মুমিন ব্যক্তির জন্য সদা কুরআন অনুধাবন করে তিলাওয়াত করা উচিৎ। কেননা, কুরআন আমাদের জন্য উপদেশ, আত্মার খোরাক ও শিফা দানকারী এবং শ্রেষ্ঠ্য যিকির বা আল্লাহকে স্মরণের সর্বোত্তম পন্থা যা আল্লাহ তা‘আলা বান্দার বুঝার জন্য সহজ করে দিয়েছেন ঐ ব্যক্তির জন্য যে ইলমে নাফিয়ান অর্জ।ন করেছেন। আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা‘আলা বলেন, وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ. ‘আমরা কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, উপদেশের জন্য। অতএব আছো কি কোন উপদেশ গ্রহণকারী?’ (ক্বামার ৫৪/১৭) অন্যত্র তিনি বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ‘হে মানব জাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে এসে গেছে উপদেশবাণী (কুরআন) এবং অন্তরের রোগসমূহের নিরাময়কারী এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭)।
কুরআন তিলাওয়াতকারী মুমিন ও মুনাফিক্ব সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
مَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الأُتْرُجَّةِ ، رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ ، وَمَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ التَّمْرَةِ لاَ رِيحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ ، وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ مَثَلُ الرَّيْحَانَةِ ، رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ ، وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الْحَنْظَلَةِ ، لَيْسَ لَهَا رِيحٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ.
‘যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে তার উদাহরণ হ’ল কাগজী লেবুর মতো যার গন্ধ সুবাসিত, স্বাদও ভালো। আর যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে না তার উদাহরণ হ’ল খেজুরের মতো যার কোন গন্ধ নেই, তবে স্বাদ খুব মিষ্টি। আর কুরআন তিলাওয়াতকারী মুনাফিক্ব হ’ল রাইহানা ফুলের মত, যার গন্ধ ভালো কিন্তু স্বাদ অত্যন্ত তিক্ত। কুরআন তিলাওয়াত করে না এমন মুনাফিক্ব হ’ল মাকাল ফলের মতো যার গন্ধও তিক্ত স্বাদও তিক্ত’। মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২১১৪।
কুরআনের দু’টো আয়াত অনুধাবন করার ফযীলত উঁচু কুঁজবিশিষ্ট দু’টো উটের মত উত্তম হবে। উক্ববা ইবনে আমির (রাঃ) বলেন, একবার আমরা সুফ্ফায় (মসজিদে নব্বীর আঙ্গিনায়) অবস্থান করছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বের হয়ে বললেন, أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْمٍ إِلَى بُطْحَانَ أَوْ إِلَى الْعَقِيقِ فَيَأْتِىَ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ فِى غَيْرِ إِثْمٍ وَلاَ قَطْعِ رَحِمٍ. فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ نُحِبُّ ذَلِكَ. قَالَ أَفَلاَ يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمَ أَوْ يَقْرَأَ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ وَثَلاَثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلاَثٍ وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الإِبِلِ. ‘তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে প্রতিদিন সকালে বুত্বহান বা আক্বীক্ব উপত্যাকা হ’তে কোন প্রকার পাপ বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ব্যতিরিকে উঁচু কুঁজবিশিষ্ট দু’টো উট নিয়ে আসতে পছন্দ করে? আমরা বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমরা তা পছন্দ করি। তিনি বললেন, ‘তোমরা কেউ কি এরূপ করতে পার না, সকালে মসজিদে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার কিতাব থেকে দু’টো আয়াত অনুধাবন করবে অথবা পাঠ করবে; এটা তার জন্য দু’টো উটের তুলনায় উত্তম। আর তিনটি আয়াত তিনটি উট থেকে উত্তম। চারটি আয়াত চারটি উট হ’তে