ক্বিয়ামতের আলামত সমূহের অন্যতম হ’ল দাজ্জালের আবির্ভাব। সে ক্বিয়ামতের পূর্বে বের হয়ে আসবে। হাদীছে তার সম্পর্কে সবিস্তার বিবরণ উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কেউ কেউ দাজ্জালের আবির্ভাবের কথা ফলাও করে প্রচার করছে। আবার তাদের দাবীর পক্ষে কুরআন-হাদীছের দলীলও পেশ করছে। যা সর্বৈব মিথ্যা। এসব মিথ্যা প্রচারের ফলে জনমনে সৃষ্ট ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে এবং দাজ্জাল সম্পর্কে সঠিক বিষয় তুলে ধরার জন্যই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
দাজ্জালের পরিচয় :
দাজ্জালের পুরো নাম ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’। মাসীহ : এর অর্থ সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, يُقَالُ إِنَّهُ سُمِّيَ بِذَلِكَ لِكَوْنِهِ يَمْسَحُ الْأَرْضَ وَقِيلَ سُمِّيَ بِذَلِكَ لِأَنَّهُ مَمْسُوحُ الْعَيْنِ ‘বলা হয় যে, তাকে এই নামে নামকরণ করা হয়েছে, কারণ সে পৃথিবী ধ্বংস করবে। কারো মতে, যেহেতু তার এক চোখ কানা থাকবে তাই এ নামে তাকে নামকরণ করা হয়েছে’।[1] অন্য বর্ণনায় রাসূল (ছাঃ) বলেন, দাজ্জাল শেষ যামানায় খোরাসান থেকে বের হবে (তিরমিযী হা/২২৩৭; ইবনু মাজাহ হা/৪০৭২)।
দাজ্জালের বৈশিষ্ট্য :
১. দাজ্জাল খুরাসান হ’তে বের হবে।[2] ২. দাজ্জালের সাথে পানি ও আগুন থাকবে। তার আগুন হবে ঠান্ডা পানি এবং তার পানি হবে আগুন।[3] ৩. দাজ্জালের ডান চোখ কানা হবে। যেন তা ফোলা আঙ্গুর।[4] ৪. দাজ্জাল স্থুলকায়, লাল বর্ণের, কোঁকড়ানো চুল বিশিষ্ট হবে।[5] ৫. দাজ্জালের দু’চোখের মাঝখানে কাফির শব্দটি লেখা থাকবে।[6] ৬. দাজ্জাল মক্কা-মদীনাতে প্রবেশ করতে পারবে না।[7] ৭. দাজ্জাল মধ্য বয়স্ক যুবক হবে। সে শাম ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থানে আবির্ভূত হবে।[8] ৮. সে চল্লিশ দিন বা চল্লিশ মাস বা চল্লিশ বছর অবস্থান করবে। এরপর আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে প্রেরণ করবেন। তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন।[9]
দাজ্জাল সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদা ও তা পর্যালোচনা :
অনেকেই দাজ্জালের দেহবিশিষ্ট ‘ব্যক্তি’ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা দাজ্জাল বলতে ‘ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা’কে উদ্দেশ্য করেন। সম্প্রতি মোহাম্মাদ বায়েজীদ খান লিখিত ‘দাজ্জাল? ইহুদী-খৃস্টান সভ্যতা!’ শিরোনামে একটি বই প্রচার করা হচ্ছে। বইটির মূল প্রতিপাদ্য হ’ল- ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতাই দাজ্জাল। সেখানে অনেক ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতিপয় তথ্য বিশ্লেষণ সহ নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
