ঈমানহীন মানুষের যুগ আসন্ন

ঈমান মুমিন ব্যক্তির জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই ঈমানহীনতা মুমিনের জন্য মরণতুল্য বিষয় হতে পারে। অথচ সমাজে অধিকাংশ মানুষ ঈমান ও সৎ আমলহীন হয়ে যাচ্ছে প্রায়। কারণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের ভ্রান্ত আদর্শ বুকে ধারন করা, হারাম পথে আয় করে তা ভালো ও মন্দ পথে ব্যয় করা, মানুষের পেছনে ছিদ্রান্বেষণ করা এবং গীবত-তহমতে ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি।

আমাদের প্রথমে জানা প্রয়োজন কী কী কারণে ঈমান দুর্বল ও নষ্ট হয়। যদিও ঈমানের দ্বীপ্ততার ক্ষীণতা ও উজ্জ্বলতা বা কম বেশী হতে থাকে। আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও স্মরণে বৃদ্ধি পায় এবং মন্দ আমলের মাধ্যমে তার তীক্ষ্ণতা ক্ষীণ হয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,‘প্রত্যেক মুমিনকে তার আমল পরিমাণে নূর দেয়া হবে। ফলে কারও নূর পর্বতসম, কারও খর্জুর বৃক্ষসম এবং কারও মানবদেহসম হবে। সর্বাপেক্ষা কম নূর সেই ব্যক্তির হবে, যার কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলিতে নূর থাকবে; তাও আবার কখনও জ্বলে উঠবে এবং কখনও নিভে যাবে’ (ইবনে কাসীর)।

ঈমান ভঙ্গের কারণগুলো মূলত তিন প্রকার: বিশ্বাসগত, কর্মগত ও উক্তিগত। এই কারণগুলো একজন ব্যক্তির ঈমানকে দুর্বল করে দিতে পারে বা সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে দেয়।

ক. বিশ্বাসগত কারণ :

ঈমান বা বিশ্বাসগত কারণের মধ্যে প্রধান কারণ হলো- আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা (শিরক), আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা, বা আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করা। এছাড়া, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসে ঘাটতি থাকা, পরকাল ও তাক্বদীরের প্রতি অবিশ্বাস ইত্যাদি ঈমান ভঙ্গের কারণ।

 ঈমান ভঙ্গের প্রথম ও প্রধান কারণ হলো শিরক করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ ‘নিশ্চয়ই যে আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার আবাসস্থল হয় জাহান্নাম। আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (মায়েদাহ ৭২)। অন্যত্র বলেন,  إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا ‘নিশ্চয় আল্লাহ তার সঙ্গে অংশীদার করা ক্ষমা করেন না। তা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; এবং যে কেউ আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে সে এক মহাপাপ করে।’ (নিসা ৪৮) তিনি আরো বলেন, وَلاَ تَجْعَلْ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ فَتُلْقَى فِيْ جَهَنَّمَ مَلُوْمًا مَدْحُوْرًا ‘আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির কর না। তাহ’লে নিন্দিত ও (আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে) বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’ (বানী ইসরাঈল ৩৯)।

ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ مَاتَ وَهْوَ يَدْعُو مِنْ دُوْنِ اللهِ نِدًّا دَخَلَ النَّارَ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’(বুখারী হা/৪৪৯৭)। কারণ শিরককারী ব্যক্তি ঈমানের কোন অংশ অবশিষ্ট থাকে না। আর ঈমানহীন ব্যক্তি সরাসরি জাহান্না, প্রবেশ করবে।

খ. কর্মগত কারণ :

আমল বা কর্মগত কারণের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর ইবাদতে অবহেলা করা, গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া এবং সৎকাজ থেকে বিরত থাকা বা সৎ কাজে বাঁধা প্রদান করা। ইবাদত কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আনকাবূত ১৭)। আল্লাহ পাক আরো বলেন, وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُوْ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَنْ لاَّ يَسْتَجِيْبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُوْنَ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে এমন বস্ত্তর পূঁজা করে, যে ক্বিয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? তারাতো তাদের পূঁজা সম্পর্কেও বেখবর’ (আহকাফ ৫)। কোন কিছু চাইতে হ’লে কেবল আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ ‘যখন তুমি কোন কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই করবে’(তিরমিযী হা/২৫১৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৯৫৭)।

