কুরআন পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য জ্ঞান ও হেদায়াত লাভের উৎসমূল। রাসূল (ছাঃ) বলেন,عَلَيْكُمْ بِالْقُرْآنِ، فَإِنَّهُ فَهْمُ الْعَقْلِ وَنُورُ الْحِكْمَةِ وَيَنَابِيْعُ الْعِلْمِ وَأَحْدَثُ الْكُتُبِ بِالرَّحْمَنِ عَهْدًا، وَقَالَ فِي التَّوْرَاةِ : يَا مُحَمَّدُ إِنِّي مُنَزِّلٌ عَلَيْكَ تَوْرَاةً حَدِيْثَةً تَفْتَحُ فِيْهَا أَعْيُنًا عُمْيًا وَآذَانًا صُمًّا وَقُلُوْبًا غُلْفًا- ‘তোমরা কুরআনকে আবশ্যক করে নাও। কেননা এটি বিবেকের খোরাক, প্রজ্ঞার আলোকমালা, জ্ঞানের প্রস্রবন, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বাধুনিক। আর আল্লাহ তাওরাতে বলেন, হে মুহাম্মাদ! আমি তোমার উপর সর্বাধুনিক কিতাব নাযিল করেছি। যা অন্ধের দৃষ্টিকে, বধিরের শ্রবণশক্তিকে এবং অনুভূতিশূন্য বদ্ধ হৃদয়ের বোধশক্তিকে উন্মোচিত করবে’।(দারেমী হা/৩৩৭০, সনদ হাসান; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩১৭৩৮।)
ক. কুরআন শিক্ষাকারী ও শিক্ষাদানকারী মর্যাদায় সেরা :
কুরআন শিক্ষাগ্রহণকারী ও শিক্ষাদানকারীগণ সর্বশেষ্ঠ মানুষ হিসাবে পরিগণিত। ওছমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শিখে ও অন্যকে শিখায়’। (বুখারী হা/৫০২৭; মিশকাত হা/২১০৯) অন্য বর্ণনায় এসেছে,إِنَّ أَفْضَلَكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা করে ও অন্যকে শিখায়’। (বুখারী হা/৫০২৮; ইবনু মাজাহ হা/২১১) অতএব কুরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করতে হবে এবং এর সঠিক মর্ম অনুধাবন করে তদনুযায়ী জীবন গঠন করতে হবে।
কুরআন তেলাওয়াত করা এবং তার আয়াতগুলি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা ও সেগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহওয়ালা হওয়া যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, দুনিয়াতে মানুষের মধ্যে কতিপয় আল্লাহওয়ালা রয়েছেন। ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তারা আবার কারা? তিনি বলেন,أَهْلُ الْقُرْآنِ هُمْ أَهْلُ اللهِ وَخَاصَّتُهُ- ‘কুরআন ওয়ালারাই প্রকৃত আল্লাহওয়ালা এবং তাঁর নিকটতর’। (আহমাদ হা/১২৩০১; হাকেম হা/২০৪৬; ছহীহুত তারগীব হা/১৪৩২)
পবিত্র কুরআন মুখস্থ করা ও সেটা সংরক্ষিত রাখা চূড়ান্ত ধৈর্য ও সর্বোচ্চ স্মৃতিশক্তির কাজ। এই অসাধ্য সাধনকারীদের বিশেষ মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَثَلُ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهْوَ حَافِظٌ لَّهُ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ، وَمَثَلُ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهْوَ يَتَعَاهَدُهُ وَهْوَ عَلَيْهِ شَدِيدٌ فَلَهُ أَجْرَانِ- ‘কুরআনের হাফেয ও তেলাওয়াতকারীগণ সম্মানিত লেখক ফেরেশতাগণের ন্যায় উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। অতি কষ্টসাধ্য হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি সর্বদা তেলাওয়াত করে কুরআনের হিফযকে সংরক্ষিত রাখে, সে দ্বিগুণ নেকী হাছিল করবে’। (বুখারী হা/৪৯৩৭; আহমাদ হা/২৪৮৩২)