(১) ‘৪৭৬ বছর আগেই দাজ্জালের জন্ম হোয়েছে এবং সে তার শৈশব, কৈশোর পার হোয়ে বর্ত্তমানে যৌবনে আছে…’।[10]
জবাব : কোন যঈফ বা জাল হাদীছেও দাজ্জালের বয়স সম্পর্কে বলা হয়নি। দাজ্জালের জন্ম তারিখ বা সন কোন হাদীছে বর্ণিত হয়নি।
(২) ‘মহাশক্তিধর পাশ্চাত্য বস্ত্তবাদী সভ্যতাই হচ্ছে আল্লাহর রাসুল বর্ণিত সেই নির্দিষ্ট দাজ্জাল’।[11]
জবাব : এটি মনগড়া ও কপোলকল্পিত দাবী। কোন নির্দিষ্ট সভ্যতাকে দাজ্জাল বলার দলীল নেই। এমনকি ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতাকে দাজ্জাল আখ্যায়িত করা স্রেফ মিথ্যাচার বৈ কিছুই নয়। কারণ হাদীছে দাজ্জালের দৈহিক বর্ণনা ও অবস্থানকাল বর্ণিত হয়েছে। অথচ হাদীছের বিরোধিতা করে ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতাকে দাজ্জাল বলা হচ্ছে। যার পক্ষে কোন আয়াত কিংবা ছহীহ বা হাসান হাদীছ নেই।
(৩) ‘তেমনি অনেক সত্য হাদীছও সত্য হওয়া সত্ত্বেও এসনাদের অভাবে বাদ পোড়ে গেছে। কোন একটি বিষয়ে পূর্ণ ধারণা করার জন্য প্রয়োজন ঐ বিষয়টি সম্বন্ধে সহিহ, হাসান, দয়ীফ, এমন কি পরিত্যক্ত হাদীছও পর্যালোচনা করে একটি সম্যক ধারণা করা। তাতে ঐ বিষয়টি সম্বন্ধে একটি পূর্ণ চিত্র মনে ফুটে ওঠে। দাজ্জাল সম্বন্ধে আলোচনাতেও আমি এই নীতিই গ্রহণ করেছি, যদিও ভিত্তি অবশ্যই রয়েছে ছহিহ হাদীছগুলির ওপর’।[12]
জবাব : এটি হাস্যকর ও অজ্ঞতাপ্রসুত দাবী। সত্য হাদীছ ইসনাদের (সনদের) অভাবে বাদ পড়ে গেছে মর্মে দাবী করার অর্থ হ’ল আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে হেফাযত করতে ব্যর্থ হয়েছেন (নাঊযুবিল্লাহ)। যঈফ, জাল, পরিত্যক্ত হাদীছ দ্বারা কোন বিষয়ের সম্যক ধারণা পেতে হবে, এটিও একটি বাতিল চিন্তাধারা। আমরা জানি যে, নবী করীম (ছাঃ) এবং ছাহাবাদের মধ্যে পরিত্যক্ত, বাতিল হাদীছ ছিল না। তাই বলে কি ছাহাবীগণ ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা অর্জন করেননি? তিনি যদিও ছহীহ হাদীছকে ভিত্তি করার দাবী করেছেন। কিন্তু স্বীয় দাবী মোতাবেক একটি ছহীহ হাদীছও পেশ করতে সক্ষম হননি।
(৪) ‘কিন্তু তার সময়ের মানুষের শিক্ষার স্বল্পতার জন্য তাঁকে বাধ্য হোয়ে দাজ্জালকে রূপকভাবে বর্ণনা করতে হয়েছে’।[13]
পর্যালোচনা : (ক) মুহাম্মাদ (ছাঃ) দাজ্জালের বিষয়টি ‘মাজাযী’ বা রূপকভাবে বর্ণনা করেছেন বলে কোন দলীল নেই। (খ) অত্র উক্তি দ্বারা তিনি ছাহাবীদেরকে স্বল্প শিক্ষিত বলে দাবী করেছেন, যা আদবের খেলাফ ও চরম ভ্রান্তিমূলক। কারণ শরী‘আত সম্পর্কে ছাহাবীগণ সর্বাধিক অবহিত ছিলেন।
(৫) ‘কিন্তু সে রূপক বর্ণনা আজ পরিষ্কারভাবে ধরা দিয়েছে, যদিও আমাদের প্রায়ান্ধ দৃষ্টির জন্য সে বর্ণনাও আমরা বুঝতে সক্ষম হোচ্ছি না’…।[14]
