দরসে কুরআন : ভালবাসায় শিরক

(অন্ধভাবে) আলেম, বজুর্গ ও নেতাদের আনুগত্য করলো, সে মূলত তাদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করে বা মান্য করে থাকে। আল্লাহ তা’আলা বলেন :

اِتَّخَذُوۡۤا اَحۡبَارَهُمۡ وَ رُهۡبَانَهُمۡ اَرۡبَابًا مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ الۡمَسِیۡحَ ابۡنَ مَرۡیَمَ ۚ وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡۤا اِلٰـهًا وَّاحِدًا ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ سُبۡحٰنَهٗ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদের* রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে, তিনি ছাড়া কোন (হক) ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা থেকে পবিত্র।রা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় নেতা ও পুরোহিতদেরকে রব হিসেবে বরণ করে নিয়েছে।’’ (তাওবা ৯/৩১)

এ আয়াতের তাফসীর; আদী বিন হাতিম(রাযিঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায়। আদী ইবনু হাতিম (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি গলায় স্বর্ণের ক্রুশ পরে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে এলাম। তিনি বললেনঃ হে ‘আদী! তোমার গলা হতে এই প্রতিমা সরিয়ে ফেল।

আদী ইবনু হাতিম (রাযিঃ)বলেন তখন নাবী (সাঃ)-এর মুখে এ আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনতে পাই। তখন আমি বললাম, আমরা তো তাদের ইবাদত করিনা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন: আল্লাহ তা‘আলা যা হালাল করেছেন সেটা কি তারা হারাম করে দেয়না? অতঃপর তোমরাও তা হারাম হিসেবে গ্রহণ করে নাও। আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করে দিয়েছেন- তারা কি সেটা হালাল করে দেয়না? অতঃপর তোমরা তা হালাল হিসেবে গ্রহণ করে নাও। আমি বললাম: হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন: এটাই তাদের ইবাদত করা। (তিরমিজী হা/৩০৯৫)

তাদেরকে তো শুধু এ নির্দেশই দেয়া হচ্ছিল যে, তারা এক ইলাহেরই ইবাদত করবে, যিনি কোন কিছু হারাম করলেই কেবল তা হারাম হবে, আর যিনি হালাল করলেই তা হালাল হবে। অনুরূপভাবে যিনি শরীআত প্রবর্তন করলে সেটাই মানা হবে, তিনি হুকুম দিলে সেটা বাস্তবায়িত হবে। তিনি ব্যতীত আর কোন সত্য ইলাহ নেই। তারা যা তাঁর সাথে শরীক করছে তা থেকে তিনি কতই না পবিত্র। তাঁর সন্ততি নেই, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি ছাড়া কোন রব নেই। [ইবন কাসীর] কিন্তু তারা সে নির্দেশের বিপরীত কাজ করেছে। তার সাথে শরীক করেছে। মহান আল্লাহ তাদের সে সমস্ত অপবাদ ও শরীক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তার পূর্ণতার বিপরীত তার জন্য যে সমস্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ গুণ সাব্যস্ত করে তা গ্রহণযোগ্য নয়। [সা’দী]

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, يوشك أن تنــزل عليكم حجارة من السماء أقول: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم وتقولون : قال أبوبكر وعمر ‘‘তোমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হওয়ার সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। কারণ, আমি বলছি, ‘‘রাসূল (সা:) বলেছেন।’’ অথচ তোমরা বলছো, ‘‘আবুবকর এবং ওমর (রাঃ) বলেছেন।’’ 📕মুসনাদে আহমেদ :২৬২৯

✅💠রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার বিপরীত আবু বকর (রা:) ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার কথার ব্যাপারে যদি এরূপ সতর্কীকরণ করা হয় তবে যারা ইলম, তাকওয়া, রাসূলের সাহচর্য ও খিলাফতে তাদের চেয়ে অনেক কম মর্যাদাবান তাদের কথা গ্রহণের ক্ষেত্রে কিরূপ হবে?! অতএব তাদের কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কথা প্রত্যাখ্যান করা অধিক সমীচীন নয় কি ??!!।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন: আমি ঐ সকল লোকদের ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ করি যারা (কোন হাদীসের) সনদ সহীহ হিসেবে জানে ,তার পরে (তা বাদ দিয়ে) সুফইয়ান সাওরীর কথার দিকে চলে যায়।

তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন: فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴿النور:63﴾ ‘‘যারা তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা করে, তাদের এ ভয় করা উচিৎ যে, তাদের উপর কোন কঠিন পরীক্ষা কিংবা কোন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এসে পড়ে।’’ (📕নূর . ৮৩)

এবং তিনি বললেন: তোমরা কি জান ফেতনা কী?? ফেতনা হলন শিরক, যদি কেউ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা পাওয়ার পর তা বর্জন করে তাহলে তার অন্তরে এমন বক্রতা সৃষ্টি হবে যা তাকে ধ্বংস করে দিবে ।

💐✍🏾রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যাক্তি এমন কোন কাজ করবে যা আমার প্রদর্শিত পথের উপর নয়, তা তার উপরই ফিরিয়ে দেয়া হবে, গ্ৰহণযোগ্য হবে না।” [📕বুখারীঃ ২৬৯৭, 📘মুসলিমঃ ১৭১৮,📔আহমাদ: ২৬০৯২)]

রাসূল (ছাঃ)-এর ভালবাসায় বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয় : 

পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের নিয়ে তাদের উম্মতের অতিভক্তি, মতানৈক্য ও বাড়াবাড়িতে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল’(মুসলিম হা/১৩৩৭; মিশকাত হা/২৫০৫)। তাদের উক্ত বিষয়ে সাবধান করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ- ‘তোমরা আমার বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না, যেমনটি খৃস্টানরা মরিয়ম তনয় ঈসাকে নিয়ে করেছে। আমি তো আল্লাহর বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূলই বল’ (বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭)।

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)-এর মৃত্যুপীড়া শুরু হ’লে তিনি একটা চাদরে নিজের মুখমন্ডল ঢেকে নিলেন। যখন নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হ’ল, তখন মুখমন্ডল হ’তে চাদর সরিয়ে দিয়ে বললেন,لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ- ‘আল্লাহর লা‘নত ইহূদী ও খৃষ্টানদের প্রতি, যারা তাদের নবীগণের কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে’ (বুখারী হা/৪৩৫-৪৩৬; মুসলিম হা/৫৩১; মিশকাত হা/৭১২)। এ কথা বলে তিনি মুসলমানদেরকে ভক্তির আতিশয্যে কবর পূজার শিরকে লিপ্ত হওয়া থেকে সতর্ক করেছিলেন।

আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে আলাপচারিতার সময় বলল, مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ، ‘যা আল্লাহ ও আপনি ইচ্ছা করেন’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন,جَعَلْتَنِى لِلَّهِ عَدْلاً، مَا شَاءَ اللهُ وَحْدَهُ- ‘তুমি তো আমাকে আল্লাহর সমতুল্য গণ্য করলে। বরং (বল) একমাত্র আল্লাহ ইচ্ছা করেন’ (আহমাদ হা/৩২৪৭; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৯৫৭৩; ছহীহাহ হা/১০৯৩)।

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে বলল,يَا مُحَمَّدُ يَا سَيِّدَنَا وَابْنَ سَيِّدِنَا وَخَيْرَنَا وَابْنَ خَيْرِنَا، ‘হে মুহাম্মাদ, হে আমাদের নেতা এবং আমাদের নেতার পুত্র। আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তির সন্তান’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,أَيُّهَا النَّاسُ عَلَيْكُمْ بِتَقْوَاكُمْ، وَلاَ يَسْتَهْوِيَنَّكمُ الشَّيْطَانُ، أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ، وَاللهِ مَا أُحِبُّ أَنْ تَرْفَعُونِى فَوْقَ مَنْزِلَتِى الَّتِى أَنْزَلَنِى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ- ‘হে জনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে। বরং আমি আব্দুল্লাহর পুত্র ‘মুহাম্মাদ’। আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহর কসম! আমি পসন্দ করিনা যে, মহান আল্লাহ আমাকে যে মর্যাদা প্রদান করেছেন, তোমরা অতিরঞ্জিত করে আমাকে তার ঊর্ধ্বে উঠাবে’(আহমাদ হা/১৩৫৫৩; নাসাঈ কুবরা হা/১০০০৭; ছহীহাহ হা/১৫৭২)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top