—লিলবর আল-বারাদী
মানব সমাজে ‘শিক্ষা’ হ’ল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জীবনের সফলতা ও বিকাশ লাভের অন্যতম বাহন হ’ল ‘শিক্ষা’। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয় বিবেক ও সুপ্রবৃত্তি। আর এ জন্যেই বলা হয়, শিক্ষাই হচ্ছে একটি সভ্য সমাজ ও জাতির মেরুদন্ড। সুতরাং শিক্ষা ব্যতিত কোন মানব, সমাজ ও জাতি কখনও উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম নয়। সভ্যতা, সম্মান, মর্যাদা এবং সকল প্রকার সাফল্য ও উন্নতির মূল চাবিকাঠি হ’ল শিক্ষা। শিক্ষার মানদন্ডে প্রত্যেকের স্ব স্ব মর্যাদা পরিলক্ষিত হয়। আর শিক্ষার মর্যাদার মানদন্ডে প্রকৃত মানুষ ও ইতর প্রাণির এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। কারণ মানুষ যা শিখে তা-ই তার ব্যক্তিগত জীবনে ও সমাজে বাস্তবায়ন করতে চায়। যে জাতি যত বেশী শিক্ষিত, বাহ্যিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সে জাতি তত বেশী উন্নতির সফলতার শিখরে।
শিক্ষা হ’ল একটি সমাজ বা জাতির নির্ভরযোগ্য ভিত্তি। তাই শিক্ষা সম্পর্কে জ্ঞানীগণ বহু হিতবাক্য উচ্চারণ করেছেন। ইংরেজীতে বলা হয়েছে, Education is the backbone of a nation. ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। সংস্কৃত ভাষায় বলাহয়,‘বিদ্যা সর্বস্য ভূষনম’। বিদ্যাহীন মানুষ অন্ধের সমতুল্য। আর চোখ থাকলেও সে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে সক্ষম হয় না। আলী (রাঃ) বলেছেন,‘অন্ধ নয়নের কাছে সূর্য নয়ন কার্যকরী’। অতএব এটাই প্রতিপাদ্য যে, বিদ্যা শিক্ষা করা অতিব যরূরী। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ইলম (বিদ্যা) অর্জন করা ফরয’ ।
প্রত্যেক ব্যক্তি খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে তার স্ব দায়িত্ব পালন করার পূর্বেই তাকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা গ্রহণ করা অতিব জরুরী। তাই মহান আল্লাহ্ রাসূল (ছাঃ)-কে সর্বপ্রথম শিক্ষা গ্রহণের আদব ও জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বলেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ () خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ () اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ () الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ () عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ‘পড়, তোমার প্রভূর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক্ব’ থেকে। পড়, তোমার প্রতিপালক অতিব সম্মানিত, যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলম দ্বারা, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না’ (আলাক্ব-৯৬/১-৫)।
এমনকি মহান আল্লাহ্ আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করার পর সর্বপ্রথম বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এরশাদ হচ্ছে, وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ‘তিনি আদমকে শিক্ষা দিলেন সমস্ত কিছুর নাম, অত:পর সেগুলি পেশ করলেন ফেরেশতাদের কাছে’(বাক্বারাহ-২/৩১)।
শিক্ষার সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা হ’লো, বাংলা ‘শিক্ষা’ শব্দটি সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতু থেকে উৎপন্ন। ‘মাস’ অর্থ শাসন করা, নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দেশ বা উপদেশ দেওয়া। ‘শিক্ষা’ শাব্দের সমার্থক ‘বিদ্যা’ শব্দটি সংস্কৃতি ‘বিদ’ ধাতু থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ ‘জানা’ বা ‘জ্ঞান আহরণ করা’ । শব্দ দু’টি বিশেষ কৌশল অর্জনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং বুৎপত্তিগত অর্থে ‘শিক্ষ’ বলতে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করা কিংবা বিশেষ কোন কৌশল আয়ত্ত করাকে বুঝায়। বাংলা ‘শিক্ষা’ শব্দের ইংরেজী প্রতিশব্দ Education” । “Education”শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন “Educere” ” শব্দ থেকে। এ শব্দটির অর্থ নিষ্কাশন করা কিংবা ভিতর থেকে বাইরে নিয়ে আসা, (To lead out, to draw out) ।
