ফাসিক (فاسق) একটি আরবী শব্দ, যার দ্বারা শারঈ বিধান লঙ্ঘিত হয়। তাছাড়া ইসলামী আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। একজন ফাসিক ব্যক্তিকে অবিশ্বাসযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ইসলামিক আদালতে একজন ফাসিক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না।
গালমন্দ করা :
একজন মুসলিম ভাইকে গাল দেওয়াকে ফাসেকী বলা হয়েছে। আর ফাসেকী হলো আল্লাহর আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়া। আর যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইকে হত্যা করে সে অবশ্যই কাফির হয়ে যাবে এবং মুসলিম হওয়া থেকে বের হয়ে যাবে যদি সে হত্যা করাকে বৈধ বলে বিশ্বাস করে। আর যদি কোন দুনিয়াবী উদ্দেশ্য বা ক্ষোভের কারণে হত্যা করে হালাল মনে করে নয়, তখন তা হবে ছোট কুফর। তাতে সে ইসলাম থেকে বের হবে না। তখন তার ওপর কুফর শব্দের ব্যবহারটি ভীতিপ্রদর্শনে সর্বচ্চো গুরুত্ব প্রদান হিসেবে হবে। তাই রাসূল (ছাঃ) বলেন, «سِبابُ المسلم فسوق، وقتاله كفر». ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং তার সাথে লড়াই ঝগড়া করা কুফুরী’ (মিশকাত হা/৪৮১৪)।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর হতে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “কবিরা গুনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল নিজের পিতা-মাতাকে লানত করা। জিজ্ঞাস করা হলো: হে আল্লাহর রাসুল (সা)! আপন পিতা-মাতাকে কোনো লোক কিভাবে লানত করতে পারে? তিনি বললেন: সে অন্যের পিতাকে গালি দেয়, তখন সে তার পিতাকে গালি দেয় এবং সে অন্যের মাকে গালি দেয়, তখন সে তার মাকে গালি দেয়। [বুখারী হা/৫৯৭৩, মুসলিম হা/৯০] অন্যত্র বলেন, ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ’পরস্পরকে গালি দানকারীর মধ্যে যে পূর্বে গালি দিয়েছে সে দোষী, যদি নির্যাতিত (প্রথম যাকে গালি দেয়া হয়েছে) ব্যক্তি পরিসীমা অতিক্রম না করে থাকে’। (মুসলিম)
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা বসিয়াছিলেন, তাহার উপস্থিতিতে এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (আঃ) উনাকে গালি দিলো। তিনি (ঐ ব্যক্তির বার বার গালি দেওয়া এবং হযরত আবু বকর সিদ্দিক (আঃ) উনার সবর ও খামুশ থাকার উপর) খুশী হইতে থাকেন এবং মুচকি হাসিতে থাকেন। অতঃপর যখন সেই ব্যক্তি অনেক বেশী গালিগালাজ করিল তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (আঃ) তাহার কিছু কথার জবাব দিলেন। ইহার উপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসন্তুষ্ট হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (আঃ) ও তাহার পিছনে পিছনে তাহার নিকট পৌঁছিলেন এবং আরজ করিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (যতক্ষণ) ঐ ব্যক্তি আমাকে গালি দিতেছিল আপনি সেখানে অবস্থান করিতেছিলেন, তারপর যখন আমি তাহার কিছু কথার জওয়াব দিলাম তখন আপনি নারাজ হইয়া উঠিয়া গেলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিলেন, যতক্ষণ তুমি চুপ ছিলে এবং সবর করিতেছিলে তোমার সহিত একজন ফেরেশতা ছিল, যে তোমার পক্ষ হইতে জওয়াব দিতেছিল। তারপর যখন তুমি তাহার কিছু কথার জওয়াব দিলে তখন সেই ফেরেশতা চলিয়া গেলো আর শয়তান মাঝখানে আসিয়া গেলো। আর আমি শয়তানের সহিত বসি না। এই জন্য আমি উঠিয়া রওনা হইয়া গিয়াছি। (মুসনাদে আহমদ)
তাছাড়া মৃত ব্যক্তিকে গাল-মন্দ করা ও তাদের দোষ চর্চা নিষিদ্ধ হওয়ার প্রমাণ। আর এটি খারাপ স্বভাবের একটি। নিষিদ্ধ হওয়ার হিকমত রাসূলের বাণীর অবশিষ্ট অংশে: “কারণ, তারা স্বীয় কর্মফল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ, তারা তাদের স্বীয় কর্ম খারাপ হোক বা ভালো হোক সে পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন। আর গাল দেওয়া তাদের কাছে পৌঁছবে না, বরং তা জীবিতদের কষ্ট দেয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, «لا تسبوا الأموات؛ فإنهم قد أفضوا إلى ما قدموا» “তোমরা মৃতদের গালি দিও না; কারণ, তারা স্বীয় কর্মফল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।”(বাখারী হা/১৬৬৪)।
- হাদীসটি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মৃতদের গাল দেয়া হারাম। আর এটির ব্যাপকতা প্রমাণ করে যে, চাই তারা মুসলিম হোক বা কাফের।
- এ থেকে বাদ দেওয়া হয় তাদেরকে যাদের দোষ আলোচনা করাতে কোনো উপকার আছে।
