)।

পারিভাষিক অর্থ : আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতে, ‘ঈমান’ হ’ল অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম, যা আনুগত্যে বৃদ্ধি হয় ও গুনাহে হ্রাস হয়। প্রথম দু’টি মূল ও শেষেরটি হ’ল শাখা, যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না (ইবনু মান্দাহ, কিতাবুল ঈমান ১/৩৩১)।

ঈমানের পুরোপুরি তাৎপর্য ও সংজ্ঞা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হবে তখনি, যখন মানুষ মুখের স্বীকৃতি, অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস ও আমলের মাধ্যমে ঈমান পোষণ করা। এই তিন ধাপের সমন্বয়ের বাস্তব রূপ হ’ল একজন মুমিন বান্দার। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ পেরিয়ে তৃতীয় ধাপের বাস্তব রূপ হলো সৎ আমল ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যথাযথ বাস্তাবায়ন করা। আর কর্মে বাস্তবায়ন না করতে পারলে সে প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না। বান্দা তার স্রষ্টার তরে সকল কিছু সপে দিবেন। আর যারা সপে দিতে পারেনি তারা ইবলিশ শয়তান, ফেরাউন, নমরূদ, আবূ জাহেল, আবূ লাহাব, আব্দুল্লাহ ইবনে উবায় এবং এমন আরো অনেক কাফেরও মত হবে, যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করত। কিন্তু অমান্য করার কারণে তারা ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। সুতরাং বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকৃতি দেয়া এবং কর্মে বাস্তব ও যথাযথ পরিণত করার সমষ্টির নাম ঈমান। আর ঈমান ধারনকারী মুমিন।

দুনিয়া বাসী মুমিন বান্দার পরিচয় দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,    الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ – وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡكَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِكَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ هُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ – اُولٰٓئِكَ عَلٰی هُدًی مِّنۡ رَّبِّهِمۡ  وَ اُولٰٓئِكَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ –

‘যারা গায়বের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়িম করে এবং আমি যে জীবনোপকরণ তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে। আর তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং পরকালের প্রতিও তারা নিশ্চিত বিশ্বাসী। তারাই তাদের প্রতিপালকের হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, আর তারাই সফলকাম’ (বাক্বারাহ ২/৩-৫)।

অদৃশ্য বা গায়েবের প্রতি ঈমান আনা বিশেষ ফযীলতপূর্ণ। ‘ঈমান বিল-গায়েব’ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘গায়েবের বিষয়াদির উপর ঈমান আনার চেয়ে উত্তম ঈমান আর কারও হতে পারে না। তারপর তিনি এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৬০] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনার সাথে জিহাদ করেছি, আমাদের থেকে উত্তম কি কেউ আছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তারা তোমাদের পরে এমন একটি জাতি, যারা আমাকে না দেখে আমার উপর ঈমান আনবে [সুনান দারমী: ২/৩০৮, মুস্তাদরাকে হাকিম: ৪/৮৫] 

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُكِرَ اللّٰهُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتُهٗ زَادَتۡهُمۡ اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّهِمۡ یَتَوَكَّلُوۡنَ ‘মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপরই ভরসা করে (আনফাল ৮/২)।

ঈমানেরও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। যে ব্যক্তি কুরআনের কোন আয়াত সম্পর্কে ভালভাবে জানলো, সে ব্যক্তির ঈমান ঐ ব্যক্তির চেয়ে অবশ্যই বেশী যার সে আয়াতের জ্ঞান নেই। সুতরাং ঈমানদারগণ তাদের ঈমানে সমপর্যায়ের নন। যেমন- আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর ঈমান অন্যান্য সাহাবাদের ঈমানের চেয়ে অনেক বেশী। সাহাবাদের ঈমান তাবেয়ীদের ঈমানের চেয়ে অনেক বেশী। অনুরূপভাবে যারা শরীআতের হুকুম-আহকামের উপর আমল করে, তাদের ঈমান ঐ লোকদের থেকে বেশী যারা শরীআতের হুকুম-আহকাম ঠিকমত পালন করে না। সুতরাং যে সমস্ত লোকেরা আল্লাহর হুকুম-আহকাম ও তার বিধান অনুযায়ী না চলেও ঈমানের দাবী করে, তারা মূলতঃ ঈমানই বুঝে না। তাদের ঈমান সবচেয়ে নিমস্তরের ঈমান।