শিক্ষার পারিভাষিক অর্থ হ’ল:- শিক্ষার মাধ্যমে বিদ্যার্জন করে এবং বিদ্যা দ্বারা জ্ঞানকে পরিপক্ক করে সুপ্ত বিবেককে সর্বদা জাগ্রত রেখে, শিক্ষার সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে আত্ম উন্নয়ন বিকাশে নিজেকে পরিচালিত করা এবং অন্যকে পরিচালিত হওয়ার জন্য সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সাহায্য করাকে শিক্ষা বলে।
ডঃ এ.কে.এম. ওবায়েদ উল্লাহর মতে, ‘নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীকে জ্ঞান ও নৈপুণ্য অর্জনে সহায়তা করা।
শিক্ষাবিদ রেমেন্টের মতে, ‘শিক্ষা হ’ল মানুষের শৈশব থেকে পরিপক্কতার স্তর অবধি বিকাশের একটি পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে ধীরে ধীরে শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।
শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষাবিদ ম্যাকেঞ্জীর মতানুসারে ‘শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা আমাদের সারা জীবন দরে চলতে থাকে এবং এর মাধ্যমে মানুষ নিজেদের পারস্পারিক সম্পর্ক নির্ণয় ও পারিপার্শ্বিক জগতের সাথে নিজের অবস্থান উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়’।
শিক্ষার এ ব্যাপক অর্থ ব্যাখ্যা করে এ.এন. হোয়াইট হেড বলেছেন,‘শিক্ষার একটিমাত্র বিষয় বস্তু আছে, আর তাহ’ল জীবনকে সর্বতোভাবে প্রকাশিত করা। ব্যাপক অর্থে শিক্ষা ও জীবন সমার্থক। জীবন মানেই শিক্ষা’।
শিক্ষার গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য অপরিসীম। শিক্ষা দ্বারা বিদ্যা অর্জিত হয়। বিদ্যা জ্ঞানকে পরিপক্ক করে। আর জ্ঞান বিবেককে জাগ্রত রাখে। এই বিবেক দ্বারা অর্জিত জ্ঞান, শিক্ষার সঞ্চিত অভিজ্ঞতা পরিচালিত হয়। আল্লাহ মানুষকে প্রদেয় সর্বোত্তম নেয়ামত বন্টন হ’ল বিবেক। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ ‘ তিনি যাকে ইচ্ছা বিশেষ জ্ঞান দান করেন এবং যাকে বিশেষ জ্ঞান দান করা হয়, সে প্রভূত কল্যাণকর বস্তু প্রাপ্ত হয়। উপদেশ তারাই গ্রহণ করে, যারা জ্ঞানবান’(বাক্বারাহ-২/২৬৯)। সুস্থ্য বিবেক মানুষের সৌন্দর্যের প্রতিক। সুস্থ্য বিবেক বিকাশে সঠিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সটিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়। সম্মান ও মর্যাদার সমকক্ষ কোন কিছুর তুলনা হয়না। আর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষা অর্জন, জ্ঞান গ্রহণ ও বিবেক জাগ্রত রাখার মাধ্যমে। এই তিনটি জিনিসের সমন্বয় সাধিত হ’লেই চরিত্র ত্রুটি মুক্ত এবং চরিত্র কুলুষ মুক্ত মানেই সম্মান, মর্যাদা ও উন্নতির মূল কাঠামো তৈরী হয়। একজন শিক্ষা অর্জনকারী ব্যক্তি আলোকিত প্রদ্বীপের ন্যায় এবং পক্ষান্তরে একজন বিদ্যা বর্জনকারী ব্যক্তি আধাঁরের সমতুল্য। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ ‘বল, দৃষ্টিহীন ও দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি কি সমান হতে পারে ? অথবা, অন্ধকার ও আলো কি কখনো সমান হতে পারে’? (রায়াদ-১৩/১৬)। অন্যত্র বলেন, ‘হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা গবেষণা ও শিক্ষা গ্রহণ কর’ (হাশর-২)। শিক্ষা মানুষের অন্তরকে বিশেষভাবে আলোকিত ও পরিমার্জিত করে। এসম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘শিক্ষা বা জ্ঞান-বুদ্ধি হ’ল অন্তরের আলো যা হক্ক ও বাতিল, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে’ (আল-হাদীছ)। বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদে আছে, ‘Knowledge is power and virtue but ignorance is
