ভূমিকা : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর এই সেরা হবার পেছনে যার অবদান তা হলো বিবেক। যার বিবেক নেই, সে মানব সমাজে মানুষের মত চলাফেরা করলেও প্রকৃতপক্ষে সে মানুষ নয়। তাই মানুষ মাত্রই হবে বিবেক সম্পন্ন। কারো বিবেক থাকে জাগ্রত, আবার কারো হয় মৃত। সেই জন্যে মনীষীরা বলেন, ‘বিবেক যেখানে উপস্থিত, সুখ সেখানে তিরোহিত’। ‘সুখ যেখানে উপস্থিত, বিবেক সেখানে তিরোহিত’। আর বিবেক আছে বলেই মানব মনে নানা ধরনের প্রশ্নের অবতারণা হবে এটাই স্বাভাবিক। অনুরূপভাবে আমাদের তিনটি প্রশ্নের জবাব জেনে রাখা অতিব জরুরী। প্রশ্নগুলো হলো-
১. আমরা কে?
২. আমাদের দায়িত্ব কী?
৩. কেন আমরা দায়িত্ব পালন করব?
১. আমরা কে?
ক. প্রথম উত্তর আমরা সৃষ্টিগত মানুষ।
খ. আমাদের ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয় আমরা মুসলমান।
গ. আমাদের আক্বীদাহগত পরিচয় আমরা আহলেহাদীছ।
ঘ. আমরা এক একজন খলীফা।
ক. আমরা সৃষ্টিগত মানুষ :
মহান আল্লাহ বলেন,'(হে নবী!) তুমি বলে দাও, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মত একজন মানুষ মাত্র (কাহ্ফ ১৮/১১০)। প্রত্যেক নবী-রাসূল তাদের উম্মাতদের অবহিত করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের মত মানুষ মাত্র’ (ইবরাহীম ১৪/১১)।
খ. আমাদের জাতীগত পরিচয় আমরা মুসলমান :
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের ধর্মে কায়েম থাকো। তিনিই তোমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন পূর্বেও এবং এই কুরআনেও, যাতে তোমাদের রাসূল তোমাদের জন্যে সাক্ষ্যদাতা এবং তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও সমস্ত মানব জাতির জন্যে’ (হজ্জ ২২/৭৮)। মানব শিশু জন্মগ্রহণ করার পর ফিৎরাত অনুযায়ী মুসলমান। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ বলেন, ‘প্রত্যেক শিশুই ফিৎরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, নাছারা বা অগ্নিপূজক রূপে গড়ে তোলে’(বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৯০)। আমাদের ফিৎরাত হ’ল আমরা মুসলমান। কিন্তু পিতা-মাতার সহযোগীতায় আমরা বিভিন্ন ভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে থাকি। যেমন, কেহ মুশরেক, পীর পুজারী, মাজার পুজারী, মাযহাবী সংকির্ণতাবাদে বিশ্বাসী, খারেজী, শিয়া এরা আবার বহু দলে বিভক্ত। অথচ আমরা জন্মগ্রহণ করে থাকি মুসলিম মিল্লাতের উপরে।
গ. আমাদের আক্বীদাহগত পরিচয় আমরা আহলেহাদীছ :
আহলেহাদীছ তারাই যারা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর অনুসারী। এদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হ’ল নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। যার জন্য প্রখ্যাত ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) কোন মুসলিম যুবককে দেখলে খুশী হয়ে বলতেন,‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাকে ‘মারহাবা’ জানাচ্ছি। ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদীছ বুঝাবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও পরবর্তী ‘আহলেহাদীছ’ (আল-মুস্তাদরাক ১/৮৮ পৃঃ; আলবানী, সিলসিলা ছহীহা হা/২৮০)।
ঘ. আমরা এক একজন খলীফা :
মানুষ আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধি মাত্র। মহান আল্লাহ যখন মানুষ সৃষ্টি করার ইচ্ছে পোষণ করে বলেন, وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً ‘আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই (বাকারাহ ২/৩০)। আমরা এক একজন খলীফাহ এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘নিশ্চয়ই তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’(বুখারী হা/৭১৩৮; মুসলিম হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫; নেতৃত্ব ও বিচার অধ্যায়)। খলীফাহ মানে প্রতিনিধি। এই প্রতিনিধির প্রথম দায়িত্ব হলো, নিজেকে এবং পরিবারকে দুনিয়াবী ধ্বংস ও পরকালের জাহান্নাম থেকে বাঁচানো। তাই মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قُوْا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيْكُمْ نَارًا ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং পরিবারকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর’ (তাহরীম ৬)।
২. আমাদের দায়িত্ব কি?