কুরআন ও সুন্নাহ প্রমাণ করে যে, আনুগত্যের দ্বারা ঈমান বর্ধিত হয় আর অবাধ্যতার কারণে ঈমান কমে যায়। মহান আল্লাহর বাণীঃ (وَالَّذِينَ اهْتَدَوْا زَادَهُمْ هُدًى وَآتَاهُمْ تَقْوَاهُمْ) “আর যারা হেদায়াত অবলম্বন করে তিনি তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করে দেন, তাদেরকে তাকওয়া প্রদান করেন”। [মুহাম্মাদঃ ১৭]

মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ (إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ) “মুমিন তো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, এবং যখন তাঁর আয়াত সমূহ তাদের নিকট পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বর্ধিত করে আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে।” [আল-আনফাল ২]

আহলেহাদীস বা সালাফীদের আক্বীদা। এই আক্বীদার অনুসারীগণ কবীরা গোনাহগার ব্যক্তিকে কাফের বলেন না। বরং ফাসেক বা ত্রুটিপূর্ণ ঈমানদার বলেন। তারা কবীরা গোনাহকে ঘৃণা করেন ও তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করেন এবং পূর্ণ ঈমানদার হওয়ার জন্য সৎকর্ম সম্পাদনকে আবশ্যিক গণ্য করেন। আল্লাহর উপরে ঈমান রাখেন ‘রব’ হিসাবে, একক ‘ইলাহ’ হিসাবে, তাঁর অনন্য নাম ও গুণাবলী সহকারে, যা মাখলূকের নাম ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। এই নির্ভেজাল একত্ববাদকেই বলা হয় ‘তাওহীদ’, যাকে তিনভাগে ব্যাখ্যা করা চলে। যথা-

(ক) তাওহীদে রবূবিয়াত (ةوحيد الربوبية) : সৃষ্টি ও পালনে আল্লাহর একত্ব :

তাওহীদে রুবূবিয়াত’-এর অর্থ হ’ল আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রূযীদাতা, রোগ ও আরোগ্যদাতা, জীবন ও মরণদাতা প্রভৃতি হিসাবে বিশ্বাস করা। কিছু সংখ্যক নাস্তিক ও প্রকৃতিবাদী ছাড়া দুনিয়ার প্রায় সকল মানুষ সকল যুগে এমনকি শেষনবী (ছাঃ)-এর আগমনকালে মক্কার মুশরিক আরবরাও আল্লাহকে ‘রব’ হিসাবে, সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করত। কুরায়েশ নেতারা তাদের ছেলেদের নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুল মুত্ত্বালিব ইত্যাদি রাখত।

(খ) তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত (توحيد الأسماء والصفات) : নাম ও গুণাবলীর একত্ব :

তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত’-এর অর্থ হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পৃক্ত ও সনাতন বলে বিশ্বাস করা, যা বান্দার নাম ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। সুগন্ধিকে যেমন ফুল হ’তে পৃথক করা যায় না, কিরণকে যেমন সূর্য হ’তে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, আল্লাহর গুণাবলীকে তেমনি তাঁর সত্তা হ’তে পৃথক ভাবা যায় না। তিনি দয়া বিহীন দয়ালু, কথা বিহীন কথক, কর্ণহীন শ্রোতা বা হস্তবিহীন দাতা নন। তিনি নিরাকার বা নির্গুণ সত্তা নন। বরং তাঁর আকার রয়েছে। কিন্তু তা কেমন তা কেউ জানে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)। আরো বলেন, ‘তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই’ (ইখলাছ ১১২/৪)। অন্যত্র বলেন, ‘লোকেরা তাঁর সম্পর্কে যেসব বিশেষণ প্রয়োগ করে থাকে, সেসব থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে’ (ছাফফাত ৩৭/১৮০)