sin’. ‘জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই পূণ্য কিন্তু অজ্ঞতা পাপ’।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দু’প্রকারের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষা। বাংলাদেশ বিগত ৪০ বছরেও শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেননা, প্রত্যেক অভিভাবক তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু অধিকাংশ ছাত্রই মধ্যম প্রতিভার অধিকারী এবং অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অন্যদিকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে লেখাপড়ার মান নিম্নমানের হওয়ায় অভিভাবকরা আশা-আকাংখাহত।
আমাদের মাদরাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা নামে প্রচলিত দ্বিমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা, যা মূলতঃ ১৯৩৬ সালে বৃটিশ সরকার লর্ড মেকলের মাধ্যমে চালু করে। তাদের এই বিভক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম উম্মাহ্র শিক্ষিত শ্রেণির মানুষকে দু’টি ধারায় বিভক্ত করে নৈতিকতার মানদন্ড স্বমূলে ধ্বংস করা। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য শিক্ষার চুড়ান্ত পর্যায়ে নাইট, নবাব, খান, বাহাদুরের মত আবোল তাবোল উপাধিতে ভূষিত করে এবং সরকারী চাকুরীতে সুযোগ করে দিয়ে তাদের মায়াজালে আটকিয়ে ফেলে ইংরেজ বিরোধী জিহাদ ও স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিমূখ করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। তাদের এ পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছিল তা আমারা পরিজ্ঞাত। কিন্তু এই উপমহাদেশে তাদের অনুকরণ প্রিয় কিছু নেতা স্মৃতিচারণ করে চলেছে, যা আমাদের সোনার ছেলেদের সোনালী ভবিষ্যত ধূলিসাৎ করে দিয়ে চলেছে। পরিপ্রেক্ষিতিতে লক্ষ্য করলে শিক্ষার হার গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত মান ও শিক্ষার্থীর নৈতিকতা জ্যামিতিক হারে হ্রাস পাচ্ছে। এর একটিই কারণ হ’ল আমরা বিগত বৃটিশদের রেখে যাওয়া ৭৭ বছরের পূরনো দ্বিমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা আজও অন্ধের মত অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলেছি এবং শিক্ষিত সমাজকে বিভক্ত করে তাদের চিন্তা চেতনাকে দ্বিমূখী করে ফেলেছি। এতে করে শিক্ষার মান ও শিক্ষিত সমাজ গোল্লায় যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বিগত সরকারগুলি বিভিন্ন সময়ে যেসব কমিটি গঠণ করেছেন, সেখানে দেখা গেছে সবারই মূল টার্গেট ছিল মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষাকে সংকুচিত রেখে সাধারণ শিক্ষাকে বিস্তার এবং প্রসার করার জন্য সফল পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সক্রিয়। ‘এনাম কমিটি’ ও ‘কুদরাত-ই খুদা’ রিপোর্ট এদেশে ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যার ধারাবাহিকতায় আজ আমরা সর্বক্ষেত্রে অধঃপতিত। আর আমাদের বর্তমান প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী শিক্ষার অনুকুলে নয়। কারণ বর্তমান পরীক্ষা সিলেবাসে ৮০০-১০০০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ১০০ নম্বরের বরাদ্দ ইসলামী শিক্ষা এবং বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক অনিহাবশত সবশেষে পাঠদান করে। এতে করে ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক মনযোগ থাকে না এবং স্বভাবত: এ বিষয়ের প্রতি বিরক্তিভাব পরিলক্ষিত হয়।
ইসলামী নীতি শিক্ষা ব্যতিত বিবর্জিত শিক্ষা কখনও হিতকর নয়। অথচ আধুনিক সভ্যতার প্রবক্তা তথাকথিত প্রগতিশীল শিক্ষাবিদরা শিক্ষা কারিকুলাম ও সিলেবাস থেকে ইসলামী নীতি-শিক্ষাকে বর্জন করার পক্ষপাতী। বিশেষতঃ ইসলাম শিক্ষা ও ধর্মই তাদের টার্গেট। ইসলাম বা ধর্ম শিক্ষা বর্জন করলে, নীতি-শিক্ষা তার সঙ্গে সঙ্গেই বিদায় হয়। কেননা, ইসলাম বা ধর্ম শিক্ষা ব্যতিরেকে নীতি-শিক্ষা অর্থহীন।
