বিশ্ব ভালবাসা দিবস: প্রগতির আড়ালে অশ্লীলতার বিজ্ঞাপন

এক নোংরা ও জঘন্য ইতিহাসের স্মৃতিচারণের নাম বিশ্ব ভালবাসা দিবস। এই দিবস প্রগতির নামে নব আবিষ্কৃত পশ্চিমা অপসাংস্কৃতি। এই ইতিহাসটি অনেক পুরোনো। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, যিশু খ্রীষ্ট আগমণের পূর্বে পৌত্তলিকরা দেবতার পূজা করতো এবং দেবতার নামে নানা রকমের আচার অনুষ্টানাদি পালন করতো। অনুষ্টানের কর্মসূচির মধ্যে ছিল যুবতিদের নামে লটারী করা হত। অর্থ্যাৎ লটারিতে যে যুবতির নাম যে যুবকের ভাগ্যে পড়তো, সে যুবক আগামী এক বছর ঐ দিন আসার আগ পর্যন্ত তার সাথে লিভ দুগেদার করবে। ঐদিনকে যুবতি বন্টনের দিনও বলা হতো। ১০ ফেব্রুয়ারি এই অনুুষ্টানের আয়োজন করা হতো। খৃষ্ট ধর্ম মতে যীশু-খ্রীষ্টের ভূমিষ্টের পর তারা তাদের ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী এই কুসংস্কার দিবস পরিবর্তন করে ১৪ ফেব্রুয়ারী তারিখে সাধু পাদ্রির নাম দিয়ে আবারো পালন করতে লাগলো ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বা ‘বিশ্ব ভালবাসা’ দিবস’। ২৭০ সালের চৌদ্দই ফেব্রুয়ারীর কথা তখন রোমের স¤্রাট ছিলেন ক্লডিয়াস। সে সময় ভ্যালেন্টাইন নামে একজন সাধু, তরুণ যুবক যুবতীদেরকে গোপন পরিণয় মন্ত্র দীক্ষা দিত। এ অপরাধে স¤্রাট ক্লডিয়াস সাধু ভ্যালেন্টাইনের শিরচ্ছেদ করেন। তার এ ভ্যালেন্টাইন নাম থেকেই এ দিনটির নাম করণ করা হয় ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ যা আজকের ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’।
বাংলাদেশে এ দিবসটি পালন করা শুরু হয় ১৯৯৩ইং সালে। কিছু ব্যবসায়ীর মদদে এটি প্রথম চালু হয়। অপরিণামদর্শী মিডিয়া কর্মীরা এর ব্যাপক কভারেজ দেয়। আর যায় কোথায় ! লুফে নেয় বাংলার তরুণ-তরুণীরা। প্রগতিশীল মুক্তমনা সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। পাশ্চাত্যের ধ্বজাধারী আতুনিক রীতিনীতিতে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। দেশে ফিরে তিনিই ভালবাসা দিবসের শুরুটি করেন। এ নিয়ে অনেক ধরনের মতবিরোধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত শফিক রেহমানের চিন্তাটি নতুন প্রজন্মকে বেশি আকর্ষণ করে। সেই থেকে এই আমাদের দেশে দিনটির যাত্রা শুরু। এজন্য শফিক রেহমানকে বাংলাদেশের ভালবাসা দিবসের জনক বলা হয়।(দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৪; ‘কবে থেকে ভালোবাসা দিবসের শুরু’)।
আর ভালবাসা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে ঈমানের ঘরে ভালবাসার পরিবর্তে ভুলের বাসা বেঁধে দেয়ার কাজটা যথারীতি চলছে। আর এর ঠিক পিছনেই মানব জাতির আজন্ম শত্রু শয়তান এইডস নামক মরণ-পেয়ালা হাতে নিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। মানুষ যখন বিশ্ব ভালবাসা দিবস সম্পর্কে জানত না, তখন পৃথিবীতে ভালবাসার অভাব ছিল না। আজ পৃথিবীতে ভালবাসার বড় অভাব। তাই দিবস পালন করে ভালবাসার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়! আর হবেই না কেন! অপবিত্রতা নোংরামি আর শঠতার মাঝে তো আর ভালবাসা নামক ভাল বস্তু থাকতে পারে না। তাই মহান আল্লাহ মানুষের হৃদয় থেকে ভালবাসা উঠিয়ে নিয়েছেন।
বিশ্ব ভালবাসা দিবসকে চেনার জন্য আরও কিছু বাস্তব নমুনা পেশ করা দরকার। দিনটি যখন আসে তখন শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো একেবারে বেসামাল হয়ে উঠে। নিজেদের রূপা-সৌন্দর্য উজাড় করে প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় নেমে আসে। শুধুই কি তাই! অঙ্কন পটীয়সীরা উল্কি আঁকার জন্য পসরা সাজিয়ে বসে থাকে রাস্তার ধারে। তাদের সামনে তরুণীরা পিঠ, বাহু আর হস্তদ্বয় মেলে ধরে পছন্দের উল্কিটি এঁকে দেয়ার জন্য। তারপর রাত পর্যন্ত নীরবে-নিভৃতে প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে খোশ গল্প , চুটিয়ে আড্ডা, অসামাজিকতা, অনৈতিকতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নগ্নতা, সবশেষে কখনো কখনো অবৈধ যৌন মিলন ও ধর্ষণ। এ হলো বিশ্ব ভালবাসা দিবসের প্রচ্ছন্ন চিত্র! এ হলো বিশ্ব ভালবাসা দিবসের কর্মসূচি! বিশ্ব ভালবাসা দিবস না বলে বিশ্ব বেহায়াপনা দিবস বললে অন্তত নামকরণটি যথার্থ হতো।
