পানি পানের বিধি-বিধান ও এর উপকারিতা

পৃথিবীর সকল কিছু সৃষ্টির মূল উপাদান পানি। এই মৌলিক উপাদান পৃথিবীর সকল জীবদেহের মধ্যে বিদ্যমান। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ ‘আর প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি হ’তে’ (আম্বিয়া ২১/৩০)। জীব বিজ্ঞানের মতে, সাগরের অভ্যন্তরের পানিতে যে প্রোটোপ্লাজম বা জীবনের আদিম মূলীভূত উপাদান রয়েছে তা থেকেই সকল জীবের সৃষ্টি। আবার সকল জীবদেহ কোষ দ্বারা গঠিত। আর এই কোষ গঠনের মূল উপাদান হচ্ছে পানি। সুতরাং পরিস্কার পানির অপর নাম জীবন । প্রত্যেক দিন সর্বনিম্ন আট গ্লাস পানি পান করুন। তবে খাবার খাওয়ার ১৬/২০ মিনিট পূর্বে এক/দুই গ্লাস পানি পান করুন। এতে শারীরিক উপকার তিনটি রয়েছে।

(১) খাওয়ার পূর্বে পানি পান করার কারণে পাকস্থলিতে স্থান কমে যায়, ক্ষুধা কমে যায়। এর ফলে কম খাওয়া যায়। কম খাওয়া শরীরের জন্য বিশেষ করে লিভারের জন্য খুবই উপকারী।

(২) রক্তে যথেষ্ট পরিমাণ পানি পৌছে, যা খাবার পরবর্তী নিউট্রিশন ট্রান্সপোর্টেশনে সাহায্য করে।

(৩) কিডনি ভাল থাকে। রক্তে ক্রিটিনাইনের পরিমাণ কমে যায়। দেহ সুস্থ্য থাকে।

(বি.দ্র: আয়রণ ও সেকারিনযুক্ত পানি/ড্রিংকস কিডনির জন্য চরম ক্ষতিকর)

(ক) পানি পানের আদব :

পানি পান করার আদব হ’ল:

(১) প্রথমে বিসমিল্লাহ বলা

(২) ডান হাতে পাত্র ধরা

(৩) বসে পান করা

(৪) তিন নিঃশ্বাসে পান করা

(৫) পাত্রের ভিতরে নিঃশ্বাস না ফেলা

(৬) পান শেষে আল-হামদুলিল্লাহ বলা (ছহীহুল জামে‘ হা/৪৯৫৬)।

(৭) বড় পাত্রে মুখ লাগিয়ে পান না করা (বুখারী হা/৫৬২৮; ছহীহাহ হা/৩৯৯)।

(৮) পান করার ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা (তিরমিযী হা/২৩৮০; ছহীহাহ হা/২২৬৫)।

৯) স্বর্ণ বা রৌপ্যের পাত্রে পান না করা (বুখারী হা/৫৬৩৪; মুসলিম হা/২০৬৫)।

(খ) দাঁড়িয়ে পান করার বিধি নিষেধ :

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «لَا يَشْرَبَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ قَائِمًا فَمَنْ نَسِيَ مِنْكُمْ فَلْيَسْتَقِئْ»  ‘তোমাদের কেউই যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। যদি কেউ ভুলবশতঃ এরূপ করে, সে যেন বমি করে ফেলে। (মুসলিম হা/২০২৪-২৬; মিশকাত হা/৪২৬৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৭১৮)।

উক্ত হাদীসের মধ্যে দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীসের মধ্যে যমযমের পানি এবং ওযূর অবশিষ্ট পানি দাঁড়িয়ে পান করার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ বিরোধের সমাধানে ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ দাঁড়িয়ে পান করা নিষেধের হাদীস মাকরূহে তানযীহীর উপর প্রযোজ্য, আর দাঁড়িয়ে পান করা (সম্পর্কিত হাদীস) হচ্ছে জায়িযের উপর প্রযোজ্য।