পর্যালোচনা : নবীর বাণীর মর্ম এতদিন গোপন ছিল (?)। আজ তার অন্তর্নিহিত মর্ম পরিষ্কার হয়েছে টাঙ্গাইলের একজন সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তির নিকটে (?)।* উক্ত দাবী একেবারেই হাস্যকর ও উদ্ভট দাবী। ঐ উক্তিতে সকল স্তরের মানুষদেরকে ‘প্রায়ান্ধ’ বলে তুচ্ছ করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছেন বায়েজীদ খান। যাদের মধ্যে ইমাম, মুহাদ্দিছ, মুফাসসির, ফক্বীহ সবাই শামিল। এটা মূলতঃ লেখকের অপরিপক্ক জ্ঞান ও অনুর্বর মস্তিষ্কের চিন্তা-ধারার ফসল।
(৬) ‘আল্লাহর রসুল একে দাজ্জাল নামে অভিহিত কোরেছেন। কিন্তু এটা কোন নাম নয়, এটা একটা বর্ণনা, অর্থাৎ বিষয়টার বর্ণনা’।[15]
পর্যালোচনা : এটাও অজ্ঞতাসূলভ হাস্যকর দাবী। রাসূল (ছাঃ) দাজ্জাল নামের একজন ব্যক্তির কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। ‘দাজ্জাল’ কোন বর্ণনা নয়। বরং এটি ব্যক্তির নাম। কোন নাম আর বর্ণনা এক নয়।
‘দাজ্জালের পরিচিতি’ (পৃঃ ২৯) শিরোনামে লেখক কতগুলি হাদীছ এনেছেন। যেমন-
হাদীছ-১ : ‘দাজ্জাল ইহুদী জাতির মধ্যে থেকে উত্থিত হবে এবং ইহুদী ও মুনাফেকরা তার অনুসারী হবে’ (পৃঃ ২৯)।
পর্যালোচনা : তিনি এখানে ইহুদী ও মুনাফেক্বের কথা বলে সেটি রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি সম্বন্ধ করেছেন এবং মুসলিমের দলীল প্রদান করেছেন। অথচ ছহীহ মুসলিমে এমন কোন হাদীছ নেই। বরং يَخْرُجُ الدَّجَّالُ فِيْ أُمَّتِيْ ‘আমার উম্মতের মধ্য হ’তে দাজ্জাল বের হবে’ এমনটিই বলা হয়েছে।[16] অন্য হাদীছে এসেছে যে, ‘ইহূদীগণ তার অনুসারী হবে’। কিন্তু ছহীহ মুসলিমের কোথাও ‘দাজ্জাল ইহূদীর মধ্য হ’তে হবে’ বলে কোন হাদীছ নেই। এভাবে তিনি হাদীছ বিকৃত করেছেন ও তথ্যসূত্র ভুল উল্লেখ করেছেন।
হাদীছ-২ : ‘দাজ্জাল নিজেকে মানুষের রব, প্রভু বোলে ঘোষণা কোরবে এবং মানবজাতিকে বোলবে তাকে রব বলে স্বীকার কোরে নিতে’ (পৃঃ ৩০)।
পর্যালোচনা : এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর তিনি উদ্ভট কিছু ব্যাখ্যা প্রদান করে এটি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, পাশ্চাত্যের ইহুদী-খ্রীষ্টানই অত্র হাদীছে উদ্দেশ্য। তিনি কোন হাদীছের নম্বর বা অনুচ্ছেদ, অধ্যায় উল্লেখ করেননি। আরবী ইবারতও লিখেননি। স্রেফ ‘বুখারী’ লিখে দিয়েছেন। ছহীহুল বুখারীর দাজ্জাল বিষয়ক হাদীছগুলিতে অত্র উক্তি সম্বলিত কোন হাদীছ আমরা অবগত হ’তে পারিনি।[17]
হাদীছ-৩ : ‘দাজ্জালের বাহনের দুই কানের দূরত্ব হবে সত্তর হাত’ (পৃঃ ৩১)।
পর্যালোচনা : এখানে উদ্ধৃতি হিসাবে বায়হাক্বী ও মিশকাতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অত্র হাদীছটির সনদ ও মতন হ’ল-