আমরা মহান আল্লাহর পক্ষ হতে এক একজন খলীফা বা প্রতিনিধি। প্রত্যেকের কোন না কোন দায়িত্ব রয়েছে? তবে প্রথম কাজ মহান আল্লাহর ইবাদত করা। এমর্মে মহান আল্লাহ বলেন, – وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ‘আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যই ’ (আয-যারিয়াত ৫১/৫৬)। আমি আপনি পরিবারের কর্তা বা নেতা বা দায়িত্বশীল। সমাজপতি সমাজের, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল। অনুরূপভাবে আরো একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব আপনার ওপর বর্তানো হয়েছে। আপনি যা জানেন তা অন্যের নিকটে পৌঁছে দিতে হবে। এসম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, بَلِّغُوْا عَنِّىْ وَلَوْ آيَةً ‘একটি মাত্র আয়াত হলেও তা আমার পক্ষ থেকে মানুষের নিকট পৌঁছে দাও…।’ (বুখারী; মিশকাত হা/১৯৮)। বিদায় হজ্জের ভাষণেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একই নির্দেশ প্রদান করেছেন, أَلَا لِيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ ‘উপস্থিত ব্যক্তিরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়’। [বুখারী হা/৬৫, ৪০৫৪, ৫১২৪, ৬৮৯৩]
আমাদেরকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহকে অন্যের নিকটে পৌঁছায়ে দিতে বলা হয়েছে। আমরা ঐসকল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই যারা মহান আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্ত হয়েছে। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, -صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ‘ঐ সমস্ত লোকের পথে যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ’ (ফাতিহা ১/৭)।
এবার প্রশ্ন হতে পারে ঐ সমস্ত ব্যক্তি কারা? এর জবাব, আমরা যারা রাসূল (ছাঃ)-এর উম্মাত। যারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সর্বাধীক অনুসারী আহলেহাদীছ। এরা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করে ও অকল্যাণের পথে নিষেধ করে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখে। এমর্মে আল্লাহ সুবহানা ওয়া‘তায়ালা বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللهِ- ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা ন্যায়ের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। অন্যত্র বলেন, وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ- ‘আর তারা (মানুষকে) হক্বের ও ধর্য্য ধারনের উপদেশ দেয় (আছর ১০৩/৩)। হক্বের দিকে আহবান করা মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ – ‘ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা কার আছে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে… (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৩)। আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ- ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকে মানুষকে আহ্বান কর এবং অবশ্যই তুমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৭)। আর এই দ্বীনের দাওয়াত দেয়া নছীহত। এসম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ لِلَّهِ وَلِرَسُوْلِهِ- ‘দ্বীন হ’ল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নছীহত’(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬৬, ৬৭)।
প্রত্যেক মুমিন পরস্পরকে হক-এর উপদেশ দিবে। যেমন কাউকে শিরক কিংবা বিদ‘আত করতে দেখলে বা কোন ফরয কাজে গাফলতি দেখলে তাকে বলতে হবে, হে ভাই! শিরক বর্জন কর। ফরয কাজটি আগে সম্পন্ন কর। অনুরূপভাবে কাউকে কোন অন্যায় করতে দেখলে বলতে হবে, হে ভাই! আল্লাহকে ভয় কর! অন্যায় থেকে বিরত হও।
৩. কেন আমরা দায়িত্ব পালন করব?