খ. কুরআন তেলাওয়াতকারী মুমিন মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতম :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন সময় ছাহাবায়ে কেরামকে নানা উদাহরণের মাধ্যমে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। যেমনটি তিনি অন্যান্য মুমিনের চাইতে কুরআন তেলাওয়াতকারী মুমিনের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার সময় শিক্ষা দিয়েছিলেন। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الأُتْرُجَّةِ رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ، وَمَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ التَّمْرَةِ لاَ رِيحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ، وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ مَثَلُ الرَّيْحَانَةِ رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ، وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الْحَنْظَلَةِ لَيْسَ لَهَا رِيحٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ- ‘যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে, সে হ’ল উৎরুজ্জা ফলের (কমলালেবুর) ন্যায়। ফলটি সুগন্ধিযুক্ত এবং স্বাদও উত্তম। আর যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে না, তার উদাহরণ হ’ল খেজুরের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই কিন্তু সুস্বাদু। আর যে মুনাফিক কুরআন তেলাওয়াত করে, সে হ’ল রায়হানা (লতানো) ফুলের ন্যায়। যা সুগন্ধিযুক্ত, কিন্তু স্বাদ তিক্ত। যে মুনাফিক কুরআন তেলাওয়াত করে না, সে হ’ল মাকাল (লতানো লেবুজাতীয় তিক্ত) ফলের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই এবং স্বাদও তিক্ত’ (বুখারী হা/৫৪২৭; মুসলিম হা/৭৯৭; মিশকাত হা/২১১৪)
কুরআন তিলাওয়াতকারী মু’মিনের দৃষ্টান্ত হলো উতরুজ্জাহ্ বা তুরঞ্জ ফলের ন্যায়। তুরঞ্জ (ফল) হলো বাতাবী লেবু অথবা কমলালেবু জাতীয় একটি অতীব মুখরোচক, উপাদেয় এবং সুগন্ধযুক্ত ফল। ‘আরবদের নিকট এটি ফলসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফল। কেউ কেউ বলেছেন, এমনকি এটি সকল দেশের ফলের শ্রেষ্ঠ। এর মধ্যে রয়েছে বহুবিধ বৈশিষ্ট্য ও গুণের সমাহার, দেখতেও ভারী চমৎকার। এর রং সত্যিই দৃষ্টিনন্দন ও হৃদয়গ্রাহী। এতে রয়েছে প্যারালাইসিস, জন্ডিস, কুষ্ঠরোগ এবং অর্শ্ব বা বাউশী রোগসহ বিভিন্ন রোগের প্রতিকার ও প্রতিষেধক উপাদান। জীবনী শক্তি বর্ধক উপকরণও এতে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান।
হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, অন্য কোন ফলের নাম উল্লেখ না করে উতরুজ্জাহ্ ফলের নাম উল্লেখ করার হিকমাত হলো এর ছাল দিয়ে ঔষধ তৈরি হয়, বীজ থেকে নানা উপকারী তৈল বের করা হয়। বলা হয় যে বাড়িতে তুরঞ্জ ফল থাকে সে বাড়িতে জিন্ প্রবেশ করতে পারে না। ওর বীজের উপরের পাতলা আবরণীর সম্পর্ক হলো মু’মিনের কলবের ন্যায়। এছাড়াও ওর বহুবিধ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
ঈমানের বিশেষণ খাদ্যের সাথে আর কুরআন তিলাওয়াতের বিশেষণ সুগন্ধির সাথে সাদৃশ্যযুক্ত করা হয়েছে। কেননা ঈমান মু’মিনকে কুরআন ধারণে বাধ্য করে যদিও ঈমান অর্জন কুরআন তিলাওয়াত ছাড়াও সম্ভব। অথবা ঈমানকে সুগন্ধযুক্ত খাদ্যের সাথে সাদৃশ্য দেয়া হয়েছে এজন্য যে, ঈমানের কল্যাণটা হলোঃ আত্মিক, প্রত্যেকের কাছে তা প্রকাশিত হয় না, কিন্তু কুরআন তিলাওয়াতের সুগন্ধি দ্বারা সকলেই উপকৃত হয়। প্রতিটি শ্রোতাই প্রকাশ্যভাবে এর সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়।