আল্লাহ তা‘আলা নবী করীম (ছাঃ)-কেও শিরক থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বললেন এভাবে, لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘যদি তুমি শিরক কর, তবে তোমার সমস্ত আমল অবশ্যই বাতিল হয়ে যাবে এবং নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৬৫)।

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِىْ غَيْرِىْ تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ ‘যে ব্যক্তি এমন আমল করে যে আমলে আমার সাথে অন্যকে শরীক করেছে, এমন আমল ও যাকে সে শরীক স্থাপন করেছে, আমি উভয়ই প্রত্যাখ্যান করি (মুসলিম হা/৭৬৬৬; মিশকাত হা/৫৩১৫)।

যে ব্যক্তি কোন কাজ করবে এবং তাতে আমার সন্তুষ্টির পাশাপাশি অন্য কোন মাখলুকের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করবে তাহলে আমি তাকে আমার রহমতের দৃষ্টি থেকে পরিত্যাগ করব এবং তা শিরকযুক্ত ‘আমলকে কবুল করা থেকে বর্জন করব। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

গ. উক্তিগত কারণ :

মানুষের কথা বা উক্তির মাধ্যমে রয়েছে আল্লাহর প্রতি কুফরী বা অস্বীকৃতি। যথা- কুফরী কথা বলা, অথবা ইসলামের বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা, দ্বীনের বিষয়াবলীকে তুচ্ছজ্ঞান করা ইত্যাদি। উক্তি গত কারণে যারা ঈমানহীন হয়ে পড়েন তাদের মধ্যে অন্যতম মুনাফিক্ব। আল্লাহ রাববুল আলামীন উল্লেখ করেন, وَإِذَا لَقُوا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قَالُوْا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِيْنِهِمْ قَالُوْا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ ‘আর তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশে, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি, আমরাতো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্র’ (বাক্বারাহ ২/১৪)। অন্যত্র তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا لاَ تَتَّخِذُوا الَّذِيْنَ اتَّخَذُوْا دِيْنَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِنَ الَّذِيْنَ أُوتُوْا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاءَ وَاتَّقُوْا اللهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ، وَإِذَا نَادَيْتُمْ إِلَى الصَّلاَةِ اتَّخَذُوْهَا هُزُوًا وَلَعِبًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لاَ يَعْقِلُوْنَ-  ‘হে মুমিনগণ! আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হও। আর যখন তোমরা ছালাতের জন্য আহবান কর, তখন তারা একে উপহাস ও খেলা মনে করে। কারণ তারা নির্বোধ’ (মায়েদাহ ৫৭-৫৮)।

মুনাফিক্বরা আল্লাহর আয়াত নিয়ে বিদ্রূপ করত। মু’মিনদের সাথে ঠাট্টা-ব্যঙ্গ করত। এমনকি রসূল (সাঃ) সম্বন্ধেও অসভ্য কথা বলা হতেও বিরত থাকত না।  আল্লাহ বলেন, قُلْ أَبِاللهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُوْلِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُوْنَ، لاَ تَعْتَذِرُوْا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيْمَانِكُمْ ‘আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সাথে তাঁর হুকুম-আহকামের সাথে এবং তাঁর রাসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? ছলনা কর না, ঈমান আনার পর তোমরা যে কাফির হয়ে গেছ’ (তওবা ৬৫-৬৬)।

ঘ. মানহীন যুগের আগমন :

পৃথিবীতে মানুষে মানুষে পার্থক্যের মানদণ্ড হ’ল ঈমান। যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী, তারা ইহকাল ও পরকালে সফল। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহতে অবিশ্বাসী, তারা ইহকাল ও পরকালে বিফল। ঈমানদারের সকল কাজ হয় আখিরাতমুখী। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীদের সকল কাজ হয় প্রবৃত্তিমুখী। দু’জনের জীবনধারা হয় সম্পূর্ণ পৃথক।

