আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত (أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ)

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত এবং ছাহাবী ও তাবেঈগণের জামা‘আতের অনুসারী ব্যক্তিকে ‘আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ বলা হয়। এক্ষণে আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পরিচয় দিতে গিয়ে স্পেনের বিশ্বখ্যাত মনীষী হিজরী পঞ্চম শতকের ইমাম আবু মুহাম্মাদ আলী ইবনু আহমাদ ইবনু হায্ম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) বলেন,
وَأَهْلُ السُّنَّةِ الَّذِيْنَ نَذْكُرُهُمْ أَهْلَ الْحَقِّ وَ مَنْ عَدَاهُمْ فَأَهْلُ الْبَاطِلِ فَإِنَّهُمُ الصَّحَابَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَ كُلُّ مَنْ سَلَكَ نَهْجَهُمْ مِنْ خِيَارِ التَّابِعِيْنَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ ثُمَّ أَهْلُ الْحَدِيْثِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ مِنَ الْفُقَهَاءِ جِيْلاً فَجِيْلاً إِلَى يَوْمِنَا هذَا وَ مَنِ اقْتَدَى بِهِمْ مِنَ الْعَوَامِ فِى شَرْقِ الْأَرْضِ وَ غَرْبِهَا رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ-
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত- যাদেরকে আমরা হক্বপন্থী ও তাদের বিরোধী পক্ষকে বাতিলপন্থী বলেছি, তাঁরা হ’লেন (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলেহাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত (ঙ) এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল ‘আম জনসাধারণ, যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন।[1]

এর দ্বারা বুঝা গেল যে, ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম, মুহাদ্দেছীন ও হাদীছপন্থী ফকীহগণই কেবল আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বা ‘আহলুল হাদীছ’ ছিলেন না, বরং তাঁদের তরীক্বার অনুসারী ‘আম জনসাধারণও ‘আহলুল হাদীছ’ নামে সকল যুগে কথিত হ’তেন বা আজও হয়ে থাকেন। আল্লাহ পাক বলেন, وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ يَهْدُوْنَ بِالْحَقِّ وَ بِهِ يَعْدِلُوْنَ  ‘আমার সৃষ্টির (মানুষের) মধ্যে একটি দল আছে, যারা হক্ব পথে চলে ও সেই অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে’ (আ‘রাফ ১৮১)। অন্যত্র তিনি বলেন, قَلِيْلٌ مِنْ عِبَادِىَ الشَّكُوْرُ  ‘আমার কৃতজ্ঞ বান্দার সংখ্যা কম’ (সাবা ১৩)
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রত্যেক নবীর উম্মতের মধ্যে হক্বপন্থী একদল উম্মত চিরদিন ছিলেন, আজও আছেন; যদিও তারা সংখ্যায় কম হবেন। এমনকি কোন কোন নবীকে তার উম্মতের মধ্যে একজন মাত্র ব্যক্তি সত্য বলে বিশ্বাস করবেন।[2] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের উম্মত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন,
عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لاَ تَزَالُ طَائِـفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَالِكَ، رَوَاهُ مُسْلِمٌ-
(লা তাযা-লু ত্বা-য়েফাতুম মিন উম্মাতী যা-হিরীনা ‘আলাল হাক্বক্বে, লা ইয়াযুররুহুম মান খাযালাহুম, হাত্তা ইয়া’তিয়া আমরুল্লা-হি ওয়াহুম কাযা-লিকা’)
অর্থ : ‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।[3] অর্থাৎ নিতান্ত অল্প সংখ্যক হ’লেও ক্বিয়ামত পূর্বকাল পর্যন্ত হক্বপন্থী দলের অস্তিত্ব থাকবে এবং তাঁরাই হবেন সত্যিকার অর্থে বিজয়ী দল। উল্লেখ্য যে, হাদীছে বিজয়ী দল বলতে আখেরাতে বিজয়ী বুঝানো হয়েছে, দুনিয়াবী বিজয় নয়। নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) কেউই দুনিয়াবী দিক দিয়ে বিজয়ী ছিলেন না। তথাপি তাঁরাই ছিলেন প্রকৃত বিজয়ী, হক্বপন্থী ও বিশ্ব মানবতার আদর্শ পুরুষ।
এক্ষণে ‘হক্ব’ কোথায় পাওয়া যাবে? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا-
‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন ‘হক্ব’ তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে আসে। অতঃপর যে চায় সেটা বিশ্বাস করুক, যে চায় সেটা অবিশ্বাস করুক। আমরা সীমা লংঘনকারীদের জন্য জাহান্নাম তৈরী করে রেখেছি…’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)
উক্ত আয়াতের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, মানুষের চিন্তাপ্রসূত কোন ইযম, মাযহাব, মতবাদ বা তরীক্বা কখনই চূড়ান্ত সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। এ সত্য পাওয়া যাবে কেবলমাত্র আল্লাহ প্রেরিত ‘অহি’র মধ্যে, যা সংরক্ষিত আছে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছসমূহের মধ্যে। এদিকে ইঙ্গিত করেই ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, فَلَيْسَ لِلْعَقْلِ حُكْمٌ فِى حُسْنِ الْأَشْيَاءِ وَ قُبْحِهَا  ‘কোন বস্ত্তর চূড়ান্ত ভাল ও মন্দ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দানের ক্ষমতা ‘জ্ঞান’-এর নেই’।[4] তাই সবকিছুর বিনিময়ে যারা সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী থাকবেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী কেবল তারাই হবেন উম্মতের হক্বপন্থী ‘নাজী’ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِى مَا أَتَى عَلَى بَنِى إِسْرَائِيلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ … وَإِنَّ بَنِى إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِى عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِى النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِىَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَ فِىْ رِوَايَةٍ لِّلْحَاكِمِ فِىْ مُسْتَدْرَكِهِ: مَا أَنَا عَلَيْهِ الْيَوْمَ وَ أَصْحَابِىْ، وَحَسَّنَهُمَا الْأَلْبَانِىُّ-