(فَمَنْ نَسِيَ مِنْكُمْ فَلْيَسْتَقِئْ) এখানে ভুলে দাঁড়িয়ে পান করলে বমি করে ফেলার নির্দেশ ওয়াজিব নয়, বরং মুস্তাহাব। যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে পান করল তার ওপর মুস্তাহাব হলো বমি করে ফেলা। দলীল স্বরূপ এ সহীহ হাদীসটি। কেননা হাদীসটি কোন ওযরে ওয়াজিব না হলে মুস্তাহাব হবেই।

কাযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, জ্ঞানীদের মধ্যে কোন ইখতিলাফ (মতভেদ) নেই যে, কোন ব্যক্তি ভুল করে দাঁড়িয়ে পান করলে তাকে বমি করা লাগবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়ত কোন ওযরের কারণে দাঁড়িয়ে পান করেছিলেন। ‘ইকরিমাহ্ (রহঃ) শপথ করে বলেন, সেদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরোহী অবস্থায় ছিলেন। (শারহুন নাবাবী ১৩শ খন্ড, হাঃ ২০২৪)

ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা.)-এর যামানায় আমরা হাঁটতে হাঁটতে খাবার খেতাম এবং দাঁড়িয়ে থাকাবস্থায় পানি পান করতাম। (তিরমিযী হা/১৮৮০, মিশকাত:৪২৭৫)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে পান করেছেন জীবনে একবার অথবা দু’বার বৈধতার জন্য অথবা স্থানের অসুবিধার জন্য আর বসে সর্বাবস্থায় পান করেছেন এবং যা উত্তম অভ্যাস। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

’আমর ইবনু শু’আয়ব (রহঃ) তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দাঁড়ানো এবং বসা উভয় অবস্থায় পান করতে দেখেছি। (তিরমিযী হা/১৮৮3, মিশকাত:৪২৭6)

আয়শা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে দাঁড়িয়ে ও বসে পানি পান করতে, খালি পায়ে ও জুতা পরিহিত অবস্থায় সালাত আদায় করতে এবং সালাত শেষে তাঁর ডান দিক থেকে ও বাম দিক থেকে ফিরে বসতে  দেখেছি’ (নাসায়ী হা/১৩৬১) অপর হাদীসে এসেছে, ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, একদিন আমি এক বালতি যমযমের পানি নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে উপস্থিত হলাম, তিনি তা দাঁড়িয়েই পান করলেন। (বুখারী হা/১৬৩৭, মুসলিম হা/২০২৭, মুসনাদে আহমাদ হা/২২৪৪, নাসাঈ হা/২৯৬৫, তিরমিযী হা/১৮৮২, ইবনু মাজাহ হা/৩৪২২, মিশকাত হা/৪২৬৮)

আল্লামা সুয়ূত্বী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসটি জায়িযের উপর প্রযোজ্য। যেমনটি ইমাম নাবাবীর কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এটারও সম্ভাবনা আছে যে, যমযমের পানি পান করার সময় মানুষের ভিড়ে তিনি বসার মতো জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে পান করেন। এটাও সম্ভাবনা আছে যে, পরবর্তীতে দাঁড়িয়ে পান করার বিধানকে মানসূখ করা হয়েছে।

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন তিনি কারও থেকে দাঁড়িয়ে পান করার হাদীসটি শুনলেন, তখন তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দাঁড়িয়ে পান করতে দেখেছিলাম, পরবর্তীতে তাঁকে দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করতেও শুনেছি। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ.) বলেন, الشرب قاعدًا أفضل والشرب قائمًا لا بأس به، والحديث الذي فيه الاستقاء منسوخ  “(পানি) বসে পান করা উত্তম। দাঁড়িয়ে পান করায় কোনও অসুবিধা নেই। আর যে হাদিসে বমি করার কথা এসেছে তা মানসুখ (রহিত)।”

