[মিসরের এক গৃহবধূ কর্তৃক প্রসিদ্ধ দৈনিক পত্রিকা আল-আহরামে পাঠানো সাম্প্রতিক কালের একটি বাস্তব ঘটন]
গৃহবধূ লিখেন,
একটি পত্রের উত্তরে লেখা আপনার কবিতার দু’টি শ্লোক আমাকে এ পত্রটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। শ্লোকগুলো এই,
إِنَّمَ الدنّيا هَبَّات* وعَوَارٍ مُسْتَدَّة
شِدَة بعدَ رَخَاء * ورَخاءٌ بعدَ شِدَة
‘কিছু ঝাপটা ও ফেরতযোগ্য কিছু ঋণ,
সুখের পর দুঃখ ও দুঃখের পর সুখ,
এটাই তো দুনিয়া।’ তাই আমি আমার কাহিনীটি লিখতে ইচ্ছে করেছি। হয়তো কারো শিক্ষাগ্রহণের খোরাক হবে। আমি এক গৃহবধূ, কলেজপড়–য়া এক তরুণী ও দুই ছেলের পিতা এক যুবকের মা। আমার স্বামী সামরিক অফিসার। কায়রো শহরের একটি এলাকায় আমাদের বাসা। দাম্পত্য জীবনের সূচনা থেকে সুখময় জীবন যাপন করে আসছি। সন্তানদের প্রতিপালনের জন্য আমরা অনেক পরিচারিকা রেখেছি। তাদের সংখ্যা এতবেশি যে, সঠিক সংখ্যা এখন মনে পড়ছে না। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, কেননা, কোনো পরিচারিকা আমাদের বাসায় দুই মাসের অধিক অবস্থান করতে পারতো না। আমার স্বামীর স্বভাবগত অস্বাভাবিক কঠোরতার কারণে ক’দিন পরেই পালিয়ে যেতো। জানিনা এ কঠোরতা তার সামরিক
জীবনের ফসল, না বংশগত দোষ? তিনি বাসায় কর্মরত যে-কোনো পরিচারিকাকে বিভিনড়ব পন্থায় শাস্তি দিতেন। স্বীকার করছি, আমিও মাঝেমধ্যে তার অপরাধের অংশীদার হতাম। পনের বছর পূর্বের কথা। তখন মেয়ের বয়স সাত বছর ও ছেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। একদিন স্বামীর পূর্বপরিচিত, তাঁরই শহরের এক কৃষক নয় বছরের শিশুকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে
আমাদের বাসায় আসে। আমার স্বামী তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞাভরে স্বাগত জানান। সাদাসিধে কৃষক বললো, ‘মেয়েকে নিয়ে এসেছি, সে মাসিক বিশ পাউন্ডের বিনিময়ে আপনাদের বাসায় কাজ করুক।’ আমরা সম্মত হই। খেটে খাওয়া কৃষক তার সুপুষ্ট কন্যাকে রেখে দিতে চাইলে সে পিতার আঁচল ধরে কানড়বা জুড়ে দেয়। আর কেঁদে কেঁদে কসম দিয়ে বলে, আমাকে তাড়াতাড়ি দেখতে আসবেন, আর আম্মু ও ভাই বোনদেরকে সালাম জানাবেন। পিতা তার দাবিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নেয়। মেয়েটি আমাদের সঙ্গে তার নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করে। প্রতিদিন নাশতা ক্সতরিতে সহযোগিতার জন্য আমার দুই শিশুর পূর্বেই প্রত্যুষে উঠে যায়। এরপর স্কুলের ব্যাগ হাতে সড়কের পাশে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকে। স্কুলের অটোবাস আসলে তাদেরকে তুলে দিয়ে বাসায় ফিরে। তারপর সকালের নাশতা করে। অধিকাংশ সময় এ নাশতা হতো তেলবিহীন সবজি ও বাসি রুটি। মাঝেমধ্যে আমরা তাকে সামান্য মধু বা পনির দিতাম। নাশতার পর থেকে অর্ধরাত পর্যন্ত বাসার কাজে ব্যাপৃত থাকে। অর্ধরাতের পর রণে ভঙ্গ দিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে মেঝেতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। এভাবেই চলতো তার দিনরাত। দায়িত্ব পালনে সামান্য বিচ্যুতি, বিলম্ব