ঈমানের আভিধানিক অর্থ : ‘ঈমান’ অর্থ নিশ্চিন্ত বিশ্বাস, নিরাপত্তা দেওয়া, যা ভীতির বিপরীত। রাগেব আল-ইছফাহানী (রহঃ) বলেন, ঈমানের মূল অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি এবং ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাওয়া (আল-মুফরাদাত, পৃঃ ৩৫)। সন্তান যেমন পিতা-মাতার কোলে নিশ্চিন্ত হয়, মুমিন তেমনি আল্লাহ্র উপরে ভরসা করে নিশ্চিন্ত হয়। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ ও আমলের মাধ্যমে (আছ-ছারিম আল-মাসলূল, পৃঃ ৫১৯)।
ঈমানের পারিভাষিক অর্থ : আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতে, ‘ঈমান’ হ’ল অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম, যা আনুগত্যে বৃদ্ধি হয় ও গুনাহে হ্রাস হয়। প্রথম দু’টি মূল ও শেষেরটি হ’ল শাখা, যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না (ইবনু মান্দাহ, কিতাবুল ঈমান ১/৩৩১) ।
ঈমান হ’ল মূল এবং আমল হ’ল শাখা, এদু’টি না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘যাতে তারা তাদের ঈমানের সঙ্গে ঈমান মজবুত করে নেয়’ (ফাতাহ ৪৮/৪) ‘আমরা তাদের সৎ পথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম’ (কাহাফ ১৮/১৩) ‘এবং যারা সৎপথে চলে আল্লাহ তাদের অধিক হিদায়াত দান করেন’ (মারইয়াম ১৯/৭৬) ‘যাতে মু’মিনদের ঈমান বেড়ে যায়’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৩১) ‘এটা তোমাদের মধ্যে কারু ঈমান বাড়িয়ে দিলো? যারা মু’মিন এ তো তাদের ঈমান বাড়িয়ে দেয়’ (তাওবাহ ৯/১২৪) ‘এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্য আরও বৃদ্ধি পেল’ (আহ্যাব ৩৩/২২)।
ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে :
ভালো আমলের ফলে ঈমানের দ্বীপ্ত বা নূর বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে মন্দ কাজের ফলে ঈমানের নূর নিষ্প্রভ হয়। আল্লাহর তা‘আলা বলেন, ,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ- ‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)। তিনি বলেন,هُوَ الَّذِيْ أَنْزَلَ السَّكِيْنَةَ فِيْ قُلُوْبِ الْمُؤْمِنِيْنَ لِيَزْدَادُوْا إِيْمَانًا مَعَ إِيْمَانِهِمْ ‘তিনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন, যাতে তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বেড়ে যায়’ (ফাতহ ৪৮/৪)।
মু’মিন বান্দা যখন যিনার কাজে লিপ্ত হয় তখন তার থেকে ঈমান বেরিয়ে যায়। তার অন্তর থেকে ঈমানের শাখাসমূহের বড় শাখাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর তা হলো আল্লাহর প্রতি লজ্জাবোধ। অথবা তার অবস্থা এমন হয় যে, যেন তার থেকে ঈমান চলে গেছে। এ ধরনের লোক ঈমান বিরোধী কাজ সত্ত্বেও সে ঈমানের ছায়াতেই থাকে। তার থেকে ঈমানের হুকুম দূর হয় না এবং ঈমান বিষয়টি তার থেকে উঠে যায় না। কারণ যখন সে ঐ কাজ থেকে বেরিয়ে আসে, তখন অনুতপ্ত হয় এবং এর ফলে ঈমানের নূর ও পূর্ণ ঈমান আবার ফিরে আসে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَزْنِى الزَّانِى حِيْنَ يَزْنِىْ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَسْرِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيْهَا أَبْصَارَهُمْ حِيْنَ يَنْتَهِبُهَا وَهْوَ مُؤْمِنٌ- وَلاَ يَغُلُّ أَحَدُكُمْ حِيْنَ يَغُلُّ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَإِيَّاكُمْ إِيَّاكُمْ- যিনাকারী যখন যিনা করে তখন আর সে ঈমানদার থাকে না, মদ্যপ যখন মদ পান করে তখন তার আর ঈমান থাকে না, চোর যখন চুরি করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। যখন ডাকাত এভাবে ডাকাতি করে যে, মানুষ তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে তখন তার ঈমান থাকে না। এভাবে কেউ যখন গনীমতের মালে খিয়ানত করে, তখন তার ঈমান থাকে না। অতএব সাবধান!’ (এসব গুনাহ হ’তে দূরে থাকবে)।[বুখারী হা/২৪৭৫ ‘অত্যাচার, ক্বিছাছ ও লুণ্ঠন’ অধ্যায়; মুসলিম হা/৫৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৫৩।]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِذَا زَنَى الْعَبْدُ خَرَجَ مِنْهُ الإِيمَانُ كَانَ عَلَيْهِ كَالظُّلَّةِ فَإِذَا انْقَطَعَ رَجَعَ إِلَيْهِ الإِيمَانُ- ‘যখন কোন বান্দা ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন তার থেকে (তার অন্তর থেকে) ঈমান বেরিয়ে যায় এবং তা তার মাথার উপর ছায়ার ন্যায় অবস্থিত থাকে। অতঃপর যখন সে এ অসৎকাজ থেকে বিরত হয় তখন ঈমান তার নিকট প্রত্যাবর্তন করে’।[তিরমিযী হা/২৬২৫ ‘ঈমান’ অধ্যায়; আবূ দাঊদ হা/৪৬৯০; সিলসিলা ছাহীহাহ হা/৫০৯, ছহীহুল জামে‘ হা/৫৮৬, ছহীহ আত-তারগীব হা/২৩৯৪; মিশকাত হা/৬০।]
মুমিন যতক্ষণ ফিৎনা ও পাপসমূহ হ’তে দূরে থাকে, ততক্ষণ তার হৃদয় পরিচ্ছন্ন থাকে এবং ঈমান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যখনই সে পাপসমূহকে তুচ্ছ মনে করে এবং ফিৎনা সমূহের সম্মুখীন হয়, তখন তার ঈমান হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘দৃষ্টিকে অবনত রাখার মধ্যে তিনটি উপকারিতা রয়েছে। (১) ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করা (২) হৃদয়ের জ্যোতি ও দূরদর্শিতা বৃদ্ধি পাওয়া (৩) হৃদয়ের শক্তি, দৃঢ়তা ও বীরত্ব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া’ (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৫/৪২০-২৬)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ الْإِيْمَانَ لَيَأْرِزُ إِلَى الْمَدِيْنَةِ كَمَا تَأْرِزُ الْحَيَّةُ إِلىَ جُحْرِهَا. ‘ঈমান ঐভাবে মদীনায় ফিরে আসবে যেভাবে সাপ তার গর্তে ফিরে আসে’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৬০ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কুরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ। উক্ত হাদীছে উল্লেখিত لَيَأْرِزُ শব্দের পঠনরীতি উল্লেখ করতে গিয়ে ব্যাখ্যাকার বলেন, بكسر الراء عند الأكثر، ويروى بالفتح، وحكى بالضم، أى يأوى وينضم، وينقبض ويلتجئ. ‘অধিকাংশের মতে ‘রা’ বর্ণে যের দিয়ে। যবর দিয়েও বর্ণিত আছে। পেশ দ্বারাও কথিত আছে। অর্থাৎ আশ্রয় নিবে, মিলিত হবে এবং গুটিয়ে আসবে’।মির‘আত ১/২৫৬। হাদীছটি বিভিন্ন গ্রন্থে এসেছে (বুখারী হা/১৮৭৬, মুসলিম হা/১৪৭, আহমাদ হা/৯৪৫২; মিশকাত হা/১৬০)। এর তাৎপর্য হ’ল, শেষ যামানায় যখন ফেতনা বৃদ্ধি পাবে তখন মানুষ তার ঈমান রক্ষার জন্য মদীনায় চলে যাবে দ্রুত বেগে, যে ভাবে সাপ দ্রুত তার গর্তে ঢুকে পড়ে (মির‘আত ১/২৫৬ পৃঃ)।
ছাহেবে লুম‘আত আব্দুল হক দেহলভী (রহঃ) বলেন, হাদীছের প্রকাশ্য অর্থে বুঝা যায় যে, দাজ্জাল বের হওয়ার পরে এ ঘটনা ঘটবে- যা অন্যান্য হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়’। অবশ্য ক্বাযী আয়ায, ইমাম কুরতুবী, ইমাম নববী, হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী প্রমুখ বিদ্বানগণ বলেন যে, এ ঘটনা সকল যুগেই ঘটতে পারে’। তবে ছাহেবে মির‘আত বলেন, والأول أظهر অর্থাৎ ছাহেবে লুম‘আত-এর বক্তব্যই অধিকতর স্পষ্ট’। কারণ দাজ্জাল মক্কা ও মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না (মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত হা/২৭৪২)। অন্য হাদীছে এসেছে,بَدَأَ الْإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ- ‘ইসলাম স্বল্পসংখ্যক লোকের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। অচিরেই সে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে। সুতরাং সুসংবাদ সেই স্বল্পসংখ্যক লোকদের জন্য’।মুসলিম হা/১৪৫; মিশকাত হা/১৫৯।