এখানে বৈধ কি অবৈধ, ন্যায় কি অন্যায়, কল্যাণ কি অকল্যাণ এ যেন বিবেচনার সুযোগ নেই। ভালোবাসা বললেই যেন বৈধ কথাটা হারিয়ে যায়, কিন্তু কেন? ইসলাম ভালোবাসার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে কিন্তু অবৈধ ভালোবাসাকে কখনো অনুমোদন করেনি। ইসলামে ভালোবাসার রূপরেখার মধ্যে পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন পদ্ধতি। ইসলামী শরীয়তের যথাযথ অনুসরণ, হালাল-হারামের সীমারেখা, শালীন পোশাক-পরিচ্ছেদ, আত্মিক ও দৈহিক সৌন্দর্যবোধ, সুস্থ বিনোদনমূলক কর্মকান্ড পরিচালিত বিষয়াবলী।
বিশ্ব ভালবাসা দিবসের চুড়ান্ত ফলাফল হ’ল মানব সমাজে অসামাজিকতা, অনৈতিকতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নগ্নতা ও অবৈধ যৌনতার বিষাক্ত ছোবলে মানবিক, নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ মারাত্মক ভাবে হ্রাস পায়, ফলে সমাজ জীবনে এর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী নানা ধরনের মারাত্মক পারিবারিক ও সামাজিক বিরূপ প্রতিক্রয়ার বিষাক্ত ফলাফল প্রকাশিত হয় এবং মহামারী আকারে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সমাজে দায়-দায়িত্বহীন অবাধ অবৈধ যৌনতার প্রসার ঘটে এবং বিবাহ নামক পবিত্র দায়িত্বপূর্ণ সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত বৈধ যৌন সম্পর্কের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে মানব সমাজ ও সভ্যতা ধীরে ধীরে দায়-দায়িত্বহীন অসভ্য-বর্বর পাশবিক সমাজের দিক দ্রুত ধাবিত হয়। ফলে মনুষত্ব হারিয়ে পশুত্ব বরণ করে নেয়। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক পবিত্র বন্ধন শিথীল হয়ে যায় এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাঁধাহীন অশ্লীলতা মারাত্মক সয়লাবে কলুষিত সমাজে ধর্ষণ, পরকীয়া, অবৈধ গর্ভধারণ, অবৈধ গর্ভপাত, আত্মহত্যা, মানসিক বিকৃতি, সংসার ভাঙ্গন ও অবৈধ সন্তানের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে। নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। ফলে সমাজে চুরি, ডাকাতি, লুট, ছিনতাই, রাহাজানি, গুম ও খুন এর ব্যাপক সয়লাব ঘটে।
অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ব্যাধিতে মুসলিম উম্মাহও আজ আক্রান্ত। মুসলমান হিসাবে আমাদের জানা থাকা দরকার যে, বিবাহের পূর্বে তরুণ-তরুণীর পরস্পর দেখা-সাক্ষাত, কথা-বার্তা-মিলা-মিশা, প্রেম-ভালবাসা ইসলামী সংবিধানে স¤পুর্ণভাবে হারাম। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের পূর্বে যুবক-যুবতীদের প্রেম- ভালবাসা বলতে কিছুই নেই। পবিত্র কুরআন ও হাদীছের আলোকে ভালবাসা কেবল বিবাহের পরে-ই। বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রির মধ্যে যে ভালবাসা সৃষ্টি হয় এর মধ্যে অনেক চিরন্তন কল্যাণ রয়েছে । এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ‘তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ কর এবং তোমাদের পরস্পরের মাঝে হৃদ্যতা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন’ (রুম: ৩০/২১)। দাম্পত্য জীবনের জন্য রোমান্টিক প্রেমের পরিবর্তে বাস্তব প্রেম ও পরস্পরের প্রতি দয়া, সহমর্মিতা ও সহনশীলতাপূর্ণ ভালবাসা একান্ত প্রয়োজন।