ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। দুনিয়াতে নবী-রাসূলগণ তাওহীদ তথা আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্বত করার জন্য দাওয়াত প্রদান করেছেন। নবী-রাসূলগণ সকল প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে স্ব স্ব কওমের নিকটে তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য যে পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً ِ ‘আমার পক্ষ হতে (মানুষের কাছে) একটি বাক্য হলেও পৌঁছিয়ে দাও’ (মিশকাত হা/১৯৮)
আমাদের প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জাহেলী যুগে জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ تُفْلِحُوْا، ‘হে লোক সকল! তোমরা বল, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, (ছহীহ ইবনে হিববান হা/৬৫৬২)। আর দাওয়াতের প্রধান মূলমন্ত্র হলো- لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ অর্থাৎ- আল্লাহ ব্যতীত (সত্য) কোন ইলাহ নেই।
১. দাওয়াতের মূলনীতি ইলম অর্জন করা :
আল্লাহর পথে দাওয়ার প্রথম মূলনীতি হলো জ্ঞানার্জন করা। কেননা দ্বীন জেনে বুঝে অপর ভাইদের নিকটে দাওয়াত দিতে হবে। এ সম্পর্কে সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, ‘ইলমের প্রথম ধাপ হ’ল চুপ থাকা। দ্বিতীয় ধাপ হ’ল মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা এবং তা মুখস্ত রাখা। তৃতীয় ধাপ হ’ল ইলম অনুযায়ী আমল করা। চতুর্থ ধাপ হ’ল ইলম অন্যকে শিক্ষা দেয়া এবং তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা’ (হিলয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৬২)।
আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ ‘অতএব তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং ফিরে এসে নিজ কওমকে (আল্লাহর নাফরমানী হ’তে) ভয় প্রদর্শন করে যাতে তারা সতর্ক হয়’ (তওবা ৯/১২২)।
২. নিজেকে, পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়া :
দাওয়াত দেওয়ার আগে নিজের জীবনে ইসলামের শিক্ষার বাস্তবায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন দাঈ (দাওয়াত প্রদানকারী) যদি নিজে ইসলামিক নীতিমালা মেনে চলেন, তাহলে তার দাওয়াত গ্রহণযোগ্য হয় এবং তা আরও বেশি প্রভাবশালী হয়। সুতরাং উপরোক্ত তৃতীয় ধাপ অতিবাহিত করে তবেই দাওয়াত প্রদানে ব্রত হলে সবচেয়ে ফলপ্রসু হওয়া যাবে। তবেই দাওয়াতের এই পদ্ধতিকে নিজের প্রতি দাওয়াত বলা যায়। নিজেকে সংশোধন করে অন্যের সংশোধন চিন্তা করা বুদ্ধিমানের কাজ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قُوْا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيْكُمْ نَارًا وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُوْنَ اللهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ، ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে বাঁচাও, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর’ (তাহরীম ৬৬/৬)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ ‘তুমি তোমার নিকটতম আত্মীয়দের সতর্ক কর’ (শু‘আরা ২৬/২১৪)।
৩. হিকমার সাথে দাওয়াত দেওয়া :
দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করতে হবে। সময়, স্থান ও ব্যক্তির মানসিকতা বিবেচনা করে দাওয়াত দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমার রবের পথে আহ্বান করো প্রজ্ঞার সাথে এবং সুন্দর উপদেশ দ্বারা, এবং তাদের সাথে আলোচনা করো সেই পন্থায় যা উত্তম’ (আন-নাহল ১৬/১২৫)।
৪. সহজপন্থা অবলম্বন ও কঠোরতা পরিহার করা :