মু‘আত্ত্বিলাগণ আল্লাহকে নির্গুণ ও নিরাকার মনে করে শূন্য সত্তার পূজারী হয়েছে। জাহমিয়া, ক্বাদারিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি এদের অনেকগুলি উপদল রয়েছে। মুজাসসিমাহ ও মুশাবিবহাগণ আল্লাহকে বান্দার সদৃশ কল্পনা করে মূর্তিপূজারী হয়েছে। প্রকৃত সত্য রয়েছে এ দুইয়ের মধ্যবর্তী পথে, যা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের গৃহীত পথ।

(গ) তাওহীদে ইবাদাত ও উলূহিয়াত (ةوحيد العبادة أو الألوهية) : ইবাদত বা উপাসনায় একত্ব :

 ‘তাওহীদে ইবাদত বা উলূহিয়াত’-এর অর্থ হ’ল ‘সর্বপ্রকার ইবাদতের জন্য আল্লাহকে একক গণ্য করা’। আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালোবাসা সহ চরম প্রণতি পেশ করাকে ‘ইবাদত’ বলা হয়। সামগ্রিক অর্থে ‘ইবাদত’ ঐসকল প্রকাশ্য ও গোপন কথা ও কাজের নাম, যা আল্লাহ ভালবাসেন ও খুশী হন’। ‘ইলাহ’ সেই সত্তাকে বলা হয়, যাঁর নিকটে আশ্রয় ভিক্ষা করতে হয় ও যাঁকে ইবাদত করতে হয় মহববতের সাথে একনিষ্ঠভাবে ভীতিপূর্ণ সম্মান ও সর্বোত্তম শ্রদ্ধার সাথে।

মানুষের জীবনে ইবাদাত ও মু‘আমালাত বা আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক দু’টি দিক রয়েছে। এর মধ্যে আধ্যাত্মিক বা রূহানী জগতটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আধ্যাত্মিক জগতের বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ তার বৈষয়িক জীবন পরিচালনা করে। এ কারণে আধ্যাত্মিক জগতকে সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্য ইসলাম যে বিধান সমূহ প্রদান করেছে তা হ’ল ‘তাওক্বীফী’। অর্থাৎ যার কোন নড়চড় নেই। বান্দার পক্ষ হ’তে সেখানে কোনরূপ রায়-ক্বিয়াস বা ইজতিহাদের অবকাশ নেই। ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, যবহ-মানত ইত্যাদি ইবাদত সমূহের নিয়ম পদ্ধতি উক্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত। এসব ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে প্রাপ্ত বিধান মেনে চলাই নিরপেক্ষ মুমিনের কর্তব্য।