আমাদেরকে এজন্যে দায়িত্বপালন করতে হবে কারণ আমরা সকলেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি। প্রত্যেক প্রতিনিধির দায়িত্ব ও কর্তব্য হ‘ল, অধীনস্ত ব্যক্তিদের নিকটে হক্বের দাওয়াত দিয়ে জান্নাতের পথে আহ্বান করা এবং অন্যায় থেকে বিরত রেখে জাহান্নামের পথ হতে দুরে রাখা। সুতরাং আমরা যা জানি তা অন্যের নিকটে খুব দ্রুত দাওয়াত হিসাবে পৌঁছায়ে দিতে হবে। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِيْنَ. ‘হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার নিকট যা নাযিল হয়েছে তা পৌঁছে দিন। আপনি যদি এরূপ না করেন, তাহ’লে আপনি রিসালাতের বাণী পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের নিকট থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদের পথ দেখান না’ (মায়েদা ৫/৬৭)। অন্যত্র বলেন, وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘তোমরা নেকী ও কল্যাণের কাজে পরস্পকে সহযোগিতা কর, কিন্তু পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে কাউকে সহযোগিতা কর না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা’ (মায়েদা ৫/২)।
যারা জানে অথচ মানুষকে জানায় না তাদের উপর আল্লাহ লা‘নত করেছেন। আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ يَكْتُمُوْنَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَـئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللهُ. ‘আমি যে সমস্ত সুস্পষ্ট বিষয় ও হেদায়াতের বাণী মানুষের জন্য নাযিল করেছি, কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার পরও যারা (মানুষ থেকে) গোপন রাখে তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত’ (বাক্বারাহ ২/১৫৯)।
এ ব্যাপারে হাদীছেও বিভিন্নভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اَلدِّيْنُ اَلنَّصِيْحَةُ قُلْنَا لِمَنْ قَالَ لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُوْلِهِ وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ وَعَامَّتِهِمْ- ‘দ্বীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা বা উপদেশ দেয়ার নাম। আমরা (ছাহাবীরা) জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ, তাঁর রাসূল, মুসলিম নেতৃবর্গ এবং সাধারণ মানুষের জন্য। [মুসলিম হা/১৯৬; আহমাদ হা/১৬৯৪; তিরমিযী হা/১৯২৬]
উল্লেখ্য, আল্লাহর কল্যাণ কামনা দ্বারা তাঁর প্রতি খালেছ ঈমান আনা ও ইবাদত করা বুঝায়। রাসূলের কল্যাণ কামনার অর্থ হ’ল রাসূলের আনুগত্য করা। মুসলমান নেতাদের কল্যাণ কামনার মাধ্যমে ভাল কাজে তাদের আনুগত্য করা ও তাদের বিদ্রোহ না করা এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণ কামনা দ্বারা তাদের উপদেশ দেয়া বুঝায়। অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ جَرِيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ بَايَعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى إِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ- জারীর বিন আব্দিল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ছালাত প্রতিষ্ঠার, যাকাত প্রদানের, নেতার আদেশ শোনার ও তাঁর আনুগত্য করার এবং প্রত্যেক মুসলমানকে উপদেশ দেয়ার শপথ গ্রহণ করলাম’। [বুখারী হা/৫৭, ‘ঈমান’ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৯৯; আহমাদ হা/১৯১৯১] আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, بَلِّغُوْا عَنِّيْ وَلَوْ آيَةً، وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ وَلاَ حَرَجَ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ- ‘একটি আয়াত হ’লেও তোমরা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও। বনী ইসরাঈলের নিকট থেকে বর্ণনা কর, কোন দোষ নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার উপরে মিথ্যা আরোপ করবে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিল। [বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া হা/৩৪৬১; আহমাদ হা/৬৪৮৬] বিদায় হজ্জের ভাষণেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একই নির্দেশ প্রদান করেছেন, أَلَا لِيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ ‘উপস্থিত ব্যক্তিরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়’। [বুখারী হা/৬৫, ৪০৫৪, ৫১২৪, ৬৮৯৩]