মানুষের বোধ্য হয় এমন সহজ সরল ভাষাতে দাওয়াত দিতে হবে। রাসূল (ছা.) বলেন, يَسِّرُوا وَلَا تُعَسِّرُوا وَبَشِّرُوا وَلَا تُنَفِّرُوا ‘তোমরা সহজ পন্থা অবলম্বন কর, কঠিন পন্থা অবলম্বন করো না, মানুষকে সুসংবাদ দাও, বিরক্তি সৃষ্টি করো না’ (বুখারী হা/৬৯)।
মানুষ হীনকর কথা অপছন্দ করে এবং আশা ও আকাংখার কথা শুনতে পছন্দ করে। রাসূলুল্লাহ (ছা.) যখনই কোনো কাজে কোনো সাহাবীকে পাঠাতেন তখন বলতেন, ‘তোমরা জনগণকে আশার বাণী শুনাবে। হতাশাব্যঞ্জক কথা বলে তাদের জন্য অবহেলা-ঘৃণা সৃষ্টি করবে না। তাদের সাথে সহজ-সরল বিধান নীতি ব্যবহার করবে, কঠোরতা অবলম্বন করবে না’ (বুখারী হা/৬১২৪, মুসলিম হা/১৭৩২, মিশকাত হা/৩৭২২)।
৫. নরম ও সুন্দর সাবলীল ভাষা ব্যবহার করা :
মুমিনদের দাওয়াত দেওয়ার সময় ভাষার ব্যবহারে কোমলতা ও সৌন্দর্য সাবলীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলা যেমনটি মুসা (আ.) ও হারুন (আ.)-কে ফেরাউনের প্রতি নরম ভাষায় কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা তার সাথে কোমলভাবে কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে’ (ত্বহা ৪৪)।
৬. নবী-রাসূল ও সালাফদের জীবনী থেকে উদাহরণ ও উপমা পেশ করা :
কথা ও বক্তব্যকে প্রভাবশালী করতে, দাওয়াতের সময় নবী-রাসূল ও সালাফদের জীবনী থেকে উদাহরণ ও উপমা পেশ করা উচিত। এতে মানুষ বিষয়টি সহজে বুঝতে পারে এবং মনে রাখতে পারে। রাসূলুল্লাহ (ছা.) যখন সাহাবীদের সামনে দাওয়াত দিতেন তখন তিনি বিভিন্ন উদাহরণ পেশ করতেন।
৭. ধৈর্যশীলতা ও সহনশীলতা বজায় রাখা :
দাওয়াতের পথে অনেক বাঁধা-বিপত্তি, সংঘাত আসতে পারে। কেউ অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করতে পারে, অপমানও করতে পারে। এহেন পরিস্থিতিতে ধৈর্য ও সহনশীলতা বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছা.)-কে বলেন, ‘তোমার রবের পথে ধৈর্য ধারণ করো’ (মুদ্দাসসির ৭)
৮. আত্মবিশ্বাস ও আন্তরিকতার সাথে দাওয়াত দেওয়া :
দাওয়াত দেওয়ার সময় আত্মবিশ্বাস ও আন্তরিকতা থাকা জরুরী। মানুষ আন্তরিক দাওয়াতকে সহজে গ্রহণ করে। রাসূলুল্লাহ (ছা.) তার দাওয়াতে সর্বদা আন্তরিকতা ও বিনম্রতা প্রদর্শন করতেন।
৯. দাওয়াত দেওয়ার ফলাফল আল্লাহর নিকটে কামনা করা :
আমরা মানব জাতি হেতু আমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। সুতরাং তাওহীদ তথা দ্বীনের দাওয়াতে ব্রত রাখা আমাদের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। যদিও মানুষকে সঠিক ও হেদায়াতের পথে আনতে পারা আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। তাই দাওয়াতের ফলাফল আল্লাহ তা‘আলার হাতে ছেড়ে দিতে হবে এবং তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখতে হবে।
হক্বের দাওয়াত বা উপদেশ প্রদানের সময় যে বাঁধা-বিপত্তি আসবে, সেখানে ছবরের সাথে অবিচল থাকতে হবে। এটা মহৎ গুণ। সবায় এ গুণ অর্জন করতে সক্ষম নয়। তবে প্রত্যেক মুমিনের এই গুণ অবশ্যই অর্জন করতে হবে, নতুবা সে পরাজিত হবে। সফলতা তারাই অর্জন করেছে যারা ছবর করেছেন। এটা ঈমানের পরীক্ষাও হ’তে পারে এবং সেখানে সর্বদা ধর্য্যধারণ করতে হবে। তাই তো বাঁধা না থাকলে দ্বীনের দাঈ অনুভব করতে পারবে না যে, তার দাওয়াত কতটুকু ফলপ্রসূ হচ্ছে। প্রত্যেক নবী-রাসূলের জীবনে এমনটি ঘটেছে। বর্তমানে এটা স্বাভাবিক। আর এর ফলাফল হবে অতীব সুস্বাদু। শুধু মাত্র ধৈর্য্যধারণ করতে হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা বৈ কিছুই নয়। আল্লাহ তাআলা দাওয়াতের ময়দানে আমাদেরকে দাঈ হিসেবে কবূল করুন, আমীন।