مُحَمَّدُ بْنُ عُقْبَةَ بْنِ أَبِيْ عَتَّابٍ الْمَدِيْنِيُّ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يَخْرُجُ الدَّجَّالُ عَلَى حِمَارٍ أَقْمَرَ، مَا بَيْنَ أُذُنَيْهِ سَبْعُوْنَ بَاعًا-
‘দাজ্জাল সাদা (সবুজ মিশ্রিত) রং-এর গাধায় চড়ে বের হবে। তার দু’কানের মাঝে সত্তর হাত (প্রসারিত দু’বাহু পরিমাণ) দূরত্ব থাকবে’।[18]
(১) শায়খ আলবানী (রহঃ) একে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন।[19]
(২) শায়েখ যুবায়ের আলী যাঈ বলেছেন, এটা আমি পাইনি। বায়হাক্বী একে ‘আল-বা‘ছু ওয়ান-নুশূর’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন (যা আমি পাইনি)। বুখারী একে আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে (১/১৯৯) বর্ণনা করেছেন। তবে এর সনদ যঈফ।[20]
গ্রহণযোগ্য হাদীছে বলা হয়েছে-
يَخْرُجُ الدَّجَّالُ عَلَى حِمَارٍ، رِجْسٌ عَلَى رِجْسٍ ‘দাজ্জাল একটি অপবিত্র গাধার উপর চড়ে বের হবে। নাপাকির উপর নাপাকি (যার পুরোটাই নাপাকিতে ভরপুর থাকবে)’।[21]
হাদীছ-৪ : ‘দাজ্জালের গতি হবে অতি দ্রুত। সে বায়ু তাড়িত মেঘের মত আকাশ দিয়ে উড়ে চোলবে’ (পৃঃ ৩২)।
পর্যালোচনা : তিনি নাওয়াস বিন সাম‘আন (রাঃ)-এর বর্ণনায় মুসলিম ও তিরমিযীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মুসলিমে এমন কোন হাদীছ নেই। বরং মুসলিমে আছে, قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا إِسْرَاعُهُ فِي الْأَرْضِ؟ قَالَكَالْغَيْثِ اسْتَدْبَرَتْهُ الرِّيحُ، ‘বাতাসের প্রবাহ মেঘমালাকে যেভাবে হাঁকিয়ে নিয়ে যায় তার গতি হবে তেমন’।[22] অন্য হাদীছে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে,إِنَّهُ شَابٌّ قَطَطٌ، عَيْنُهُ طَافِئَةٌ، كَأَنِّي أُشَبِّهُهُ بِعَبْدِ الْعُزَّى بْنِ قَطَنٍ ‘সে হবে মধ্যবয়সী যুবক। তার চোখ হবে ফোলা আঙ্গুরের ন্যায়। যেন আমি তার মধ্যে আব্দুল উয্যা বিন ক্বাত্বান-এর সাদৃশ্য পাচ্ছি (ঐ)। এখানে দাজ্জালকে স্পষ্টভাবে মানুষ বলা হ’ল। তাকে মানুষের সাথে সাদৃশ্যও দেয়া হ’ল। এরপরও দাজ্জালকে মানুষ হিসাবে অস্বীকার করার কোন কারণ থাকতে পারে না।
হাদীছ-৫ : ‘আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের আদেশে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ হবে’ (পৃঃ ৩৩)।
তাহক্বীক্ব : এখানেও তিনি উপরোল্লিখিত নাওয়াস বিন সাম‘আনের হাদীছটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এতে আছে, إِنَّهُ شَابٌّ قَطَطٌ، عَيْنُهُ طَافِئَةٌ[23] এখানে স্পষ্টভবে বলা হয়েছে যে, দাজ্জাল একজন মধ্যবয়স্ক যুবক হবে যে চল্লিশ দিন থাকবে। অথচ এই কথাটিকে গোপন রেখে স্রেফ পানি বর্ষণের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি ধোঁকা দিয়েছেন।