.ঈমান এমন একটি অদৃশ্য নূর যার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। যেমন আল্লাহর বাণী,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ- ‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)। অন্যত্র তিনি বলেন, هُوَ الَّذِيْ أَنْزَلَ السَّكِيْنَةَ فِيْ قُلُوْبِ الْمُؤْمِنِيْنَ لِيَزْدَادُوْا إِيْمَانًا مَعَ إِيْمَانِهِمْ ‘তিনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন, যাতে তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বেড়ে যায়’ (ফাতহ ৪৮/৪)।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইলম উঠে যাবে অর্থাৎ- ‘আমল না করাকে সমাজ থেকে ‘ইলম চলে যাওয়া ও পৃথিবীতে মূর্খতা প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ- কোন ইলম তথা কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান বা কথা জানার পর সে অনুযায়ী ‘আমল না করা সে বিদ্যা না জানা বা মূর্খতারই নামান্তর। অতএব একজন মূর্খ ব্যক্তি ও শিক্ষিত ‘আমলহীন ব্যক্তি উভয়ই সমান, পর্যায়ক্রমে শিক্ষিত ‘আমলহীন ব্যক্তি বোঝা বহনকারী গাধা। হাদীসটি মানুষকে ‘আমলের প্রতি উৎসাহিত ও সতর্ক করছে।

এছাড়াও ‘ইলম, ফারায়িয ও কুরআন শিক্ষার ব্যাপারে ও তা মানুষকে শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে নির্দেশ করছে এবং এতে অদূর ভবিষ্যতে ‘ইলম উঠিয়ে নেয়া, ফিতনাহ্ (ফিতনা) প্রকাশ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এমনকি কোন একটি ফরয বিষয় নিয়ে দু’ ব্যক্তি মতানৈক্যে পতিত হবে কিন্তু তারা এমন কাউকে পাবে না যে, তাদের দু’জনের মাঝে মীমাংসা করে দিবে। আর তা বিদ্যার কমতি বা ফিতনার আধিক্যের কারণে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ الصَّابِرُ فِيهِمْ عَلَى دِينِهِ كَالْقَابِضِ عَلَى الْجَمْرِ ‘মানুষের উপর এমন একটি যুগের আগমন ঘটবে যখন তার পক্ষে ধর্মের উপর ধৈর্য ধারণ করে থাকাটা জ্বলন্ত অঙ্গার মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা ব্যক্তির মতো কঠিন হবে’( . তিরমিযী হা/২২৬০)।

.’আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শীঘ্রই মানুষের ওপর এমন এক যুগ আসবে, যখন শুধু নাম ব্যতীত ইসলামের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, সেদিন কুরআনের অক্ষরই শুধু অবশিষ্ট থাকবে। তাদের মাসজিদগুলো তো বাহ্যিকভাবে আবাদ হতে থাকবে, কিন্তু হিদায়াতশূন্য থাকবে। তাদের ’আলিমগণ হবে আকাশের নীচে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোক, তাদের নিকট হতেই (দীনের) ফিতনাহ্-ফাসাদ সৃষ্টি হবে। অতঃপর এ ফিতনাহ্ (ফিতনা) তাদের দিকেই ফিরে আসবে। (হাদীসের মান খুবই দুর্বল : শু‘আবুল ঈমান হা/১৯০৮, য‘ঈফাহ্ হা/১৯৩৬। কারণ এর সানাদে বিশর ইবনু ওয়ালীদ আল ক্বাযী নামে একজন দুর্বল রাবী রয়েছে যার বার্ধক্যজনিত বুদ্ধিভ্রষ্টতা ছিল)।

হাদীসটি অনুরূপভাবে ইমাম হাকিম-এর তারীখে ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। দায়লামী মু‘আয এবং আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকেও বর্ণনা করেছেন। হাদীস থেকে বুঝা যায়, ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি হবে যে, ইসলামের নাম যেমন সালাত, সিয়াম, হাজ্জ, যাকাত ছাড়া ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও প্রকৃত সালাত সিয়াম, হাজ্জ, যাকাত কিছুই থাকবে না এবং কুরআনের লেখা ছাড়া তার ওপর মানুষের ‘আমল থাকবে না, মাসজিদসমূহ উঁচু দালান ও কারুকার্য খচিত প্রাচীর দ্বারা বাহ্যিক দৃষ্টিতে আবাদ হবে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হবে হিদায়াতশূন্য। ‘আলিমদের দ্বারা ফিতনাহ্ শুরু হয়ে তার মন্দ পরিণতি তাদের দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে।