অর্থাৎ- কাযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, জ্ঞানীদের মধ্যে কোন ইখতিলাফ বা মতভেদ নেই যে, কোন ব্যক্তি ভুল করে দাঁড়িয়ে পান করলে তাকে বমি করা লাগবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়ত কোন ওযরের কারণে দাঁড়িয়ে পান করেছিলেন। ‘ইকরিমাহ্ (রহঃ) শপথ করে বলেন, সেদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরোহী অবস্থায় ছিলেন। (শারহুন নাবাবী ১৩শ খন্ড, হাঃ ২০২৪)

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পান করা যে জায়েয, সেটা বুঝানোর জন্যই রাসূল (ছাঃ) এরূপ করেছেন (ফাৎহুল বারী হা/২৬১৫-১৬-এর আলোচনা)।

ইমাম নববীও একই মন্তব্য করেছেন (শরহ নববী হা/২০২৭-এর আলোচনা)।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, দাঁড়িয়ে পান থেকে বিরত থাকাই সঠিক। তবে ওযরবশতঃ জায়েয (যাদুল মা‘আদ ১/১৪৩-৪৪)।

ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, হজ্জের সময় ভিড়ের কারণে বসার সুযোগ না থাকায় তিনি দাঁড়িয়ে পান করেছিলেন এবং এটাই ছিল তাঁর শেষ আমল (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩২/২১০)।

মোদ্দাকথা যেকোন খানা-পিনা বসে করাই শরী‘আতের নির্দেশনা এবং এটাই সর্বোত্তম (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ২২/১৩৩)।

  • দাঁড়িয়ে পানি পান করা ক্ষতিকর :

পর্যাপ্ত পানি পানের যেমন সুফল আছে, তেমনি অপর্যাপ্ত পানি পানের কারণে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। ফলে পানি পান করে সবাই তৃষ্ণা মেটায় বটে। কিন্তু সেই সঙ্গে শরীরেরও মারাত্মক ক্ষতি করে ফেলে। এর একটি হ’ল দাঁড়িয়ে পানি পান করা, যা কখনই উচিত নয়। কারণ এতে শরীরের ভিতরে থাকা ছাকনিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে তা ঠিক মতো কাজ করতে পারে না এবং পানিতে বিদ্যমান অস্বাস্থ্যকর উপাদানগুলো রক্তে মিশতে শুরু করে। এতে এক সময়ে শরীরে টক্সিনের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, একাধিক অঙ্গের উপর তার খারাপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরে আরো নানারকম ক্ষতি হয়। যেমন-

(১) পাকস্থলীতে ক্ষত সৃষ্টি হয় : 

দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তা সরাসরি পাকস্থলীতে গিয়ে আঘাত করে। সেই সঙ্গে পাকস্থলীতে বিদ্যমান অ্যাসিডের কর্মক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। ফলে বদ হজমের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। আর পাকস্থলীর কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ায়  তলপেটে যন্ত্রণাসহ নানা ধরনের শারীরিক অসুবিধা দেখা দেয়।

(২) আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায় :

 দাঁড়িয়ে পানি পান করার সঙ্গে আর্থ্রাইটিসের সম্পর্ক রয়েছে। এক্ষেত্রে শরীরের ভিতর থাকা কিছু উপকারী রাসায়নিকের মাত্রা কমতে শুরু করে। ফলে জয়েন্টের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ায় এই ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। যারা ইতিমধ্যেই এই রোগে আক্রান্ত তাদের ভুলেও দাঁড়িয়ে পানি পান করা যাবে না।

আমাদের শরীরে প্রায় দেড় লিটার পর্যন্ত পানি জমতে পারে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলে একবারে বেশী পানি পান করা সম্ভব হয় না। ফলে দেহে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। বারবার তৃষ্ণা পায়। আর সবসময় আর হাতের কাছে পানি থাকে না। তাই সারা দিনে পানি অনেক কম পান করা হয়। তৃষ্ণার সময় পানি পানের আগে কোথাও বসে বিশ্রাম নিয়ে একটু সময় নিয়ে বেশী করে পানি পান করলে শরীর সুস্থ থাকবে মনও ভাল থাকবে। (Dr. Vipul Rustgi, general physician, Apollo Spectra, Delhi.)