অতঃপর ‘মু‘আমালাত’ বা বৈষয়িক জীবনে মুমিন আল্লাহ প্রেরিত ‘হুদূদ’ বা সীমারেখার মধ্যে থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। আদেশ-নিষেধ ও হালাল-হারাম-এর সীমারেখার মধ্যে থেকে যোগ্য আলেমগণ শারঈ মূলনীতির আলোকে ‘ইজতিহাদ’ করবেন ও যুগ-সমস্যার সমাধান দিবেন। রাজ্যশাসন, প্রজাপালন, চাকুরী-বাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি মানুষের জীবনের বিস্তীর্ণ কর্মজগত তার মু‘আমালাত বা বৈষয়িক জীবনের অন্তর্ভুক্ত। একজন প্রকৃত মুমিন তার আধ্যাত্মিক জীবনে যেমন আল্লাহর বিধান মেনে চলেন, তেমনি বৈষয়িক জীবনেও ইসলামী শরী‘আতের আনুগত্য করে থাকেন। আধ্যাত্মিক জীবনে আল্লাহর আনুগত্য ও বৈষয়িক জীবনে গায়রুল্লাহর আনুগত্য স্পষ্ট শিরক। জান্নাতপিয়াসী মুমিনকে তাই ইবাদতের ক্ষেত্রে যেমন হাদীছপন্থী হ’তে হবে, বৈষয়িক জীবনেও তেমনি শারঈ বিধানের আনুগত্য করে চলতে হবে। নইলে তার তাওহীদের দাবী মিথ্যা প্রমাণিত হবে। তাওহীদে রুবূবিয়াতকে মেনে নিলেও কাফের আরব নেতারা তাওহীদে ইবাদতকে মেনে নিতে পারেনি বলেই নবীকে অস্বীকার করেছিল।

(২) ফিরিশতাগণের উপর ঈমান (الإيمان بالملائكة) 

আহলেহাদীস বা সালাফীদের আক্বীদা হিসাবে বর্ণিত এক নম্বর ক্রমিকের ছয়টি বিষয়ের মধ্যে দ্বিতীয়টি হ’ল ফিরিশতাগণের উপরে ঈমান আনা। ফিরিশতাগণ নূরের তৈরী আল্লাহর এক বিশেষ সৃষ্টি, যারা অদৃশ্যভাবে সৃষ্টিকুলের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত এবং আল্লাহর হুকুমে তৎপর আছেন। ফিরিশতাগণের সর্দার জিব্রীল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশক্রমে নবীদের নিকটে ‘অহি’ বহনের মহান দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কুরআন ও হাদীছে ফিরিশতা সম্পর্কে যা কিছু এরশাদ হয়েছে, সবকিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। এগুলি অদৃশ্য বিষয়ক জ্ঞান। এখানে ‘অহি’ ব্যতীত কল্পনার কোন স্থান নেই।

(৩) রাসূলগণের প্রতি ঈমান (الإيمان بالرسل) 

‘রাসূল’ বলতে আল্লাহর পক্ষ হ’তে বান্দার মধ্য থেকে নির্বাচিত আল্লাহর বাণীবাহকগণকে বুঝায়। কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবী ও রাসূল এবং হাদীছে যে সর্বমোট ৩১৫ জন রাসূলসহ এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গাম্বরের কথা বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের সকলেই এতে শামিল হবেন। নবী ও রাসূলগণ
সম্পর্কে এই বিশ্বাস পোষণ করা ওয়াজিব যে, তাঁরা সকলেই মানুষ ছিলেন এবং নবুঅত প্রাপ্তির আগে ও পরে স্বেচ্ছাকৃত যাবতীয় ছগীরা ও কবীরা গোনাহ হ’তে তাঁরা মা‘ছূম বা নিষ্পাপ ছিলেন। আল্লাহর যে সমস্ত বাণী তাঁরা প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তা সবই নির্ভুল ও যথাযথভাবে তাঁরা স্ব স্ব উম্মতের নিকটে পৌঁছে দিয়েছেন। উম্মতের কোন বিশেষ ব্যক্তির নিকটে বিশেষ কোন ইল্ম তাঁরা লুকিয়ে রেখে যাননি। তাবলীগে
দ্বীনের ব্যাপারে খেয়ানত, অলসতা, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা ইত্যাদি যাবতীয় রকমের ক্রটি হ’তে তাঁরা মুক্ত ছিলেন। চারজন শ্রেষ্ঠ রাসূলের মধ্যে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন জিন্ ও ইনসান সহ সকল মাখলূক্বাতের জন্য প্রেরিত বিশ্বনবী। বাকী সকলে ছিলেন স্ব স্ব গোত্রের ও সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত নবী (বুখারীমুসলিম)

