একজন মুসলিম অপর মুসলিমের প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হবে না

একজন মুসলমান অপর মুসলমানের প্রতি হত্যার উদ্দেশ্যে নিজো হাতকে সম্প্রসারিত করতে পারে না। প্রকৃত মুসলিম সদা নিজেকে নিবৃত রাখবে কবীরা গোণাহ থেকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, لَئِنۡۢ بَسَطۡتَّ اِلَیَّ یَدَكَ لِتَقۡتُلَنِیۡ مَاۤ اَنَا بِبَاسِطٍ یَّدِیَ اِلَیۡكَ لِاَقۡتُلَكَ ۚ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اللّٰهَ رَبَّ الۡعٰلَمِیۡنَ (হাবিল তার ভাই কাবিলকে বলেছিলেন) ‘আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি আমার দিকে হাত বাড়ালেও আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য তোমার দিকে হাত বাড়াব না, আমি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদা ৫/২৮)।

আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যখন দু’জন মুসলিম তাদের হাতিয়ার নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হবে, তখন তাদের দু’জনই জাহান্নামে যাবে। বলা হল, এতে হত্যাকারীর ব্যাপারটি তো বোঝা গেল, কিন্তু যাকে হত্যা করা হয়েছে তার ব্যাপারটি কেমন? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সেও তো তার সাথীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। [বুখারী হা/৭০৮৩; মুসলিম হা/২৮৮৮]

অন্য হাদীসে এসেছে, সাদ ইবন আবী ওক্কাস বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি সে আমার ঘরে প্রবেশ করে আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন কি করতে হবে আমাকে জানান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তুমি তখন আদম সন্তানদের মত হয়ে যাও। তারপর বর্ণনাকারী তেলাওয়াত করলেন, যদি তুমি আমার প্রতি তোমার হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমার প্রতি আমার হস্ত প্রসারিত করব না। [আবু দাউদ হা/৪২৫৭; তিরমিযী হা/২১৯৪] এর অর্থ, তুমি তাকে হত্যা করবে না সেটা জানিয়ে দাও।

অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, হে আবু যর! তোমার কি করণীয় থাকবে, যখন দেখবে যে, আহযারু যাইত স্থানও রক্তে ডুবে গেছে? আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ ও তার রাসূল আমার জন্য যা পছন্দ করবেন। রাসূল বললেন, তোমার উচিত তখন তুমি যেখান থাকো সেখানে থাকা। অর্থাৎ পরিবার পরিজনের বাইরে না যাওয়া। তিনি বললেন, আমি কি আমার তরবারী নিয়ে ঘাড়ে লাগাব না? রাসূল বললেন, তাহলে তো তুমি তাদের সাথে হত্যায় শরীক হলে।

আবু যর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে আমার করণীয় কি? তুমি তোমার ঘরে অবস্থান করবে। আমি বললাম, যদি তারা আমার ঘরে প্রবেশ করে? তিনি বললেন, যদি তুমি ভয় পাও যে, তরবারীর চমকানো আলো তোমাকে বিভ্রান্ত করবে, তাহলে তুমি তোমার চেহারার উপর কাপড় দিয়ে ঢেকে দাও, এতে করে (যদি তোমাকে সে হত্যা করে, তবে) সে তোমার ও তার গোনাহ নিয়ে ফিরে যাবে। [আবু দাউদ হা/৪২৬১; ইবন মাজাহ হা/৩৯৫৮; মুসনাদে আহমাদ হা/৫/১৬৩]

কাউকে অবৈধভাবে হত্যা করাও কবীরা গুনাহ্। তবে উক্ত হত্যা আরো ভয়ঙ্কর বলে বিবেচিত হয় যখন তা এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে হয় যাকে বাঁচানো সবার নৈতিক দায়িত্ব এবং যাকে হত্যা করা একেবারেই অমানবিক। যেমন: নিষ্পাপ শিশু, নিজ মাতা-পিতা, নবী-রাসূল, ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী রাষ্ট্রপতি অথবা উপদেশদাতা আলিমকে হত্যা করা। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«إِنَّ الَّذِيْنَ يَكْفُرُوْنَ بِآيَاتِ اللهِ، وَيَقْتُلُوْنَ النَّبِيِّيْنَ بِغَيْرِ حَقٍّ، وَيَقْتُلُوْنَ الَّذِيْنَ يَأْمُرُوْنَ بِالْقِسْطِ مِنَ النَّاسِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ، أُوْلَآئِكَ الَّذِيْنَ حَبِطَتْ أَعْمَالُـهُمْ فِيْ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَمَا لَـهُمْ مِّنْ نَّاصِرِيْنَ»