ঙ. ঈমানহীন যুগের মানুষ যেমন হবে :

ঈমান মুসলিমের মূল সম্পদ হলেও এর যত্ন করে না অধিকাংশ মানুষ। মানুষ ঈমান হারা হতে রাজি কিন্তু দুনিয়া ছাড়তে রাজি নয়। মানুষ বড়ই আযব প্রাণী। দ্বীনের চেয়ে দুনিয়াকে বড় করে দেখে, সম্মানের চেয়ে সম্পদকে প্রধান্য দেয়। আর এটা করে কেবল মাত্র মুমিন ব্যতীত নির্বোধ মানুষরা। তাই তো মানুষের অন্তরে ঈমানের নূরের চেয়ে অন্ধকার বেশী।

১. দ্বীন শূন্য ক্বলব চিটার মত হবে :

দুনিয়া থেকে ভালো মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত আলেম সমাজ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে চলেছে। মানুষের  দ্বীনদারিত্ব প্রায় শূন্য হতে চলেছে। ঈমান ও আমলের দিক দিয়ে মানুষের ক্বলব ফসলের চিটার মত হয়ে পড়ছে। কারণ মিথ্যা ও হারাম অর্জনে আমলের কবূলিয়াত বিনষ্ট হচ্ছে। মিরদাস আল আসলামী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ভালো ও সৎ লোকেরা (পর্যায়ক্রমে) একের পর এক চলে যাবে। অতঃপর অবশিষ্টরা যব অথবা খেজুরের নিকৃষ্ট চিটার মতো থেকে যাবে। আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি কোন গুরুত্ব দিবেন না। (বুখারী হা/৬৪৩৪, সহীহুল জামি হা/৮০৭৮, সিলসিলাতুস সহীহাহ্ হা/২৯৯৩)
নেককার বান্দারা একের পর এক মৃত্যুবরণ করবে। নিকৃষ্ট বা নিম্নমানের লোকেরা অবশিষ্ট থাকবে। আল্লাহ তা’আলা তাদের কোন পরোয়াই করবেন না। তাদের মর্যাদাকে বাড়িয়েও দিবেন না এবং তাদের ‘আমলকে ওজনও করবেন না। (ফাতহুল বারী ১১/৬৪৩৪, মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।

২. দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাত বিক্রি করবে :

দুনিয়ার মানুষ দ্বীনকে দুনিয়ার সামান্যতম হারাম সম্পদের বিনিময়ে বিক্রি করে ফেলবে এবং আমলে তথা আল্লাহর স্মরণে ও ইবাদতে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। আর এটা প্রচলিত পদ্ধতিতে চলতে থাকবে, অর্থাৎ- দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাতের যত্ন কমিয়ে দিবে এবং এভাবে ধীরে ধীরে ঈমানহীন হয়ে পড়বে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,মানুষ দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে তার দ্বীনকে বিক্রি করে দিবে’’(ছহীহুল জামি‘ হা/৫১২৫)। অথচ আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়া বিক্রয় করা উচিৎ (নিসা ৪/৭৪)। আর মুনাফিক্ব ও কাফের দুনিয়ার সামান্য মালের বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করে থাকে (ইবনে কাছীর)।

