জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা’

মূল : ড. শাইখ উরাইফী, অনুবাদ : আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

১. নিজের গুনাহের কথা মানুষের নিকট প্রকাশ করা উচিৎ নয় তিন কারণে:

ক. গুনাহ কোনো গর্বের বিষয় নয়।

খ. আপনি গুনাহ থেকে তওবা করলেও মানুষ তা মনে রেখে দেয়।

গ. গুনাহ করার পর যে তা প্রকাশ করে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না।

২. সব চেয়ে খারাপ চরিত্রের মানুষ কে?

– যে রাগ হলে আপনার সব অবদান অস্বীকার করে।

– আপনার গোপন কথা ফাঁস করে দেয়।

– এবং আপনার প্রতি এমন সব মিথ্যা অভিযোগ করে যার সাথে আপনি আদৌ সম্পৃক্ত নন।

৩. জ্ঞানীগণ বলেছেন, “শারীরিক গঠন নিয়ে গর্ব করবেন না। কারণ তা আপনার সৃষ্টি নয়। বংশ নিয়েও গর্ব করবেন না। কারণ, এটা আপনি নির্বাচন করেন নি। বরং গর্ব করুন আপনার উন্নত চরিত্র নিয়ে। কারণ, এটি আপনিই গঠন করেছেন।”

৪. জনৈক মনিষী বলেন, আমি জীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ৬টি শিক্ষা পেয়েছি। সেগুলো হল:

ক. ছালাতে থাকলে মন নিয়ন্ত্রণ কর।

খ. বৈঠকে থাকলে মুখ নিয়ন্ত্রণ কর।

গ. অন্যের বাড়িতে থাকলে চোখ নিয়ন্ত্রণ কর।

ঘ. খাবারের কাছে থাকলে পেট নিয়ন্ত্রণ কর।

ঙ. কেউ তোমার উপকার করলে কখনো তা ভুলে যেয়ো না।

চ. তুমি কারো উপকার করলে কখনো তা মুখে এনো না।

৫. সাবিত বিন কুররা রহ. বলেন, “কম আহারে দেহের প্রশান্তি। কম পাপে আত্মার প্রশান্তি এবং কম কথায় মুখের প্রশান্তি।” [ইবনুল কাইয়েম-যাদুল মাআদ, অনুচ্ছেদ: তিব্বে নববী]

৬. মানুষের উদাহরণ পেন্সিলের মত। পেন্সিলের মাথাটা কেটে-ছিলে সরু বানানো হয় যেন তা দ্বারা সুন্দরভাবে লিখা যায়। তদ্রূপ মানুষের জীবন নানা দু:খ-বেদনা ও ঘাত-প্রতিঘাতে আহত হয়। কিন্তু পরিশেষে তা হয়ে উঠে আরও সুন্দর-আরও শুদ্ধ। পেন্সিল লিখতে লিখতে এক দিন নি:শেষ হয়ে যায় কিন্তু বাকি থেকে যায় তার মাধ্যমে লিখিত সুন্দর কথামালা। তেমনি মানুষ একদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যায় কিন্তু থেকে যায় তার কল্যাণকর কাজের স্মৃতিচিহ্ন।

৭. সমস্যা ও সংকটে চোখের পানিতে বালিশ ভেজালে অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না কিন্তু জায়নামাজে বসে আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেললে আপনার কোন সমস্যাই বাকি থাকবে না (ইনশাআল্লাহ)।

৮. ভাগ্যকে বরণ করো সন্তুষ্ট চিত্তে।

– মানুষের সাথে আচরণ করো সতর্কতার সাথে।

– স্ত্রী-পরিবারের সাথে আচরণ করো নম্রতার সাথে।

– ভাইদের সাথে আচরণ করো ক্ষমার দৃষ্টি নিয়ে।

– বন্ধুদের সাথে আচরণ করো বন্ধুত্বের সাথে।

আর যুগের সাথে পথ চলো যুগ পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে।

এই মূলনীতিগুলো মনে রাখলে জীবন হয়ে উঠবে আরও সুন্দর।আর যে কোন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

৯. “দুনিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য হল, যারা তার পেছনে ছোটে সে তার থেকে পালিয়ে বেড়ায় এবং যে তার কাছ থেকে পালায় সে তার পিছনে ছুটে বেড়ায়।” [তাফসির ইবনে কাসির, ৪/১৯৭

১০. ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান বলেন, “সবচেয়ে বেশি সৌন্দর্য রয়েছে সুন্দর আচরণের মাঝে। যার আচরণ সুন্দর নয়, তার কোন সৌন্দর্যই নেই।” [আর-রাওদাহ, পৃষ্ঠা: ২২২০]