(৪) আল্লাহর কিতাব সমূহের উপরে ঈমান (الإيمان علي الكةب المنزلة) : 

আল্লাহ পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ চারখানা কিতাব তাওরাত, যবূর, ইঞ্জীল ও কুরআন ছাড়াও ইবরাহীম (আঃ) ও অন্যান্য নবী ও রাসূলের নিকটে প্রেরিত সকল গ্রন্থ ও পুস্তিকাকে আল্লাহ প্রেরিত কিতাব ও সহীফা হিসাবে বিশ্বাস করা ওয়াজিব। পবিত্র কুরআন তার
পূর্বেকার সকল কিতাব ও সহীফা সমূহের সত্যায়নকারী ও সর্বশেষ ইলাহী কিতাব।

(৫) আখেরাতে বিশ্বাস (الإيمان بالآخرة) 

দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবন শেষে আখেরাতের অনন্ত জীবন রয়েছে। মৃত্যুর পরেই যার সূচনা হয়। ক্বিয়ামতের দিন সকল মৃতব্যক্তি স্ব স্ব দেহে পুনর্জীবন লাভ করবে। অতঃপর আল্লাহর দরবারে সারা জীবনের আমলের জন্য বিচারের সম্মুখীন হবে। প্রত্যেকের আমলনামা তার ডান হাতে অথবা বাম হাতে দেওয়া হবে। অতঃপর সে অনুযায়ী সে জান্নাতে শান্তিময় জীবন যাপন করবে অথবা জাহান্নামের আগুনে দগ্ধীভূত হ’তে থাকবে।

(৬) তাক্বদীরে বিশ্বাস (الإيمان بالقدر) : 

আজাল (হায়াত), আমল, রিযিক, জান্নাতী বা জাহান্নামী- এই প্রধান চারটি বিষয় সহ বান্দার সমগ্র জীবনের ভাল-মন্দ সকল কাজকর্ম আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বৎসর পূর্বে আল্লাহর ইলমে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তাছাড়া একদল মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের জন্য ও একদলকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছেন। যার খবর তিনি ব্যতীত অন্য কারু পক্ষে জানা সম্ভব নয়। জানা না থাকার কারণেই জান্নাত পাওয়ার আশায় মুমিন বান্দা তার তাক্বদীরের উপরে আস্থা রেখে
পূর্ণ তাদবীর ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। বিপদে সে ধৈর্য হারায় না, আনন্দে সে আত্মহারা হয় না। ইহকালে সে সুষ্ঠু (balanced), নিশ্চিন্ত ও শান্তিময় জীবন যাপন করে। কারণ সে জানে যে, তাক্বদীরের লিখনের বাইরে সে কিছুই প্রাপ্ত হবে না। 

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كُلُّ شَىْءٍ بِقَدَرٍ حَتَّى الْعَجْزُ وَالْكَيْسُ ‘প্রত্যেক বস্তু নির্ধারিত ভাগ্যানুযায়ী হয়ে থাকে। এমনকি অক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তাও’। (মিশকাত হা/৮০)।

এখানে (حَتّى الْعَجْزِ وَالْكَيْسِ) অর্থাৎ- বুদ্ধিমত্তা ও অপারগতা- এ দু’টিও আল্লাহর তাক্বদীর অনুযায়ী হয়ে থাকে। বান্দার উপার্জন ও কাজকর্মের বিষয়ে তা’ শুরুর ব্যাপারে ইচ্ছা বা অবগতি থাকলেও তা আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত সম্পাদন হয় না। সবকিছুই স্রষ্টার নির্ধারণ বা তাক্বদীর অনুযায়ীই হয়। এমনকি বুদ্ধিমত্তা যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে কিংবা অপারগতার কারণে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে বিলম্ব ঘটে বা পৌঁছতে পারে না, ইহাও আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত।