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে যারা আল্লাহ এবং তার রাসূলের উপর বিশ্বাসী তারা শুধুমাত্র হৃদয়ের আবেগে বা নফসের কামনা-বাসনায় বা জৈবিক লালসায় অবৈধ ভালবাসার লাগামহীন পথে পা বাড়ায় না, বরং তারা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সর্বদা আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলেন। কেবলমাত্র ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের লক্ষ্যে বিবাহ নামক পবিত্র সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমেই নারী-পুরুষের স্বীকৃত বৈধ দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মুমিনদের এই পবিত্র ভালবাসার দায়-দায়িত্ব ও কল্যাণকর প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক ও বন্ধু। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয়, খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, ছালাত কায়িম করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। আল্লাহ তাদের প্রতি অচিরেই রহমত নাযিল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রজ্ঞাময়। আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য এমন জান্নাতের অঙ্গীকার করেছেন যে জান্নাতের নীচে দিয়ে ঝর্ণাসমূহ বয়ে যায়। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন মহাপবিত্র স্থায়ী বাসস্থান আদন নামক জান্নাতের। বস্তত: আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা (তওবা: ৯/৭১-৭২)।
‘ভালবাসা’ পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর কোমল দুরন্ত মানবিক অনুভূতি। ভালবাসা নিয়ে ছড়িয়ে আছে কত শত পৌরাণিক উপাখ্যান। সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি সর্বত্রই পাওয়া যায় ভালবাসার সন্ধান। এই ভালবাসা গড়ে উঠে পিতা মাতা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন এবং স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে। স্বামী স্ত্রীর ভালবাসার অকৃত্রিম বন্ধন গড়ে বিবাহের পর। তাই বলা হয়, দু’টি মনের অভিন্ন মিলনকে ভালবাসা বলে। এই ভালবাসার রূপকার মহান আল্লাহ। ভালবাসা’ শব্দটি ইতিবাচক। মহান আল্লাহ সকল ইতিবাচক কর্ম-সম্পাদনকারীকেই ভালবাসেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘এবং স্বহস্তে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ো না। তোমরা সৎকর্ম কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মুহসিনদের ভালবাসেন (বাক্বারাহ: ২/১৯৫)। ভুলের পর ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পবিত্রতা অবলম্বন করা এ দুটিই ইতিবাচক কর্ম। তাই আল্লাহ তাওবাকারী ও পবিত্রতা অবলম্বনকারীদেরকেও ভালবাসেন। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাওবাকারী ও পবিত্রতা অবলম্বনকারীদেরকে ভালবাসেন’(বাক্বারাহ: ২/২২২)। তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি সকল কল্যাণের মূল। আল্লাহ তা’আলা মুত্তাকীদেরকে খুবই ভালবাসেন। এমর্মে বলেন, فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ ‘আর নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালবাসেন’(ইমরান: ৩/৭৬)।
ভালবাসা হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য সুতোর টান। কোন দিন কাউকে না দেখেও যে ভালবাসা হয়; এবং ভালবাসার গভীর টানে রূহের গতির এক দিনের দূরত্ব পেরিয়েও যে দুই মুমিনের সাক্ষাত হতে পারে তা ইবন আব্বাস (রা:) এক বর্ণনা থেকে আমরা পায়। তিনি বলেন, النِّعَمُ تُكْفَرُ ، والرَّحِمُ تُقْطَعُ ، ولَم نَرَ مِثَل تَقَارُبِ القُلُوبِ ‘কত নিয়ামতের শুকরিয়া করা হয় না, কত আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হয়, কিন্তু অন্তরসমূহের ঘনিষ্ঠতার মত (শক্তিশালী) কোন কিছুই আমি কখনও দেখিনি’। (ইমাম বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ: হা/২৬২)