উত্তম। আর সমসংখ্যক উট লাভ করা থেকেও তা অধিক উত্তম হবে’। মুসলিম হা/৮০৩; মিশকাত হা/২১১০; তিরমিযী হা/১৫৮৯, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, পিতা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ১২ বছরে সূরা বাক্বারাহ শেষ করেন। অতঃপর যেদিন শেষ হয়, সেদিন তিনি কয়েকটি উট নহর (যবেহ) করে সবাইকে খাওয়ান’। মুক্বাদ্দামা তাফসীর কুরতুবী ‘আল্লাহ্র কিতাব শিক্ষা করা ও তা অনুধাবনের পদ্ধতি’ অনুচ্ছেদ, ৭৬ পৃ.; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম (বৈরূত : দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ ১৪০৭/১৯৮৭) ৩/২৬৭।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিঃ) বলেন, কুরআন হ’ল আরোগ্য গ্রন্থ। যা আত্মা ও দেহ এবং দুনিয়া ও আখেরাত সবকিছুকে শামিল করে। যাদুল মা‘আদ ৪/৩২৩। অন্যত্র তিনি বলেন, فقراءة آية بتفكر وتفهم خير من قراءة ختمة بغير تدبر وتفهم ‘আল কুরআনের একটি আয়াত খতমের উদ্দেশ্যে অনুধাবন ছাড়া ও না বুঝে পাঠ করার চেয়ে, উক্ত আয়াত অনুধাবন সহকারে বুঝে পাঠ করা উত্তম’। মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ, ১/১৮৭।
উমাইয়া খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয ইসলামের ইতিহাসে অধিক ক্রন্দনকারী হিসাবে খ্যাত। তাঁর পুণ্যময় জীবনের বিস্ময়কর একটি ঘটনা হচ্ছে, ফাতেমা বিনতে আব্দুল মালেক কেঁদে কেঁদে তাঁর দৃষ্টিশক্তি দুর্বল করে ফেলল। অতঃপর তাঁর ভাই মাসলামা ও হিশাম তাঁর নিকট এসে বলল, কোন জিনিসটি তোমাকে এভাবে কাঁদাচ্ছে? তোমার যদি দুনিয়ার কোন কিছু হারায় তাহ’লে আমাদের সম্পদ ও পরিজন দ্বারা তোমাকে আমরা সাহায্য করব। তাদের জবাবে ফাতেমা বললেন, ওমরের কোন কিছুর জন্যে আমি দুঃখ করছি না। কিন্তু আল্লাহর কসম! গত রাত্রে দেখা একটি দৃশ্য আমার ক্রন্দনের কারণ। অতঃপর ফাতেমা বিনতে আব্দুল মালেক বললেন, আমি গত রাত্রে ওমর বিন আব্দুল আযীযকে ছালাতরত অবস্থায় দেখেছি। অতঃপর তিনি আল্লাহর বাণী,يَوْمَ يَكُوْنُ النَّاسُ كَالْفَرَاشِ الْمَبْثُوْثِ، وَتَكُوْنُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوْشِ. ‘যেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মত এবং পর্বতমালা হবে ধুনিত রঙিন পশমের মত’ (ক্বারি‘আহ ১০১/৪-৫) ।
এই আয়াত পাঠ করে চিৎকার করে উঠলেন এবং মাটিতে পড়ে গেলেন। অতঃপর কঠিনভাবে চিৎকার করতে থাকলে আমার মনে হ’ল তাঁর রূহ বের হয়ে যাবে। অতঃপর তিনি থামলে আমার মনে হ’ল তিনি হয়ত মারা গেছেন। এরপর তিনি চেতনা ফিরে পেয়ে ফরিয়াদ করে বলতে লাগলেন, হায়! মন্দ সকাল! এরপর তিনি লাফিয়ে উঠে ঘরের মধ্যে ঘুরতে থাকলেন আর বলতে লাগলেন, ‘হায়! আমার জন্য দুর্ভোগ। সেদিন কোন লোক হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মত এবং পর্বতমালা হবে ধুনিত রঙিন পশমের মত’? (জামালুদ্দীন আল-জাওযী, আল-মুনতাযাম ফী তারীখিল উমাম ওয়াল মুলূক, তাহক্বীক : মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির ও মোস্তফা আব্দুল ক্বাদির (বৈরূত : দারুল কুতুবুল ইলমিয়াহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হিঃ/১৯৯২ খ্রীঃ), ৭/৭২।)
কুরআন অনুধাবন করে পাঠ করার অর্থ হ’ল কোন আয়াতের যথাযথ মর্ম নির্ধারণ করা এবং আয়াতের মুখ্য উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা এবং সেখান থেকে আহকাম নিশ্চিত করা। আর এটা মোটেই সহজ নয় এবং এর জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শর্তাবলী। সেই সকল শর্ত ও নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ না করে কেউ কুরআন অনুধাবনের দাবী করতে পারে না। এতদ্ব্যতীত কুরআনে রয়েছে কেবল মৌলিক বিষয়াদির বর্ণনা। এছাড়া অমূলক ভাবে মনগড়া ব্যাখ্যা করাকে কুরআন অনুধাবন বলে না। যারা এর সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করেন একমাত্র তারাই ইলমে নাফেয়ান বা উপকারী জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ قَالَ فِى الْقُرْآنِ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি ইলম ব্যতিরেকে কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করল, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা করে নিল’। (তিরমিযী হা/২৯৫০; শারহুস সুন্নাহ হা/১১৭; আহমাদ হা/২০৬৯; মিশকাত হা/২৩৪। ইমাম তিরমিযী ও ইমাম বাগাবী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। তাফসীরে কুরতুবীর মুহাক্কিক আব্দুর রাযযাক আল-মাহদী বলেন, তিরমিযী উক্ত হাদীছকে ‘হাসান’ বলেছেন, সেটাই যথার্থ। তিনি বলেন, হাদীছের সকল সূত্র বিশ্বস্ত (মুক্বাদ্দামা তাফসীর কুরতুবী হা/৭০, পৃ. ৬৬)। কিন্তু শায়খ আলবানী ও শু‘আয়েব আরনাঊত্ব ‘যঈফ’ বলেছেন। সনদ যঈফ হ’লেও মর্ম ছহীহ। )।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী বলেন, ঐ ব্যক্তির জন্য কুরআনের তাফসীরে প্রবেশ করা হারাম, যে ব্যক্তি কুরআনের ভাষা জানেনা, যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে এবং রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবী ও তাবেঈগণ থেকে বর্ণিত ব্যাখ্যা সম্পর্কে অবগত নয়। যে ব্যক্তি কুরআনের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ও আয়াত নাযিলের কারণ এবং নাসেখ-মানসূখ সম্পর্কে অবগত নয়’।
নীসাপূরী বলেন, কথার সারাংশ হচ্ছে- কুরআনের কোন আয়াতের তাফসীর কুরআনের অন্য আয়াত এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রবণ করা ছাড়া এমনটা বলা যাবে না। উল্লিখিত ইবারত হতে উদ্দেশ্য করা বৈধ হবে না। কেননা সাহাবীগণ তাফসীর করেছেন এবং সে তাফসীরের ব্যাপারে তাঁরা মতানৈক্য করেছেন এবং তাঁরা প্রত্যেকে যা বলেছেন তা কেবল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রবণ করার পরই বলেছেন এমনও নয়। কারণ যদি পরিস্থিতি এমনই হয়ে থাকে তাহলে সে মুহূর্তে ইবনু ‘আব্বাসের জন্য রসূলের দু‘আ اَللّهُمَّ فَقَهْهُ فِي الدِّيْنِ وَعَلِّمْهُ التَّأْوِيْلِ কোন উপকারে আসবে না। কুরআনের ভাষা অথবা সুন্নাহ অথবা আরবদের সার্বজনীন ভাষা রীতি অথবা উক্ত বিষয়ে ছাহাবীগণের বক্তব্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।فَأَمَّا تَفْسِيرُ الْقُرْآنِ بِمُجَرَّدِ الرَّأْيِ فَحَرَامٌ ‘মোটকথা কুরআনের তাফসীর স্রেফ রায়-এর মাধ্যমে করা হারাম’। এটাই হ’ল ইবনু কাছীরের বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত সার’(মির‘আত হা/২৩৬-এর আলোচনা; মুক্বাদ্দামা তাফসীর ইবনু কাছীর ১/৩৫-৩৬)।
হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলতেন,أَيُّ أَرْضٍ تُقِلُّنِي، وَأَيُّ سَمَاءٍ تُظِلُّنِي، إِذَا قُلْتُ فِي الْقُرْآنِ مَا لاَ أَعْلَمُ ‘যদি আমি না বুঝে কুরআন সম্পর্কে কিছু বলি, তবে কোন যমীন আমাকে বহন করবে এবং কোন আকাশ আমাকে ছায়া দিবে?’(তাফসীর ত্বাবারী ১/৭৮)।
কুরআনের অপরিচিত ও অস্পষ্ট শব্দগুলো এবং যেখানে তাক্বদীম ও তা‘খীর আছে এবং বিলুপ্ত ইবারত আছে সে স্থানগুলোর তাফসীর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রবণের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করে ‘আরাবী ভাষার বাহ্যিক দিক লক্ষ্য করে দ্রুত তাফসীর করা। সুতরাং বাহ্যিক তাফসীর এর ক্ষেত্রে প্রথমত আবশ্যক হচ্ছে, তা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রবণ বা কুরআন ও হাদীস হতে নকল হতে হবে। যাতে এর মাধ্যমে ভুলের স্থানগুলো আলাদা হয়ে যায়। অতঃপর ব্যক্তির পক্ষে জ্ঞান খাটানো ও মাসআলাহ্ ইস্তিম্বাততের সুযোগ রয়েছে। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা তাফসীর করার দু’টি নিষেধাজ্ঞা ছাড়া নিষেধাজ্ঞার আর কোন কারণ নেই; যতক্ষণ তা ‘আরাবী জ্ঞান-বিজ্ঞানের নীতিমালা ও মূল ও শাখা-প্রশাখাজনিত নিয়ম অনুযায়ী হবে।