কিন্তু বাস্তবে এদের পরিচয় হ’ল যারা সূদের লেন-দেন করে, ঘুষ বা উৎকোচ দ্বারা কার্যসিদ্ধি করে, অন্যের মাল নিজের মনে করে আত্মসাৎ করে, পিতা-মাতা সন্তানের মধ্যে সম্পদের সুষমো বণ্টণ করে না, ভাই বোনের অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে, প্রতিবেশীর প্রতি যুলুম, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করছে, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার ভিডিও, ফেসবুক রীল, ইনস্ট্রাগ্রাম ভিডিও থেকে যে টাকা উপার্জন করছে, মজুদদারী করে ভোক্তাদের কষ্ট দেয়া, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা অধঃস্তন কর্মচারীর প্রতি যুলুম, সার্টিফিকেট জাল করে কিংবা জন্ম তারিখ কমিয়ে বা বাড়িয়ে অথবা মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকুরীতে উপাজর্ন করে, সর্বত্র খাবারে ভেজাল মিশিয়ে ধোঁকা দিয়ে যে সম্পদ উপার্জন করা হচ্ছে প্রভৃতি ভাবে ছলচাতুরী করে আয়ের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে, যদিও তা আল্লাহর নিকটে অতিব তুচ্ছ। তাই এগুলোকে সামান্য সম্পদ বলা হয়েছে। ‘আমার চোখে সবচেয়ে হতবুদ্ধি সেই ব্যক্তির, যে সন্তানের সুখের জন্য নিজে হারাম উপার্যন করে এবং অন্যের হক্ব নষ্ট করে’। আর এই সকল ব্যক্তিরা মসজিদে গিয়ে ভীড় করে ইবাদতে মশগুল হবে যা হবে ঈমানহীন ইবাদত।

৩. খেয়ানতকারী মানুষ বেড়ে যাবে :

মানুষ দিনে দিনে মিথ্যের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং আমানতদারীতা, ন্যায্যতা, সঠিক ওযন দ্রেয়া বিলুপ্ত হবে।এমনকি ব্যাভিচার, খুন খারাপি বেড়ে যাবে।মুসলমানের অন্তরে জিহাদের জজবা কমে গিয়ে অন্তরে শথ্রুর ভয় প্রবেশ করবে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে সম্প্রদায়ের মধ্যে খিয়ানত বা আত্মসাতের রোগ ঢুকে, আল্লাহ তা’আলা তাদের অন্তরে শত্রুর ভয় ঢেলে দেন। যে সম্প্রদায়ের মধ্যে যিনা ব্যভিচার বিস্তার লাভ করে তাদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যে সম্প্রদায় মাপে-ওযনে কম দেয়, তাদের রিযিক উঠিয়ে নেয়া হয়। যে সম্প্রদায় বিচারে ন্যায়নীতি রক্ষা করে না, তাদের মাঝে খুনাখুনি ব্যাপক হয়। আর যে সম্প্রদায় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তাদের ওপর শত্রুকে চেপে দেয়া হয়। (মালিক হা/১৬৭০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ হা/১০৬-১০৭, মিশকাত হা/৫৩৭০)।

আর যখন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে যিনা-ব্যভিচার বৃদ্ধি পাবে তখন তাদের মধ্যে মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে যাবে। তথা তারা বিভিন্ন রোগ, মহামারিতে মারা যাবে অথবা অন্তর মরে যাবে অথবা ‘আলিম সম্প্রদায়ের মৃত্যু হবে। এবং যখন কোন সম্প্রদায় মাপে, ওযনে বা সংখ্যায় ধোঁকাবাজি করবে বা প্রতারণা করবে, তখন তাদের হালালভাবে উপার্জিত সম্পদের বরকত নষ্ট হয়ে যাবে। আর যখন কোন সম্প্রদায় অন্যায়ভাবে বা অজ্ঞতাবশত ফায়সালা করবে, তখন তাদের মধ্যে রক্তপাত বা হত্যা বৃদ্ধি পাবে। আর যখন কোন সম্প্রদায় প্রাধান্য বিস্তারের আশায় ওয়াদা ভঙ্গ করবে, তখন আল্লাহ তা’আলা তাদের ওপর শত্রুদেরকে ক্ষমতা প্রদান করবেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।

৪. মানুষ দুনিয়াকে ভালবাসবে :

