(এক) খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয যখন মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন, জানা গেছে তাঁর খাদেম খাদ্যে বিষ মিশিয়ে পরিবেশন করায় তিনি আক্রান্ত হয়েছেন, তিনি উক্ত খাদেমকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন এই হতভাগা ! আমার খাবারে বিষ মিশিয়েছ কেন ???
খাদেম প্রকম্পিত হয়ে ভয়ে ভয়ে তাঁকে বলল: প্রিয় মুনীব,বানু উমাইয়্যার যুবরাজরা আমাকে এক হাজার দীনার দিয়েছেন এবং আমাকে স্বাধীন করে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন এ শর্তে যে এই জঘন্য অপরাধটি আমি….
মহান খলীফা তাকে বললেন,তুমি ঐ এক হাজার দীনার বায়তুল মালে জমা দাও, তুমি এখন থেকে মুক্ত,আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম।
মৃত্যু সন্নিকটে জেনেও খলীফা মুসলমানদের বায়তুল মালের উন্নয়নে চিন্তিত এবং প্রতিশোধ নেয়ার শক্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘাতক কে ক্ষমা করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ঐ যুগের শত সহস্র আলেম সাক্ষী,খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয নেক নিয়ত ছাড়া একটি পদক্ষেপ ও গ্রহণ করতেন না।
তাই তাঁর মাত্র আড়াই বছরের শাসনামলে দারিদ্র্য মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এবং ন্যায়নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, এমনকি পথে প্রান্তরে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা শোনা যেত: “বিয়ে -শাদি,ঋণ পরিশোধ, এবং হজ্জ করতে আগ্রহীদের বায়তুল মাল থেকে পরিপূর্ণ ভাবে সহযোগিতা করা হবে,আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন।”
এত ন্যায়পরায়ন খলীফা হওয়া সত্ত্বেও তিনি পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত শুনে কাঁদতেন, আলেমদের একদল বলেন যে খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয এর কান্নায় মনে হত জাহান্নামের আগুন বুঝি কেবলমাত্র তাঁর জন্য ই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি প্রায় ই ওলামায়ে কেরামের সমাবেশ এর আয়োজন করে আখিরাত বিষয়ে নসীহত শুনতেন।
পুরো পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ যিনি শাসন করতেন, তাঁর জীবন যাপন, বেশভূষা এবং আহার আপ্যায়ন ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে,মনে হত যেন দুনিয়া বিমুখ মুসাফির।
ফারূকে আ’যমের নাতি খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয কখনো খেয়াল খুশি ও সহজাত প্রবৃত্তির অনুসরণ করতেন না, সহজাত প্রবৃত্তি ও তাঁর থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করত, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে ই দুনিয়া ত্যাগী মনীষী, দুনিয়ার বিনিময়ে তিনি চিরস্থায়ী জান্নাতের প্রত্যাশী ছিলেন, মৃত্যুর মুহুর্তে তাঁর মুখ থেকে ক্ষীন কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল: تلك الدار الآخرة نجعلها للذين لا يريدون علوا فى الارض ولا فسادا والعاقبةللمتقين