হাদীছ-৬ : ‘দাজ্জালের কাছে রেযকের বিশাল ভান্ডার থাকবে। সেখান থেকে সে যাকে ইচ্ছা তাকে দেবে। যারা তার বিরোধিতা কোরবে তাদের সে ঐ ভান্ডার থেকে রেযক দেবে না। এইভাবে সে মোসলিমদের অত্যন্ত কষ্ট দিবে। যারা দাজ্জালকে অনুসরণ কোরবে তারা আরামে থাকবে আর যারা তা কোরবে না তারা কষ্টে থাকবে’ (পৃঃ ৩৪)।
পর্যালোচনা : এখানে তিনি বুখারী এবং মুসলিমের উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। ছহীহ বুখারীতে এই ভাষার কোন হাদীছ নেই। মুসলিমেও এমন সরাসরি উক্তি নেই যাকে নবীর কথা বলে চালানো যায়।
হাদীছ-৭ : ‘দাজ্জালের ডান চোখ অন্ধ হবে’ (পৃঃ ৩৫)।
পর্যালোচনা : তিনি এখানে বুখারী ও মুসলিমের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন।
(১) বুখারীতে আছে- নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘এরপর আমি তাকাতে থাকলাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম, একজন ব্যক্তি স্থুলকায় লাল বর্ণের, কোঁকড়ানো চুল, এক চোখ অন্ধ, চোখটি যেন ফোলা আঙ্গুরের ন্যায়’।[24] অত্র হাদীছে রাসূল (ছাঃ) ‘রাজুল’ তথা ‘পুরুষ মানুষ’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন। অতঃপর স্থুলকায়, লাল বর্ণ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যা প্রমাণ করে যে দাজ্জাল নিঃসেন্দহে একজন মানুষ। এগুলিকে পরিহার করে নিজের মনগড়া দাবীর পক্ষে একরাশ মিথ্যচারকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লেখক হাদীছের খন্ডিত অংশ উপস্থাপন করে বানোয়াট ব্যাখ্যার অবতারণা করেছেন।
(২) (ক) ছহীহ মুসলিমে আছে, ‘আর আমি একজন পুরুষকে দেখলাম, লালবর্ণ…[25] হাদীছটির ইবারত-
وَرَأَيْتُ وَرَاءَهُ رَجُلًا أَحْمَرَ، جَعْدَ الرَّأْسِ، أَعْوَرَ الْعَيْنِ الْيُمْنَى، أَشْبَهُ مَنْ رَأَيْتُ بِهِ ابْنُ قَطَنٍ، فَسَأَلْتُ مَنْ هَذَا؟ فَقَالُوا الْمَسِيحُ الدَّجَّالُ-
‘আমি তার পিছনে একজন লালবর্ণের, ঘন-কেশের পুরুষ মানুষকে দেখলাম। যার একটি চোখ অন্ধ। আমি যাকে দেখেছি সে ইবনু ক্বাত্বান-এর ন্যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ কে? তারা বলল, মাসীহুদ দাজ্জাল’।[26]
(খ) মুসলিম (রহঃ) লিখেছেন,فَإِذَا رَجُلٌ أَحْمَرُ، جَسِيْمٌ، جَعْدُ الرَّأْسِ، أَعْوَرُالْعَيْنِ، كَأَنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ، قُلْتُ: مَنْ هَذَا؟ قَالُوا: الدَّجَّالُ، ‘হঠাৎ একজন লালবর্ণের, মোটা, ঘন-কেশের পুরুষ মানুষকে দেখলাম। যার একটি চোখ অন্ধ, চোখটি যেন ফোলা আঙ্গুরের ন্যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই ব্যক্তি কে? তারা বলল, মাসীহুদ দাজ্জাল’।[27]