(গ) পানের সময় পান পাত্রে নিঃশ্বাস না ফেলা :

পানের সময় পানপাত্রে নিঃশ্বাস ফেলা উচিৎ নয়। এতে পান করার সময় পাত্রের মধ্যে নিঃশ্বাসের সাথে মুখের লালা বা থুথু পানীয়ের মধ্যে পড়তে পারে। আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُتَنَفَّسَ فِي الْإِنَاءِ أَوْ يُنْفَخَ فِيهِ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কিছু পান করার সময়) পাত্রের মধ্যে নিঃশ্বাস ফেলতে এবং তার মধ্যে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন।(ইবনু মাজাহ হা/৩৭২৮, তিরমিযী হা/ ১৮৮৮, নাসায়ী হা/৪৮, ছহীহুল জামি‘ হা/১২৭৭৬, মিশকাত হা/৪২৭৭ )

সবচেয়ে উত্তম হলো নিঃশ্বাস নিবে, না ফুঁ দিবে, না অপেক্ষা করবে ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত আর যদি কোন ময়লা দেখে তাহলে তা আঙ্গুল, কাঠি বা অন্য কোন জিনিস দিয়ে উঠাবে বা সরাবে। আর গরম অবস্থায় খাবে না, কেননা বারাকাত চলে যায় আর গরম হলো জাহান্নামীদের খাদ্য। (‘আওনুল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৭২৪) আধুনিক বিজ্ঞান মতে, যখন পানিতে নিঃশ্বাস ফেলা হয় বা ফুঁ দেওয়া হয় তখন সেই নিঃশ্বাসে বা ফুঁ-এর সাহায্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড পানির সাথে বিক্রিয়া করে কার্বোনিক এসিড উৎপন্ন করে এবং এই এসিড পানির সাথে পেটে প্রবেশ করে। যখন এই কার্বোনিক এসিড পেটে প্রবেশ করে তখন পেটে গ্যাস উৎপন্ন হয়, যার ফলে পেট ফেঁপে যায়। যা আমাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই এসিডের কারণে আমাদের হজম ক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং খাদ্য পাকস্থলি হ’তে ক্ষুদ্রান্ত্রে যেতে অনেক সময় নেয়। এসকল কারণে পেট ফেঁপে গিয়ে আমাদের অস্বস্থি অনুভূত হয়। (The Economic Times, 18 march, 2018.)

(ঘ) পানীয় ধীরে ধীরে পান করা :

তিন নিঃশ্বাসে ধীরে ধীরে পানি পান করা উচিত। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا شَرِبَ تَنَفَّسَ ثَلاَثًا وَقَالَ‏ “‏هُوَ أَهْنَأُ وَأَمْرَأُ وَأَبْرَأُ ‘নবী করীম (ছাঃ) তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করতেন এবং বলতেন, এভাবে পানি পান করলে তৃষ্ণা উত্তমরূপে নিবারিত হয়, খাদ্য অধিক হজম হয় এবং স্বাস্থ্য ভাল থাকে’(আবূদাউদ হা/৩৬৮৫।)।