‘বনু ইসরাঈলদের (ইহুদী-নাছারাদের) যেমন অবস্থা হয়েছিল, আমার উম্মতেরও ঠিক তেমন অবস্থা হবে। যেমন এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার ঠিক সমান হয়। … বনু ইসরাঈলগণ ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এদের সব দলই জাহান্নামে যাবে একটি দল ব্যতীত। ছহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সে দল কোন্টি? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি, তার উপরে যে দল থাকবে’। হাকেম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ‘আমি ও আমার ছাহাবীগণ আজকের দিনে যার উপরে আছি’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَهِىَ الْجَمَاعَةُ‘সেটি হ’ল জামা‘আত’।[6] উক্ত জামা‘আত বলতে কী বুঝায় এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, اَلْجَمَاعَةُ مَا وَافَقَ  الْحَقَّ وَإِنْ كُنْتَ وَحْدَكَ  ‘হক্ব’-এর অনুসারী দলই হ’ল জামা‘আত, যদিও তুমি একাকী হও’।[7] এক্ষণে সেই হক্বপন্থী জামা‘আত বা ‘নাজী’ দল কোন্টি, সে সম্পর্কে বিগত ওলামায়ে দ্বীন ও সালাফে ছালেহীনের অভিমত শ্রবণ করব।



[1]. আলী ইবনু হাযম, কিতাবুল ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল (বৈরুত: মাকাতাবা খাইয়াত্ব ১৩২১/১৯০৩) শহরস্তানীর ‘মিলাল’ সহ ২/১১৩ পৃ: কিতাবুল ফিছাল (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ ১৪২০/১৯৯৯) ১/৩৭১ পৃঃ ‘ইসলামী ফের্কাসমূহ’ অধ্যায়।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৪৪ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়।
[3]. ছহীহ মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায় ৩৩, অনুচ্ছেদ ৫৩, হা/১৯২০; অত্র হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ ঐ, দেউবন্দ ছাপা শরহ নববী ২/১৪৩ পৃঃ; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭১ ‘ইল্ম’ অধ্যায় ও হা/৭৩১১-এর ভাষ্য ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা।
[4]. শাহ অলিউল্লাহ, আল-‘আক্বীদাতুল হাসানাহ (দিল্লী ছাপা: ১৩০৪ হিঃ/১৮৮৪ খৃঃ) পৃঃ ৫; থিসিস পৃঃ ১১৩ টীকা ১১ (ক)।
[5]. সনদ হাসান, আলবানী, ছহীহ তিরমিযী হা/২১২৯; ঐ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩৪৮; হাকেম ১/১২৯ পৃঃ; আলবানী, মিশকাত হা/১৭১ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[6]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৭২ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[7]. ইবনু ‘আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব, সনদ ছহীহ, আলবানী মিশকাত হা/১৭৩-এর টীকা নং ৫ দ্রষ্টব্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top