আমাদের অনেকেরই উপুড় হয়ে ঘুমানো অভ্যাস। তবে এভাবে শোয়া সাময়িক আরামদায়ক মনে হলেও এ অভ্যাসের কারণে মেরুদণ্ড, শ্বাস-প্রশ্বাস, শরীরের বিশ্রাম ও ঘুমের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে। চিকিৎসকরা সব সময় উপুড় হয়ে শোয়ার বদলে চিত হয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দিয়ে এসেছেন। চিত হয়ে শুয়ে থাকলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা, কোমরে ব্যথা এমনকি ত্বকের সমস্যারও অনেক উপকার পাওয়া যায়।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে বললেন, «إِنَّ هَذِهِ ضِجْعَةٌ لَا يُحِبُّهَا اللَّهُ» ‘এভাবে শয়ন করা আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন না’। (তিরমিযী হা/২৭৬৮, আহমাদ হা/৮০৪১, সহীহুল জামি‘ হা/২২৭০, মিশকাত হা/৪৭১৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে উপুড় হয়ে শয়ন করে ও গভীর ঘুমে মগ্ন থাকার কারণে তাকে সম্বোধন করে বললেন, «هَذِهِ ضِجْعَةٌ يَبْغَضُهَا اللَّهُ» এ ধরনের শয়ন আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন না। ইসলামী শারী‘আতে উপড় হয়ে শয়ন করা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ। যথা-
১. উপুড় হয়ে শয়ন করা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন না। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস বলেছেন, এভাবে উপুড় হয়ে শয়ন করাতে আল্লাহ রাগান্বিত হন।
২. উপুড় হয়ে শোয়া জাহান্নামীদের বৈশিষ্ট্য। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নিশ্চয় জাহান্নামীরা এভাবে শয়ন করে।
৩. উপুড় হয়ে শয়ন করলে নাকে-মুখে রক্ত এসে মৃত্যু হতে পারে।
৪. এটা শয়তান ও তার অনুসরীদের শোয়া।
৫. বুক ও মুখমণ্ডলে শরীরের মধ্যে মর্যাদাসম্পন্ন অঙ্গ। তাই সিজদা্ ব্যতীত অন্য কোন অবস্থায় তা নিম্নমুখী করা উচিত নয়।
এসকল কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপুড় হয়ে শয়ন করতে নিষেধ করেছেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
অপর এক বর্ণনায় এসেছে, ইয়া’ঈশ ইবনু ত্বিখফাহ্ ইবনু কায়স আল-গিফারী (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন, ত্বিখফাহ্ ইবনু কায়স আল-গিফারী আসহাবে সুফফাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি বলেন, আমি একদিন বুকের ব্যথার কারণে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁর পা দ্বারা নাড়া দিয়ে আমাকে বললেন, «هَذِهِ ضِجْعَةٌ يَبْغَضُهَا اللَّهُ» ‘এরূপ শয়নে আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট হন’। তখন আমি তাকিয়ে দেখলাম, তিনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। (আবূ দাঊদ হা/৫০৪০, ইবনু মাজাহ হা/৩৭২৩, মিশকাত হা/৪৭১৯)
এখানে আহলে সুফফার পরিচয়, বলা হয় যে সকল গরিব সাহাবী মসজিদে নাবাবীর বারান্দায় অবস্থান করতেন তাদেরকে আহলে সুফফাহ্ বলে। তারা জ্ঞান অর্জনের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিল। দুনিয়ার প্রতি তাদের আসক্তি ছিল না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাদিয়া স্বরূপ যা আসতো তারা তাই আহার করত। এরা সংখ্যায় ৭০ বা তার কিছু বেশি। (يحركني بِرجلِه) ইসলামী শারী‘আতের সংস্কৃতির প্রবর্তক রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন শায়িত লোকটিকে পা দিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। এরূপ করার রহস্য হলো :
ক. ত্বিখফাহ্ ছিলেন অসুস্থ। একদিন তার ভীষণ বুক ব্যথা হয়। ফলে তিনি মসজিদে নাবাবীতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন। কারণ উপুড় হয়ে শয়ন করলে বুকে পেটে চাপ পড়লে কিছুটা আরামবোধ হয়। কিন্তু এরূপ শয়ন আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন না, তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পা দিয়ে নাড়া দিলেন এবং উপুড় হয়ে না শোয়ার জন্য সতর্ক করলেন। এ মতটি অধিক গ্রহণযোগ্য।
খ. জাহিলী যুগে ‘আরবদের ধারণা ছিল কোন ব্যক্তিকে জীন-ভূত আসর করলে অথবা মৃগী রোগে আক্রান্ত হলে তাকে পা দিয়ে নাড়া দিলে সে ভালো হয়ে যেত। সম্ভবত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কারণেই তাকে পা দিয়ে নাড়া দিয়েছিলেন।
গ. হয়তো বা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাঁটতে গিয়ে তার শরীরে পা লেগে গিয়েছিল।(মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
ইমাম ইবনে কাইয়েম রহ.বলেছেন, “বাম দিকে অথবা পেটের উপর ভর করে শয়ন করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।”
উপুড় হয়ে ঘুমালে মেরুদণ্ড বা অন্ত্রের ওপর চাপ পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে উপুড় হয়ে শোয়ার অভ্যাস ঘাড় ও পিঠে ব্যথার কারণ হতে পারে। উপুড় হয়ে শোয়ার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এর ফলে অনেক সময় ঘুমের ব্যাঘাতও ঘটে। আর পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে শারীরিক নানান জটিলতাও দেখা দিতে পারে।
পরিশেষে, রাসূল (ছা.)-এর সুন্নাত আমাদের জন্য সার্বজনীন কল্যাণকর। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এবিষয়ে সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।