কাউকে ভালবাসতে হলে সেই ভালবাসার মানদন্ড থাকতে হবে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক। কাউকে ভালবাসবার আগে আল্লাহর জন্য হৃদয়ের গভীরে সুদৃঢ় ভালবাসা রাখতে হবে। কিছু মানুষ এর ব্যতিক্রম করে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ ‘আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে আল্লাহ্র সমকক্ষ রূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালবাসার মত তাদেরকে ভালবাসে; কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ভালবাসায় তারা সুদৃঢ়’ (বাক্বারাহ: ২/১৬৫)। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালবাসতে হবে, নতুবা কোন ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছ:) বলেছেন, ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا ، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِى الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِى النَّارِ ‘‘তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকে সে ঈমানের স্বাদ পায়। ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে প্রিয় হওয়া। ২. শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালবাসা। ৩. কুফুরীতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপছন্দ করা।’ (বুখারী, কিতাবুল ঈমান অধ্যায়, হা /১৬, ২১ ও ৬৯৪১) কোন ব্যক্তির সাথে শত্রুতা রাখার মানদন্ড হলো একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালবাসতে হবে অথবা শত্রুতা রাখতে হবে। এটাই শ্রেষ্ঠতম কর্মপন্থা। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছা:) বলেছেন, إِنَّ أَحَبَّ الأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ الْحُبُّ فِى اللَّهِ وَالْبُغْضُ فِى اللَّهِ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালবাসা এবং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কারো সাথে শত্রুতা পোষন করা।’ (আহমদ, মিশকাত হা/৫০২১) আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালবাসার ফযীলত হ’ল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মহত্ত্বের নিমিত্তে যারা পরস্পর পরস্পরের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে তিনি তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছা:) বলেছেন, إِنَ­ إِنَّ اللَّهَ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَيْنَ الْمُتَحَابُّونَ بِجَلاَلِى الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِى ظِلِّى يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلِّى ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, আমার মহত্ত্বের নিমিত্তে পরস্পর ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপনকারীরা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার বিশেষ ছায়ায় ছায়া দান করব। আজ এমন দিন, যে দিন আমার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া নেই।’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৫০০৬)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন, إِنَّ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ لَأُنَاسًا مَا هُمْ بِأَنْبِيَاءَ وَلَا شُهَدَاءَ يَغْبِطُهُمُ الْأَنْبِيَاءُ وَالشُّهَدَاءُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِمَكَانِهِمْ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ تُخْبِرُنَا مَنْ هُمْ قَالَ هُمْ قَوْمٌ تَحَابُّوا بِرُوحِ اللَّهِ عَلَى غَيْرِ أَرْحَامٍ بَيْنَهُمْ وَلَا أَمْوَالٍ يَتَعَاطَوْنَهَا فَوَ اللَّهِ إِنَّ وُجُوهَهُمْ لَنُورٌ وَإِنَّهُمْ عَلَى نُورٍ لَا يَخَافُونَ إِذَا خَافَ النَّاسُ وَلَا يَحْزَنُونَ إِذَا حَزِنَ النَّاسُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে যারা নবীও নয়, শহীদও নয়; কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তাঁদের