আধুনিক বিজ্ঞান মতে, একজন মানুষ যখন পানি গিলে খায়, সাধারণত প্রায় ৫০-১০০ মি.লি. পানি প্রতি ঢোকে গিলে খাওয়ার সাথে সাথে খাদ্যনালী এবং পেটে প্রবেশ করে। তবে চুমুকের আকার এবং গিলে ফেলার ধরনের উপর ভিত্তি করে এর পরিমাণ কমবেশী হয়। আবার কোনকিছু গিলার সময় ০.৫-১.৫ মিলি মুখের লালা খাদ্যনালী দিয়ে পেটে প্রবেশ করে। এই লালা খাদ্য হজমে সহায়তা করে। লালায় অ্যামাইলেজ নামক এনজাইম রয়েছে, যা হজমের প্রাথমিক পর্যায়ে ভূমিকা পালন করে। অ্যামাইলেজ জটিল কার্বো-হাইড্রেটগুলিকে সহজ শর্করাতে ভেঙ্গে দেয়। যখন আমরা খাদ্য গ্রহণ করি, তখন লালা আমাদের মুখের খাবারের সাথে মিশে যায় এবং লালার মধ্যে থাকা অ্যামাইলেজ এনজাইম খাদ্যের মাল্টোজ এবং ডেক্সট্রিন নামক স্টার্চ ভেঙ্গে ফেলতে সহায়তা করে। এই এনজাইমেটিক হজম খাদ্যের রাসায়নিক ভাঙ্গনের একটি অংশ যা পাকস্থলীতে পৌঁছানোর আগে মুখের মধ্যে ঘটে। একবার খাবার গিলে ফেলা হ’লে এটি পরিপাকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে চলে যায় এবং অন্যান্য পাচক এনজাইম এবং পাকস্থলীর অ্যাসিডের সাহায্যে পাকস্থলী এবং ক্ষুদ্রান্ত্রে আরো হজম ক্রিয়া চালাতে থাকে। ফলে আমাদের হজম ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। (The Economic Times, 18 march, 2018.)

(ঙ) যমযমের পানি :

আল্লাহর অফুরন্ত নে‘মতরাজির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নে‘মত হ’ল যমযমের পানি। এটি শুধু পানীয় নয়, এটি খাদ্যের চাহিদা পূরণেও সক্ষম। এতে রয়েছে অবারিত ঔষধি গুণ।  যমযমের পানিসহ যেকোন পানাহার বসে করাই সুন্নাত (মুসলিম হা/২০২৪; আহমাদ হা/৭৭৯৫-৯৬; মিশকাত হা/৪২৬৬, ৬৭; ছহীহাহ হা/১৭৬)। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদায় হজ্জের সময় (ভিড়ের মধ্যে) যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪২৬৮)।
ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, سَقَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ زَمْزَمَ فَشَرِبَ وَهُوَ قَائِمٌ‏.‏ আমি যমযমের পানি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পেশ করলাম। তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করলেন। (রাবী’) ’আসিম বলেন, ’ইকরিমা (রহঃ) হলফ করে বলেছেন, مَا كَانَ يَوْمَئِذٍ إِلاَّ عَلَى بَعِيرٍ তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন উটের পিঠে আরোহী অবস্থায়ই ছিলেন(বুখারী হা/১৫৩৬)।

  • যমযমের পানির উপকারিতা :

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, -‏ مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ ‏ ‘যমযমের পানি যে উপকার লাভের আশায় পান করা হবে, তা অর্জিত হবে’ (ইবনু মাজাহ হা/৩০৬২; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৫০২)। এজন্য যেকোন রোগ থেকে সুস্থতা কামনা করে দো‘আ পাঠ করা যায় (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ২৬/১৪৪)।

ছাহাবায়ে কেরাম যমযমের পানি পাত্রে রাখতেন। কেউ অসুস্থ হ’লে তার শরীরে পানি ছিটিয়ে দেওয়া হ’ত এবং তাদেরকে পান করানো হ’ত (ছহীহাহ হা/৮৮৩)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,خَيْرُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءُ زَمْزَمَ، وَفِيْهِ طَعَامٌ مِنَ الطُّعْمِ، وَشِفَاءٌ مِنَ السُّقْمِ، ‘পৃথিবীর বুকের সর্বশ্রেষ্ঠ পানি হ’ল যমযমের পানি। তাতে রয়েছে তৃপ্তিকর খাদ্য এবং রোগের প্রতিষেধক’। (ত্বাবারানী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৩৯১২, ৮১২৯; মু‘জামুল কাবীর হা/১১০০৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩২২)

