(ফযীলতপূর্ণ দো‘আ ও যিকির’ বই থেকে নেয়া)
বিদ্বানগণের মতে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ছালাতে (দরূদ) পাঠ কখনো ওয়াজিব আবার কখনো মুস্তাহাব। ইমাম শাফেঈ ও আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর মতে তাশাহহুদের পর দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। আর ইমাম আবূ হানীফা ও মালেক (রহঃ)-এর মতে সুন্নাত।(আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-বাসসাম, তায়সীরুল আল্লাম শরহে উমদাতুল আহকাম, (কুয়েত : জমঈয়াতু ইহয়াইত তুরাছ আল-ইসলামী, ১৯৯৪ খৃঃ), পৃঃ ১/২৬৮।)
নবী করীম (ছাঃ) নিজের উপর তাশাহহুদ ও তাশাহহুদের পরে দরূদ পাঠ করতেন এবং উম্মতদেরকে পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন। (আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন নাবী (ছাঃ), ‘দরূদ পাঠ’ অধ্যায়। )
ফাযালাহ ইবনে ‘উবাইদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক ব্যক্তির ছালাত আদায় করার সময় শুনলেন যে, সে দো‘আ করল বটে কিন্তু আল্লাহ্র প্রশংসা করল না ও নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি ছালাতে (দরূদ) পাঠ করল না। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, লোকটি তাড়াহুড়া করছে। তারপর তিনি তাকে ডেকে বললেন, إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلْيَبْدَأْ بِتَمْحِيْدِ رَبِّهِ وَالثَّنَاءِ عَلَيْهِ، ثُمَّ يُصَلِّي عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ يَدْعُوْ بِمَا شَاءَ. ‘যখন তোমাদের কেউ ছালাত আদায় করবে তখন সে প্রথমে আল্লাহ্র হাম্দ ও গুণগান পাঠ করবে, তারপর নবী করীম (ছাঃ)-এর উপরে সালাম (দরূদ) পাঠ করবে, তারপর স্বীয় পছন্দমত দো‘আ পাঠ করবে’। (আবূদাঊদ হা/১৪১৮; তিরমিযী হা/৩৪৭৬; নাসাঈ হা/১২৮৪।)
.
দরূদ পাঠ :
أَللهمّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ. أَللهمّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ছাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদিন কামা ছাল্লায়তা ‘আলা ইবরা-হীমা ওয়া ‘আলা আ-লি ইবরা-হীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লা-হুম্মা বা-রিক ‘আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদিন কামা বা-রকতা ‘আলা ইবরা-হীমা ওয়া ‘আলা আ-লি ইবরা-হীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি রহমত বর্ষণ করুন মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবারের উপরে, যেমন আপনি রহমত বর্ষণ করেছেন ইবরাহীম ও ইবরাহীমের পরিবারের উপরে। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত। হে আল্লাহ! আপনি বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবারের উপরে, যেমন আপনি বরকত নাযিল করেছেন ইবরাহীম ও ইবরাহীমের পরিবারের উপরে। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত’। (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৯১৯ ‘রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ’ অনুচ্ছেদ-১৬)
(১) দরূদ পাঠ না করলে বিপদগ্রস্ত হবে :
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,مَا جَلَسَ قَوْمٌ مَجْلِسًا لَمْ يَذْكُرُوا اللهَ فِيْهِ وَلَمْ يُصَلُّوا عَلَى نَبِيِّهِمْ إِلاَّ كَانَ عَلَيْهِمْ تِرَةً فَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُمْ وَإِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُمْ ‘কোন সম্প্রদায় কোন মজলিসে বসে যদি আল্লাহ তা‘আলার যিকির না করে এবং তাদের নবীর প্রতি দরূদ পাঠ না করে, তারা বিপদগ্রস্ত ও আশাহত হবে। আল্লাহ তা‘আলা চাইলে তাদেরকে শাস্তিও দিতে পারেন কিংবা ক্ষমাও করতে পারেন’। (তিরমিযী হা/৩৩৮০; ছহীহ হাদীছ )
(২) দরূদ পাঠে অলস ব্যক্তি, বখীল :
অলসতা করে যে দরূদ পাঠ করে না, সে বখীল হিসাবে গণ্য হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْبَخِيْلُ الَّذِيْ مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَه فَلَمْ يُصَلِّ عَلَـيَّ، ‘সেই হচ্ছে কৃপণ, যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হয়েছে অথচ সে আমার উপর দরূদ পড়েনি’। (তিরমিযী হা/৩৫৪৬; আহমাদ হা/১৭৩৫; মিশকাত হা/৯৩৩) অন্যত্র তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না, সবচেয়ে বখীল কে? সকলে বলল, অবশ্যই হে আল্লাহ্র রাসূল! তিনি বললেন, যার নিকট আমার নাম উল্লেখ করা হ’ল, অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল না। সেই সবচেয়ে বড় কৃপণ’ (ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬৮৪)।
(৩) দরূদ পাঠ না করলে জান্নাতের পথ ভুলে যাবে :