মাযহারী বলেন, কুরআন তিলাওয়াতকারী মু’মিনের দৃষ্টান্ত এরূপ যে, তার দৃঢ় ঈমান স্বীয় অন্তরে সুগন্ধি ছড়ায়, আর সে যখন কুরআন তিলাওয়াত করে তখন তার সম্মোহনী সুর লহরীতে মানুষ প্রশান্তি লাভ করে। শ্রোতা কুরআন শুনে সাওয়াব অর্জন করে এবং সেখান থেকে শিক্ষা লাভ করে। এটাই হলো তুরঞ্জ ফলের দৃষ্টান্ত যার স্বাদও সুন্দর গন্ধও সুন্দর।
গ. কুরআন তেলাওয়াতকারীর দুনিয়াবী মর্যাদা :
কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তির মর্যাদা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে বৃদ্ধি পায়। নাফে‘ বিন আব্দুল হারিছ (রাঃ) উসফান নামক স্থানে ওমর (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য গেলেন। ওমর (রাঃ) তাকে কর্মকর্তা হিসাবে মক্কায় নিযুক্ত করেছিলেন। অতঃপর তিনি নাফে‘কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি মক্কা ও ত্বায়েফের উপত্যকাবাসীদের জন্য কাকে তোমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছ? তিনি বললেন, ইবনু আবযাকে। ওমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ ইবনু আবযা? তিনি বললেন, আমাদের আযাদকৃত গোলামদের একজন। ওমর (রাঃ) বললেন, فَاسْتَخْلَفْتَ عَلَيْهِمْ مَوْلًى؟ ‘তুমি একজন ক্রীতদাসকে তাদের জন্য তোমার স্থলাভিষিক্ত করেছ?’ নাফে‘ বললেন,إِنَّهُ قَارِئٌ لِّكِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَإِنَّهُ عَالِمٌ بِالْفَرَائِضِ، قَاضٍ، ‘তিনি মহান আল্লাহর কিতাবের একজন বিজ্ঞ আলেম, ফারায়েয শাস্ত্রেও অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ বিচারক’। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, তোমাদের নবী (ছাঃ) যথার্থই বলেছেন,إِنَّ اللهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِيْنَ- ‘এই কিতাবের অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ অনেক জাতিকে মর্যাদায় উন্নীত করেন এবং কুরআন পরিত্যাগকারীদের অবনত করেন’।[ মুসলিম হা/৮১৭; ইবনু মাজাহ হা/২১৮; মিশকাত হা/২১১৫]
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাবের দ্বারা কোন জাতিকে উন্নত করেন’’। এই কিতাবের অর্থ হলো কুরআনুল কারীম। এটা মহান এবং শাশ্বত মর্যাদাসম্পন্ন পরিপূর্ণ কিতাব। পূর্ববর্তী আসমানী কোন গ্রন্থই এ মর্যাদায় পৌঁছতে পারেনি। এ জাতির উন্নতির কারণ হলো আল কুরআনের প্রতি তাদের বিশ্বাস, আল কুরআনের যথাযথ মর্যাদা দান এবং তার উপর ‘আমল করা। এদের মর্যাদা এভাবে বাড়িয়ে দেয়া হবে যে, ইহকালে পাবে তারা এক সম্মানজনক জীবন এবং পরকালে আল্লাহর নৈকট্যশীল পুরস্কারপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যারা তার প্রতি পূর্ণরূপে ঈমান আনয়ন করবে না, তার ‘আমল ছেড়ে দিবে এবং তার যথাযোগ্য মর্যাদা দানে ব্যর্থ হবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের লাঞ্ছিত করবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘‘এ কুরআন দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা অনেক মানুষকে পথপ্রদর্শন করেন আবার অনেককে করেন পথভ্রষ্ট।’’ (আল বাকারাহ্ ২/২৬)
অন্যত্র বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ عَلَى ذِكْرٍ فَتَفَرَّقُوْا عَنْهُ إِلاَّ قِيْلَ لَهُمْ : قُوْمُوْا مَغْفُوراً لَّكُمْ، قَدْ بُدِّلَتْ سَيِّئَاتِكُمْ حَسَنَاتٍ- ‘যখন কোন জনসমষ্টি আল্লাহকে স্মরণের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয় অতঃপর পৃথক হয়, তখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা পাপ থেকে ক্ষমাকৃত অবস্থায় দন্ডায়মান হও। কেননা তোমাদের পাপকে পুণ্য দিয়ে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে’।(আহমাদ হা/১২৪৭৬; মুসনাদ আবু ইয়া‘লা হা/৪১৪১; ছহীহুত তারগীব হা/১৫০৪)