(গ) ইমাম মুসলিম (রহঃ) হাদীছ বর্ণনা করেছেন, الدَّجَّالُ أَعْوَرُ الْعَيْنِ الْيُسْرَى، جُفَالُ الشَّعَرِ، مَعَهُ جَنَّةٌ وَنَارٌ، فَنَارُهُ جَنَّةٌ وَجَنَّتُهُ نَارٌ ‘দাজ্জালের বাম চোখ কানা ও ঘন চুলের অধিকারী হবে। তার সাথে জান্নাত ও জাহান্নাম থাকবে। তার জাহান্নামই হ’ল (প্রকৃত) জান্নাত এবং তার জান্নাত হ’ল (প্রকৃত) জাহান্নাম’।[28]
বুখারী ও মুসলিমের উপরোল্লিখিত চারটি হাদীছের মধ্যে দাজ্জালকে মানুষ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এরপরও একে অস্বীকার করে ‘ইহুদী-খ্রীষ্টান সভ্যতা’কে দাজ্জাল বলা অন্যায় ও জঘন্য মিথ্যাচার।
হাদীছ-৮ : ‘আমার উম্মতের সত্তর হাজার লোক দাজ্জালের অনুসরণ কোরবে’ (পৃঃ ৪৬)।
পর্যালোচনা : তিনি দলীল হিসাবে ‘শারহুস সুন্নাহ’র উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। হাদীছটি হ’ল-
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ أُمَّتِي سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ السِّيجَانُ-
আবূ সাঈদ খুদরী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্য হ’তে সত্তর হাযার লোক দাজ্জালকে অনুরণ করবে’।[29]
তাহক্বীক্ব : এ হাদীছটি অত্যন্ত যঈফ।
(১) শায়েখ আলবানী (রহঃ) এটিকে যঈফ বলেছেন।[30] তিনি বলেন, ضعيف جداً بلفظ أمتي ‘আমার উম্মত’ শব্দ যোগে (এটি) অত্যন্ত দুর্বল। তিনি আরো বলেছেন, قلت: وهذا إسناد ضعيف جداً؛ أبو هارون اسمه: عمارة بن جُوَين، قال الحافظ في التقريب متروك، ومنهم من كذبه ‘আমি বলেছি, সনদটি খুবই যঈফ। আবূ হারূণের নাম হ’ল উমারাহ বিন জুয়াইন। হাফেয ইবনে হাজার ‘আত-তাক্বরীব’ গ্রন্থে বলেছেন, তিনি মাতরূক। তিনি মিথ্যুকদের অন্যতম।[31]
(২) শায়েখ যুবায়ের আলী যাঈ (রহঃ) বলেছেন, ‘এর সনদ খুবই দুর্বল। বাগাবী এটি শারহুস সুন্নাহ (হা/৪২৬৫, ১৫/১২) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এতে ‘আবূ হারূন আল-আবদী’ নামক মাতরূক রাবী রয়েছেন। যিনি মিথ্যার দোষে অভিযুক্ত। আর মুসলিমের হাদীছটি (হা/২৯৪৪)-এর বিরোধী’।[32]
(৩) মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (রহঃ) বলেছেন, قِيلَ: فِي سَنَدِهِ أَبُو هَارُونَ وَهُوَ مَتْرُوكٌ ‘বলা হয়েছে, এর সনদের মধ্যে আবূ হারূণ রয়েছেন। আর তিনি মাতরূক’।[33] এটি ছহীহ মুসলিমের হাদীছের সরাসরি বিরোধী- আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেছেন,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ يَهُودِ أَصْبَهَانَ، سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ الطَّيَالِسَةُ ‘ইস্পাহানের সত্তর হাযার ইহুদী দাজ্জালের অনুসরণ করবে। যাদের পরনে ত্বায়ালিসাহ (এক ধরনের পোষাক) থাকবে।[34] অতএব সত্তর হাযার উম্মত তাকে অনুসরণ করবে- এটি ভ্রান্ত দাবী।
