আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ قَطَّعۡنٰهُمۡ فِی الۡاَرۡضِ اُمَمًا ۚ مِنۡهُمُ الصّٰلِحُوۡنَ وَ مِنۡهُمۡ دُوۡنَ ذٰلِکَ ۫ وَ بَلَوۡنٰهُمۡ بِالۡحَسَنٰتِ وَ السَّیِّاٰتِ لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ ‘আর যমীনে আমি তাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতিতে। তাদের কেউ নেককার আর কেউ অন্যরূপ এবং আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি ভাল ও মন্দ দ্বারা, হয়তো তারা ফিরে আসবে’ (আরাফ ৭/১৬৮)।
.
ব্যাখ্যা : আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, ‘আমি ভাল-মন্দ অবস্থার দ্বারা তাদের পরীক্ষা করেছি যেন তারা নিজেদের গহিত আচার-আচরণ থেকে ফিরে আসে।’ ‘ভাল অবস্থার দ্বারা’-এর অর্থ হল এই যে, তাদেরকে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ও ভোগবিলাসের উপকরণ দান। আর ‘মন্দ অবস্থার দ্বারা’-এর অর্থ হয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনার সে অবস্থা যা যুগে যুগে বিভিন্নভাবে তাদের উপর নেমে এসেছে, অথবা কোন কোন সময়ে তাদের উপর আপতিত দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্য। [তাবারী; ইবন কাসীর] সারমর্ম এই যে, মানব জাতির আনুগত্য ও ঔদ্ধত্যের পরীক্ষা করার দুটিই প্রক্রিয়া। তাদের ব্যাপারে উভয়টিই ব্যবহৃত হয়েছে।
.
কিন্তু মানব সম্প্রদায় এতদুভয় পরীক্ষাতেই অকৃতকার্য হয়েছে। যেমন ইহুদী-নাসারা সম্প্রদায়। আল্লাহ তা’আলা যখন তাদের জন্য নেয়ামতের দুয়ার খুলে দিয়ে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য দান করেছেন, তখন তারা বলতে শুরু করেছে, (إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ) অর্থাৎ- ‘আল্লাহ হলেন ফকীর আর আমরা ধনী’ (আলে-ইমরান ৩/১৮১)। পক্ষান্তরে আবার তাদেরকে যখন দারিদ্র্য ও দুর্দশার মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়েছে, তখন বলতে শুরু করেছে, (يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ) অর্থাৎ- ‘আল্লাহর হাত সংকুচিত হয়ে গেছে’ (আল-মায়েদাহ ৫/৬৪)।
অথচ রিযিক্ব বা ধন-সম্পদ যাকে বেশী দান করা হয়েছে, আবার যাকে কম দেওয়া হয়েছে উভয়কেই পরীক্ষা করা হয়েছে।
যাকে সম্পদ বেশী দান করা হয়েছে সে কি আমল করে তা আল্লাহ পরীক্ষা করে দেখেন, সে কি সঠিক ভাবে সম্পদ ব্যয় ও বন্টন করছেন কি-না? যেমন- ঠিকমত যাকাত, দান-ছাদাক্বাহ, গরীব, অসহায়, ইয়াতিম, প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি কেমন আচরণ করছেন, অপচয়, অপব্যবহার করছেন কি-না প্রভৃতি। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদেরকে তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের নিজ জীবন সম্পর্কে পরীক্ষা করা হবে’ (ইমরান ৩/১৮৬)।
যারা আল্লাহর নিয়ামত দ্বারা উপকৃত তো হয়, কিন্তু তাঁর কৃতজ্ঞতা না করে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। অনুরূপ মাল-ধনের আসক্তিতে বন্দী হয়ে তার সেই হক্বসমূহ আদায় করে না, যা আল্লাহ অন্যের প্রাপ্য হিসাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহ তা’আলা আবু লাহাবকে যেমন দিয়েছিলেন অগাধ ধন-সম্পদ, তেমনি দিয়েছিলেন অনেক সন্তান-সন্ততি। অকৃতজ্ঞতার কারণে এ দুটি বস্তুই তার গর্ব, অহমিকা ও শাস্তির কারণ হয়ে যায়।
.