সম্মানজনক অবস্থান দেখে নবী এবং শহীদগণও ঈর্ষান্বিত হবেন। ছাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছা:)! আমাদেরকে বলুন, তারা কারা ? তিনি বললেন, তারা ঐ সকল লোক, যারা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই একে অপরকে ভালবাসে। অথচ তাদের মধ্যে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই, কিংবা কোন অর্থনৈতিক লেন-দেনও নেই। আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই তাঁদের চেহারা হবে নূরানী এবং তারা নূরের মধ্যে থাকবে। যে দিন মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে, সেই দিন তাঁদের কোন ভয় থাকবে না এবং যে দিন মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকবে, সে দিন তাঁদের কোন চিন্তা থাকবে না..।’ (আবু দাঊদ, মিশকাত হা/৫০১২)
পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য স্থাপিত না হলে পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া যায় না, শান্তিও নিরাপত্তা লাভ করা যায় না, এমনকি জান্নাতও লাভ করা যাবে না। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুমিনদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির জন্য একটি চমৎকার পন্থা বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, لَا تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَوَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُم ‘তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার না হবে, তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য স্থাপন করবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয়ের কথা বলব না, যা করলে তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হবে? সাহাবীগণ বললেন, নিশ্চয়ই ইয়া রাসূলাল্লাহ ! (তিনি বললেন) তোমাদের মধ্যে বহুল পরিমাণে ছালামের প্রচলন কর।’’(মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হা/ ৯৩)
আজ আমরা অনুকরণ প্রিয় প্রগতিবাদ সুশীল সমাজের প্রগতিশীল মানুষ। বিজাতীয় অনৈতিক সাংস্কৃতিকে বুকে আগলে ধরে নিজেদের ইজ্জত সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিতে প্রস্তুত। মুসলমান হিসাবে ঔসকল বিজাতীয় আচার অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে চলতে হবে। ছাহাবী আবু অকেদ (রাঃ) বলেন, أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَمَّا خَرَجَ إِلَى خَيْبَرَ مَرَّ بِشَجَرَةٍ لِلْمُشْرِكِينَ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ يُعَلِّقُونَ عَلَيْهَا أَسْلِحَتَهُمْ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ. فَقَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم سُبْحَانَ اللَّهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى (اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ) وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ ‘রাসূল (ছাঃ) খায়বার যাত্রায় মূর্তিপূজকদের একটি গাছ অতিক্রম করলেন। তাদের নিকট যে গাছটির নাম ছিল ‘জাতু আনওয়াত’। এর উপর তীর টানিয়ে রাখা হ’ত। এ দেখে কতক ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্যও এমন একটি ‘জাতু আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দিন। রাসূল (ছাঃ) ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, ‘সুবহানাল্লাহ, এ তো মূসা (আঃ)-এর জাতির মত কথা। আমাদের জন্য একজন প্রভু তৈরি করে দিন, তাদের প্রভুর ন্যায়। আমি নিশ্চিত, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমরা পূর্ববর্তীদের আচার-অনুষ্ঠানের অন্ধানুকরণ করবে’ (মিশকাত হা/৫৪০৮)।
