গোঁড়ামি পরিহার করুন !

গোঁড়ামি কখনো ধর্মতত্ত্ব নয়,

ধর্মে (দ্বীনে) কভু গোঁড়ামী নাই।

মানুষ নিজের বুঝের উপরে অটল থাকতে চায়। সে যা ভাল মনে করে তাই করে। তার এই গোঁড়ামি তাকে হক্ব গ্রহণে বাঁধাগ্রস্ত করে। গোঁড়ামি ঈমান-আমল ও দ্বীনের জন্য অনেক ক্ষতিকর।

‘গোঁড়ামি’ (Bigotry, Oorthodoxy, Narrowness) শব্দটি বিশেষ্য পদ, যার আভিধানিক অর্থ- অন্ধবিশ্বাস, একান্ত রক্ষণশীলতা, অপ্রশস্ততা, সংকীর্ণতা প্রভৃতি।

পারিভাষিক অর্থে, শরীয়তের মধ্যে কিংবা বাহিরে বিনা দলিলে কোন কথা ও কাজে অন্ধবিশ্বাস রেখে অন্তরে ইলমের সংকীর্ণতা গড়ে তোলাকে গোঁড়ামী বলে।

সকলের উচিত গোঁড়ামি ছেড়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করা। আমাদের প্রিয়নবী (ছাঃ) কোন বিষয়ে গোঁড়ামি তথা বাড়াবাড়ি পসন্দ করতেন না। তিনি বলেন, هَلَكَ الْمُتَنَطِّعُوْنَ ‘অতিরঞ্জনকারীরা ধ্বংস হয়েছে’।[বুখারী হা/৩৪৪৫; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৭৮৫]  

চরমপন্থীরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়িকারী এবং কথায় ও কাজে সীমালঙ্ঘনকারী। আর কথার সীমালঙ্ঘন হলো অনর্থক কথাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা বা সে কথার পক্ষে অন্ধবিশ্বাস স্থাপন করা।

তাছাড়া কাজের সীমালঙ্ঘন হলো গর্হিত কোন কাজকে দ্বীন হিসেবে সুন্দরভাবে উদযাপন বা উপস্থাপন করা। যাকে বিদ‘আত বলা হয়। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; শারহুন নাবাবী ১৬শ খন্ড, হাঃ ২৬৭০/৭)

শৈথল্যবাদীরা ঠিক অনুরূপই করে থাকে। দ্বীনের ব্যাপারে শৈথল্যতা প্রদর্শন করে এবং কথায় ও কাজে দ্বীনের নামে সীমালঙ্ঘন করে। আর কথার সীমালঙ্ঘন হলো অনর্থক কথাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে বা সে কথার পক্ষে অন্ধবিশ্বাস স্থাপন করে, যদিও তা কল্পকাহিনী হয়।

গোঁড়ামিকারী নেতা বা দলের অন্ধ মুকাল্লিদ :

অধিকাংশ মানুষ তাক্বলীদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে। এমনকি দলীলের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও তারা ব্যক্তির রায় নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, যা ঘৃণিত। এ কাজ কখনো কখনো কুফুরির দিকে নিয়ে যায়। আমরা আল্লাহর নিকট এ কাজ থেকে আশ্রয় কামনা করছি। মনে রাখবেন, রাসূল (ছাঃ) তাঁর নিজের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ  ‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, যেমন খৃষ্টানরা ঈসা ইবনে মারিয়ামকে নিয়ে করেছে। আমিতো আল্লাহর দাস মাত্র। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর দাস ও তাঁর রাসূলই বল’।[ ত্বাবারানী,  ছহীহুল জামে হা/৩৭৯৮, মিশকাত হা/৪৮৯৭]

নাসারাগণ তথা খ্রিষ্টানগণ ‘ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর বান্দা ও রসূল হিসেবে না মেনে আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র হিসেবে মান্য করত। এটা তারা করত সম্মান ও ভক্তির ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার কারণে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’মিনদেরকেও সতর্ক ও সাবধান করে বলেন, নাসারাগণ যেভাবে মারইয়াম-এর পুত্র ‘ঈসা (আ.)-কে নিয়ে প্রশংসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরাও এভাবে আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। বরং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল বল (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৪৪৫)।