যমযমের পানি পিপাসা দূর করে, ক্ষুধা নিবারণ করে এবং মানুষকে সুস্থ রাখতে সহায়ক পানীয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যমযমের পানি যে যেই উদ্দেশ্যে পান করবে তার সেই উদ্দেশ্য পূরণ হবে, তুমি যদি সুস্থতার জন্য পান কর তাহ’লে আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করবেন। তুমি ক্ষুধা নিবারণের জন্য পান করলে আল্লাহ তোমার ক্ষুধা নিবারণ করবেন, তুমি পিপাসা দূর করার জন্য পান করলে আল্লাহ তোমার পিপাসা দূর করবেন (ছহীহুত তারগীব হা/১১৬৪)।

যমযমের পানি তৃপ্তিদায়ক ও শেফা দানকারী প্রতিষেধক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّهَا مُبَارَكَةٌ وَإِنَّهَا طَعَامُ طُعْمٍ وَشِفَاءٌ سَقَمٌ،  ‘নিশ্চয়ই তা (যমযমের পানি) বরকতপূর্ণ। এটা তৃপ্তিকর খাদ্য এবং রোগের প্রতিষেধক’। (ত্বাবারানী, মু‘জামুছ ছগীর হা/২৯৫; ছহীহুল জামে‘ হা/২৪৩৫)।

যমযমের পানি পানে মানুষ রোগ মুক্ত হয় এবং স্বাস্থ্য সম্মত বলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। আবু যার গিফারী (রাঃ) যযময কূপের পাশে ত্রিশদিন অবস্থান করেন। এ সময় তিনি কি খেয়েছেন এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জানতে চাইলে তিনি বলেন, مَا كَانَ لِى طَعَامٌ إِلاَّ مَاءُ زَمْزَمَ. فَسَمِنْتُ حَتَّى تَكَسَّرَتْ عُكَنُ بَطْنِى وَمَا أَجِدُ عَلَى كَبِدِى سُخْفَةَ جُوعٍ قَالَ إِنَّهَا مُبَارَكَةٌ إِنَّهَا طَعَامُ طُعْمٍ. ‘যমযমের পানি ব্যতীত আমার অন্য কোন খাদ্য ছিল না। এ পানি পান করেই আমি স্থূলদেহী হয়ে গেছি। এমনকি আমার পেটের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে এবং আমি কখনো ক্ষুধায় দুর্বলতা বুঝতে পারিনি। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, এ পানি অতিমাত্রায় বরকতময় ও প্রাচুর্যময় এবং অন্যান্য খাবারের মত পেট পূর্ণ করে দেয়’। (মুসলিম হা/২৪৭৩)

তবে যমযমের পানি পান করার সময় পঠিতব্য দো‘আর ব্যাপারে ইবনু আববাস থেকে যে আছার বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ (যঈফুত তারগীব হা/৭৫০)।

যমযমের পানি দ্বারা রাসূল (সা.)-এর ক্বলব ধৌত করা হয়েছিল। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) এলেন, তখন তিনি শিশুদের সাথে খেলছিলেন। তিনি তাঁকে ধরে শোয়ালেন এবং বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁর হৎপিন্ডটি বের করে আনলেন। তারপর তিনি তাঁর বক্ষ থেকে একটি রক্তপিন্ড বের করলেন এবং বললেন এ অংশটি শয়তানের। এরপর হৎপিণ্ডটিকে একটি স্বর্ণের পাত্রে রেখে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন এবং তার অংশগুলো জড়ো করে আবার তা যথাস্থানে পূনঃস্থাপন করলেন। তখন ঐ শিশুরা দৌড়ে তাঁর দুধমায়ের কাছে গেল এবং বলল, মুহাম্মাদ -কে হত্যা করা হয়েছে। কথাটি শুনে সবাই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল তিনি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছেন! আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বক্ষে সে সেলাই-এর চিহ্ন দেখেছি। (বুখারী হা/১৬২)।

