প্রকৃত বন্ধু তার সাথীদেরকে জান্নাতের দিকে আহ্বান করে। কখনো তাদের ক্ষতি করার মনোভাব পোষণ করে না। বরং সর্বদা তাদের ভালো করে ও পরামর্শ দেয়। ভালো বন্ধু হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা যেমন জটিল তেমনি ভালো বন্ধু পাওয়াও অনেক কঠিন। ভালো বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে মহান আল্লাহর অশেষ রহমতের অনুকৃপা।
তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, হে মু’মিনগণ! আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি তাদের সাথে বন্ধুত্ব করছ অথচ তারা তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এবং তোমাদেরকে (স্বদেশ থেকে) বহিস্কার করেছে এ কারণে যে তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে বিশ্বাস কর। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমার পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে থাক তবে কেন তোমরা ওদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করছ? তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর তা আমি সম্যক অবগত আছি। আর তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ কাজ করে সে তো বিচ্যুত হয়ে যায় সরল পথ থেকে (৬০: ১)
وَمَنْ تَوَلَّى قَوْمًا بِغَيْرِ إِذْنِ مَوَالِيهِ، فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ،
যে ব্যাক্তি তাঁর মাওলার (মিত্রের) অনুমতি ব্যতীত অন্য অন্য কাওমের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তাঁর প্রতিও আল্লাহর লা’নত এবং সকল ফেরেশতা ও মানুষের। সে ব্যাক্তির কোন নফল এবং ফরজ ইবাদাত কবুল করা হবে না।
আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “ أَلاَ إِنِّي أَبْرَأُ إِلَى كُلِّ خَلِيلٍ مِنْ خُلَّتِهِ وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيلاً لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيلاً إِنَّ صَاحِبَكُمْ خَلِيلُ اللَّهِ ” জেনে রাখো! আমি প্রত্যেক বন্ধুর বন্ধুত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছি। যদি আমি কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম তবে আবূ বকরকেই অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। নিশ্চয় তোমাদের এই সাথী আল্লাহ্র অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিরমিযী ৩৬৫৫,
আবূ হুরাইরাহ্ রাদিয়াল্লাহু ’আনহু কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ، فَليَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ ’’মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর হয়। অতএব তোমাদের প্রত্যেককে দেখা উচিত যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে।’’ (আবূ দাউদ, তিরিমিযী, বিশুদ্ধ সূত্রে) তিরমিযী ২৩৭৮, আবূ দাউদ ৪৮৩৩, আহমাদ ৭৯৬৮, ৮২১২
ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ’আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ বনী ইসরাঈলের মধ্যে প্রথমে এভাবে অন্যায় ও অপকর্ম প্রবেশ করেঃ এক (আলিম) ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে মিলিত হতো এবং তাকে বলত, হে অমুক! আল্লাহকে ভয় কর এবং যা করছ তা পরিত্যাগ কর, কারণ, তোমার জন্য এ কাজ অবৈধ, সে তার সঙ্গে দ্বিতীয় দিনও মিলিত হয়ে তাকে একই অবস্থায় দেখতে পেত কিন্তু সে কাজ তাকে তার পানাহার ও উঠা-বসায় অংশীদার হতে বাধা দিত না, তাদের অবস্থা এরকম হওয়ার প্রেক্ষিতে তাদের একের অন্তরের (কালিমার) মাধ্যমে অপরের অন্তরকে আল্লাহ তা’আলা অন্ধকার করে দিলেন। তারপর তিনি এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেনঃ ’’বানী ইসলাঈলের মাঝে যারা কুফরীর পথ ধরল দাঊদ ও ’ঈসা ইবনু মারইয়ামের মুখ দিয়ে তাদের প্রতি লানত করা হলো। কেননা, তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং অতিরিক্ত সীমালঙ্ঘন করেছিল।
তারা পরস্পরকে পাপ কাজ করতে নিষেধ করত না। তারা অতিশয় নিকৃষ্ট কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিল।
«إِنَّ أَوَّلَ مَا دَخَلَ النَّقْصُ عَلٰى بَنِي إِسْرائيلَ أَنَّهُ كَانَ الرَّجُلُ يَلْقىٰ الرَّجُلَ فَيَقُولُ : يَا هٰذَا اتَّقِ اللهِ وَدَعْ مَا تَصْنَعُ فَإِنَّهُ لَا يَحِلُّ لَكَ، ثُمَّ يَلْقَاهُ مِنَ الْغَدِ وَهُوَ عَلىٰ حَالِهِ، فَلَا يَمْنَعُهُ ذٰلِكَ أَنْ يَكُوْنَ أَكِيلَهُ وَشَرِيْبَهُ وَقَعِيْدَهُ، فَلَمَّا فَعَلُوْا ذٰلِكَ ضَرَبَ اللهِ قُلُوْبَ بَعْضِهِمْ بِبَعْضٍ»
বহু লোককে তোমরা দেখছ, যারা (মু’মিনদের বদলে) কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব ও সহায়তা করতে ব্যস্ত। নিশ্চয়ই সামনে খুব মন্দ পরিণতই রয়েছে, যার ব্যবস্থা তাদের প্রবৃত্তিসমূহ করেছে। আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি ক্রোধান্বিত হয়েছেন। তাদের আযাবভোগ স্থায়ী হবে। আল্লাহ, রাসূল এবং সেই জিনিসের প্রতি তারা যদি প্রকৃতই ঈমান আনত, তাঁর (নবীর) প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তাহলে তারা কখনও বন্ধুরূপে (ঈমানদার লোকদের বিপরীতে) কাফিরদেরকে গ্রহণ করতো না। কিন্তু তাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তই ফাসিক’’- (সূরা আল-মায়িদা ৭৮-৮১)। তারপর তিনি (মহানবী) বললেনঃ কখনও নয়! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কসম! অবশ্যই তোমরা সৎ কর্মের আদেশ দিতে থাক এবং অন্যায় ও খারাপ কাজ হতে (মানুষকে) বিরত রাখ, অত্যাচারীর হাত মজবূত করে ধর এবং তাকে টেনে তুলে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত কর। তাকে হকের উপর এনে ছাড়। নচেৎ আল্লাহ তা’আলা তোমাদের (নেককার ও গুনাহ্গার) পরস্পরের অন্তরকে একত্রিত করে (অন্ধকার করে) দিবেন, তারপর তোমাদেরকেও বনী ইসরাঈলের ন্যায় অভিশপ্ত করবেন। হাদীসটি ইমাম আবূ দাউদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। তিরমিযি বলেছেন, এটা হাসান হাদীস। হাদীসের মূল শব্দগুলো আবূ দাউদের-৪৩৩৬।
মূল হাদীসের অর্থ নিম্নরূপ:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন বনী ইসরাঈল গর্হিত কর্মে লিপ্ত হলো, তাদেরকে তাদের আলিমগণ তা হতে বিরত থাকতে বলল, কিন্তু তারা তা করল না। তাদের সাথে আলিমগণ উঠা-বসা ও পানাহার চালিয়ে যেতে থাকল। তারপর আল্লাহ তা’আলা তাদের পরস্পরের হৃদয়কে একত্রিত করে দিলেন (ফলে আলিমরাও অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ল)। আল্লাহ তা’আলা দাউদ ও ঈসা ইবনু মারইয়ামের মুখ দিয়ে তাদেরকে অভিশাপ দিলেন। কেননা, তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং অত্যন্ত বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠেস দিয়ে বসা ছিলেন। তিনি সোজা হয়ে বসলেন এবং বলেলনঃ কখনও নয়, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন! তাদেরকে তোমরা (অত্যাচারীদেরকে) হাত ধরে টেনে এনে হক্ব ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত ছেড়ে দিবে না।
