(একটি ব্যাখ্যা স্বরূপ নিবন্ধ)
ফযীলত সমূহ :
(১) আবু কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আরাফাহ দিবসের ছিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّى أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِى بَعْدَهُ-
‘আরাফার দিনের ছিয়াম, আমি মনে করি বিগত এক বছর ও আগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে’ (মুসলিম হা/১১৬৩)।
(২) আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِى بِهِمُ الْمَلاَئِكَةَ فَيَقُوْلُ مَا أَرَادَ هَؤُلاَءِ
‘আরাফার দিন আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দারা আমার কাছে কি চায়’?(মুসলিম হা/১৩৪৮)।
“আরাফার দিন অপেক্ষা এমন কোনো দিন নেই, যেদিন আল্লাহ সর্বাধিক বেশি সংখ্যায় বান্দাকে দোযখ-মুক্ত করেন।” অর্থাৎ দিনসমূহের মধ্যে ‘আরাফার দিনের মতো আর কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ তার ইচ্ছা অনুযায়ী জাহান্নাম থেকে অধিক মানুষকে মুক্তি ও নাজাত দেন। “এ দিন তিনি (বান্দার) নিকটবর্তী হন, অতঃপর তাদের সম্পর্কে ফিরিশতাদের নিকট গৌরব করেন।” অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা বাস্তবেই তার বান্দাদের কাছে আসেন। তাদের নিয়ে ফিরিশতাদের মধ্যে গর্ব করেন। ফিরিশতাদের কাছে হাজীগণের মর্যাদা ও সম্মান প্রকাশ করেন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত বিশ্বাস করেন, স্বীয় শান ও মহত্ব অনুযায়ী বাস্তবেই আল্লাহ তার বান্দাদের নিকটে। আর তিনি তার আরশের ওপর আসন গ্রহণ করে আছেন। তার মাখলুক থেকে আলাদা। আর তিনি সত্যি সত্যি বান্দাদের দিকে অগ্রসর হন এবং সত্যি সত্যি তাদের কাছে আসেন। “তারা কী চায়” “এ দিন তিনি (বান্দার) নিকটবর্তী হন, অতঃপর তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের নিকট গৌরব করেন” তখন তিনি বলেন, “তারা কী চায়” অর্থাৎ তারা কোন জিনিষটি কামনা করে? যার জন্য তারা তাদের পরিবার পরিজন, ঘরবাড়ী ছেড়ে আসল, টাকা-পয়সা খরচ করল এবং দেহকে কষ্ট দিল। অর্থাৎ একমাত্র ক্ষমা, সন্তুষ্টি, নৈকট্য লাভ ও সাক্ষাত চায়। আর তারা যা কামনা করল তা তারা লাভ করল। আর তাদের মর্যাদা তাদের নিয়ত অনুযায়ী।
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলে কারীম (ছাঃ) বলেছেন,
إِذَا كَانَ يَوْمُ عَرَفَةَ، إِنَّ اللهَ يَنْزِلُ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، فَيُبَاهِيْ بِهِمُ الْمَلائِكَةَ، فَيَقُوْلُ : انْظُرُوْا إِلَى عِبَادِيْ أَتَوْنِيْ شُعْثًا غُبْرًا-
‘যখন আরাফার দিন হয়, তখন আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। অতঃপর তিনি আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকটে গর্ব করেন। আল্লাহ বলেন, আমার এ সকল বান্দাদের দিকে চেয়ে দেখ। তারা এলোমেলো কেশ ও ধূলায় ধূসরিত হয়ে আমার কাছে এসেছে’ (আহমাদ, ইবনু মাজাহ হা/৮১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৬১; মিশকাত হা/২৬০১)।
(৪) নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,
خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّوْنَ مِنْ قَبْلِى لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيْرٌ-
‘সবচেয়ে উত্তম দো‘আ হ’ল আরাফাহ দিবসের দো‘আ। আর সর্বশ্রেষ্ঠ কথা যা আমি বলি ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণ বলেছেন তা হ’ল- আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই, রাজত্ব তাঁরই, সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য এবং তিনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (তিরমিযী হা/২৮৩৭; মিশকাত হা/২৫৯৮, সনদ ছহীহ)।