বা বিস্মৃতি ঘটলে আমার স্বামী নির্দয়ভাবে তাকে পেটাতো। মেয়েটি কেঁদে কেঁদে সয়ে যেতো সব নির্যাতন। সে ছিলো খুবই আমানতদার, পরিচ্ছনড়ব, মার্জিতরুচি ও বাসার সকলের প্রতি আন্তরিক। সামান্যতেই সন্তুষ্ট থাকতো। থালাবাটি পরিষ্কার করার সময় নিজের মাতৃভূমি, মা ও ভাইবোনদের শোকে গুনগুন করে অস্ফুট সুরে বিরহের গান গাইতো। স্বীকার করছি, পরিচারিকাদের প্রতি আমার স্বামীর নিষ্ঠুর আচরণে অনেকাংশে আমিও শরিক ছিলাম। তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি
অনেক সময় অজুহাত খোঁজে বের করতেন। তবে মাঝেমধ্যে এই মেয়েটির প্রতি আমার দয়া হতো। কারণ সে ছিলো পরিচ্ছনড়ব, বিনয়ী ও আন্তরিক। আমি তাকে না মারার জন্য স্বামীর প্রতি মিনতি করতাম। বলতাম, ‘সে তো বড় হয়েছে, আমাদের স্বভাবের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, আমাদের অনেক কিছুই তার সহ্য হয়ে গেছে। অতএব তাকে মারতে থাকার কোনো কারণ নেই।’ তিনি অট্টহাসি দিয়ে বলতেন, ‘আমি যদি তাকে না মারি, সে মারতে বলবে। কেননা মার খাওয়ার উপরই সে গড়ে উঠেছে। এ ধরণের মানুষগুলোর সাথে ভাল ব্যবহার ফলপ্রসূ হয় না।’ যা হোক, কিশোরী সকল নিপীড়ন নীরবে সহ্য করতে থাকে। আমার মনে পড়ে, যখন ঈদ আসতো এবং আমার সন্তানদ্বয় হেসে খেলে ঈদ উদ্যাপনে বের হতো, তখনো তাদের সমবয়সী এই কিশোরী কোনো আদর-যতড়ব ছাড়াই বাসায় ঘষামাজার কাজে লেগে থাকতো।
কঠিন কাজগুলো সেরে তার পুরাতন গাউনটি গায়ে জড়িয়ে বের হতো। পুরাতন হলেও তার কাপড় থাকতো ঝরঝরে। কেননা, সে তার মামুলি কাপড়গুলোর পরিচ্ছনড়বতার প্রতি ছিলো সদা যতড়বশীল। আমাদের কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে সে মাত্র বারকয়েক তার বাপের সাক্ষাৎ পেয়েছে। কয়েক মাস পর থেকেই তাকে দেখতে আসা বন্ধ হয়ে যায় পিতার। কেবল মাসিক বেতনটা নেওয়ার জন্য এক নিকটাত্মীয়কে পাঠাতেন। তদ্রƒপ মা ও ভাইদের সাক্ষাৎ পেয়েছে কেবল তিনটি উপলক্ষ্যে। প্রথম: যখন তার বড় ভাই জর্ডান থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মারা যায়। ভাইয়ের ফিরে আসাকে ঘিরে এই বঞ্চিতা কিশোরী অনেক রঙিন স্বপড়ব বুনতো। সে আশা করতো, ভাই ফিরে এসে তাকে এই অনিশেষ খাটুনি ও যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার মৃত্যুতে জীবনের শেষ আশাটুকুও হারিয়ে ফেলে কিশোরী। ভাইয়ের বিরহযাতনায় অনেক কেঁদেছে, তবে নীরবে নিভৃতে। পাছে আমার স্বামী দেখে ফেললে পিটুনি খেতে হবে! দ্বিতীয়: যখন সে একটি সংμামক রোগে আμান্ত হয়। দয়ার কারণে নয়, রোগের সংμমণ থেকে আমাদের সন্তানদেরকে বাঁচানোর জন্য তাকে এই বলে দেশে পাঠিয়ে দিই যে, তুমি আম্মা ও ভাইবোনদেরকে দেখতে যাও। তৃতীয়. ক্সকশোরে পদার্পণের পর যখন তার পিতা মারা যায় ও শোকে-দুঃখে সে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে। জনাব, আশা করি আমার কথাগুলো বিশ্বাস করবেন। কেননা, আমি নিজেই নিজের ঘটনা লিখছি। এখানে মিথ্যা বলার কোনো কারণ নেই। সামান্য সামান্য ভুলের কারণে আমাদের পক্ষ হতে তার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের কথা যখনই মনে পড়ে, আমি কানড়বায় ভেঙ্গে পড়ি। অন্য যে কোনো শিশুর মতো, বরং অন্য যে কোনো মানুষের মতো ভুল করা ছিলো তার জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু আমার স্বামী তাকে বৈদ্যুতিক