ঈমান মজবুত করুন
হযরত আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْإِيمَانَ لَيَخْلَقُ فِي جَوْفِ أَحَدِكُمْ كَمَا يَخْلَقُ الثَّوْبُ الْخَلِقُ، فَاسْأَلُوا اللهَ أَنْ يُجَدِّدَ الْإِيمَانَ فِي قُلُوبِكُمْ- ‘নিশ্চয় ঈমান তোমাদের হৃদয়ে জীর্ণ হয়ে যায়, যেমন তোমাদের পোষাক জীর্ণ হয়ে যায়। সেকারণ তোমরা আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা কর, যেন তিনি তোমাদের হৃদয় সমূহে ঈমানকে তাযা করে দেন’ (হাকেম হা/৫, ১/৪৫; ছহীহাহ হা/১৫৮৫)।
আব্দুল্লাহ বিন ‘উকায়েম বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাঃ)-কে দো‘আ করতে শুনেছি, اللَّهُمَّ زِدْنَا إِيمَانًا وَيَقِينًا وَفِقْهًا ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ঈমান, ইয়াক্বীন ও দ্বীনের বুঝ বৃদ্ধি করে দাও’(ইবনু বাত্ত্বাহ, আল-ইবানাতুল কুবরা (রিয়াদ : দারুর রা’য়াহ, তাবি) হা/১১৩২, ২/৮৪৬; ইবনু হাজার বলেন, বর্ণনাটির সনদ ছহীহ (ফাৎহুল বারী ১/৪৮)।
আবুদ্দারদা (রাঃ) বলতেন,إِنَّ مِنْ فِقْهِ الْعَبْدِ أَنْ يَعْلَمَ نَزَعَاتِ الشَّيْطَانِ أَنَّى تَأْتِيهِ- ‘বান্দার দ্বীনী বুঝের অন্যতম প্রমাণ হ’ল এই যে, সে মনের মধ্যে শয়তানের খটকা এলে জানতে পারে’। তিনি আরও বলতেন, مِنْ فِقْهِ الْعَبْدِ أَنْ يَعْلَمَ أَمُزْدَادٌ هُوَ أَوْ مُنْتَقِصٌ؟ ‘বান্দার দ্বীনী বুঝের অন্যতম প্রমাণ হ’ল এই যে, সে জানতে পারে সে তার ঈমানকে বৃদ্ধি করছে, না কমিয়ে দিচ্ছে?’(আল-ইবানাতুল কুবরা হা/১১৪০, ২/৮৪৯)
হাদীছে জিব্রীল ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,هَلْ تَدْرُونَ مَنْ هَذَا؟ هَذَا جِبْرِيلُ جَاءَكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ- ‘তোমরা কি জান কে এই ব্যক্তি? ইনি হ’লেন জিব্রীল। এসেছিলেন তোমাদেরকে দ্বীনের প্রশিক্ষণ দিতে’(মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২,)। অথচ ঐ মজলিসে হযরত ওমর সহ বড় বড় ছাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন। যারা আগে থেকেই এগুলি জানতেন। এতে বুঝা যায় যে, সর্বদা দ্বীনের চর্চা ও পরিচর্যার মাধ্যমে দ্বীনকে তাযা রাখা আবশ্যক।
অথচ ভ্রান্ত ফিরক্বা মুরজিয়াদের আক্বীদা হ’ল ঈমানের কোন হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। তাদের নিকট আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমান ও সাধারণ লোকদের ঈমান সমান। যুগে যুগে শৈথিল্যবাদী ফাসেক মুসলমানরা এই ভ্রান্ত দলের অন্তর্ভুক্ত।
এর বিপরীতে হোদায়বিয়ার সফরে সূরা ফাৎহ নাযিল করে আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ ‘তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন যেন তারা নিজেদের ঈমানের সাথে ঈমানকে আরও বাড়িয়ে নেয়’ (ফাৎহ ৪৮/৪)। বিগত যুগে ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে থাকা গুহাবাসী যুবকদের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى ‘তারা ছিল কয়েকজন যুবক। যারা তাদের প্রতিপালকের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমরা তাদের হেদায়াত (অর্থাৎ আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকার শক্তি) বৃদ্ধি করে দিয়েছিলাম’ (কাহফ ১৮/১৩)। ঈমানদারগণের ঈমান বৃদ্ধি করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَيَزِيدُ اللهُ الَّذِينَ اهْتَدَوْا هُدًى ‘যারা সৎপথে থাকে, আল্লাহ তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করে দেন’ (মারিয়াম ১৯/৭৬)। ৫ম হিজরীতে সংঘটিত খন্দক যুদ্ধে মদীনা অবরোধকারী দশ হাযার সৈন্যের সম্মিলিত আরব বাহিনীকে দেখে মুসলমানদের ঈমানী তেয বৃদ্ধি পাওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَمَا زَادَهُمْ إِلاَّ إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا ‘এটি তাদের ঈমান ও আনুগত্যকে আরও বৃদ্ধি করল’ (আহযাব ৩৩/২২)।
উপরোক্ত দলীল সমূহের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে ও বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রকৃত মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। আর এগুলির মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনদের ঈমানকে বারবার তাযা করেন।
মজলিশে আল্লাহকে স্মরণ করা :
মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) একদিন তার সাথী আসওয়াদ বিন হেলালকে বললেন, اجْلِسْ بِنَا نُؤْمِنْ سَاعَةً ‘তুমি আমাদের সাথে বস। কিছুক্ষণ আমরা ঈমানের আলোচনা করি’। অতঃপর তাঁরা উভয়ে বসলেন এবং আল্লাহকে স্মরণ করলেন ও প্রশংসা করলেন’ (ফাৎহুল বারী ‘ঈমান’ অধ্যায় ১/৪৮)।
আত্বা বিন ইয়াসার (মদীনা : ২৯-১০৩ হি.) বলেন, ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রাঃ) একদিন তাঁর এক সাথীকে বললেন, تَعَالَ حَتَّى نُؤْمِنَ سَاعَةً ‘এসো আমরা কিছুক্ষণ ঈমানের আলোচনা করি’। সাথীটি বলল, أَوَلَسْنَا بِمُؤْمِنَيْنِ؟ ‘আমরা দু’জন কি মুমিন নই?’ তিনি বললেন, بَلَى، وَلَكِنَّا نَذْكُرُ اللهَ فَنَزْدَادُ إِيمَانًا ‘হ্যাঁ, তবে আমরা কিছুক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করব, তাতে আমরা ঈমান বৃদ্ধি করে নিব’ (বায়হাক্বী, শো‘আব হা/৫০)।
পাপ থেকে বিরত থাকার কারণে :
মরিচা লোহাকে খেয়ে জরাজীর্ণ করে দেয়। আর কুফর, নিফাক ও ফাসেকীর কলুষ-কালিমা ঈমান গ্রহণের যোগ্যতাকে অকেজো করে দেয় এবং ঈমানের দ্বীপ্ততা নিষ্প্রভ করে দেয়। আল্লাহ বলেন, كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ- ‘কখনই না। বরং তাদের অপকর্মসমূহ তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/১৪)।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বান্দা যখন কোন পাপ করে তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। অতঃপর যখন সে পাপ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নেয় ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে ও তওবা করে, তখন অন্তরের মরিচা ছাফ হয়ে যায়। কিন্তু যদি সে পাপের পুনরাবৃত্তি করে, তাহ’লে মরিচা বৃদ্ধি পায়। এমনকি মরিচা তার অন্তরের উপরে জয়লাভ করে (অর্থাৎ সে আর তওবা করে ফিরে আসে না)। এটাই হ’ল সেই মরিচা যে বিষয়ে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন’(তিরমিযী হা/৩৩৩৪; নাসাঈ হা/১১৬৫৮; ইবনু মাজাহর বর্ণনায় إن المؤمن এসেছে; ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৪; মিশকাত হা/২৩৪২ ‘ইস্তিগফার ও তওবা’ অনুচ্ছেদ, সনদ হাসান।)
রাসূল (ছা.) ও ছাহাবাগণ ও সালাফদের জীবনী পাঠের মাধ্যমে :