আবার যাকে সম্পদ কম দেওয়া হয়েছে তাকেও আল্লাহ পরীক্ষা করা হচ্ছে মালের স্বল্পতা দিয়ে। সে কি অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর প্রতি নাফারমানী করছেন না-কি দৃঢ়তার সাথে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছেন? যথা- সম্পদ স্বল্পতার কারণে মানুষের নিকটে না-কি আল্লাহর নিকটে মুখাপেক্ষী? আবার শিরক-বিদআত, ঋণের মাধ্যমে সূদ-ঘুষের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছেন কি-না? আল্লাহ বলেন, وَ لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫)।
.
আপনি আপনার অবস্থানে থেকে যথাযথ শুকরিয়া জ্ঞাপন করুন। কেননা অধিকাংশ মানুষ অকৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী। অতএব, আমরা তেমন হই যেমনটা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاذۡکُرُوۡنِیۡۤ اَذۡکُرۡکُمۡ وَ اشۡکُرُوۡا لِیۡ وَ لَا تَکۡفُرُوۡنِ ‘‘অতপর, তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় কর, আমার সাথে কুফরী করো না’’ (বাক্বারাহ ২/১৫২)।
তবে এটা সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لِرَبِّهٖ لَکَنُوۡدٌ ‘নিশ্চয়ই মানুষ তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ’ (আদিয়াত ১০০/৬)। আর মানুষ নিজের প্রতি যুলুম করে স্বয়ং নিজের অকৃতজ্ঞতার সাক্ষ্য দেয়। এখানে সকল প্রকার রবের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার প্রতি আহ্বান করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ আমাদের সকলের রব বা প্রতিপালক। আবার স্বামী তার পরিবারের রব, সে পরিবারের যাবতীয় বিষয়াদী দেখাশুনা করেন। অন্যদিকে মনিব বা মালিক চাকর-চাকরাণী, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের রব বা প্রতিপালনকারী। প্রভৃতি প্রকার রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ।
.
পরিশেষে, আল্লাহ বলেন, یَمۡحَقُ اللّٰهُ الرِّبٰوا وَ یُرۡبِی الصَّدَقٰتِ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یُحِبُّ کُلَّ کَفَّارٍ اَثِیۡمٍ ‘আল্লাহ সূদকে ধ্বংস করে দেন এবং ছাদাক্বাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী (অকৃতজ্ঞ) পাপীকে ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সূদ যদিও বৃদ্ধি পায় কিন্তু এর শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বল্পতা’। [মুসনাদে আহমাদঃ ১/৩৯৫]
.
মানুষ হ’ল স্পর্শকাতর প্রাণী। এরা অধিক ধন-সম্পদে বখিল ও অকৃতজ্ঞ হয়। তাই রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ দুনিয়া বিমুখতার প্রতি জোরালো আহ্বান করেছেন। তাছাড়া আল্লাহর নিকট এই দুনিয়াতে যা রয়েছে তা অতিব তুচ্ছ বস্তু মাত্র। যদি সামান্য মূল্যমান হতো তবে আল্লাহ অকৃতজ্ঞ কুফরীকারী ব্যক্তিদের এক ফোটা পানি পান করতে দিতেন না। মূলকথা : আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে দুনিয়া বিমুখ হয়ে অমূল্য জান্নাতে দাখিল করতে অতিব আগ্রহশীল। যদিও আমরা শয়তানের মরীচিকাময় ধোঁকাতে পড়ে নিজেদের সর্বনাশ তথা নিজেদের প্রতি যুলুম করেই চলেছি। সুতরাং আল্লাহ আমাদেরকে যে পর্যায়ে রেখেছেন সেই পর্যায় ভুক্ত থেকে যথাযথ ভাবে রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।