‘ঐটি আখিরাতের সেই আবাস, যা নির্ধারিত করি তাদের জন্য, যারা পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায়না,শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য। (সূরা আল কাসাস: ৮৩)।
খলীফার মৃত্যুর দশ বছর পর একটি খাদ্যগুদামে বড় দানা বিশিষ্ট কয়েক বস্তা গম পাওয়া গিয়েছিল,যা প্রায় খেজুরের সমান সমান,ন্যায় ও ইনসাফের সমাজে বরকতের নমূনা ছিল এগুলো।
যে জীবনের লক্ষ্য থাকে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি, আল্লাহ তার মনের আশা পুরণ করে থাকেন।
কথিত আছে যে এই সময়ে দেশে এত সুখ ও সমৃদ্ধি ছিল যে কারো কোন অভিযোগ ছিল না,এক ই পালে বাঘ বকরি চরে বেড়াত।
বর্তমান ফিতনার যুগে হিংস্র জন্তুর আক্রমণ তো রয়েছেই,উপরোন্ত আমাদের গ্রাস করছে
আমাদের ই স্বজাতি ও স্বধর্মের লোকেরা। তাই বড় ই পরিতাপের সাথে বলতে হচ্ছে খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয চলে গেছেন , সেই সাথে চলে গেছে ন্যায়-পরায়ণতাও ইনসাফ।
———————-***———————–
(দুই) ছোটবেলায় হিন্দুস্তানের বাদশাহ কুতুবউদ্দীন আইবকের ইনসাফের বিষয়ে একটা ঘটনা পড়েছিলাম। একবার উনি শিকার করছিলেন। দূর থেকে একটা কিছু দেখে তির চালিয়ে দিলেন। তারপর শিকারের কাছে গিয়ে দেখলেন, একটি কিশোর তাঁর তিরের আঘাতে জখম হয়ে পড়ে আছে ! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেই আহত কিশোরের মৃত্যু হল। বাদশাহ খোঁজ নিয়ে জানলেন, কিশোরটি ছিল কাছের এক গ্রামে বাস করা এক বৃদ্ধার একমাত্র সাহারা। সে জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করে বিক্রি করত এবং যা মিলত তাই দিয়েই কোনও রকমে নিজের ও মায়ের পেট চালাত। বাদশাহ কুতুবউদ্দীন নিহত কিশোরের মায়ের কাছে গেলেন। বললেন যে, ভুলবশত তাঁর ছোড়া তিরের আঘাতে তাঁর ছেলের মৃত্যু হয়েছে। মা কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। এরপর বাদশাহ কুতুবউদ্দীন খোদ নিজেকে কাজীর আদালতে সোপর্দ করলেন এবং নিজের অপরাধের উল্লেখ করে নিজেরই বিরুদ্ধে মামলা চালানোর আর্জি পেশ করলেন। কাজী সাহেব শুরু করলেন মোকদ্দমা। আদালতে ডেকে পাঠালেন মৃত কিশোরের বৃদ্ধা মাকে। তারপর তাঁকে বললেন, ‘আপনি যে শাস্তির কথা বলবেন, সেই শাস্তিই দেওয়া হবে এই অপরাধীকে।’
বৃদ্ধা বললেন, ‘এমন বাদশাহ ফের কোথায় পাওয়া যাবে, যিনি নিজেরই সাম্রাজ্যে নিজেরই বিরুদ্ধে মামলা চালাবেন এবং এমন এক ভুলের জন্যে যা করা হয়নি জেনে বুঝে ! আজ থেকে কুতুবউদ্দীন হবে আমার ছেলে। আমি মাফ করে দিলাম একে !’
কাজী সাহেব তখন বাদশাহ কুতুবউদ্দীনকে মুক্তি দিলেন এবং বললেন, ‘আপনি যদি আদালতে সামান্য হলেও আপনার শাহী প্রভাব দেখাতেন, তাহলে আমি আপনাকে এই বৃদ্ধার সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিতাম না, বরং আমি নিজেই আপনাকে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দিতাম !’
এর উত্তরে বাদশাহ কুতুবউদ্দীন নিজের কোমর থেকে খঞ্জর বের করে, কাজীকে দেখিয়ে বললেন, আপনি যদি আমার সঙ্গে অপরাধীর মতো ব্যবহার না করে আমার বাদশাহীর কথা একটুও খেয়াল করতেন, তাহলে আমি এই খঞ্জর দিয়ে আপনাকে মৃত্যুর ঘাট পার করিয়ে দিতাম !’ এই হলো আসল বাদশাহী ও তার ইনসাফ !
(সংগৃহীত : হিন্দি হতে বাংলা অনুবাদকৃত)