তারের অভ্যাঘাতে বেহুশ করে ফেলতেন! প্রচন্ড শীতের রাতে বহুবার রাতের আহার থেকে তাকে বঞ্চিত করেছি। তখন সে ক্ষুধার যন্ত্রণায় জড়সড় হয়ে রাত কাটিয়ে দিতো। দীর্ঘ বহু বছরে একটি রাতও সে না কেঁদে ঘুমিয়েছে আমার স্মরণে নেই! জনাব, জিজ্ঞাসা করতে পারেন, এত কঠিন যন্ত্রণা সে কেন সহ্য করেছে? কেনইবা হাড় জড়ানো চামড়াটা নিয়ে পালিয়ে যায়নি? উত্তরে বলবো, তার পালানোর কোনো পথ ছিলো না। শুনুন, ক্সকশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণের সময় সে একদিন পালিয়ে গিয়েছিলো। সবজি কিনতে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। আমার স্বামী দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, একই সড়কে কসাই দোকানে কর্মরত এক যুবকের সাথে সে দীর্ঘ সময় কথা বলতো। হয়তো বিবাহ করে এই কষ্টের জীবন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য উক্ত যুবকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এক সপ্তাহ না যেতেই আমার স্বামীর প্রভাবশক্তি তাকে তার নিভৃত প্রকোষ্ঠ থেকে বের করে আনলো। ফেরার পর আমরা সর্বপ্রকার শাস্তি দ্বারা তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। আমার স্বামী তাকে বিদ্যুতের সেঁক দিলো। ছেলেও তাকে কঠিন পদাঘাত করে ঝাল মেটালো। কিন্তু আমার মেয়ে কেঁদে কেঁদে তার পিতাকে বলছিলো, হারাম, আব্বু! হারাম হারাম। কিন্তু তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন এবং ঘুরে তাকেও মারতে আরম্ভ করলেন! এই প্রথম বারই তাকে তার পিতা প্রহার করেছে! তরুণী আমাদের বাসায় সেই কঠিন কাজে আবার ফিরে আসলো এবং তার বিবেকের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। শুরু হলো সেই পুরনো একই নিয়ম তার ভুল হয়, কাজে মাঝেমধ্যে বিলম্ব হয়, আর আমার স্বামী তাকে নির্দয়ভাবে পেটান। সপ্তাহিক ছুটির সময় আমরা পিরামিড এলাকায় যেতাম গোশতের খাবার উপভোগ করার জন্য এবং তার খাওয়ার জন্য রেখে যেতাম পুরো সপ্তাহের অবশিষ্ট বাসি খাবার। ধীরে ধীরে আমরা লক্ষ্য করলাম, মাঝেমধ্যে তার হাত থেকে বাসন- পেয়ালা পড়ে যাচ্ছে এবং চলতে গিয়ে সে হোঁচট খাচ্ছে। তাকে ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার নিশ্চিতভাবে বললেন, ‘তার দৃষ্টিশক্তি খুবই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। আবার ধীরে ধীরে ফিরে আসতে পারে।’ এখন সে পায়ের জিনিসও দেখতে পায় না। অর্থাৎ প্রায় অন্ধের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাসত্ত্বেও আমরা তার প্রতি রহম করিনি। পূর্বের ন্যায় এখনো ঘর পরিষ্কারের কাজ করছে ও সবজি কেনার জন্য বাজারে