ঘ. প্রতি হরফে দশ নেকী :
পৃথিবীর বুকে এমন কোন গ্রন্থ, মহাগ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ অথবা বিশ্বকোষ নেই, যার একটি হরফ বা বর্ণ পাঠ করলে ১০টি নেকী হয়, কেবল কুরআন মাজীদ ব্যতীত। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِّنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لاَ أَقُولُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) থেকে একটি হরফ পাঠ করল তার একটি ছওয়াব হ’ল। আর একটি ছওয়াবের পরিমাণ হয় দশ গুণ। আমি বলছি না যে, আলিফ-লাম-মীম (তিনটি বর্ণ মিলে) একটি হয়ফ। বরং আলিফ একটি হরফ বা বর্ণ, লাম একটি বর্ণ এবং মীম একটি বর্ণ’। (তিরমিযী হা/২৯১০; মিশকাত হা/২১৩৭; ছহীহাহ হা/৩৩২৭) কুরআন থেকে একটি বর্ণ তেলাওয়াত করলে মহান আল্লাহ তাকে দশটি ছওয়াব প্রদান করেন।
ঙ. একটি আয়াত তেলাওয়াতের ফযীলত :
প্রতিদিন মসজিদে গিয়ে কুরআনের ১টি বা দু’টি মাত্র আয়াত শিখলে বহু নেকী লাভ হয়। যেমন উক্ববা বিন আমের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَّغْدُوَ كُلَّ يَوْمٍ إِلَى بُطْحَانَ أَوْ إِلَى الْعَقِيقِ فَيَأْتِىَ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ فِى غَيْرِ إِثْمٍ وَلاَ قَطْعِ رَحِمٍ؟ فَقُلْنَا : يَا رَسُولَ اللهِ نُحِبُّ ذَلِكَ، قَالَ : أَفَلاَ يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمَ أَوْ يَقْرَأَ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ خَيْرٌ لَّهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ وَثَلاَثٌ خَيْرٌ لَّهُ مِنْ ثَلاَثٍ وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَّهُ مِنْ أَرْبَعٍ وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الإِبِلِ- ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কি এমন পসন্দ করে যে, সে প্রতিদিন সকালে মদীনার ‘বুতহান’ কিংবা মক্কার ‘আক্বীক্ব’ নামক স্থানে যাবে এবং সেখান থেকে কোন অন্যায় না করে কিংবা কোন প্রকার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন না করে বড় বড় কুঁজবিশিষ্ট দু’টি উষ্ট্রী নিয়ে আসবে? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! অবশ্যই আমরা তা পসন্দ করি। তিনি বললেন, যে ব্যক্তি সকালে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাবের দু’টি আয়াত শিখে অথবা তেলাওয়াত করে, যা তার জন্য দু’টি উটনীর চেয়ে উত্তম। আর তিন আয়াত তার জন্য তিনটি উটনীর চেয়ে উত্তম এবং চার আয়াত চারটি উটনীর চেয়ে উত্তম। এমনিভাবে যত আয়াত তেলাওয়াত করবে, সেগুলি তত উটনীর চাইতে উত্তম হবে’।(মুসলিম হা/৮০৩; মিশকাত হা/২১১০) আল্লাহ কুরআন তেলাওয়াতকারীদের জন্য তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের নিকট বিশেষভাবে আলোচনা করেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِى بَيْتٍ مِّنْ بُيُوتِ اللهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ، وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ- ‘আর যখন কোন জনসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যকার কোন ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে এবং পরস্পর তা থেকে শিক্ষা অর্জন করে, তখন ফেরেশতারা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখে, তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয়, দয়া ও অনুগ্রহ তাদের আবৃত করে রাখে এবং আল্লাহর নৈকট্যশীল ফেরেশতাদের সাথে তাদের বিষয়ে আলোচনা করেন। যার আমল তাকে পিছিয়ে দেবে বংশমর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারবে না’। (মুসলিম হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/২০৪)