স্কুল মাদরাসাতে নাস্তিকতাপূর্ণ শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাথমিক তৃতীয় শ্রেণির বিজ্ঞান, পৃ: ৪ এ প্রাকৃতিক পরিবেশের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, আমাদের চারদিকে রয়েছে গাছপাল, পশুপাখি, সূর্যের আলো, মাটি, পানি ও বায়ু। এগুলো আমরা তৈরী করতে পারি না। প্রাকৃতিক উপায়ে এগুলো তৈরী হয়েছে। প্রাকৃতিক এসব উপাদান নিয়েই প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রাকৃতিক উপায়ে এগুলো তৈরী হয়েছে এর পরিবর্তে আমার ছেলে যখন তার পরীক্ষার খাতায় লিখেছেন, মহান আল্লাহর এসব তৈরী করেছেন। প্রাকৃতিক এসব উপাদান নিয়েই প্রাকৃতিক পরিবেশ। তখন তার শিক্ষিকা তাকে কোন নাম্বার দেন নাই। ঐ শিক্ষিকা এটা উপলদ্ধি করতে পারেনি যে, উক্ত সংজ্ঞার মধ্যে নাস্তিকতার গন্ধ রয়েছে। নাস্তিক মনে করে সকলকিছু এমনি এমনিতেই সৃষ্টি হয়, আর আস্তিক জানেন সকল কিছুই মহান আল্লাহর মাধ্যমে সৃজিত হয়। এক্ষুণে আমরা আমাদের এই প্রগতিশীল সমাজে আমাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জন করতে পাঠিয়ে দিয়েও নিরাপদ নয়। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর বিবেক জাগ্রত করার পরিবর্তে ধ্বংস করে ফেলছে। তাদেরকে প্রগতির নানা কুটকৌশল রপ্ত করানোর প্রচ্ষ্টোয় নিয়োজিত।
বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থার মান জ্যামিতিক হারে নিম্নমূখী। যদিও পাসের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। পাসের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হ’ল পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রাথমিক, জেএসসি/জেডিসি, মাধ্যমিক/দাখিল, উচ্চ মাধ্যমিক/আলিম, ডিগ্রি/ফাযিল, কামিলসহ সকল বোর্ডের এবং শিক্ষক নিবন্ধন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফটোকপির দোকানে পাওয়া যায়। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ডিবি পুলিশের দাবী এর জন্য দায়ী ফেসবুক, সাইবার ক্যাপ এবং ল্যাপটপ, ট্যাব, এনড্রোইড ফোন ব্যবহারকারীরা। কারণ নিমিষেই প্রশ্নপত্রসহ যাবতীয় তথ্য আদান প্রদান করতে পারে। তাহলে এটা কি প্রগতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া? না’কি আমাদের ব্যর্থতা?
আমাদেন সমাজে সহশিক্ষা একটি সমাজ বিধ্বংসী ঘাতব ব্যাধি। এটি সমাজের জন্য মহা অভিশাপ হয়ে দায়িছে। নারী-পুরুষের যৌবনের ভরা বসন্ত অতিবাহিত হয় এই সময়ে। আর এর সুবাদে অনেক তরুন-তরুনী অবাধে মেলামেশা ও অবৈধ প্রেম বিনিময় করার সুযোগ পায়। এমনকি বিভিন্ন প্রকার অবৈধ অনাচার ও আইনী পরিপন্থী ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হয়। মা-বাবর নয়নের পুতিল হয়ে যায় বখাটে, সন্ত্রাসী, মাস্তান, দাঙ্গাবাজ, প্রভৃতি ভূষণধারী। এটি একটি সামাজিক অবক্ষয়।
এছাড়াও সহশিক্ষার কুফলের দরূন নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একত্রে বসা, যুবক-যুবতী এক সাথে অর্ধনগ্ন পোশাক পরে সুইমিং পুলে সাতার কাটা, ব্যায়াম করা, গেঞ্জি-হাফপ্যান্ট পরে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা এহেন কর্মকান্ড নারীর সম্ভ্রমহানীর পথকে সুগম করে দিয়েছে। ফলে সমাজে নারী ধর্ষন, অপহরণ, খুন, অঙ্গহানী, এসিড নিক্ষেপ, উত্ত্যক্ত করা ইত্যাদি জঘন্য কর্ম সংঘটিত হচ্ছে।
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন তাদের সন্তানদের নিয়ে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার সংস্কৃতি যেভাবে দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন সুশীল সমাজ। প্রযুক্তির প্রসার ও সামাজিক যোগাযোগসহ বিভিন্ন মাধ্যমের কারণে তরুণ সমাজে খুব দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড ও দোস্ত কালচার, এমনকি তা গড়িয়ে যাচ্ছে পরোকিয়ায়। পর্নোগ্রাফির বিস্তার ও সংস্পর্শে আসার কারণে লজ্জা এবং নৈতিকতার বাঁধন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। বিপরীতে ছড়িয়ে পড়ছে লজ্জাহীনতা, খোলামেলা ও অবাধ মেলামেশার পরিবেশ। একসময় মা-বাবার উদ্বেগ ছিল