হাদীছ-৯ : ‘দাজ্জালের শক্তি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি পৃথিবীর সমস্ত মাটি ও পানি (ভূ-ভাগ ও সমুদ্র) আচ্ছন্ন কোরবে। সমস্ত পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ চামড়া দিয়ে জড়ানো একটি বস্ত্তর মত তার করায়ত্ত হবে’ (পৃঃ ৪৮)।
পর্যালোচনা : এমন কোন হাদীছ আমরা খুঁজে পাইনি। তবে একটি হাদীছ এর কাছাকাছি-وَإِنَّهُ سَيَظْهَرُ عَلَى الْأَرْضِ كُلِّهَا إِلاَّ الْحَرَمَ، وَبَيْتَ الْمَقْدِسِ ‘আর অচিরেই দাজ্জাল হারাম ও বায়তুল মাক্বদেস ব্যতীত সমগ্র যমীনকে জয় করবে’।[35] যা হাদীছে নেই তাকে রাসূলের প্রতি সম্বন্ধ করা হারাম। এটি জঘন্যতম মিথ্যাচার।
(১) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রয়েছে, يَخْرُجُ الدَّجَّالُ فَيَتَوَجَّهُ قِبَلَهُ رَجُلٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ‘দাজ্জাল বের হবে এবং সে একজন মুমিন ব্যক্তির প্রতি মনোনিবেশ করবে’।[36] দাজ্জাল সেই লোকটিকে হত্যাও করবে। লেখকের দাবী মোতাবেক দাজ্জালের আবির্ভাবের ৪৭৬ বছর হয়ে গিয়েছে (পৃঃ ১)। তাহ’লে দাজ্জাল এই লোকটিকে এখনো হত্যা করল না কেন?
(২) বুখারীর অসংখ্য স্থানে ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’ শব্দটি এসছে। তন্মধ্যে একটি হাদীছে এসেছে- وَإِذَا أَنَا بِرَجُلٍ جَعْدٍ قَطَطٍ، أَعْوَرِ العَيْنِ اليُمْنَى كَأَنَّهَا عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ ‘আর একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ মানুষকে দেখলাম যার বাম চোখ কানা যেন তা ফোলা আঙ্গুরের ন্যায়’।[37] অত্র হাদীছে স্পষ্টভাবে ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’কে পুরুষ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
(৩) মুসলিমের অসংখ্য স্থানেই ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’ শব্দটি এসেছে। তবে বুখারীর উপরোক্ত হাদীছটি (হা/৫৯০২) ছহীহ মুসলিমেও আছে।[38]
(৪) আবূদাঊদের একাধিক স্থানে ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’ শব্দটি এসেছে। একটি হাদীছে এসেছে, إِنَّ مَسِيْحَ الدَّجَّالِ رَجُلٌ قَصِيْرٌ ‘নিশ্চয়ই মাসীহ দাজ্জাল একজন খাটো মানুষ (হা/৪৩২০)। লেখকের উদ্ধৃত উবাদাহ বিন ছামেত বর্ণিত এই হাদীছেও একেবারেই স্পষ্ট ভাষায় দাজ্জালকে ‘একজন খাটো মানুষ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপসংহার : দাজ্জালের বিষয়ে মুসলমানদেরকে ফিৎনায় ফেলা কিছু মানুষের উদ্দেশ্য ছিল। ফলে তারা এ বিষয়ে মিথ্যা প্রচারণা আরম্ভ করে। সাথে সাথে হাদীছের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে অপপ্রয়াস চালায়। তাই তাদের খপ্পর থেকে বেঁচে থাকার জন্য মুসলমানদেরকে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।-আমীন!