আলেমগণের কথা বা মতামতের মধ্যে কল্যাণ নিহিত। বিশেষত সালাফে সালেহীন, ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, চার ইমাম এবং যে সকল ফক্বীহদের ফিক্বহকে এই উম্মাহ ইসলামী ফিক্বহ বলে সাক্ষী দিয়েছেন, তাদের ফিক্বহ এর মধ্যে কল্যাণ বিদ্যমান। তাদের মতামত থেকে উপকার গ্রহণ করা যাবে। তবে চূড়ান্ত ফায়ছলা হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। বরং সেক্ষেত্রে আমরা দলীল গ্রহণের জন্য আদিষ্ট।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রহ.) বলেন, ‘‘যদি কেউ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির ব্যাপারে গোঁড়ামি করে; যেমন ইমাম মালিক, শাফি‘ঈ, আহমাদ ও আবু হানিফা (রহ.) প্রমুখ ইমামদেরকে নিয়ে। আর মনে করে যে, নির্দিষ্ট ইমামের কথাই সঠিক, তারই অনুসরণ করা আবশ্যক, অন্যান্য ইমামকে নাকচ করে। যে এরূপ কাজ করে সে পথভ্রষ্ট, জাহিল। বরং সে কখনো কাফির বলে গণ্য হতে পারে। যখন কেউ এ বিশ্বাস করবে যে, তাদের মধ্যে একজন ইমামকেই অনুসরণ করা ওয়াজিব, অন্যদের নয়। তবে তাকে তওবা করতে হবে, আর তাওবা না করলে তাকে হত্যা করতে হবে’ (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২২/২৪৮-২৪৯)।

গোঁড়ামিকারী ব্যক্তি বিপথগামী :

প্রত্যেক দল ধারণা করে যে, তারাই সত্য পথে প্রতিষ্ঠিত আছে, আর অন্যেরা আছে ভ্রান্ত পথে। আর যে যুক্তি তারা খাড়া করে রেখেছে এবং যাকে তারা প্রমাণ বলে আখ্যায়িত করে, তা নিয়ে তারা হর্ষোৎফুল্ল ও সন্তুষ্ট আছে। দুঃখের বিষয় যে, বর্তমানে মুসলিমদের অবস্থাও অনুরূপ হয়ে পড়েছে। তারাও বিভিন্ন মযহাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং প্রত্যেক মযহাব ঐ বাতিল ধারণা অনুযায়ী নিজেকে হকপন্থী মনে করে খোশ আছে। অথচ হকপন্থী শুধুমাত্র একটি দলই হবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং সাহাবীগণের তরীকার অনুসারী হবে।’’ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা নিজেদের দ্বীনকে বিভক্ত করে ফেলেছে এবং বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেছে। প্রত্যেক দল নিজেদের কাছে যা আছে তাই নিয়ে উল্লসিত’ (রুম ৩০/৩৩)।

সত্য ধর্ম পরিত্যাগ করে অথবা তাতে নিজেদের মনমত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করে তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। যেমন কেউ ইয়াহুদী, কেউ খ্রিষ্টান, কেউ অগ্নিপূজক ইত্যাদি।

মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেন, صِنْفَانِ مِنْ أُمَّتِيْ لَنْ تَنَالَهُمَا شَفَاعَتِيْ: إِمَامٌ ظَلُوْمٌ غَشُوْمٌ وَكُلُّ غَالٍ مَارِقٌ  ‘আমার উম্মতের দুই শ্রেণীর লোক আমার সুফারিশ লাভ করতে পারবে না। অত্যাচারী রাষ্ট্রনেতা এবং প্রত্যেক বিপদগামী অতিরঞ্জনকারী’(ছহীহুল জামি’ হা/৩৭৯৮, হাসান হাদীস)।

 দ্বীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে গোঁড়ামী নিষিদ্ধ :