মানুষ দিনে দিনে দুনিয়ার প্রতি এমন ভাবে  আকৃষ্ট হবে যে সে মৃত্যে বরণ করতে অপসন্দ করবে। মানুষের অন্তর থেকে দ্বীনের প্রতি ভালবাসা উঠে যাবে এবং দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে।সাওবান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: অদূর ভবিষ্যতে তোমাদের বিরুদ্ধে (ইসলামবিদ্বেষী) অন্যান্য সম্প্রদায় একে অন্যকে আহ্বান করবে, যেরূপ খাবার পাত্রের প্রতি ভক্ষণকারী অন্যান্যদেরকে ডেকে থাকে। বর্ণনাকারী বলেন, এটা শুনে সাহাবীদের কেউ বললেন, তা কি এজন্য হবে যে, আমরা সেই সময় সংখ্যায় অল্প হব? তিনি (সা.) বললেন, বরং তখন তোমরা সংখ্যায় অনেক বেশি হবে, কিন্তু তোমাদের অবস্থা হবে স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তোমাদের হৃদয়ে ’ওয়াহন’ সৃষ্টি করে দেবেন। তখন কোন একজন প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রসূল! ’ওয়াহন কি? তিনি (সা.) বললেন, দুনিয়ার ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা (বাঁচার লোভ)। (আবূ দাউদ হা/৪২৯৭, সিলসিলাতুস সহীহাহ্ হা/৯৫৮, সহীহুল জামি’ হা/৮১৮৩)।

 অচিরেই কাফির ও বাতিল সম্প্রদায় তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তোমাদের শক্তিকে খর্ব করে তোমাদের অধিনস্থ ঘরবাড়ি ও সম্পদ দখল করার জন্য তোমাদের বিরুদ্ধে একে অপরকে আহ্বান করবে।  যেমনিভাবে খাদ্য গ্রহণকারী ব্যক্তিরা একে অপরকে খাদ্যের প্লেটে ডাকে। অর্থাৎ যেমনিভাবে খাদ্যগ্রহণকারী তার প্লেট থেকে বিনা কষ্টে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে তারা তোমাদের অধিনস্থ ধন-সম্পদ বিনা বাধায় গ্রহণ করবে। বরং তোমরা বন্যার পানিতে ভেসে আসা আবর্জনার মতো অনেক থাকবে, কিন্তু তোমাদের কোন শক্তি ও সাহস থাকবে না। তাই তোমাদেরকে বন্যার আবর্জনা ও খড়কুটার সাথে তুলনা দেয়া হয়েছে। (‘আওনুল মা’বুদ ৭/৪২৯০, মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

৫. প্রচুর্যতা ও বিলাসিতায় নিমগ্ন থাকবে :

দুনিয়াতে সুখ-স্বাচ্ছন্দ এমন ভাবে বৃদ্ধি পাবে যে, মানুষ দ্বীনের প্রতি অনিহা প্রকাশ করবে এবং সাজ-সোজ্জা, খানা-পিনা, আবাসন নিয়ে ব্যতি ব্যস্ত থাকবে।

মুহাম্মাদ ইবনু কা’ব আল কুরাযী (রহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে সে ব্যক্তিই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন যিনি ’আলী (রাঃ) হতে শ্রবণ করেছেন, তিনি বলেছেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে মসজিদে বসা ছিলাম। এমন সময় মুস্’আব ইবনু উমায়র (রাঃ) এমন অবস্থায় সেখানে এসে উপস্থিত হলেন যে, তাঁর চাদরে চামড়ার তালি লাগানো ছিল। তাঁকে দেখে রাসূলুল্লাহ (সা.) কেঁদে দিলেন। (অতীতে) তিনি কতই না সুখ-সাচ্ছন্দে ছিলেন, অথচ আজ তার এ অবস্থা। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ঐ সময় তোমাদের অবস্থা কেমন হবে? যখন তোমরা সকালে এক জোড়া পরিধান এবং বিকালে আরেক জোড়া পরিধান করে বের হবে। আর তোমাদের সম্মুখে রাখা হবে (পৃথক পৃথক প্রকারের) খানার পেয়ালা এবং তা তুলে নিয়ে রাখা হবে সে স্থলে আরেক পেয়ালা। আর তোমরা ঘরকে এমনভাবে পর্দা দ্বারা আচ্ছাদিত করবে, যেভাবে আচ্ছাদিত করা হয় কা’বা ঘরকে। তখন সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! সেদিন আমরা আজকের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থায় থাকব। কেননা তখন আমাদের খাওয়া-পরার দুশ্চিন্তা থাকবে না। ফলশ্রুতিতে আমরা অধিক সময় আল্লাহর ইবাদতের জন্য অবসর ও সুযোগ পাব। নবী (সা.) বললেন, তোমাদের এ আন্দাজ সঠিক নয়, বরং তোমরা সেদিন অপেক্ষা এখনকার সময়ই ভালো আছ। (তিরমিযী হা/২৪৭৬, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ হা/২৩৮৪, হাসান হাদীছ)।