তাক্বদীরের ফয়সালা অনুসারে প্রত্যেক মানুষ হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ خَلَقَ خَلْقَهُ فِي ظُلْمَةٍ، فَأَلْقَى عَلَيْهِمْ مِنْ نُورِهِ، فَمَنْ أَصَابَهُ مِنْ ذَلِكَ النُّورِ اهْتَدَى، وَمَنْ أَخْطَأَهُ ضَلَّ، فَلِذَلِكَ أَقُولُ: جَفَّ القَلَمُ عَلَى عِلْمِ اللَّهِ “ ‘আল্লাহ তা’আলা অন্ধকারে তার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি এদের উপর তার নূরের আলোকপ্রভা ঢেলে দিয়েছেন। সুতরাং সেই নূরের আলোকপ্রভা যে ব্যক্তির উপর পড়েছে সে সৎপথ পেয়েছে এবং যে ব্যক্তির উপর তা পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। এ জন্যেই আমি বলি, আল্লাহ তা’আলার ইলম অনুযায়ী কলম (তাকদীরের লিখন) শুকিয়ে গেছে’ (তিরমিযী হা/২৬৪২; মিশকাত হা/১০১)।

সঠিক আক্বীদা পোষণের অপরিহার্যতা :

  1. সঠিক আক্বীদা পোষণ করা ইসলামের যাবতীয় কর্তব্যসমূহের মাঝে সবচেয়ে বড় কর্তব্য। রাসূল (ছা:) বলেন, ‘আমি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং মুহাম্মাদকে রাসূল হিসাবে স্বীকৃতি দেয়’ (মুত্তাফাক আলাইহে, ‘ঈমান’ অধ্যায়, হা/১২)
  2. ঈমান সাধারণভাবে সমস্ত দ্বীনে ইসলামকেই অন্তর্ভূক্ত করে। আর আক্বীদা দ্বীনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয় তথা অন্তরের অবিমিশ্র স্বীকৃতি ও আমলে তা যথার্থ বাস্তবায়নকে নিশ্চিত করে।
  3. আক্বীদার সাথে সংশ্লিষ্ট পাপ তথা শিরক এমন ধ্বংসাত্মক যে পাপী তওবা না করে মারা গেলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শিরককারীকে ক্ষমা করবেন না। এ ব্যতীত যে কোন পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিতে পারেন’ (নিসা ১১৬)
  1. আক্বীদা সঠিক থাকলে কোন পাপী ব্যক্তি জাহান্নামে গেলেও চিরস্থায়ীভাবে সেখানে থাকবে না। ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, কোন এক ব্যক্তি জীবনে কোনদিন সৎ আমল না করায় তার পুত্রদের নির্দেশ দেয় তাকে পুড়িয়ে দিয়ে ছাইভস্ম যমীনে ও পানিতে ছড়িয়ে দিতে এই ভয়ে যে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দান করবেন। তার ধারণা ছিল এর মাধ্যমে সে আল্লাহর কাছ থেকে পালিয়ে জাহান্নামের আগুন খেকে পরিত্রাণ লাভ করবে। অতঃপর আল্লাহ ছাইভস্মগুলো একত্রিত করে তাতে রূহ প্রদান করলেন এবং তাকে তার এই কাজের হেতু জানতে চাইলেন। অতঃপর তাকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিলেন, যেহেতু সে আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত বিশ্বাস রাখে (বুখারী, হা/৩২৯৪ ‘কিতাবুল আম্বিয়া’, বাব ন. ৫২)। অন্য হাদীছে এসেছে, যার অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ ঈমান অবশিষ্ট থাকবে তাকেও শেষ পর্যায়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে (মুত্তাফাক আলাইহে, মিশকাত হা/৫৫৭৯,‘কিয়ামতের অবস্থাসমূহ ও সৃষ্টির পুনরুত্থান’ অধ্যায়, ‘হাউযে কাওছার ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ। অর্থাৎ সঠিক আক্বীদার কারণে একজন সর্বোচ্চ পাপী ব্যক্তিও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাহান্নামে অবস্থানের পর জান্নাতে প্রবেশ করতে সমর্থ হবে। 