- নিষেধ করার হিকমাত হাদীসটিতে এসেছে, আর তা হলো তারা ভালো বা মন্দ যা করেছেন তার পরিণতির দিকে তারা পৌঁছে গেছেন। তাই তাদের গাল দেয়াতে কোনো লাভ নেই। এছাড়াও এতে রয়েছে তার জীবিত আত্মীয়দের কষ্ট দেওয়া।
- যাতে কোনো উপকার নেই তা বলা কোনো মানুষের জন্য উচিত নয়।
উপহাস করা :
মানুষকে উপহাস করা কিংবা মন্দ নামে ডাকা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ করণে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়, সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। যার পরিণতি হয় ভয়াবহ। তাই এসব মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত থাকতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُوْنُوْا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوْا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوْا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوْقُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! কোন সম্প্রদায় যেন কোন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। হ’তে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। আর নারীরা যেন নারীদের উপহাস না করে। হ’তে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। তোমরা পরস্পরের দোষ বর্ণনা করো না এবং একে অপরকে মন্দ লকবে ডেকো না। বস্তুত : ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা হ’ল ফাসেক্বী কাজ। যারা এ থেকে তওবা করে না, তারা সীমালংঘনকারী’ (হুজুরাত ৪৯/১১)।
[১] এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে উপহাস বা ঠাট্টা-বিদ্রূপ তখনই করে, যখন সে নিজেকে তার চাইতে উত্তম এবং তাকে নিজের চেয়ে হীন ও ছোট মনে করে। অথচ আল্লাহর কাছে ঈমান ও আমলের দিক দিয়ে কে উত্তম, আর কে নয় –এ জ্ঞান কেবল তাঁরই কাছে। কাজেই নিজেকে উৎকৃষ্ট এবং অপরকে নিকৃষ্ট মনে করার কোনই বৈধতা নেই। তাই আয়াতে অপরকে উপহাস করা হতে নিষেধ করা হয়েছে। আর চারিত্রিক এ রোগ মহিলাদের মধ্যে অধিকহারে বিদ্যমান থাকায় তাদের কথা পৃথকভাবে উল্লেখ করে বিশেষভাবে তাদেরকে এ কাজ থেকে নিষেধ করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন সেখানকার অধিকাংশ লোকের দুই তিনটি করে নাম ছিল। তন্মধ্যে কোনো কোনো নাম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে লজ্জা দেয়া ও লাঞ্ছিত করার জন্য লোকেরা খ্যাত করেছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা জানতেন না। তাই মাঝে মাঝে সেই মন্দ নাম ধরে তিনিও সম্বোধন করতেন। তখন সাহাবায়ে কেরাম বলতেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সে এই নাম শুনলে অসন্তুষ্ট হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়। [আবু দাউদ: ৪৯৬২, মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৮০]
রাসূল (সাঃ)-এর হাদীসে মানুষকে তুচ্ছ মনে করাকে ‘অহংকার’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, (الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ) (মুসলিম ৯১নং, তিরমিযী, হাকেম ১/২৬) আর অহংকার ও অহংকারীকে আল্লাহ চরম ঘৃণা করেন।
[২] কোন দোষ বা ত্রুটি ধরে একে অপরকে খোঁটা দিও না। যেমন বলা, তুই তো অমুকের বেটা না, তোর মা তো এ রকম ও রকম, তুই তো অমুক বংশের না! ইত্যাদি।
[৩] ব্যঙ্গ ও তুচ্ছজ্ঞান করে মানুষের এমন নাম রেখো না (বা এমন খেতাব বের করো না), যা সে পছন্দ করে না। অথবা তার ভাল ও সুন্দর নামকে বিকৃত করে ডেকো না।
[৪] এইভাবে নাম বিকৃত করে অথবা মন্দ নাম বা খেতাব রেখে সেই নামে ডাকা, কিংবা ইসলাম গ্রহণ বা তওবা করার পর তাকে অতীত ধর্ম বা পাপের সাথে সম্পৃক্ত করে সম্বোধন করা; যেমন, এ কাফের! এ ইয়াহুদী! এ লম্পট! এ মাতাল! ইত্যাদি বলে সম্বোধন করা অতীব মন্দ ও গর্হিত কাজ। الاسْم এখানে الذِّكْرُ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ, بِئْسَ الاسْمُ الَّذِيْ يُذْكَرُ بِالفِسْقِ بَعْد دُخُوْلِهِمْ فِي الإِيْمَانِ (فتخ القدير) অবশ্য কোন কোন গুণগত নাম কারো কারো নিকট এ নিষেধের আওতাভুক্ত নয়, যা লোক মাঝে প্রসিদ্ধ হয়ে যায় এবং সে এ নামে স্বীয় অন্তরে কোন দুঃখ বা রাগও অনুভব করে না। যেমন, খোঁড়া নামে প্রসিদ্ধ কোন খোঁড়াকে ‘খোঁড়া’ বলে ডাকা, কালিয়া অথবা কালু নামে প্রসিদ্ধ কোন কালো রঙের লোককে ‘কালিয়া’, ‘কালো’ বা ‘কালু’ বলে ডাকা ইত্যাদি। (কুরতুবী)