নবীর প্রতি মহান আল্লাহর কি নির্দেশ(?) তিনি তাঁকে সম্বোধন করে বলেন, “তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে সমস্ত মানুষকে এক জাতি করতে পারতেন, কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে। তবে ওরা নয়, যাদের প্রতি তোমার প্রতিপালক দয়া করেন এবং তিনি ওদেরকে এ জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আমি জ্বিন ও মানুষ উভয় দ্বারা দোযখ পূর্ণ করবই, তোমার প্রতিপালকের এই কথা পূর্ণ হবেই।” (হুদ ১১৮) “তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে, তারা সমবেতভাবে সকলেই ঈমান আনত; তবে কি ঈমান আনার জন্য তুমি মানুষের উপর জবরদস্তী করবে?” (ইউনুস ৯৯)

“তোমরা আহলে কিতাবদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে, কিন্তু সৌজন্যের সাথে। তবে তাদের সাথে নয়, যারা ওদের মধ্যে সীমালংঘনকারী।” (আনকাবুত ৪৬)।

মানুষের বোধ্য হয় এমন সহজ সরল ভাষাতে দাওয়াত দিতে হবে। রাসূল (ছা.) বলেন, يَسِّرُوا وَلَا تُعَسِّرُوا وَبَشِّرُوا وَلَا تُنَفِّرُوا ‘তোমরা সহজ পন্থা অবলম্বন কর, কঠিন পন্থা অবলম্বন করো না, মানুষকে সুসংবাদ দাও, বিরক্তি সৃষ্টি করো না’ (বুখারী হা/৬৯)।
মানুষ হীনকর কথা অপছন্দ করে এবং আশা ও আকাংখার কথা শুনতে পছন্দ করে। রাসূলুল্লাহ (ছা.) যখনই কোনো কাজে কোনো সাহাবীকে পাঠাতেন তখন বলতেন, ‘তোমরা জনগণকে আশার বাণী শুনাবে। হতাশাব্যঞ্জক কথা বলে তাদের জন্য অবহেলা-ঘৃণা সৃষ্টি করবে না। তাদের সাথে সহজ-সরল বিধান নীতি ব্যবহার করবে, কঠোরতা অবলম্বন করবে না’ (বুখারী হা/৬১২৪, মুসলিম হা/১৭৩২, মিশকাত হা/৩৭২২)।

মুমিনদের দাওয়াত দেওয়ার সময় ভাষার ব্যবহারে কোমলতা ও সৌন্দর্য সাবলীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলা যেমনটি মুসা (আ.) ও হারুন (আ.)-কে ফেরাউনের প্রতি নরম ভাষায় কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা তার সাথে কোমলভাবে কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে’ (ত্বহা ৪৪)।

“তুমি মানুষকে জ্ঞান ও সদুপদেশ দ্বারা তোমার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান কর এবং ওদের সাথে সদ্ভাবে বিতর্ক কর। তোমার প্রতিপালক জ্ঞাত আছেন -কে তার পথ ছেড়ে বিপথগামী হয় এবং এও জ্ঞাত আছেন -কে সুপথগামী। যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণই করো, তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দেবে, যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে।

তবে তোমরা ধৈর্য ধারণ করলে ধৈর্যশীলদের জন্য তাই তো উত্তম। ধৈর্য ধারণ কর, তোমার ধৈর্য তো আল্লাহরই সাহায্যে হবে, ওদের আচরণে দুঃখ করো না এবং ওদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুন্ন হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সংযমীদের সাথে আছেন এবং তাদের সাথে যারা সৎকর্মপরায়ণ।” (নাহল ১২৫-১২৮) “ভালো এবং মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা, এর ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে।” (ফুসসিলাত ৩৪)