ছেলেমেয়েদের মোবাইলে কথা বলা এবং এসএমএস বিনিময়ে সময় ব্যয় করা নিয়ে। কিন্তু এখন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্কাইপ, ট্যাংগো, উইচ্যাট, হটসআপ ইত্যাদি ওয়েবক্যামের কারণে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি এবং কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি অবারিত হয়েছে। পর্ণো প্রসারের ফলে এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার পরিবেশ চালু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্বেগজনক চিত্রের কথা জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীদের নিষিদ্ধ পল্লীতে যাতায়াতের খবরও বের হচ্ছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর দৌলতদিয়া নিষিদ্ধ পল্লীতে খুন হয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বছরের এক শিক্ষার্থী। রাজধানীর পুরান ঢাকায় পর্ণো ভিডিওতে অভিনয়ের সময় ধরা পড়েন দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। ইসলামী বিশ্ববিদ্যারয়ের প্রফেসরের বাসা থেকে নগ্ন অবস্থায় ছাত্রী উদ্ধার হয়। রাজধানীর এক কলেজের জৈনক ছাত্রের সাথে প্রণয়ে আশক্ত শিক্ষিকা। ইডেন কলেজের এক ছাত্রী পতিতা বৃত্তিতে লিপ্ত হওয়ায় তার পিতা তাকে দেশের বাসা শেরপুর নিয়ে যায় এবং পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু মেয়ে তার পিতার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করে। এছাড়া কয়েক দিন আগে পুরান ঢাকায় বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্রী খুন হওয়ার পর জানা যায়, নিহত ওই শিক্ষার্থী এক বয়ফ্রেন্ডের সাথে বাসা ভাড়া নিয়ে লিভটুগেদার করতেন। নিহত ছাত্রীর মা-বাবা জানতেন তিনি কলেজের হোস্টেলে থাকেন। সহশিক্ষার কুফলের প্রতিফলন হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাত ১০টা পর্যন্ত হলের বাহিরে থাকতে চায়। সেখানে জৈনক ছাত্রী বলে, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা মুরগী নয় যে তারা শিয়ালের ভয়ে হলে ঢুকে পড়বে। আমরা অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়’। এমনকি ছাত্রীরা আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তারা শ্লোগান দেন, ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন; হল কোন খোয়াড় নয়, রাত ১০টার পর ঢুকতে হবে”। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৪ নভেম্বর ২০১৪ইং রাত ১২টা সময় তিনজন ছাত্রী ও চারজন ছাত্র কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে নেশায় আসক্ত হয়ে, অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। সেই সময় প্রীতিলতা হলের এক ছাত্রী অজ্ঞান হলে তাকে ছেলেরা ধরে মেয়েটির হলে পৌছে দেয়। অথচ বিশ^বিদ্যালয়ের বিজ্ঞপ্তি রাত ১০টার মধ্যে সকল গেট বন্ধ করা হবে। সহশিক্ষার কুফল থেকে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা উচিৎ। তন্মধ্যে পর্দার বিধান মেনে চলা। কেননা মহান আল্লাহ নারীদের ভদ্র ও মার্জিতভাবে চলাফেরা করার তাক্বিদ দেয়ার পাশাপাশি অজ্ঞযুগের নির্লজ্জে মত চলাফেরা করতে বিশেষ ভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ বলেন, وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا ‘তোমরা গৃহাভ্যান্তরে অবস্থান করবে; মূর্খতার যুগের মত নিজেদের প্রদর্শন করবে না’(আহযাব- ৩৩/৩৩)। এমনকি নারীরা তাদের অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে হিজাবের সাথে ঘরের বাইরে যাবে এবং এতে করে তাদেরকে কেহ উত্ত্যক্ত করার জন্য এগিয়ে আসবেনা। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا ‘হে নবী, আপনি আপনার পতœীগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীদেরকে বলে দিন তারা যেন তাদের শরীর চাদর দ্বারা আবৃত করে রাখে। এটি তাদের চেনার সহজ উপায়। ফলে তাদেরকে উত্ত্যাক্ত করা হবে না’(আহযাব-৩৩/৫৯)।
