প্রত্যেক জীবের ফিৎরাত রয়েছে। আছে দ্বীনের প্রতি সম্মান ও আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য। فطرت শব্দের মৌলিক অর্থ হল সৃষ্টি। এখানে আল্লাহর সৃষ্টি বা প্রকৃতি বলে ইসলাম ও তওহীদকে বুঝানো হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ তাআলা মু’মিন-কাফের প্রত্যেক মানুষকে ইসলাম ও তওহীদের প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর একত্ব ও তাঁর ইবাদতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং বাতিল ধর্মসমূহের প্রতি ভ্রূক্ষেপও না করাকে ফিৎরাত বলে।
ফিৎরাত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيفًا فِطْرَتَ اللهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ ‘তুমি তোমার চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে ধর্মের উপরে দৃঢ় রাখ। এটাই হ’ল আল্লাহর দেয়া স্বভাবধর্ম (ফিৎরাত), যার ওপরে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই হ’ল সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানেনা’ (রূম ৩০/৩০)।
এ আয়াতের কয়েকটি অর্থ হতে পারে, এক. তোমরা আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করো না। [ফাতহুল কাদীর] দুই. এখানে আল্লাহর সৃষ্টি বলে আল্লাহর দ্বীনকে বুঝানো হয়েছে। তখন অর্থ হবে, তোমরা আল্লাহর এ দ্বীনকে পরিবর্তন করো না। তিনি মানুষকে ইসলামের উপর সৃষ্টি করেছেন, তোমরা তাদেরকে অন্যান্য মানব মতবাদে দীক্ষিত করো না। [বাগভী| তিন. অথবা আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ মানুষকে নিজের বান্দায় পরিণত করেছেন। কেউ চাইলেও এ কাঠামোয় কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। মানুষ বান্দা থেকে অ-বান্দা হতে পারে না এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ বানিয়ে নিলেও প্রকৃতপক্ষে সে মানুষের ইলাহ হতে পারে না। [ইবন কাসীর]
ফিতরত বলে যোগ্যতা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে স্রষ্টাকে চেনার ও তাঁকে মেনে চলার যোগ্যতা নিহিত রেখেছেন। এর ফলে মানুষ ইসলাম গ্ৰহণ করে যদি সে যোগ্যতাকে কাজে লাগায়। [ফাতহুল কাদীর; কুরতুবী]
ফিৎরাত দ্বারা স্বভাবগত দ্বীন ইসলামকে বোঝানো হয়েছে। উদ্দেশ্য হ’ল আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মানুষকে প্রকৃতিগতভাবে মুসলিম ফিৎরাতের ওপর সৃষ্টি করেছেন। যদি পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশগত কোন কিছুর মন্দ প্রভাব না পড়ে, তবে প্রতিটি জন্মগ্রহণকারী শিশু ভবিষ্যতে মুমিন মুসলমান হবে। কিন্তু পারিবারিক অভ্যাসগতভাবেই পিতা-মাতা তাকে ইসলাম বিরোধী বিষয়াদি শিক্ষা দেয়। ফলে ফিৎরাতের স্বভাব পরিবর্তন হয় এবং সে ইসলামের উপর কায়েম হ’তে পারে না।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ مَوْلُوْدٍ إِلَّا يُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ كَمَا تُنْتَجُ الْبَهِيْمَةُ بَهِيْمَةً جَمْعَاءَ هَلْ تُحِسُّوْنَ فِيْهَا مِنْ جَدْعَاءَ ثُمَّ يَقُوْلُ (فِطْرَةَ اللهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللهِ ذٰلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ). ‘সকল মানব শিশুরই ফিৎরাত (ইসলাম)-এর ওপর জন্ম হয়। তারপর তার পিতা ও মাতা তাকে ইয়াহূদী, নাছারা অথবা অগ্নি উপাসক করে ফেলে। যেমন জানোয়ার পূর্ণ বাচ্চার জন্ম দেয়। তোমরা কি তার মধ্যে কোন ত্রুটি পাও? পরে তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন। আল্লাহর প্রকৃতির (ফিৎরাতের) অনুসরণ কর, তিনি যে ফিৎরাত (প্রকৃতি) মোতাবেক মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দ্বীন’।[বুখারী হা/১৩৫৮, ৪৭৭৫; মিশকাত হা/৯০]
ব্যাখ্যা: (الْفِطْرَةِ) শব্দের অনেক প্রকার ব্যাখ্যা রয়েছে তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে, এ দ্বারা উদ্দেশ্য ইসলাম। ইমাম বুখারী এ বক্তব্যকেই দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন এবং অনেক পূর্বসুরীই এটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অন্য বর্ণনাতে الْفِطْرَةِ এর পরিবর্তে الملة শব্দটিও এ বক্তব্যকে সমর্থন করে। (فِطْرَةَ اللهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا) এ আয়াতের উল্লেখ। প্রকৃত ব্যাপার বুঝানোর জন্য হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে। দুনিয়ার হুকুমের ক্ষেত্রে প্রকৃতিগত ঈমান বা ইসলামের বিষয়টি ধর্তব্য নয়। দুনিয়াতে ধর্তব্য বিষয় হলো স্বেচ্ছায় ঈমান আনা।
(فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِه) প্রমাণ করে যে, দুনিয়ার হুকুমে সে কাফির যদিও তার মধ্যে স্বভাবগত ঈমান বিদ্যমান। কিংবা এখানে ফিত্বরাতের অর্থ হলো আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টাকে চিনবার যে যোগ্যতা দিয়েছেন সেই অবস্থার নামই ফিত্বরাত। সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানকে যদি তার ফিতরাতের উপর ছেড়ে দেয়া হত এবং তার পিতা-মাতা বা অন্য কোন দিক থেকে প্রভাবিত করা না হত তাহলে সে সত্য দীনকেই আঁকড়িয়ে থাকতো। তা বাদ দিয়ে অন্য দিকে যেত না এবং এ দীন ব্যতীত অন্য কোন দীন গ্রহণ করত না।
আফসোস! আল্লাহর বিধানকে সকল জীব চিনতে ও জানতে পারলেও অধম জাতি মানুষ অনুধাবন করে না। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।