আশা করি এ কয়টি আয়াত অনুধাবন করে তোমার মনের উগ্রভাব সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে যাবে এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমার মন খুব সান্ত্বনা পাবে। তবে আরো একটি মহাবাণী শোন, তিনি মহানবী (সা.) কে বলেন, “আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের প্রতি কোমল-চিত্ত হয়েছিলে, অন্যথা যদি তুমি রূঢ় ও কঠোর-হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমার আশপাশ হতে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর, কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। আর তুমি কোন সংকল্প করলে আল্লাহর উপর নির্ভর করো; আল্লাহ তার উপর নির্ভরকারী বান্দাগণকে ভালোবাসেন।” (সূরা আলি ইমরান ১৫৯ আয়াত) 

গোঁড়ামী মধ্যমপন্থা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর ত্রাস ও ভীতি সৃষ্টি করে ধর্মপ্রচার ইসলামে নেই। “হে মানব সকল! আমি যে কর্মের আদেশ করি, তার প্রত্যেকটাই পালন করতে তোমরা কক্ষণই সক্ষম হবে না। তবে তোমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর এবং সুসংবাদ নাও।” (আহমাদ, আবু দাউদ, সহীহুল জামে ৭৮৭১)

“(দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে) তোমরা সরলতা ব্যবহার কর, কঠোরতা ব্যবহার করো না, মানুষের মনকে খোশ কর এবং তাদের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করো না।” (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, সহীহুল জামে’ ৮০৮৬ নং) “ঈমান হল সহিষ্ণতা ও উদারতার নামান্তর।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে’ ২ ৭৯৫ নং)

গোঁড়ামি দূর করতে বিনম্রতা গ্রহণ করুন!

গোঁড়া ব্যক্তি কখনো পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اَلْإِيْمَانُ: الَصَّبْرُ وَالسَّمَاحَةُ  ‘ঈমান হ’ল সহিষ্ণুতা ও উদারতার নামান্তর’।[ত্বাবারানী, ছহীহুল জামে হা/২৭৯৫] তাই পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী হতে চাইলে অবশ্যই ধর্য্য ধারন করতে হবে এবং সকল ক্ষেত্রে উদারতা থাকতে হবে। আর এর জন্য বিনম্র হতে হবে। বিনম্র অর্জণ করতে চাইলে অবশ্যই সহজ-সরল ও কোমল অন্তর দেহে প্রতিস্থাপন করতে হবে। কেননা ইসলাম পছন্দ করে উদারতা, সরলতা, নম্রতা ও কোমলতাকে এবং পছন্দ করে না গরম ও চরম কিছুকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি সহজ-সরল ও কোমল হবে, সে ব্যক্তির জন্য আল্লাহ দোযখ হারাম করে দেবেন।” (সহীহুল জামে’ ৬৪৮৪নং)

গোঁড়ামী মানুষের সাথে আচার-আচরণে নম্রতা অবলম্বনের বিষয়ে মহান আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ. ‘আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে; যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হ’তে, তবে তারা তোমার আশ-পাশ হ’তে দূরে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর কোন সংকল্প করলে আল্লাহর উপর ভরসা কর। ভরসাকারীদের আল্লাহ ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)

আল্লাহ রাববুল আলামীন ধীর-স্থিরতা ও নম্রতা অবলম্বন পূর্বক সংযত হয়ে চলাফেরা করার জন্য মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَاقْصِدْ فِيْ مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ- ‘সংযত হয়ে চলাফেরা করো এবং তোমার কণ্ঠস্বরকে সংযত রাখো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর’ (লোক্বমান ৩১/১৯)। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ. ‘তুমি তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হও’ (শুআরা ২৬/২১৫)

ইবনু আতা বলেন, هو قبول الحق ممن كان العز في التواضع، فمن طلبه في الكبر فهو كطلب الماء من النار ‘যে কোন ব্যক্তি থেকে সত্যকে গ্রহণ করা। সম্মান হ’ল নম্রতায়। যে ব্যক্তি অহংকারে তা তালাশ করবে, তা হবে আগুন থেকে পানি তালাশ তুল্য’(হাফিয ইবনুল ক্বাইয়িম জাওযিইয়ামাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারম্নল কিতাবিল আরাবী২য় সংস্করণ১৪১৬ হিঃ/১৯৯৬ খ্রীঃ)২/৩১৪ পৃঃ)।