এছাড়াও পৃথক পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুকরা অতিব জরুরী। প্রাইমারী শিক্ষা থেকে শিক্ষার সকল স্তরে সহশিক্ষা বাতিল করে আলাদা আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা। অথবা একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৃথক পৃথক শিফ্টে আলাদা শিক্ষক মন্ডলী দ্বারা পাঠ দান করা। ফলে এক দিকে পর্দার বিধান যথাযথ পালকরা হবে, অন্য দিকে শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠ ও মার্জিত হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নারী শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন এবং তাঁর সময় থেকেই পর্দার আড়ালে নারীদের জন্য পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল। আমেরিকা, রাশিয়া সহ পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বর্তমানে মেয়েদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। ১৯৭৮ সালের হিসেব মতে, সহশিক্ষার কুফলের ভয়াবহতা বিবেচনা করে আমেরিকাতে ১৭০টি এবং রাশিয়াতে ১২০টি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সম্প্রতি মালেশিয়াতে যৌন হয়রানি থেকে রক্ষাকল্পে মহিলাদের জন্য পৃথক ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। কর্মক্ষেত্রেও ছেলে ও মেয়েদের পৃথক কর্মক্ষেত্র ও কর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণ করা উচিৎ। এতে তারা মানসিক চাপমুক্ত পরিবেশ জাতীয় উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। সৎ বন্ধু গ্রহণ ও অসৎ বন্ধু ত্যাগ করতে হবে। একটি ভালো বন্ধু, জীবনের একটি অমূল্য সম্পদ। কোন ব্যক্তিকে জানতে ও বুঝতে চাইলে তার বন্ধুমহল কেমন তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সৎ বন্ধু দ্বারা সামান্যতম হলেও ভালো কিছু আসা করা যায়। এমনকি যদি তার অজান্তে কোন ক্ষতিগ্রস্থতার শিকার হয়, পক্ষান্তরে সে বন্ধু ব্যথিত হয়ে তার সমাধান করার চেষ্টা করে, শান্তনা দেয়। তাই সৎ বন্ধুদের আর সত্যবাদী সাথীদের সাথে থাকার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُواْ مَعَ الصَّادِقِيْنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)। কিন্তু অসৎ বন্ধুর নিকট থেকে সামান্যতম হলেও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ভালো বন্ধু ও অসৎ বন্ধু সঙ্গ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেছেন, (আরবী) ‘সৎ সঙ্গ ও অসৎ সঙ্গের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুগন্ধি বিক্রেতা ও কামারের হাপারে ফুঁকদানকারীর মত। সুগন্ধি বিক্রেতা হয়ত তোমাকে এমনিতেই কিছু দিয়ে দিবে, অথবা ক্রয় করবে, অথবা সুঘ্রাণ গ্রহণ করবে। আর কামারের হাপারে ফঁকদানকারী হয় তোমার কাপড় জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিবে নতুবা তার দুর্গন্ধ ও ছায় তো তুমি অর্জন করবেই। তিনি আরো বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় এবং সর্বাপেক্ষা নিকটতর আসনের অধিকারী হবে ঐ সব লোক, যাদের চরিত্র সুন্দর’। আজকাল দেখা যায় ‘পড়ালেখা’ করার উসীলা দিয়ে অনেক শিক্ষার্থীই বন্ধু ছালাত ছিয়াম পালনে অমনোযোগী। তারা পড়ালেখা করতে গিয়ে ছালাত আদায় করার সময় পায়না, ছিয়াম পলনের শক্তি পায়না, আর এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, বিদ্যা অর্জন করা ফরয, আমরা ফরয পালন করছি। কিন্তু তিনি কোন জ্ঞানের কথা বলেছেন? নিউটনের সূত্র? ক্যালকুলাস? ডেবিট ক্রেডিট কিংবা সুদের হিসাব নিকাশ?
অন্যান্য জ্ঞানও অর্জন করা উচিত কিন্তু বর্তমানে আমরা অন্যান্য সব তুচ্ছ জ্ঞান, যেগুলোর পরকালে কোন মূল্য নেই সেগুলো অর্জনকেই ফরয বানিয়ে ফেলেছি। যারা জ্ঞান অর্জন ফরয বলেন তাদেরই ইসলাম সম্পর্কিত জ্ঞান শূণ্য। প্রকৃতপক্ষে আমাদের যুবসমাজের ৯০% এর উপরে ইসলাম সম্পর্কে অশিক্ষিত। তারা বস্তুবাদী জ্ঞান অর্জনে এতোটাই ব্যস্ত যে কুরআন ও ছহীহ হাদীছগুলো ছুঁয়ে দেখার মত অবকাশ নেই বা মন চায়না। আর এরই ঘাটতি পূরণের জন্য অনেকে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চাচ্ছেন। তাই তারা বিদআতী হুজুর, মাজার ও পীরের পূজারীদের নিকটে শর্টকাট ইসলাম শিক্ষা গ্রহণে ব্যতিব্যস্ত। এর মানে হ’ল অন্ধ ব্যক্তির নিকটে পথের সন্ধান চাওয়ার নামান্তর বৈ কিছু নয়।