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, «النَّاسُ مَعَادِنُ كَمَعَادِنِ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ خِيَارُهُمْ فِي الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُهُمْ فِي الْإِسْلَامِ إِذَا فَقِهُوا» সোনা-রূপার খনির ন্যায় মানবজাতিও খনিবিশেষ। যারা জাহিলিয়্যাতের (অন্ধকারের) যুগে উত্তম ছিল, দীনের জ্ঞান লাভ করার কারণে তারা ইসলামের যুগেও উত্তম। (মুসলিম)[ বুখারী ৩৩৮৩, মুসলিম ২৬৩৮;মিশকাত হা/২০১
মানুষ সম্মান ও হীনতার দিক দিয়ে বংশগত ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে যেমন- স্বর্ণ, রূপা ও অন্যান্য পদার্থের খনি বিভিন্ন রকম হয়। খনির সাথে মানুষকে সাদৃশ্য দেয়ার অন্য কারণ এমনও হতে পারেঃ মানুষ যেমন সম্মান, জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সংরক্ষণকারী খনি তেমন উৎকৃষ্ট পদার্থ ও উপকারী বস্তুর অংশ সংরক্ষণকারী। হাদীসে বলা হয়েছে, যারা জাহিলী যুগে সর্বোত্তম গোত্রের আওতাভুক্ত ছিল; কৃতিত্ব, উত্তম গুণাবলী, জ্ঞানে, বীরত্বে, অন্যের সমকক্ষ হওয়া সত্ত্বেও কুফর ও মূর্খতার অন্ধকারে ঢাকা ছিল তারা মূলত খনিতে থাকা ঐ স্বর্ণ রৌপ্যের মতো যা প্রথমে মাটি মিশ্রিত থাকে পরে স্বর্ণকারগণ তা আহরণ করে মাটি হতে আলাদা করে নেয়। জাহিলী যুগের সর্বোত্তম ব্যক্তিগণ যখন ইসলামী যুগে শারী‘আতী জ্ঞান লাভ করে তখন সে তার জ্ঞান ও ঈমানের আলোতে আলোকিত হয়।
‘‘বর্তমান জামানায় হক্ব ও বাতিলকে আলাদা ভাবে জেনে-বুঝে বেঁচে থাকতে চাইলে, অবশ্যই তার জন্য দ্বীনি ইলম অর্জন করা ফরয’’। এছাড়া সে মন্দকে সঠিক মনে করে আমল করতে থাকবে।
জগদ্বিখ্যাত শাসক আব্দুল মালিক ইবনু মারওয়ান তার পুত্রকে উপদেশ প্রদান করে বলেছিলেন:
হে বৎস! ইলম শিক্ষা করো। কেননা যদি নেতা হও তাহলে সবার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে। আর যদি মধ্যম ধরনের লোক হও তাহলে নেতার আসন লাভ করতে পারবে। আর যদি সাধারণ প্রজা হও তাহলে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করতে পারবে।
এরপর তিনি কবিতা আবৃত্তি করে বলেন:
-যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের কিঞ্চিত তিক্ততা সহ্য করে না, সে দিনের পর দিন মূর্খতার লাঞ্ছনা গিলতে বাধ্য হয়।
-যৌবনে যার ইলম শিক্ষা করার সুযোগ হয়নি তার ওপর (জানাযার) চার তাকবীর পাঠ কর। কেননা, সে তো মৃত।
-আল্লাহ্র শপথ! যুবকের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তার ইলম ও তাক্বওয়ার কারণে। যদি এই দু’টি বস্তু না থাকে তবে তার কোনো মূল্যই নেই।
(يا بنيّ تعلموا العلم فإن كنتم سادة فقتم وإن كنتم
وسطاً سدتم وإن كنتم سوقة عشتم.
-ومن لم يذق مر التعلم ساعة تجرع ذل الجهل طول حياته
-ومن فاته التعليم وقت شبابه فكبر عليه أربعا لوفاته
-وذات الفتى والله بالعلم والتقى إذا لم يكونا لا اعتبار لذاته)
(তথ্যসূত্র: ইমাম মাওয়ারদী, আদাবুদ দুনয়া ওয়াদ দ্বীন)