উপরোক্ত প্রত্যেক হাদীছে আরাফাতের দিবসের ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। ৯ জিলহজ্জ তারিখের কথা বলা হয় নাই। যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম আরাফাতের দিন ৯ জিলহজ্জ, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছা.) বার বার আরাফাতের দিনের কথা বললেন ৯ জিলহজ্জের কথা বলেন নাই। তাছাড়া আরাফাতের দিন ব্যতীত উক্ত ফযীলত বান্দা পাবেন না। কারণ আরাফাত দিবস তাকে বলে যে দিন হাজীগণ আরাফাতের মাঠে উপস্থিত থাকেন এবং হজ্জ সম্পন্ন করে থাকেন। রাসূল (ছা.) বারংবার দিবসের কথা উল্লেখ করেছেন, তারিখের কথা বলেন নাই।
যারা এই হাদীছ দিয়ে বলছেন যে, ছিয়াম চাঁদের সাথে সম্পর্কিত তা ঠিক ।কারণ ছিয়াম ও ঈদের বিধান চাঁদ দেখার সাথে সম্পর্কিত, স্থানের সাথে নয় (ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৮০; মিশকাত, হা/১৯৭০)।
কিন্তু যেখানে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে রাসূল (ছা.) বার বার আরাফাতের দিবসের কথা বলছেন সেখানে তারিখ নয় স্থান যুক্ত েএকটি বিশেষ দিবসের কথা উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া এই হাদীছ থেকে বর্ণনা করি যে, আবু উমামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
يَوْمُ عَرَفَةَ وَيَوْمُ النَّحْرِ وَأَيَّامُ التَّشْرِيْقِ عِيْدُنَا أَهْلَ الإِسْلاَمِ وَهِىَ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ-
‘আরাফাহ দিবস, কুরবানীর দিন ও আইয়ামে তাশরীক (কুরবানী পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের ঈদের দিন। আর এ দিনগুলো খাওয়া-দাওয়ার দিন’ (আবুদাঊদ হা/২৪১৯)। এই হাদীছের ভাষ্যমতে আরাফাতের দিনে ছিয়াম রাখা নিষেধ (যুক্তির খাতিরে বলেছি)।
এটা বুঝানোর জন্য বলেছি যে, কোন হাদীছ কোথায় ব্যবহার করতে হবে তা আছে বুঝতে হবে। নিচের উদাহরণকৃত হাদীছটি হাজীদের সাথে সম্পর্কিত। অনুরূপ চাঁদের হিসাব বা গণনা মতে আমরা সকল ছিয়াম পালন করি। কিন্তু রাসূল (ছা.) দিবসের সাথে সম্পর্কিত ছিয়ামের কথাও বলেছেন। যেমন সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ছিয়াম।
– আরোও মনে রাখবেন, আরাফার দিনে হাজীদের হজ্জ গৃহীত হয়। কিন্তু কোন ব্যক্তি সেই মাঠে উপস্থিত না থাকলে তার হজ্জ বাতিল বলে গণ্য হবে। কেননা সেই দিনটা স্থানের সাথে নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কি ও আবর্তিত। অতএব এটা স্পষ্ট হাজীরা যেদিন আরাফার মাঠে উপস্থিত থাকেন সেই দিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নিয়ে গর্ব করেন ও জাহান্নাম থেকে সারা পৃথিবীর মানুষকে নাজাত দেন। সুতরাং এ দিনেই ছিয়াম পালন করতে হবে। অন্যথায় ছিয়াম জিলহজ্জ মাসের ছিয়াম হিসেবে পরিগণিত হবে।
শাইখ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)-এর তত্ত্বাবধানে সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া বোর্ড আরাফার দিন সম্পর্কে বলেছে, يوم عرفة هو اليوم الذي يقف الناس فيه بعرفة ‘যেদিন হাজীগণ আরাফার মাঠে অবস্থান করেন সেটা আরাফার দিন’ (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ, ১০/৩৯৩ পৃ.)।
শাইখ সুলায়মান আর-রুহায়লী বলেন, ‘এই দিনটা আরাফার মাঠের সাথে সম্পৃক্ত। আর আরাফার মাঠ অন্যান্য দেশে নেই, এটা সঊদীতে অবস্থিত। তাই সম্ভব হলে এ দিনেই সিয়াম রাখবে।
পরিশেষে এটা বুঝাতে চেয়েছি, আরাফাতের ছিয়াম আরাফার দিবসের সাথে সম্পর্কিত। ঐ দিনে ছিয়াম পালন করলে উপরোক্ত ফযীলত পাবে নতুবা ৯ তারিখে জিলহজ্জের নফল ছিয়ামের ছওয়াব পাবেন ইনশাআল্লাহ। আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে দ্বীন পালন করি। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।