ইসলামী শিক্ষার অর্জন করা অতীব জরুরী। সকল বিদ্যার্জন প্রকৃত ইলম (জ্ঞান) অর্জন বলে না। যদিও জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয। এ শিক্ষা অবশ্যই ধর্মভিত্তিক ও নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষা হ‘তে হবে। সুশিক্ষা যেমন জাতিকে উন্নতি ও ইহকালীন-পরকালীন সাফল্যের চরম শিখরে পৌছাতে সাহায্য করে, তেমনি অশিক্ষা-কুশিক্ষা ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্থতায় নিপতিত করে। শিক্ষা জাতীর মেরুদন্ড। কথাটি অতিব সত্য, তবে সুশিক্ষাই জাতীর মেরুদন্ড। একজন ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষিত হতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ইসলামীক জ্ঞান অর্জনও ইসলামী দর্শনে পারদর্শী না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে সুশিক্ষত বা স্ব-শিক্ষিত হতে পারবে না। প্রত্যেকটি সৃষ্টির যেমন মূল রয়েছে, শিক্ষার মূল হ’ল কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। কেননা, জ্ঞানের প্রকৃত উৎস হ’ল আল্-কুরআন ও সুন্নাহ্। এ দু’টি বস্তুর বিদ্যার্জন ব্যতিত কোন শিক্ষিত পন্ডিত বা উচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তির মূল জ্ঞান অপূর্ণাঙ্গ অসম্পূর্ণ। বর্তমানে জাগতিক তথ্যভিত্তিক জ্ঞান প্রতিদিন বৃদ্ধি পাওয়া সত্বেও মানুষের মূল্যবোধ ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। এর কারণ, যে হারে তথ্যভিত্তিক পন্ডিত ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে নৈতিক মানভিত্তিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বিধায় মানুয়ের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশী হচ্ছে। আর এজন্যই নৈতিকমান ভিত্তিক জ্ঞানার্জনের আজ অতিব যরূরী। ইসলামী শিক্ষা মানুষের সুষম উন্নয়ন সাধিত করে। ইংরেজ কবি John Milton বলেছেন, Education is the harmonious development of body,
mind & soul. . অর্থাৎ ‘শিক্ষা হ’ল দেহ, মন ও আত্মার সুষম উন্নয়ন’। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বেশ কিছু শর্ত পূরণে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দলে দলে গড়ে উঠেছে নৈতিকহীন, স্বার্থবাদী ডিগ্রিধারী পন্ডিত। অথচ মহান আল্লাহ্ বলেন,(আরবী) ‘বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? উপদেশ গ্রহণ শুধু তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান’(যুমার-৯)।
ইসলামী জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘জ্ঞান যদি তোমার দেহের জন্য বৃদ্ধি হয়, তবে এ জ্ঞান হচ্ছে এক বিষধর স্বর্প। আর জ্ঞান যদি তোমার আত্মার মুক্তির জন্য নিবেদিত হয়, তবে এ জ্ঞান হবে তোমার পরম বন্ধু ও চরম গর্ব’। তিনি আরো বলেন’ ‘জ্ঞান বলতে আমি ইন্দ্রিয়ানুভূতি ভিত্তিক জ্ঞানকেই বুঝি। জ্ঞান প্রদান করে শক্তি, আর এ শক্তি ধর্মের অধীনে হওয়া উচিত। কারণ তা যদি ধর্মের অধীনে না হয়, তবে তা হবে নির্ভেজাল পৈশাচিক’। ইসলামী শিক্ষার আবশ্যকতা সম্পর্কে ঐতিহাসিক
Stanly Hall বলেছেন,
If you teach your children the three R’s (Reading,
Writing & Arithmetic) and leave the fourth R (Religion). You will get a
fifth R (Rascality).. অর্থাৎ তোমরা যদি তোমাদের সন্তানের লেখা পড়া এবং মাত্র অংক শিক্ষা দাও কিন্তু ধর্মকে বাদ দাও, তাহ’লে তাদের কাছে তোমরা বর্বরতা পাবে’।