 মুস’আব ইবনু উমায়র (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের। তিনি প্রথমে যারা আবিসিনিয়ার হিজরত করেছিলেন তাদের সাথে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। অতঃপর মক্কায় ফিরে এসে তাঁর সমস্ত ধন-সম্পদ ছেড়ে মদীনায় রসূল (সা.)-এর নিকট হিজরত করেন। অতঃপর বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জাহিলী যুগে তিনি অত্যন্ত আরামপ্রদ জীবনযাপন করতেন এবং সৌখিন পোশাক পরিধান করতেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর দুনিয়াবিমুখ ছিলেন এবং অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন।

 তিনি চামড়ার তালিযুক্ত একটি পোশাক পরিহিত ছিলেন। নবী (সা.) তার বর্তমান অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন। কেননা তিনি অতি কষ্টে জীবনযাপন করেছেন। অথচ তিনি তার সম্প্রদায়ের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন।
তোমাদের অবস্থা কেমন হবে? যখন তোমাদের ধন-সম্পদ বেড়ে যাবে। ফলে তোমাদের প্রত্যেকে সকালে একধরনের পোশাক পরবে আবার বিকালে অন্য পোশাক পরবে। সৌখিন জীবনযাপন করবে আর তার সামনে পেয়ালা ভর্তি এক ধরনের খাবার রাখা হবে এবং সেটা উঠানোর সাথে সাথে আবার আরেক ধরনের খাবার ভর্তি পেয়ালা রাখা হবে। যা মূলত সৌখিন জীবনযাপনকারীরা করে থাকে। আর তোমাদের গৃহকে পর্দা দ্বারা সুসজ্জিত করবে যেমন কা’বাহ্ ঘরকে সাজানো হয়।
 তারা বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমরা তখন বর্তমানের চেয়ে ভালো জীবনযাপন করব। ইবাদতের জন্য মুক্ত থাকতে পারব। আর আমাদের খাদেমরা জীবিকা উপার্জনের কাজ করবে।
 নবী (সা.) বললেন, না, তোমরা সেদিনের চেয়ে এখনই ভালো আছ। কেননা ধনী ব্যক্তির চেয়ে সামান্য জীবিকার দরিদ্ররাই উত্তম। যেহেতু ধনীরা দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে,’ইবাদতের জন্য অবসর সময় পায় না। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৬/২৪৭৬, মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

৬. অধমের পুত্র গর্ব করবে :

যাদের গায়ে ভালো পোশাক নেই, পায়ে জুতা নেই, নগ্ন শরীর, নগ্ন পদো এরা তাদের অর্জিত হারাম সম্পদ নিয়ে বেশী বেশী গর্ব করবে।  হুযায়ফাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যতক্ষণ দুনিয়ার ব্যাপারে অধমের সন্তান সৌভাগ্যের অধিকারী বলে গণ্য না হবে ততক্ষণ কিয়ামত সংঘটিত হবে না। (তিরমিযী ও বায়হাক্বী’র “দালায়িলুন নুবুওয়্যাহ্”, মিশকাত হা/ ৫৩৬৫)

যতক্ষণ না তাদের মধ্যে অধিক সম্পদের মালিক, আরামদায়ক জীবনযাপনের অধিকারী এবং উচ্চ ক্ষমতা ও ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তি দুনিয়ার মালিক হবে। নিকৃষ্টের পুত্র নিকৃষ্ট। অথবা এমন ব্যক্তি যার বংশ জানা যাবে না এবং চরিত্রের প্রশংসা করা হবে না। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৬২২০৯, মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