মানুষকে আল্লাহর পথে আনার জন্যে নিজেরে মধ্যে আকাক্সক্ষা থাকতে হবে। এজন্যে আল্লাহর তাওফীক প্রয়োজন। যাতে হক্বপন্থী ব্যক্তি মানুষকে হেদায়াতের পথে ডাকার জন্য নিজের ভিতর থেকেই উৎসাহ পান ও তাকীদ অনুভব করেন। এই সহজাত আকাক্সক্ষা (ওহংঃরপঃ) না থাকলে শত যোগ্যতা থাকা সত্তেবও ঐ ব্যক্তি সমাজ সংস্কারে ব্যর্থ হবে। (সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী, মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, হাদীছ ফাউ-েশন বাংলাদেশ, প্রকাশিত, পৃষ্ঠা নং- ২৭) দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ভয় করা বা সংশয় রাখা যাবে না। কারণ মহান আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন মর্মে তিনি বলেন,لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘তোমরা ভয় করো না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি সব কিছু শুনি ও দেখি’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৬)।
আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দানের বহুবিধ ফযীলত রয়েছে। যেগুলো পড়লে বা শুনলে মুমিন হৃদয় দাওয়াত দানের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে, শত ঝঞ্ঝাট উপেক্ষা করেও দাওয়াতী ময়দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে উদ্বুদ্ধ হয়। দাওয়াতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ ‘কোন ব্যক্তি যদি ভালো কাজের পথ দেখায়, সে ঐ পরিমাণ নেকী পাবে, যতটুক নেকী পাবে ঐ কাজ সম্পাদনকারী নিজে’। [মুসলিম হা/৪৮৯৯, ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়; রিয়াযুছ ছালেহীন (বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ২০০০) ১/১৪৯, হা/১৭৩।]
খায়বার যুদ্ধের সেনাপতি আলী বিন আবু তালিবকে নছীহতের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَوَاللهِ لَأَنْ يَهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِداً خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمُرِ النَّعَمِ ‘আল্লাহর কসম! তোমার মাধ্যমে আল্লাহ যদি একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটা তোমার জন্য লাল উটের (কুরবানীর) চেয়েও উত্তম হবে। [মুত্তাফাক্ব আলাইহ, রিয়ায, হা/১৭৫]
উট ছিল আরব মরুর উৎকৃষ্ট বাহন ও উত্তম সম্পদ। তন্মধ্যে লাল উট ছিল আরো মূল্যবান। এজন্য হাদীছে লাল উটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ، لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيئاً، وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ، كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ، لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئاً. ‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে মানুষকে ডাকে তার জন্য ঠিক ঐ পরিমাণ ছওয়াব রয়েছে, যে পরিমাণ ছওয়াব পাবে তাকে অনুসরণকারীগণ। এতে অনুসরণকারীগণের ছওয়াব সামান্যতম কমবে না। আর যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার পথে কাউকে ডাকবে সে ঠিক ঐ পরিমাণ গোনাহ পাবে, যে পরিমাণ গোনাহ পাবে তাকে অনুসরণকারীগণ। এতে অনুসরণকারীদের গুনাহ সামান্যতম হরাস করা হবে না’। [মুসলিম হা/৬৮০৪; রিয়ায, ১/১৪৯, হা/১৭৪।]
দুনিয়াতে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও পরকালে চিরস্থায়ী লাভবান হবে যদি কোন ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন করে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحَبَّ دُنْيَاهُ أَضَرَّ بِآخِرَتِهِ وَمَنْ أَحَبَّ آخِرَتَهُ أَضَرَّ بِدُنْيَاهُ فَآثِرُوا مَا يَبْقَى عَلَى مَا يَفْنَى ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবাসবে, সে তার আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতকে ভালবাসবে, সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অতএব তোমরা ধ্বংসশীল বস্তুর উপরে চিরস্থায়ী বস্তুকে অগ্রাধিকার দাও’। [আহমাদ হা/১৯৭১২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩২৪৭; মিশকাত হা/৫১৭৯]
পরিশেষে, আমাদের নানামূখী যতই প্রশ্ন মনে উদ্বিগ্নের সৃষ্টি করুক না কেন (?) আমরা এর সমাধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর মানদণ্ডে অনুসরণ করব ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক্ব দান করুন, আমীন।