শয়তান প্রতিনিয়ত মানুষের মানবিক মূল্যবোধ বিনষ্ট করার চক্রান্তে লিপ্ত। চাকচিক্যপূর্ণ যুক্তি ও প্রতারণাপূর্ণ কথামালার মাধ্যমে সে ঈমানদারগণকে চুম্বকের মত সর্বদা তার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষণে তার থেকে বাঁচতে গেলে এবং জান্নাতের পথ পেতে গেলে আমাদেরকে সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বিশুদ্ধ জীবনী বারবার পাঠ করতে হবে এবং সেখান থেকে ঈমানের সঞ্জীবনী সুধা পান করতে হবে।
আল্লাহ বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)।
সেকারণ মতভেদকারী মানব সন্তানদের প্রতি সিদ্ধান্তকারী নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘আমার রাসূল তোমাদের নিকটে যা নিয়ে আসেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)।
সেই সাথে তাঁর জীবন সংগ্রামের সাথী ছাহাবায়ে কেরামের জীবনী, বিশেষ করে খুলাফায়ে রাশেদীনের জীবনেতিহাস জানা অত্যন্ত যরূরী। তাঁদের পরে তাঁদের শিষ্য তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও সালাফে ছালেহীনের জীবনী পাঠ করা আবশ্যক। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِى، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ يَجِىءُ أَقْوَامٌ تَسْبِقُ شَهَادَةُ أَحَدِهِمْ يَمِينَهُ، وَيَمِينُهُ شَهَادَتَهُ- ‘মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম যুগ হ’ল আমার যুগ (অর্থাৎ ছাহাবীগণের যুগ)। অতঃপর তাদের পরবর্তী (তাবেঈদের) যুগ। অতঃপর তাদের পরবর্তী (তাবে তাবেঈদের) যুগ। এরপর এমন লোকেরা আসবে, যাদের সাক্ষ্য তাদের শপথের আগে হবে এবং তাদের শপথ তাদের সাক্ষ্যের আগে হবে’।(বুখারী হা/২৬৫২; মুসলিম হা/২৫৩৩; মিশকাত হা/৩৭৬৭)
ইবনুল জাওযী (৫০৮-৫৯৭ হি.) বলেন, وأصْلُ الأُصُولِ الْعِلْمِ وأنْفَعُ العُلُومِ النَّظْرُ في سِيَرِ الرَّسولِ صلى الله عليه وسلم وأَصْحابِهِ: {أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ} ‘জ্ঞানের সূত্র সমূহের মূল উৎস এবং সবচেয়ে উপকারী জ্ঞান হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের জীবনী অনুধাবন করা। আল্লাহ বলেছেন, ‘এরাই হল ঐসব মানুষ যাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেছেন। অতএব তুমি তাদের অনুসরণ কর’ (আন‘আম ৬/৯০)।(আব্দুর রহমান ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাত্বের (দিমাশ্ক্ব : দারুল ক্বলম, ১ম সংস্করণ ১৪২৫ হি./২০০৪ খৃ.) ৮০ পৃ.) অত্র আয়াতে বিগত নবীগণের কথা বলা হ’লেও শেষনবী ও তাঁর সাথীগণ এর মধ্যে শামিল হবেন। কারণ তাঁরাই উম্মতের সেরা ব্যক্তি।
শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনী ছেড়ে যারা অন্যদের জীবনী থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে চাইবে, তারা বিভ্রান্ত হবে। ওমর ফারূক (রাঃ) তাওরাত থেকে কিছু অংশ লিখে নিতে চাইলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে কঠোরভাবে ধমক দেন এবং বলেন, আজ মূসা বেঁচে থাকলেও তাকে আমার অনুসরণ করা ছাড়া উপায় থাকত না’।(আহমাদ হা/১৫১৯৫; মিশকাত হা/১৭৭; ইরওয়া হা/১৫৮৯) এমনকি ক্বিয়ামতের পূর্বে ঈসা (আঃ) অবতরণ করলে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আত মেনে চলবেন।(মুসলিম হা/১৫৬; মিশকাত হা/৫৫০৭) যদি কেউ অন্যদের বিধান ও প্রথা মেনে চলে, তাহ’লে সে তাদের দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি যে কওমের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি তাদের মধ্যে গণ্য হবে’।(আবুদাঊদ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/৪৩৪৭,)
দ্বীনের উপর দৃঢ় থাকার দো‘আ :
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَى دِيْنِكَ، أَللهمّ مُصَرِّفَ الْقُلُوْبِ صَرِّفْ قُلُوْبَنَا عَلَى طَاعَتِكَ.