চ. কুরআন ঈমানের জ্যোতি ও আত্মার প্রশান্তি :
জুম‘আর দিন সূরা কাহ্ফ তেলাওয়াত করলে এক জুম‘আ থেকে পরবর্তী জুম‘আ পর্যন্ত তার ঈমান শাণিত থাকে এবং এ সময়ের যাবতীয় ফিৎনা থেকে আল্লাহ তাকে হেফাযত করেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,من قَرَأَ سُورَة الْكَهْف فِي يَوْم الْجُمُعَة أَضَاء لَهُ النُّور مَا بَيْنَ الْجُمْعَتَيْنِ- ‘যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন সূরা কাহ্ফ তেলাওয়াত করে, তার ঈমানী জ্যোতির বিকিরণ থাকবে এক জুম‘আ থেকে পরবর্তী জুম‘আ পর্যন্ত’। (বায়হাক্বী, আদ-দা‘আওয়াতুল কাবীর হা/৫২৬; হাকেম হা/৩৩৯২; মিশকাত হা/২১৭৫; ছহীহুত তারগীব হা/৭৩৬)
কুরআনে আছে শান্তির বার্তা ও রহমত প্রাপ্তির দিশা। যেমন বারা বিন আযেব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ رَجُلٌ يَقْرَأُ سُوْرَةَ الْكَهْفِ وَإِلَى جَانِبِهِ حِصَانٌ مَرْبُوْطٌ بِشَطَنَيْنِ فَتَغَشَّتْهُ سَحَابَةٌ فَجَعَلَتْ تَدْنُو وَتَدْنُو وَجَعَلَ فَرَسُهُ يَنْفِرُ فَلَمَّا أَصْبَحَ أَتَى النَّبِيَّ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ فَقَالَ تِلْكَ السَّكِيْنَةُ تَنَزَّلَتْ بِالْقُرْآنِ- ‘জনৈক ব্যক্তি সূরা কাহ্ফ তেলাওয়াত করছিল এবং তার পাশে তার ঘোড়া রশি দ্বারা বাঁধা ছিল। এমন সময় একখন্ড মেঘমালা তাকে আচ্ছন্ন করল এবং তার নিকটবর্তী হ’তে লাগল। তখন তার ঘোড়া লাফাতে লাগল। অতঃপর সে ব্যক্তি সকালে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করল। তখন তিনি বললেন, তা ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত ও প্রশান্তি, যা কুরআন তেলাওয়াতের কারণে নেমে এসেছিল’। (বুখারী হা/৫০১১; মুসলিম হা/৭৯৫; মিশকাত হা/২১১৭)
জ্ঞানার্জনে প্রথমে কুরআন শিক্ষা করা :
কুরআন শিক্ষার করার মাধ্যমে একজন ইলম অর্জনকারীর শিক্ষাজীবন শুরু করা উচিৎ। কেননা অগ্রগণ্য ও অগ্রবর্তীতার ক্ষেত্রে এটা মহিমান্বিত জ্ঞান। তারপর আল্লাহ যদি তাকে কুরআন হিফয করার তাওফীক্ব দান করেন, তাহ’লে তার উচিত হবে না সাথে সাথেই হাদীছ অথবা এমন কোন জ্ঞান আহরণে মশগূল হয়ে পড়া, যা তাকে কুরআন ভুলে যাওয়ার দিকে ঠেলে দিবে। কুরআন মুখস্থের পর শিক্ষার্থী রাসূলের হাদীছের প্রতি মনোনিবেশ করবে। কারণ মানুষের কর্তব্য হ’ল হাদীছের জ্ঞান অর্জন করা। কেননা হাদীছ শরী‘আতের অন্যতম মৌলিক উৎস ও ভিত্তি। এ সম্পর্কে ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘শিক্ষাজীবনের শুরুতে সর্বপ্রথম কুরআন মুখস্থ করতে হয়। কেননা কুরআনই সর্বাধিক গুরুতবপূর্ণ জ্ঞান। সালাফগণ কেবলমাত্র তাদেরকেই হাদীছ ও ফিক্বহ শিক্ষা দিতেন, যাদের কুরআন মুখস্থ থাকত (আল-মাজমূ‘ ১/৬৯ পৃ.)।
হাফেয ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) বলেন, فَأَوَّلُ الْعِلْمِ حِفْظُ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘জ্ঞানের প্রথম ধাপই হ’ল মহান আল্লাহর কিতাব ‘আল-কুরআন’ মুখস্থ করা’।(জামি‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, ২/১১৩০ পৃ.)