  2. আক্বীদা সঠিক না থাকলে সৎ আমলকারীকেও জাহান্নামে যেতে হবে। যেমন একজন মুনাফিক বাহ্যিকভাবে ঈমান ও সৎ আমল করার পরও অন্তরে কুফরী পোষণের কারণে সে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে (নিসা ১৪৫)। একই কারণে একজন কাফির সারা জীবন ভাল আমল করা সত্ত্বেও কিয়ামতের দিন সে তার দ্বারা উপকৃত হতে পারবে না। কেননা তার বিশ্বাস ছিল ভ্রান্তিপূর্ণ। আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন আমি তাদের কৃতকর্মের দিকে মনোনিবেশ করব, অতঃপর সেগুলো বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় রুপান্তরিত করব’ (ফুরকান ২৩)
  3. কবরের জীবনে আক্বীদা সম্পর্কেই প্রশ্ন করা হবে। অর্থাৎ তোমার রব কে? তোমার নবী কে? তোমার দ্বীন কি? সেদিন আমল সংক্রান্ত প্রশ্ন করা হবে না। এখান থেকেই দুনিয়া ও আখিরাতে আক্বীদার গুরুত্ব অনুভব করা যায়।
  1. ইসলামের কালেমা অর্থাৎ ‘কালেমা তাওহীদ’ উচ্চারণ করা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে তখনই যখন তা সঠিক বিশ্বাস প্রসূত হয়। নতুবা তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্তসমূহ হল- ক. কালেমা তাওহীদের অর্থ জানা। খ. খুলূছিয়াতের সাথে উচ্চারণ করা। গ. সত্যায়ন করা। ঘ. অন্তরে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখা। ঙ. কালেমা ও কালেমার অনুসারীদের প্রতি মুহাববত পোষণ করা। চ. আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের দাবীসমূহ পরিপূর্ণ আনুগত্য ও নিষ্ঠার সাথে পালন করা। ছ. কালেমার বিপরীত বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করা। এ বিষয়গুলো প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরের বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট। যা স্পষ্টতঃই নির্দেশ করে যে, বিশ্বাসের সঠিকতা ইসলামে প্রবেশের মূল শর্ত। অর্থাৎ কালেমায়ে তাওহীদ যদি সঠিক বিশ্বাসের সাথে উচ্চারিত না হয় তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে সকল আলেমগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
  2. ইসলামের একটি মৌলিক নীতি হল ‘ওয়ালা’ ও ‘বারা’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর জন্য সম্পর্ক স্থাপন এবং আল্লাহর জন্যই সম্পর্কচ্ছেদ’ যা আক্বীদার সাথে সংশ্লিষ্ট। একজন কাফির, মুনাফিক, মুশরিকের প্রতি আমরা যে বিমুখতা দেখাই তার কারণ হল তার কুফরী এবং বিভ্রান্ত আক্বীদা। ঠিক যেমনভাবে একজন মুমিনকে আমরা শর্তহীনভাবে ভালবাসি তার ঈমান ও বিশুদ্ধ আক্বীদার কারণে। এ কারণে একজন মুসলমান পাপাচারী হলেও তার আক্বীদার কারণে তার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন এক ব্যক্তিকে মদ্যপানের জন্য রাসূল (ছা:)-এর সামনে বেত্রাঘাত করা হচ্ছিল। তখন একজন ব্যক্তি বলল, আল্লাহ তোমার উপর লা‘নত করুন। রাসূল (ছা:) তাকে বললেন, ‘এই মদ্যপায়ীকে লা‘নত কর না, কেননা সে আল্লাহ ও তার রাসূলকে ভালবাসে’ (মুসনাদে বায্যার হা/২৬৯, ছনদ ছহীহ, দ্রঃ বুখারী হা/৬৭৮০)

চলবে ……

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top