উচ্চারণ : ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলূবি ছাব্বিত ক্বালবী ‘আলা দ্বীনিকা, আল্লা-হুম্মা মুছারিরফাল ক্বুলূবি ছাররিফ ক্বুলূবানা ‘আলা ত্বা-‘আতিকা।
অর্থ : ‘হে হৃদয় সমূহের পরিবর্তনকারী! আমার হৃদয়কে তোমার দ্বীনের উপর দৃঢ় রাখো’। ‘হে অন্তর সমূহের রূপান্তরকারী! আমাদের অন্তর সমূহকে তোমার আনুগত্যের দিকে ফিরিয়ে দাও’ (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১০২ ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ-৩।)।
ফযীলত : (১) হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলূবি ছাব্বিত ক্বালবী ‘আলা দ্বীনিকা’ অধিক পাঠ করতেন। আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমরা ঈমান এনেছি আপনার উপর এবং আপনি যা নিয়ে এসেছেন তার উপর। আপনি আমাদের ব্যাপারে কি কোনরকম আশংকা করেন? তিনি বললেন, نَعَمْ إِنَّ الْقُلُوبَ بَيْنَ أَصْبُعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ اللهِ يُقَلِّبُهَا كَيْفَ يَشَاءُ. ‘হ্যাঁ, কেননা, আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুলসমূহের মধ্যকার দু’টি আঙ্গুলের মাঝে সমস্ত অন্তরই অবস্থিত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা তা পরিবর্তন করেন’ (তিরমিযী হা/২১২৪; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৩৪; সনদ ছহীহ।)।
(২) শাহর ইবনু হাওশাব (রাহঃ) বলেন, আমি উম্মে সালামাহ (রাঃ)-কে বললাম, ‘হে উম্মুল মুমিনীন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আপনার কাছে অবস্থানকালে অধিকাংশ সময় কোন দো‘আটি পাঠ করতেন? তিনি বললেন, তিনি অধিকাংশ সময় এই দো‘আ পাঠ করতেন, ‘ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলূবি ছাব্বিত ক্বালবী ‘আলা দ্বীনিকা’। উম্মু সালামাহ (রাঃ) বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি অধিকাংশ সময় ‘ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলূবে ছাব্বিত ক্বালবী ‘আলা দ্বীনিকা’ দো‘আটি কেন পাঠ করেন? তিনি বললেন, يَا أُمَّ سَلَمَةَ إِنَّهُ لَيْسَ آدَمِىٌّ إِلاَّ وَقَلْبُهُ بَيْنَ أُصْبُعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ اللهِ فَمَنْ شَاءَ أَقَامَ وَمَنْ شَاءَ أَزَاغَ. ‘হে উম্মু সালামাহ! এমন কোন মানুষ নেই যার মন আল্লাহ তা‘আলার দুই আঙ্গুলের মধ্যবর্তীতে অবস্থিত নয়। যাকে ইচ্ছা তিনি (দ্বীনের উপর) স্থির রাখেন এবং যাকে ইচ্ছা (দ্বীন হ’তে) বিপথগামী করে দেন’(তিরমিযী হা/৩৫২২; আহমাদ হা/২৭৪৩৬; যিলালুল জান্নাহ হা/২২৩; সনদ ছহীহ।)।
(৩) ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ قُلُوبَ بَنِى آدَمَ كُلَّهَا بَيْنَ إِصْبَعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ الرَّحْمَنِ كَقَلْبٍ وَاحِدٍ يُصَرِّفُهُ حَيْثُ يَشَاءُ. ‘সমস্ত অন্তর আল্লাহর আঙ্গুলসমূহের দুই আঙ্গুলের মধ্যে একটি অন্তরের ন্যায় অবস্থিত। তিনি নিজের আঙ্গুলগুলোর দ্বারা তা যেভাবে ইচ্ছা ঘুরিয়ে থাকেন’। অতঃপর দো‘আটি পাঠ করলেন, আল্লা-হুম্মা মুছারিরফাল ক্বুলূবি ছাররিফ ক্বুলূবানা ‘আলা ত্বা-‘আতিকা (মুসলিম হা/২৬৫৪; মিশকাত হা/৮৯;