বিনা ‘ইলমে শারী‘আতের ব্যাপারে কোন কথা বলা হারাম। কুরআনের শব্দ, ক্বিরাআত (কিরআত) অথবা অর্থের ক্ষেত্রে আহাদীসে মারফূ‘আহ্ বা মাওকূ‘ফাতে তাফসীর অনুসন্ধান এবং শারী‘আতের নীতিমালার অনুকূল ‘আরাবী ভাষাবিদ ইমামদের উক্তি অনুসন্ধান ছাড়াই যে নিজের তরফ থেকে কোন কথা বলবে বরং তার জ্ঞান যা দাবী করে সে অনুপাতে কথা বলবে সে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِه عِلْمٌ কে লঙ্ঘন করবে। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তোমার নিকটে নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যেন তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহল ১৬/৪৪)।
ইবনু জারীর বলেন, কুরআন মূর্খতা ও পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্তি দেয়। মুমিনগণ এর মাধ্যমে অন্ধকারে আলোর পথ খুঁজে পান। অবিশ্বাসীরা নয়। কেননা মুমিনগণ কুরআনের হালাল-হারাম মেনে চলেন। সেজন্য আল্লাহ তাদের জান্নাতে প্রবেশ করান ও আযাব থেকে রক্ষা করেন। আর এটাই হ’ল তাঁর পক্ষ হ’তে রহমত ও অনুগ্রহ’ । আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ‘হে মানব জাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এসে গেছে উপদেশবাণী (কুরআন) এবং অন্তরের রোগসমূহের নিরাময়কারী এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭)। তিনি আরও বলেন,وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلاَ يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلاَّ خَسَارًا ‘আর আমরা কুরআন নাযিল করি, যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও রহমত স্বরূপ। কিন্তু পাপীদের জন্য তা কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (ইসরা ১৭/৮২)।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, কুরআন হ’ল আরোগ্য গ্রন্থ। যা আত্মা ও দেহ এবং দুনিয়া ও আখেরাত সবকিছুকে শামিল করে। ঐ ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি একে পূর্ণ বিশ্বাস ও ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করে এবং এর প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের শর্ত সমূহ পূরণ করে। এটি আসমান ও যমীনের মালিকের কালাম। যদি এটি পাহাড়ের উপর নাযিল হ’ত, তাহ’লে তা ফেটে চৌচির হয়ে যেত। যমীনের উপর নাযিল হ’লে তা বিদীর্ণ হয়ে যেত। অতএব আত্মার ও দেহের এমন কোন রোগ নেই, কুরআনে যার আরোগ্যের নির্দেশনা নেই’ (যাদুল মা‘আদ ৪/৩২৩)।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আমাদের জন্য কুরআনের শব্দাবলী মুখস্ত করা খুবই কঠিন। কিন্তু এর উপর আমল করা সহজ। আর আমাদের পরের লোকদের অবস্থা হবে এই যে, তাদের জন্য কুরআন হেফয করা সহজ হবে। কিন্তু তার উপর আমল করা কঠিন হবে (মুক্বাদ্দামা তাফসীর কুরতুবী ৭৫ পৃ.)।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি ওমর (রাঃ)-এর দরবারে এল। তখন তিনি তাকে লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে লোকটি বলল, হে আমীরুল মুমেনীন! তাদের মধ্যে কেউ কেউ এরূপ এরূপভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে। তখন আমি বললাম, এত দ্রুত কুরআন তেলওয়াত করা আমি পসন্দ করি না। তখন ওমর (রাঃ) আমাকে থামালেন। এতে আমি দুঃখিত মনে বাড়ী ফিরে এলাম। অতঃপর তিনি আমার নিকটে এলেন এবং বললেন, ঐ লোকটি যা বলল, তার কোনটা তুমি অপসন্দ করলে? আমি বললাম, ওরা যত দ্রুত কুরআন পড়বে, তত আপোষে ঝগড়া করবে। প্রত্যেকেই নিজেরটাকে সঠিক বলবে। আর যখনই ঝগড়া করবে, তখনই বিরোধে লিপ্ত হবে। অবশেষে নিজেরা লড়াইয়ে রত হবে। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, তোমার পিতার জন্য আমার জীবন উৎসর্গীত হৌক। আমি এটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। অবশেষে তুমিই সেটা বলে দিলে’( মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২০৩৬৮; যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/৩৪৮-৪৯)।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআন অনুধাবন করে তেলাওয়াত করার তাওফীক্ব দান করুন এবং ইলমে নাফিয়ান প্রদান করে তা বুঝতে সহজ করুন, আমীন।