১১. সময় ও পরিস্থিতি পরিবর্তনশীল।সুতরাং কাউকে অসম্মান করবেন না। পাখিরা পোকা-মাকড় খায় কিন্তু পাখি মারা গেলে পোকা-মাকড়রা পাখিকে খায়। আপনি শক্তিশালী কিন্তু মনে রাখবেন আপনার চেয়ে অন্য কেউ শক্তিশালী আছে। আপনি জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং সুন্দর চেহারার অধিকারী কিন্তু অন্য কেউ এ সব ক্ষেত্রে আপনার চেয়ে ঊর্ধ্বে আছে।

১২. কারো রাজ প্রাসাদ আর বিশাল অর্থ-বিত্ত দেখে হাহুতাশ করবেন না। কারণ, আল্লাহ আপনাকে বিশাল অর্থ-সম্পদ দেন নি কিন্তু দিয়েছেন শারীরিক সুস্থতা, অফুরন্ত সুখ, প্রশান্তিময় ঘুম, সন্তান-সন্ততি আরও কত কিছু! অথচ এগুলো থেকে অনেক সম্পদশালী বঞ্চিত। যেগুলো তারা কোটি কোটি টাকা দিয়ে কিনতে চাইলেও কিনতে পারবে না। সুতরাং সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহর শুকরিয়া করুন। আর বিশ্বাস রাখুন, আল্লাহ অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ও সুবিচারক।

১৩. যদি কখনো তোমার দ্বারা কোন গুনাহর কাজ ঘটে যায় তবে তাকে ডুবিয়ে দাও নেকির সাগরে। তাহলে তা গলে এমনভাবে নি:শেষ হয়ে যাবে যে, তার কোন চিহ্নই বাকি থাকবে না।

১৪. জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ জনেরা বলেছেন, “খুব রাগের সময় কোন সিদ্ধান্ত নিবেন না। আর খুব খুশির সময় কাউকে প্রতিশ্রুতি দিবেন না।”

১৫. অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ বলেছেন, “আমাদের জীবনের অধিকাংশ সমস্যা হয় দুটি কারণে:

এক. আমরা অনেক সময় চিন্তা না করেই কাজ করি।

দুই. আবার অনেক সময় কাজ না করে শুধু চিন্তা করি।

১৬. ইবুনুল কাইয়েম রহ. বলেন, আল্লাহর সামনে বান্দার দাঁড়ানোর স্থান হল দুটি:

ক. ছালাতে দাঁড়ানো

খ. এবং কিয়ামতের দিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। যে যত বেশি একাগ্রতা ও ভয়-ভীতি সহকারে ছালাতে দাঁড়াবে কিয়ামতের কাঠগড়ায় সে তত বেশী নাযাত লাভ করবে।

১৭. জনৈক মনিষী বলেন, “সাফল্যের মূল রহস্য কি তা জানি না। কিন্তু ব্যর্থতার মূল রহস্য হল সবাইকে খুশি করার চেষ্টা করা।”

১৮. স্ত্রীকে যদি আপনি কেবল তার গুনাগুণ দেখে ভালবাসেন তবে তা প্রকৃত ভালবাসা নয়। প্রকৃত ভালবাসা তখনই হবে যখন আপনি তার মধ্যে দোষ দেখেও তাকে ভালবাসবেন।

১৯. একটি মোমবাতির কোন ক্ষতি হয় না যদি তার দ্বারা অন্য মোমবাতিকে প্রজ্বলিত করা হয়। তদ্রূপ নিজে কোন ক্ষেত্রে সফল হলে অন্যকেও সাফল্যের সে পথ দেখানোর চেষ্টা করুন।

২০. “একটি ভুলের কারণে মানুষ আপনার অতীত জীবনের সব ভাল কাজকে মুছে ফেলে। পক্ষান্তরে অনুতপ্ত হৃদয়ে খাঁটি ভাবে একবার তওবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ আপনার অতীত জীবনের সব ভুলকে মুছে দেন।”

২১. “জ্ঞানী আগে চিন্তা করে পরে কথা বলে আর নির্বোধ আগে কথা বলে পরে চিন্তা করে।”

২২. “হক পন্থীরা বাতিল দেখে যদি চুপ থাকে তবে বাতিল পন্থীরা নিজেদেরকে হক পন্থী ভাবতে শুরু করে।”

২৩. আমরা পানির মত হই না কেন? পানির তার পিঠে অনেক ভারি বস্তু ভাসিয়ে রাখে। সে তার পেটে অনেক মূল্যবান বস্তু লুকিয়ে রাখে। সে চলার পথে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলেও থেমে যায় না বরং তার চারপাশ দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।

২৪. “পানির মত হওয়ার চেষ্টা করুন। সে পাত্র অনুযায়ী রঙ পরিবর্তন করে না। স্বর্ণের পাত্রে রাখা হোক আর মাটির পাত্রে রাখা হোক সর্বদা সে স্বকীয়তা বজায় রাখে।”