‘‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ্ তা‘আলার আয়াত ও নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করে, অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করে এবং মানুষদের মধ্য থেকে যারা ন্যায় ও ইন্সাফের আদেশ করে তাদেরকেও। (হে নবী) তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। এদেরই আমলসমূহ ইহকাল ও পরকালে নষ্ট হয়ে যাবে এবং এদেরই জন্য তখন আর কেউ সাহায্যকারী হবে না’’। (আ’লি ’ইমরা’ন : ২১-২২)

আল্লাহ্ তা‘আলা উক্ত হত্যাকারীকে চির জাহান্নামী বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তিনি তার উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। তেমনিভাবে তার উপর তাঁর অভিশাপ ও আখিরাতে তার জন্য দ্বিগুণ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَمَنْ يَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيْهَا وَغَضِبَ اللهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيْمًا»

‘‘আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন মু’মিনকে হত্যা করে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। তার মধ্যে সে সদা সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ্ তা‘আলা তার প্রতি ক্রদ্ধ হবেন ও তাকে অভিশাপ দিবেন। তেমনিভাবে তিনি তার জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন ভীষণ শাস্তি’’। (নিসা : ৯৩)

হত্যার ভয়াবহতার কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা শুধুমাত্র এক ব্যক্তির হত্যাকারীকে সকল মানুষের হত্যাকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ كَتَبْنَا عَلَى بَنِيْ إِسْرَآئِيْلَ أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِيْ الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيْعًا، وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيْعًا»

’’উক্ত কারণেই আমি বানী ইস্রাঈল্কে এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছি যে, যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে হত্যার বিনিময় অথবা ভূপৃষ্ঠে ফাসাদ সৃষ্টির হেতু ছাড়া অন্যায়ভাবে হত্যা করলো সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করলো। আর যে ব্যক্তি কাউকে অবৈধ হত্যাকান্ড থেকে রক্ষা করলো সে যেন সকল মানুষকেই রক্ষা করলো’’। (মায়েদা ৫/৩২)

আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কবীরা গোনাহর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে আল্লাহর সাথে কাউকে শির্ক করা এবং কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা। পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। মিথ্যা কথা বলা, অথবা বলেছেন মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। [বুখারী হা/৬৮৭১]

অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাস বলেছেন, “যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন হক মা’বূদ নাই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তার রক্ত তিনটি কারণ ব্যতীত প্রবাহিত করা অবৈধ। জীবনের বদলে জীবন (হত্যার বদলে কেসাস)। একজন বিবাহিত ব্যক্তি যদি অবৈধ যৌন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং ঐ ব্যক্তি যে ইসলাম ত্যাগ করে এবং মুসলিম জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। [বুখারী হ/৬৮৭৮]

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, কাউকে জীবিত করার অর্থ, আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম ঘোষণা করেছেন সে ধরনের কোন মানুষকে হত্যা না করা। এতে করে সে যেন সবাইকে জীবিত রাখল। অর্থাৎ যে অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা হারাম মনে করে, তার থেকে সমস্ত মানুষ জীবিত থাকতে সমর্থ হলো। [তাবারী]

আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীর ক্ষমার আশা খুবই ক্ষীণ। মু‘আবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন:

كُلُّ ذَنْبٍ عَسَى اللهُ أَنْ يَّغْفِرَهُ إِلاَّ الرَّجُلُ يَمُوْتُ كَافِرًا، أَوِ الرَّجُلُ يَقْتُلُ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا.

‘‘প্রতিটি গুনাহ্ আশা করা যায় আল্লাহ্ তা‘আলা তা ক্ষমা করে দিবেন। তবে দু’টি গুনাহ্ যা আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমা করবেন না। আর তা হচ্ছে, কোন মানুষ কাফির অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে অথবা ইচ্ছাকৃত কেউ কোন মু’মিনকে হত্যা করলে’’। (নাসায়ী হা/৩৯৮৪; আহমাদ হা/১৬৯০৭; হা’কিম ৪/৩৫১)

কেউ কাউকে অবৈধভাবে হত্যা করলে গুনাহ্’র কিয়দংশ আদম (আঃ) এর প্রথম সন্তান কাবিলের উপর বর্তাবে। কারণ, সেই সর্ব প্রথম মানব সমাজে হত্যাকান্ড চালু করে।

আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

لَا تُقْتَلُ نَفْسٌ ظُلْمًا، إِلاَّ كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الْأَوَّلِ كِفْلٌ مِنْ دَمِهَا، لِأَنَّهُ اَوَّلُ مَنْ سَنَّ الْقَتْلَ.

‘‘কোন মানুষ অত্যাচার বশত: হত্যা হলে তার রক্তের কিয়দংশ আদম (আঃ) এর প্রথম সন্তানের উপর বর্তাবে। কারণ, সেই সর্ব প্রথম মানব সমাজে হত্যা কান্ড চালু করে’’। (বুখারী হা/৩৩৩৫ ৭৩২১; মুসলিম হা/১৬৭৭)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top