বিনয় ও নম্রতার উপকারিতা অনেক বেশী। কেননা নির্দয়, নিষ্ঠুর ও কঠোরমনা হলো দয়া, অনুগ্রহ ও সহনশীল হওয়ার বিপরীত।  আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ. ‘হে আয়েশা! আল্লাহ তা‘আলা নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পসন্দ করেন। তিনি নম্রতার দরুন এমন কিছু দান করেন যা কঠোরতার দরুন দান করেন না; আর অন্য কোন কিছুর দরুনও তা দান করেন না’। অন্যবর্ণনায় এসেছে ‘নম্রতাকে নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কেননা যে জিনিসের মধ্যে নম্রতা আছে, সে নম্রতাই তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণ হয়। আর যে জিনিস থেকে নম্রতাকে প্রত্যাহার করা হয়, সেটা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। (মুসলিম হা/২৫৯৩মিশকাত হা/৫০৬৮)।

বিনয় ও নম্রতার মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং গোঁড়ামি দূর করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ ‘যে বান্দাহ আল্লাহর জন্য বিনীত হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন’(মুসলিম হা/২৫৮৮)।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেছেন, অধিকতর জোরদার করে মানুষের ওপর কষ্ট দেয়া থেকে ধমকি দেয়া হয়েছে। অধিক গুরুত্বতার সাথে উৎসাহিত করা হয়েছে তাদের ওপর দয়া করার জন্য। হাদীসের বাহ্যিক অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে দেখলে এটাই স্পষ্ট হয়। (শারহে মুসলিম ১২শ খন্ড, হাঃ ১৮২৮)

ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেছেন, এটার মাধ্যমে অধিক পূর্ণাঙ্গতার সাথে স্পষ্ট হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন : স্নেহ করা, দয়া করা এবং অনুগ্রহ করা উম্মাতের ওপরে। আমরা বলব, (বর্তমান ভাষার মাধ্যমে) হে আল্লাহ! তুমি দয়া কর, তোমার সম্মানিত প্রিয় বান্দার উম্মাতের ওপরে এবং তাদেরকে মুক্তি দাও মহান কষ্টদায়ক জিনিস থেকে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)

 রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ تَرَكَ اللِّبَاسِ تَوَاضُعًا لِلَّهِ وَهُوَ يَقْدِرُ عَلَيْهِ دَعَاهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى رُءُوسِ الْخَلاَئِقِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ مِنْ أَىِّ حُلَلِ الإِيْمَانِ شَاءَ يَلْبَسُهَا. ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিনয়বশত মূল্যবান পোশাক পরিধান ত্যাগ করবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সকল সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং ঈমানের পোশাকের মধ্যে যে কোন পোশাক পরার অধিকার দিবেন’(তিরমিযী হা/২৪৮১ছহীহাহ হা/৭১৮)।

বিনয় ও নম্রতার উপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ حُرِمَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ. ‘যাকে নম্রতার কিছু অংশ প্রদান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণের অংশ প্রদান করা হয়েছে। আর যাকে সেই নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত করা হয়েছে’(তিরমিযী হা/২০১৩মিশকাত হা/৫০৭৬ছহীহাহ হা/৫১৯)।

নম্রতা, কোমলতা। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, কোন কাজকে সুন্দর-সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সহকর্মী বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নরম, কোমল ও ভদ্রতাসুলভ আচরণ করার নামই হলো-‘‘রিফ্ক্ব’’, এটা মানুষের মানবিক একটা বিশেষ গুণ। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

বস্তুত:শরীয়তের মধ্যে তথা দ্বীনের বিষয়ে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর মাধ্যমে অকাট্য দলিল হিসেবে যা পাওয়া যায় তা সালফদের বুঝ অনুসারে অবিচল থাকার নাম কিন্তু গোঁড়ামি নয়। কেননা, মুমিন ব্যক্তি বলে, ‘আমরা শুনলাম এবং মানলাম’ (বাক্বারাহ ২/২৮৫)। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল বিষয়ে থেকে গোঁড়ামী পরিহার করে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top