২৫. জ্ঞানীরা বলেছেন, “যদি নিজে নিজের বিবেককে বড় মনে কর তবে শত্রু সৃষ্টি হবে আর যদি হৃদয়কে বড় কর তবে বন্ধু বৃদ্ধি হবে।”

২৬. “কথা হল ওষুধের মত।পরিমাণ মত হলে উপকার হবে। কিন্তু অতিরিক্ত হলে ক্ষতি করবে।”

২৭. “যার ভাষা নম্র হয় তার প্রতি অপরিহার্য ভাবে ভালবাসা সৃষ্টি হয়।”

২৮. ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহ. বলেন, “তোমরা চালনীর মত হয়ো না। কারণ, চালনী ভাল আটাগুলোকে বের করে দেয় আর তুষ ও আবর্জনাগুলোকে অবশিষ্ট রেখে দেয়। তদ্রূপ তোমরাও এমন হয়ো না যে, মুখ দিয়ে ভালো ভালো জ্ঞানের কথা বের করবে আর অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষগুলো জমা রেখে দিবে।” [সফওয়াতুস সাফওয়া ১/৪৫৭]

২৯. মা’মার বিন সোলাইমান বলেন, আমি আমার পিতা সোলাইমান [মৃত্যু: ১৪৩হি:] কে বলতে শুনেছি: “যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে রাগিয়ে দাও সে কখনো তোমার কথা শুনবে না।” [আল আদাব আশ শারঈয়াহ, মাকদেসী ১/১৯৪]

৩০. “সবচেয়ে উন্নত চরিত্রের অধিকারী সে ব্যক্তি, যে অন্য মানুষের ব্যাপারে সবচেয়ে কম কথা বলে। আর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারী সে ব্যক্তি, যে অন্য মানুষের প্রতি সবচেয়ে বেশি সুধারণা পোষণ করে।”

৩১. বড়ই আশ্চর্যের বিষয় হল, অনেক মানুষ অসুখের ভয়ে হালাল খাবার বর্জন করে কিন্তু জাহান্নামের ভয়ে হারাম খাবার বর্জন করে না!

৩২. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ. কে জিজ্ঞেস করা হল, বান্দা কখন আরামের স্বাদ পাবে?”

তিনি বললেন, “যখন সে জান্নাতে তার প্রথম পা রাখবে।” [আল মাকসাদুল আরশাদ, ৩/৯৮]

৩৩. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যার মধ্যে চারটি জিনিস থাকবে সে সফল হবে:

ক. সত্যবাদিতা

খ. লজ্জা

গ. সুন্দর চরিত্র

ঘ. কৃতজ্ঞতা [এহিয়া উলুমিদ্দীন]

৩৪. ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব বলেন, সুখী জীবনের মূলনীতি তিনটি:

ক. বিপদে ধৈর্য ধারণ করা।

খ. ভালো কিছু অর্জন করলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা।

গ. পাপ করলে আল্লাহ কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। [আল কাওয়ায়িদুল আরবা

৩৫. “নিজের চেহারায় হাসি ফুটান তবে অন্যের চেহারায় হাসি ফুটাতে পারবেন।”

৩৬. “যে অল্পে তুষ্ট থাকে সে সম্মান পায় আর যে অতি লোভ করে সে লাঞ্ছিত হয়।”

৩৭. জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আল্লাহ তাআলা কেন মানুষকে দুটি কান আর একটি মুখ দিয়েছেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, যাতে মানুষ কম কথা বলে আর বেশি শুনে।

৩৮. “মানুষের অন্তরে প্রভাব ফেলার জন্য সবচেয়ে উপকারী পদ্ধতি দুটি। যথা: নম্র আচরণ ও কল্যাণ কামনা। এর মাধ্যমে অপরিচিত লোকের হৃদয় জয় করা যায় সাথী-বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় ও ভালবাসা স্থায়ী হয়। আর শত্রুর ক্রোধের আগুন নির্বাপিত হয় এবং তার ক্ষতি থেকে বাঁচা যায়।” [মাদারিজুস সালেকীন, ইমাম ইবনুল কাইয়েম, ২/৫৫১]

৩৯. “এক চামচ চিনি চায়ের সাধ পরিবর্তন করে দেয়। কিন্তু একটি ভালো কথা মানুষের জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারে। বাহ্যিক সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টি কাড়ে কিন্তু চারিত্রিক সৌন্দর্য মানুষের হৃদয় জয় করে।”

৪০. আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের ৮টি গোপন রহস্য। যথা:

১) আল্লাহর সাথে সুসম্পর্ক

২) সুন্দর পোশাক

৩) সুঘ্রাণ

৪) মুচকি হাসি

৫) বিনয়

৬) মিষ্টি কথা

৭) মানুষকে কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকা

৮) মানুষের হক আদায় করা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top