প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বালেগ হওয়ার পূর্বেই কুরআন হিফয করা উচিৎ। অন্যত্র তিনি বলেন, وَتَفَهُّمُهُ وَكُلُّ مَا يُعِيْنُ عَلَى فَهْمِهِ فَوَاجِبٌ طَلَبُهُ مَعَهُ، ‘কুরআন বুঝা এবং অনুধাবনের জন্য সহায়ক সকল জ্ঞান অর্জন করাও আবশ্যক’।(জামি‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, ২/১১৩০ পৃ.)
ইবনুল মুফলিহ (রহঃ) বলেন, মায়মুনী বলেছেন, ‘আমি আবু আব্দুল্লাহ (ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, আমি আমার সন্তানকে আগে কুরআন শিক্ষা দিব নাকি হাদীছ শিক্ষা দিব? এই দুই পদ্ধতির মধ্যে কোনটা আপনার নিকট বেশী পসন্দনীয়? তখন তিনি বললেন, না, বরং আগে কুরআন শিখাও। আমি বললাম, পুরা কুরআনই কি শিখাব? তিনি বললেন, যদি কঠিন না হয়, তাহ’লে পুরা কুরআনই শিখাও, তাহ’লে সে কুরআন থেকে আস্তে আস্তে জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে। তারপর তিনি আমাকে বললেন, যদি সে প্রাথমিকভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে, তাহ’লে তাকে নিয়মিত তেলাওয়াতে অভ্যস্ত করবে। ইমাম আহমাদের অনুসারীরা আমাদের যুগ পর্যন্ত পাঠদানের ক্ষেত্রে এই নীতিমালাই অনুসরণ করে এসেছেন’।(আল-আদাবুশ শারঈয়্যাহ ২/৩৫ পৃ.।)
দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন। এর কোন বয়স বা সময়সীমা নেই। জীবনের দীর্ঘ সময় এ পথে ব্যয় করতে হবে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞানার্জন করতে হবে। তবেই জ্ঞানের সকল শাখায় বিচরণ করা সম্ভব হবে এবং পরিপক্ক জ্ঞানী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। হাসান বিন মানছূর আল-জাসসাস বলেন, আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত বছর পর্যন্ত একজন মানুষ লেখা পড়া শিখবে? তিনি বললেন, মৃত্যু পর্যন্ত’।(ত্বাবাকাতুল হানাবিলাহ ১/১৪০ পৃ.।)
আর সমাজে নেতৃত্ব দিতে হ’লে সর্বপ্রথম জ্ঞানার্জন করা আবশ্যক। ওমর (রাঃ) বলেন, تَفَقَّهُوْا قَبْلَ أَنْ تُسَوَّدُوْا ‘নেতৃত্ব দেওয়ার পূর্বে তোমরা বিদ্যা অর্জন কর’। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, ‘নেতা হওয়ার পরেও তোমরা বিদ্যা অর্জন করতে থাক। নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ তো বৃদ্ধ বয়সে বিদ্যা শিখেছেন’।(বুখারী তালীকান ১/৩৯ পৃ.।)