যাচ্ছে। বহুবার বাসি সবজি কিনে আনার কারণে আমি তাকে চপেটাঘাত করেছি। অথচ দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসার কারণেই তার এমনটি হতো। এহেন দুর্দশায় তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে দারোয়ানের স্ত্রী প্রাসাদের দ্বারকক্ষে তাকে বসিয়ে নিজেই সবজি কেনার জন্য যেতো, যেন সে লাঞ্ছনা ও প্রহার থেকে রেহাই পায়। এভাবে কিছুদিন কেটে যায়। এরপর তরুণী প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর একদিন বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। আমরাও তাকে তালাশের চেষ্টা করিনি। কয়েকটি বছর অতিবাহিত হলো। আমার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত হলেন, পদ ও প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেললেন এবং কঠিনভাবে অবসরের একঘেঁয়ে জীবনের মুখোমুখি হলেন। ফলে তাঁর রূঢ়তা, উত্তেজনা ও বিচ্যুতি অসহনীয় পর্যায়ে বৃদ্ধি পেলো। তবুও দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের কারণে সবকিছু বরদাশত করছিলাম। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করে কর্মজীবনে যোগ দিলো। তারপর তার এক সহকর্মিণীকে (ঈড়ষষবধমঁব) বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার ইচ্ছা করলো। আমরা মেয়েটির কাছে প্রস্তাব পাঠালাম। সে ছিলো অতি রূপসী তরুণী। যথাসময়ে বিয়ে হলো। আমরা সুখী হলাম। আমাদের সুখানুভূতি পূর্ণতা লাভ করলো তখন, যখন শুনলাম সে গর্ভবতী। এরপর দীর্ঘ প্রতীক্ষাশেষে সৌভাগ্যের ক্ষণ উপস্থিত হলো, পুত্রবধূ একটি ফুটফুটে ছেলে প্রসব করলো। কিন্তু সহসা প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেয়ে আমরা আবিষ্কার করলাম, নবজাতক জন্মান্ধ, পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তিহীন! মুহূর্তে আনন্দে মাতোয়ারা পরিবেশ নিদারুণ বিষাদের গাঢ় মেঘের রূপ ধারণ করলো। আমরা ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগের দীর্ঘ যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ছেলে ও পুত্রবধূ বাস্তবতার কাছে নতি স্বীকার করলো। তাদের হৃদয়ে আশার আলো নিভে গেলো। আমরা কষ্টের প্রতীক নাতিকে অন্ধদের নার্সারিতে ভর্তি করালাম। বিপদের পুনরাবৃত্তির ভয়ে পুত্রবধূ আর গর্ভবতী না হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। কিন্তু ডাক্তাররা আশ্বস্ত করে বললেন, ‘অসম্ভব কথা! স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের কারো মধ্যে বংশগত ত্রুটি নেই। কেন এই সিদ্ধান্ত নিবেন!’ আমরাও তাকে সাহস দিলাম এই আশায় যে, হয়তো আল্লাহ তাআলা আমাদের ছেলেকে স্বাভাবিক একটি শিশু দান করবেন, যা প্রথম শিশুর কারণে পুঞ্জিভূত মর্মবেদনা লাঘব করবে। পুত্রবধূ আবার গর্ভবতী হলো এবং দেখতে দেখতে তার কোলজুড়ে আসলো একটি রূপসী কন্যা। ভয়ে শংকায় আমাদের হৃদয়স্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছিলো। একটু পরেই ডাক্তার সুসংবাদ শোনালো যে, কন্যা দৃষ্টিশক্তিসম্পনড়ব। আমরা যারপরনাই ধন্য ও আনন্দিত হলাম। চতুর্দিক থেকে কন্যা ও তার সহোদরের প্রতি খেলনা, পোশাক ও রকমারি উপঢৌকনের বারি বর্ষিত হলো। সাত মাস পর বিস্ময়বিহ্বল হয়ে লক্ষ্য করলাম, তার দৃষ্টি একদিকেই কেন্দ্রীভূত থাকে, অন্য কোনো দিকে ফিরে না! চোখের সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছে পেশ করলাম। অকস্মাৎ অতি প্রচন্ড আঘাত দিয়ে তিনি শোনালেন, শিশু সামান্য আলোকরশ্মি ছাড়া কিছুই দেখে না। অচিরেই পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যেতে পারে। ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’। আমার স্বামী এ-করুণ দশা দেখে কঠিন মানসিক পীড়ায় আμান্ত হলেন। বিষিয়ে উঠলো তাঁর জীবন। সবকিছুকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন। দিনদিন তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ডাক্তার দুশ্চিন্তার চিকিৎসার জন্য তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানোর উপদেশ দিলেন। আমার হৃদয় কুঁকড়ে গেলো। অনুভব হলো, রাজ্যের সকল দুশ্চিন্তা তীব্রভাবে আমার বক্ষকে দলিত মথিত করছে। অসহনীয় বিষণড়বতা ও অবসাদে হঠাৎ মনে পড়লো আমাদের নরক থেকে অন্ধ হয়ে পালিয়ে যাওয়া সেই দুঃখিনী তরুণীর কথা, দশটি বছর যে আমাদের বাসায় কাটিয়েছে এবং লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, বেদম প্রহার ও বিদ্যুতের আঘাত ভোগ করেছে। আমি অস্থির হয়ে নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা তার প্রতি কৃত অপরাধের আসমানি শাস্তি নয় কি? সেই অসহায় এতিম তরুণীর অবয়ব একাকিত্বে আমাকে তাড়া করে ফিরছে, যাকে আমরা চিকিৎসাহীন ফেলে রেখেছিলাম এবং আমাদের নিপীড়নেই সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আল্লাহর কাছে কৃত অপরাধের ক্ষমা পাওয়ার আশা পূরণের একটিমাত্র পথই দেখতে পাচ্ছিলাম। তা হলো, তরুণীকে খোঁজে বের করে তার প্রতি সদাচার করে গোনাহের কাফফারা দেওয়া। আমি সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করলাম। এক প্রতিবেশি তার ঝুপড়ির সন্ধান দিলো। জানতে পারলাম সে একটি মসজিদের খিদমত করছে। আমি তড়িৎ গিয়ে তাকে নিয়ে আসলাম, যেন যতদিন বেঁচে থাকি সে আমার সাথেই থাকে। সকল নির্মম স্মৃতি সত্ত্বেও তাকে সন্ধান করতে ও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে দেখে সে আনন্দিত হলো। দশ বছরের সাহচর্যের কথা আমরা ভুলে গেলেও সে ভুলে যায়নি। আমি তার হাত ধরলাম, সে পথ খুঁজে খুঁজে আমার হাত ধরে বাসায় ফিরে আসলো। আমার যুবতী মেয়ের কণ্ঠ শুনে আনন্দিত হলো, যাকে সে শৈশবে ও কৈশোরে হৃদয় দিয়ে ভালবেসেছিলো। আনন্দিত হলো সন্তানদের দুশ্চিন্তায় ভেঙ্গেপড়া আমার ছেলের কণ্ঠ শুনেও। যুবতী এখন আমাদের বাসায় থাকে। এখন আমি তার সেবা করে ও দুই প্রতিবন্ধী নাতি-নাতনির খিদমত করে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আল্লাহর কাছে দুআ ও প্রত্যাশা, তিনি যেন আমার অপরাধ ক্ষমা করেন। আর যাদের অন্তরে দয়া ও মায়ার পরশ নেই তাদেরকে বলতে চাই, আল্লাহ চিরঞ্জীব ও চির জাগ্রত। অতএব, কারো প্রতি কঠোর ব্যবহার করো না। অচিরেই সে দিনটি উপস্থিত হবে, যেদিন পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে করুণা ভিক্ষা করবে এবং দাপট ও প্রতিপত্তির জীবনে কৃত অপরাধের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হবে।
(মূল: আবদুল ওয়াহহাব মুতাবি’ ও অনুবাদ: আবু উমামাহ)