সংশ্লিষ্ট লেখা : https://anniyat.com/alzt
লেখক : আহমাদুল্লাহ সৈয়দপুরীর
[1]. ফাতহুল বারী ৬/৪৭২।
[2]. মুসনাদে আবী ইয়ালা হা/৩৪; তিরমিযী হা/২২৩৭; ইবনু মাজাহ হা/৪০৭২, সনদ ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/৭১৩০; মুসলিম হা/২৯৩৪।
[4]. বুখারী হা/৭১২৩।
[5]. বুখারী হা/৭১২৮।
[6]. বুখারী হা/৭১৩১; মুসলিম হা/২৯৩৩।
[7]. বুখারী হা/১৮৮১; মুসলিম হা/২৯৪৩।
[8]. মুসলিম হা/২৯৩৭।
[9]. মুসলিম হা/২৯৪০।
[10]. দাজ্জাল? ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা, পৃঃ ১, তওহীদ প্রকাশন।
[11]. ঐ পৃঃ ৩।
[12]. ঐ।
[13]. ঐ পৃঃ ৪।
[14]. ঐ, পৃঃ ৪।
* তিনি গ্রামের স্কুল হ’তে পড়াশোনা শেষ করে করটিয়া সাদত কলেজ পড়াশোনা করেন। এরপরে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়ন করেন। এই হল লেখকের ইসলামী পড়াশোনা ও গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা!।-লেখক।
[15]. ঐ।
[16]. ছহীহ মুসিলম হা/২৯৪০, ‘ফিতনা ও ক্বিয়ামতের আলামত’ অধ্যায়-৫২, অনুচ্ছেদ-২৩।
[17]. ছহীহুল বুখারী হা/৭১২২-৭১৩৪, ৬/৩৫৩-৩৫৭, ‘কিতাবুল ফিতান’।
[18]. তাখরীজু আহাদীছিল মারফূআহ হা/১৭১; মিশকাত হা/৫৪৯৩; আত-তারীখুল কাবীর, ক্রমিক ৬১৩।
[19]. যঈফা হা/১৯৬৮।
[20]. মিশকাতুল মাছাবীহ হা/৫৪৯৩, ৩/২৭৮।
[21]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৩৭৫৩৬, সনদ হাসান।
[22]. মুসলিম হা/২৯৩৭; তিরমিযী হা/২২৪০।
[23]. মুসলিম হা/২৯৭০।
[24]. বুখারী হা/৭১২৮।
[25]. মুসলিম হা/১৬৯, ‘মাসীহ ইবনে মারইয়াম ও মাসীহ দাজ্জালের বর্ণনা অনুচ্ছেদ’ ‘ঈমান অধ্যায়’।
[26] মুসলিম হা/১৬৯।
[27]. মুসলিম হা/১৭১।
[28]. মুসলিম হা/২৯৩৪, ‘দাজ্জালের উল্লেখ এবং তার বৈশিষ্ট্য’ অনুচ্ছেদ, ‘ফিতনা ও ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ’ অধ্যায়।
[29]. বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ হা/৪২৬৫; মিশকাত হা/৫৪৯০।
[30]. তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫৪৯০।
[31]. যঈফাহ হা/৬০৮৮।
[32]. তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫৪৯০, ৩/২৭৭।
[33]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৮/৩৪৮১।
[34]. মুসলিম হা/২৯৪৪।
[35]. হাকেম, আল-মুসতাদরাক হা/১২৩০।
[36]. মুসলিম হা/২৯৩৮।
[37]. বুখারী হা/৫৯০২।
[38]. হা/১৬৯, ‘ঈমান অধ্যায়’ অনুচ্ছেদ-৭৫।