আজ আমরা যদি মুসলমান হয়ে তাদেও আচার-অনুষ্ঠান পালন করি বা অনুকরণ করি তবে আমরা আর মুসলমান থাকব না, আমরা তাদের দলভূক্ত হয়ে যাব। এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করবে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই একজন বলে গণ্য হবে’ (আহমাদ, আবূ দাঊদ হা/৪৩৪৭)। –
ভালোবাসা হতে হবে জান্নাতে যাওয়ার জন্য, তাই সেভাবে কাজ করাই হবে প্রকৃত মুমিনের পরিচয়। অন্যান্য দিবসের মতো বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমরা কি উপকৃত হয়েছি? কেউ কেউ হয়তোবা হ্যাঁ জবাবকে বেছে নেবেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই মনে করেন, ভালোবাসা দিবস সমাজকে অশ্লীল ও অন্যায়ের দিকে ধাবিত করছে। নৈতিক অবক্ষয় দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অভিভাবকগণ সঠিকভাবে সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিলে হয়তোবা অনাকাংক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে না।
পশ্চিমা দেশগুলো নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও অশ্লীল সংস্কৃতি চর্চার ফলে আজ তারা অসংখ্য সামাজিক সমস্যায় ভুগছে। তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চেয়ে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক করতে বেশি আগ্রহী। ফলে, তাদের পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। মেয়েরা সন্তান গ্রহণকে ঝামেলা মনে করছে। তাই সেসব পশ্চিমা দেশে আজ মানুষের জন্মের চেয়ে মৃত্যু হার বেশি। এরূপ নানা জটিল সমস্যায় তারা ভুগছে। পারিবারিক ব্যবস্থা পুনর্জীবিত করার জন্য তারা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে । সেখানে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন বিনষ্টকারী ও নারী-পুরুষের অবাধ সম্পর্কে শ্লোগানধারী তথাকথিত ভালবাসা দিবসের মত অপসংস্কৃতিকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না।

ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও গোটা দেশকে ভালোভাবে গড়তে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা নাহলে ভালোবাসা দিবস পালনের নামে আমাদের সন্তানরা নৈতিক অবক্ষয়ের অতলে হারিয়ে যাবে। সমাজ পতিত হবে বিশৃঙ্খলার অতল গহ্বরে। যার আলামত আমাদের চারপাশে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজকাল ধর্মের কথা শুনলেই অনেকেই নাক সিটকান। কারণ তাদের কাছে ধর্ম মানেই পশ্চাৎপদতা, মৌলবাদিতা; ধর্ম মানেই সেকেলে বিষয়। তাই তারা নিজেদের এক আধুনিক সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। কিন্তু বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের নামে যে অশ্লীলতার চর্চা চলছে তা বন্ধ না হলে তাদের সেই তথাকথিত সভ্য সমাজটাও পারিবারিক-সামাজিক কলহ এবং অশান্তির আগুনে পুড়ে ছারখার হতে বাধ্য।
ভালবাসা শব্দটির ইংরেজী শব্দ হ’ল LOVE = L – Lost, O – of, V – Vital, E – Energyঅর্থাৎ- জীবনী শক্তি হারায়। কিন্তু এর অর্থ এমন হলে কতই না ভালো হত। LOVE = L – Long Lasting Relation, O – Obediance to each other, V – Virtue & Vercity, E – Emit into Heart with Trust.
অতএব, আসুন! প্রথমত: আমরা অভিভাকগণ সচেতন হই, অতঃপর সচেতন করি আমাদের সন্তানদের। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনের নামে আমাদের সন্তানকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে বাঁচাই, সতর্ক হই আমাদের পরিবার ও সমাজকে অশ্লীলতা থেকে বাঁচাতে।
বিশ্ব ভালবাসা দিবসের নামে এসব ঈমান বিধ্বংসী কর্মকান্ড হতে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে হেফাযত করুন। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই যেন কাউকে ভালবাসি এবং শত্রুতাও যদি কারো সাথে রাখতে হয়, তাও যেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই রাখি। মহান আল্লাহ আমাদের সহায়ক হোন। আমীন !!!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top