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ نَسِيَ الصَّلاةَ عَلَيَّ خَطِئَ طَرِيقَ الْجَنَّةِ، ‘যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পাঠ করতে ভুল করল, সে আসলে জান্নাতের পথ ভুল করল’ (ইবনু মাজাহ হা/৯০৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬৮২)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘(জিব্রীল (আঃ) এসে বললেন) আপনি আমীন বলুন (এই কথার উপর) যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হ’ল অথচ সে আপনার প্রতি দরূদ পাঠ করল না, অতঃপর মারা গেল। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহ তাকে তাঁর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিবেন। জিব্রীল (আঃ) বললেন, আপনি আমীন বলুন! অতঃপর আমি আমীন বললাম’ (ছহীহ ইবনে হিব্বান হা/২৩৮৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬৭৯)।
(৪) জুম‘আর দিনে বেশী বেশী দরূদ পাঠ, নবী (ছাঃ)-এর নির্দেশ :
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أكثِروا الصَّلاةَ عليَّ يومَ الجمُعةِ وليلةَ الجمُعةِ، فمَن صلَّى عليَّ صلاةً صلَّى اللهُ عليهِ عَشرًا. ‘তোমরা জুম‘আর দিনে ও জুম‘আর রাতে আমার প্রতি বেশী বেশী দরূদ পাঠ করো। কারণ যে আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত নাযিল করেন’ (ছহীহুল জামি‘ হা/১২০৯; বায়হাকী, সুনানে কুবরা ৩/২৪৯)।
আওস ইবনে আওস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ مِنْ أَفْضَلِ أَيَّامِكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فِيهِ خُلِقَ آدَمُ وَفِيهِ قُبِضَ وَفِيهِ النَّفْخَةُ وَفِيهِ الصَّعْقَةُ فَأَكْثِرُوا عَلَىَّ مِنَ الصَّلاَةِ فِيهِ فَإِنَّ صَلاَتَكُمْ مَعْرُوضَةٌ عَلَىَّ قَالَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ تُعْرَضُ صَلاَتُنَا عَلَيْكَ وَقَدْ أَرِمْتَ يَقُولُونَ بَلِيتَ . فَقَالَ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ حَرَّمَ عَلَى الأَرْضِ أَجْسَادَ الأَنْبِيَاءِ. ‘তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম দিনটি হচ্ছে জুম‘আর দিন। এই দিনে আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই দিনই তাঁর রূহ কবয করা হয়েছিল, এই দিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে এবং এই দিনেই বিকট শব্দ করা হবে। কাজেই এই দিন তোমরা আমার ওপর বেশী করে দরূদ পড়ো। কারণ তোমাদের দরূদগুলো আমার কাছে পেশ করা হয়। আওস ইবন আওস (রাঃ) বলেন, লোকেরা বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল! কিভাবে আমাদের দরূদগুলি পেশ করা হবে, যখন আপনার শরীর তো জরাজীর্ণ হয়ে মিশে যাবে? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ মাটির জন্য নবী-রাসূলগণের দেহকে হারাম করে দিয়েছেন’(আবূদাঊদ হা/১০৪৭; রিয়াযুছ ছালিহীন হা/১৩৯৯, আলবানী হাদীছটি ছহীহ বলেছেন)।
(৫) একবার দরূদ পাঠের ফযীলত :
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً وَاحِدَةً صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ عَشْرَ صَلَوَاتٍ، وَحُطَّتْ عَنْهُ عَشْرُ خَطِيئَاتٍ، وَرُفِعَتْ لَهُ عَشْرُ دَرَجَاتٍ. ‘যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ তা‘আলা তার উপর দশটি রহমত নাযিল করবেন, দশটি গুনাহ মিটিয়ে দিবেন এবং দশটি মর্যাদায় উন্নীত করবেন’ (নাসাঈ হা/১২৯৭; মিশকাত হা/৯২২ আহমাদ হা/১১৯৯৮; হাকিম হা/২০১৮; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৪৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬৫৭।)।
(৬) রাসূল (ছাঃ)-এর উপর সালাম পেশ করলে, তিনি রূহ ফিরে পান ও সালামের জওয়াব দেন :
আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ لِلَّهِ مَلاَئِكَةً سَيَّاحِينَ فِى الأَرْضِ يُبَلِّغُونِى مِنْ أُمَّتِى السَّلاَمَ. ‘আল্লাহ তা‘আলার এমন কতক ফেরেশতা রয়েছে, যাঁরা পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়ায়, তাঁরা আমার উম্মতের সালাম আমার কাছে পৌঁছিয়ে থাকেন’ (নাসাঈ হা/১২৮২; মিশকাত হা/৯২৪; দারেমী হা/২৭৭৪; ইবনু হিব্বান হা/৯১৪; হাকিম হা/৩৫৭৬; সদন ছহীহ)।
অন্যত্র আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ أَحَدٍ يُسَلِّمُ عَلَىَّ إِلاَّ رَدَّ اللهُ عَلَىَّ رُوحِى حَتَّى أَرُدَّ عَلَيْهِ السَّلاَمَ. ‘কোন ব্যক্তি আমার উপর সালাম পেশ করলে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমার ‘রূহ’ ফিরিয়ে দেন এবং আমি তার সালামের জওয়াব দেয়’(আবূদাঊদ হা/২০৪১; মিশকাত হা/৯২৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২২৬৬; ছহীহুল জামি‘ হা/৫৬৭৯; হাসান হাদীছ)।