আদর্শ বর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান সমাজে কি সর্বনাশ ডেকে এনেছে এসম্পর্কে প্রফেসর হ্যারল্ড এইচ টিটাস বলেছেন, ‘সাধারণ জ্ঞান ভান্ডারের অবাবের চেয়েও অধিকতর মারাত্মক হচ্ছে সাধারণ আদর্শ এবং প্রত্যয়ের অনুপস্থি। শিক্ষা সত্যাপন, দৃঢ় বিশ্বাস ও নিয়মানুবর্তিতা শিখাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধ এবং বাধ্যবাধকতা থেকে বিজ্ঞান ও গবেষণা বিপজ্জনক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।…শিক্ষা অতীতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে এবং তদস্থলে বিকল্প মূল্যবোধ প্রদান করতেও ব্যর্থ হয়েছে। পরিণামে শিক্ষিত লোকেরাও আজ বিশ্বাস বঞ্চিত মূল্যবোধ বিবর্জিত এবং বঞ্চিত একটি সুসংহত বিশ্ব দর্শন থেকে’ ।
পরিশেষে, শিক্ষা গ্রহণে বিদ্যা অর্জিত হয়। কিন্তু বিদ্যা হিতকর ও অহিতকর দু’প্রকারেরই হ’তে পারে। অনেক প্রকারের বিদ্যা রয়েছে, কিন্তু সকল বিদ্যাই হিতকর বা উপকারী নয়। যে সকল বিদ্যা মানুষকে সরল পথে চলতে, নির্ভূল মত গ্রহণে ও সঠিক সমাধানে পৌঁছাতে সক্ষম করে তা হিতকর এবং অবশ্যই তা যথার্থ। পক্ষান্তরে যে বিদ্যা মানুষকে চৌর্যবৃত্তি, দস্যুতা, প্রতারণা ইত্যাদি বিদ্যা হতে পারে, কিন্তু তা হিতকর নয় এবং সমর্থনযোগ্য বিদ্যা হতে পারে না। বরং তা মানব জীবন ও সমাজের জন্য চরম ক্ষতিকর। যে বিদ্যা দ্বারা চরিত্র গঠণের পরিবর্তে চরিত্রের স্খলন ঘটে তা অবশ্যই অহিতকর। আর বিদ্যার্জনের দ্বারা অবশ্যই চারিত্রিক উৎকর্ষতা সাধিত হতে হবে। যদি তা না ঘটে তাহ’লে বুঝতে হবে, শিক্ষা গ্রহণের সকল পদ্ধতি অকেজ ও বিফলে গেছে। অতএব, আসুন মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতঃ মানব সমাজে তা বাস্তবায়ন করার ত্বাওফিক্ব দান করুন। আমিন!!!
——————————————————-
১. মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, শিক্ষার সুফল ও কুফল, (আত-তাহরীক, ১৩তম বর্ষ, ২য় সংখ্যা-নভেম্বর-২০০৯) পৃঃ-১৭।
২. ইবনু মাযাহ হা/২২৪;(কিন্তু বায়হাকীর সনদ যঈফ)। -আলবানী, মিশকাত হা২১৮, হাদীছ ছহীহ ‘ইলম’ অধ্যায়।
৩.ডঃ এ.কে.এম ওবায়েদ উল্লাহ, শিক্ষানীতি, ১ম সেমিষ্টার (রাইড, ঢাকাঃ জুলাই-১৯৮৬) পৃঃ-১৪।
৪. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫।
৫. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫।
৬. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬।
৭. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬।
৮. আহমাদ শরীফ, ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, আত-তাহরীক (২য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যা-১৯৯৯) পৃঃ ২১।
৯. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, শিক্ষা ব্যবস্থায় ধসঃ কিছু পরামর্শ, মাসিক আত-তাহরীক (৭ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা-২০০৪), পৃঃ ৩।
১০. শিক্ষা ব্যবস্থায় ধসঃ কিছু পরামর্শ, মাসিক আত-তাহরীক (৭ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা-২০০৪), পৃঃ ৩।
১১.মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদুদ, ইসলাম ও আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা, আত-তাহরীক, (২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা-১৯৯৮), পৃঃ ১২।
১২. শিক্ষার সুফল ও কুফল, (আত-তাহরীক, ১৩তম বর্ষ, ২য় সংখ্যা-নভেম্বর-২০০৯) পৃঃ-১৭।
১৩. বুখারী, ফাৎহুল বারীসহ, (বৈরুত: দারুল মা‘আরিফ) ১/২০৪।
১৪. হারুনুর রশীদ, ইভটিজিং: কারণ ও প্রতিকার, আত-তাহরীক, (১৩তম বর্ষ, ৯ম সংখ্যা-২০১০) পৃঃ ১৪।
১৫. শিক্ষা ব্যবস্থায় ধসঃ কিছু পরামর্শ, মাসিক আত-তাহরীক (৭ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা-২০০৪), পৃঃ ৬।
১৬. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৩৪; (কিতাবুয যাবায়িহ ওয়াছ ছায়দ, বাবুল শিসক)।
১৭. বুখারী, মিশকাত হা/৫০৭৪ (‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘নম্রতা’ লজ্জা ও উত্তম চরিত্র’ অনুচ্ছেদ)।
১৮. ডাঃ ফারূক বিন আব্দুল্লাহ, শিক্ষা প্রসঙ্গে কিছু কথা, মাসিক আত-তাহরীক,(৬ষ্ঠ বর্ষ, ৮ম সংখ্যা-মে ২০০৩), পৃঃ ১২।