(চ) মানুষকে পানি পান করানোর ফযীলত :

একদা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, আপনার নিকট কোন ছাদাক্বা সর্বাধিক পসন্দনীয়? তিনি বললেন, পানি পান করানো’ (আবুদাঊদ হা/১৬৭৯; হাকেম হা/১৫১১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, পানি পান করানো অপেক্ষা অধিক ছওয়াবপূর্ণ ছাদাক্বা আর নেই’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩৩৭৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/৯৬০)।

সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসূল! উম্মু সা‘দ মৃত্যুবরণ করেছেন, (তার পক্ষ হ’তে) কোন ছাদাক্বা সর্বোত্তম হবে? তিনি বললেন, পানি পান করানো। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি একটি কূপ খনন করে বললেন, এটা উম্মু সা‘দের (কল্যাণের) জন্য ওয়াকফ করা হ’ল (আবুদাঊদ হা/১৬৮১; মিশকাত হা/১৯১২)।

আল্লামা মুল্লা ‘আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন, নিশ্চয় পানি দান করাই সর্বোত্তম। কারণ দীনী ও পার্থিব উভয় ক্ষেত্রের কর্মে সবচেয়ে উপকারী বস্ত্ত হলো পানি। বিশেষ করে উষ্ণ বা উচ্চ তাপমাত্রার দেশসমূহে।

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, যে ব্যক্তি পানির কূপ খনন করল, আর সে কূপ থেকে মানুষ, জিন বা কোন পাখি পানি পান করল। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন ছওয়াব প্রদান করবেন (ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১২৯২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৯৬৩)।

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আদম সন্তানের দেহে তিনশত ষাটটি হাড় বা জোড় বা গ্রন্থি রয়েছে। এগুলোর প্রতিটির জন্য প্রত্যেক দিন ছাদাক্বা রয়েছে। প্রতিটি উত্তম কথাই ছাদাক্বা। এক ভাইয়ের পক্ষ হ’তে অন্য ভাইকে সাহায্য করা ছাদাক্বা। এক ঢোক পানি পান করানো ছাদাক্বা। পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরিয়ে দেওয়াও ছাদাক্বা’ (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪২২; ছহীহাহ হা/৫৭৬)।

এছাড়া জনৈকা বেশ্যা নারী একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করালে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একবার একটি পতিতা মহিলাকে মাফ করে দেয়া হলো। কারণ মহিলাটি একবার একটি কুকুরের কাছ দিয়ে যাবার সময় দেখল সে পিপাসায় কাতর হয়ে একটি কূপের পাশে দাঁড়িয়ে জিহবা বের করে হাঁপাচ্ছে। পিপাসায় সে মরার উপক্রম। মহিলাটি এ করুণ অবস্থা দেখে নিজের মোজা খুলে ওড়নার সাথে বেঁধে কূপ হতে পানি উঠিয়ে কুকুরটিকে পান করাল। এ কাজের জন্য তাকে মাফ করে দেয়া হলো। এ কথা শুনে সাহাবীগণ আরয করলেন, পশু-পাখির সাথে ভাল ব্যবহার করার মধ্যেও কি আমাদের জন্য সাওয়াব আছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। প্রত্যেকটা প্রাণীর সাথে ভাল ব্যবহার করার মধ্যেও সাওয়াব আছে। (বুখারী হা/৩৪৬৭; মুসলিম হা/২২৪৫; মিশকাত হা/১৯০২)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top