যখন আমার উম্মাত অহমিকা বেশে দু’হাত দুলিয়ে চলবে। এবং রোম ও পারস্যের সন্তানরা তাদের খাদেম হবে এবং তাদের আনুগত্য করবে। তখন আল্লাহ তা’আলা উত্তমের ওপর নিকৃষ্টদের ক্ষমতা দান করবেন। ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যখন আমার উম্মত গর্বের সাথে চলতে লাগবে এবং রাজা-বাদশাহদের সন্তানরা তথা পারস্য ও রূমের রাজ কুমাররা এদের খিদমতে রত থাকবে, তখন আল্লাহ তা’আলা উম্মতের খারাপ লোকেদেরকে ভালো লোকদের ওপর শাসক হিসেবে চাপিয়ে দেবেন।  তিরমিযী হা/২২৬১, সিলসিলাতুস সহীহাহ হা/৯৫৭, সহীহুল জামি হা/৮০১।

মিরকাত ভাষ্যকার বলেন, এ হাদীসটি নবী (সা.) -এর নুবুওয়্যাতের প্রমাণ বহনকারী। কেননা তিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এমন সংবাদ দিয়েছেন যা পরবর্তীতে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। কেননা যখন তারা রোম ও পারস্য দখল করল তখন তারা তাদের ধন-সম্পদ হস্তগত করল এবং তাদের সন্তানদেরকে বন্দী করল, যার ফলশ্রুতিতে তারা ক্ষমতা কেড়ে নিল এবং উসমান (রাঃ)-কে হত্যা করল, অতঃপর বানী উমাইয়্যাগণ বানী হাশিম-এর সাথে যা করার তাই করল। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৬/২২৬১, মিরকাতুল মাফাতীহ)

’উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,……………. এক আগন্তুক এবার বললেন, ’’আমাকে ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) সম্পর্কে বলুন।’’ উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ’’এ বিষয়ে যাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তিনি প্রশ্নকারীর চাইতে অধিক কিছু জানেন না।’’ আগন্তুক বললেন, ’’তবে কিয়ামতের (কিয়ামতের) নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে বলুন।’’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ’’কিয়ামতের (কিয়ামতের) নিদর্শন হলো, দাসী তাঁর আপন মুনীবকে প্রসব করবে, তুমি আরো দেখতে পাবে- নগ্নপায়ী বিবস্ত্র হতদরিদ্র মেষ চালকেরা বড় বড় দালান-কোঠা নিয়ে গর্ব ও অহংকার করবে।’’ ’উমার (রাঃ) বললেন, অতঃপর আগন্তুক চলে গেলে আমি কিছুক্ষণ সেখানেই অবস্থান করলাম। পরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, হে ’উমার! প্রশ্নকারী আগন্তুককে চিনতে পেরেছো?’’ আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, ’’ইনি হচ্ছেন জিবরীল (আঃ)। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দীন শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন’’। ( মুসলিম হা/৮, আবূ দাঊদ হা/৪৬৯৫, নাসায়ী হা/৪৯৯০, সহীহ আত্ তারগীব হা/৩৫১, আহমাদ হা/৩৬৭)।

‘দাসী তার মুনীবকে প্রসব করবে’ এর অর্থ হলো সন্তান তার মায়ের সাথে এমন অসদাচরণ করবে যেমন মুনীব তার দাসীর সাথে করে থাকে। যেহেতু অবাধ্যতা মহিলাদের মধ্যে অতিমাত্রায় দেখা দিবে, তাই কন্যা ও দাসীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘‘বকরীর রাখালেরা অট্টালিকায় অহংকার করবে’’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো নিম্নশ্রেণীর লোকেরা নেতায় পরিণত হবে, তাদের মাল বৃদ্ধি পাবে। ফলে তারা বড় বড় দালান নির্মাণ ও তার সৌন্দর্যের অহংকারে লিপ্ত হবে।

পরিশেষে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের ঈমান সংরক্ষণ করার তাওফীক্ব দান করুন এবং ক্বলবকে ঈমানের নূর দ্বারা পরিপূর্ণ রাখুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top