ব্যবসানীতি : নগদ ও বাঁকীতে লভ্যাংশ নির্ধারণ

ব্যবসানীতি একটি সহজ সরল নীতি মাত্র। এটাকে আমরা জটিল ও কঠিন করে ফেলেছি নিজেদের স্বার্থে। ওজনে কম দেওয়া, ভালো পণ্য দেখিয়ে মন্দ ও নষ্ট পণ্য প্রদান করা, মুনাফার লোভে পড়ে সূদের প্রবর্তন করা এবং মওজুদদারীতে জনসাধারণকে কষ্ট দেয়া। মওজুদ জায়েজ থাকলেও তা নিদির্ষ্ট সময়ের জন্য অনন্তকালের জন্য তা নয়। আবার লভ্যাংশ করা যাবে যদি তা সূদের শামিল না হয়। তাই বিক্রয় নীতিমালা আমাদের জানা আবশ্যক।

বিক্রয়ে লভ্যাংশের পরিমাণ :

কোন পণ্যে কত লাভ করা যাবে এরূপ কোন নির্দেশনা কুরআন-হাদীছে পাওয়া যায় না। আবার সকল পণ্যে এক রকম লাভ করা যাবে না এরূপ কোন নিষেধাজ্ঞাও নেই। আসলে শরী‘আতে বিষয়টিকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কারণ লাভ নির্ণয়ের বিষয়টি নির্ভর করে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিস্থিতি-পরিবেশের উপর। তবে লাভের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা হাদীছ থেকে লাভ করতে পারি। উরওয়া ইবনে আবিল জাদ আল-বারেকী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট পশুর একটি চালানের সংবাদ আসল। তিনি আমাকে একটি দীনার দিয়ে বললেন, উরওয়া! তুমি চালানটির নিকট যাও এবং আমাদের জন্য একটি বকরী ক্রয় করে নিয়ে আস। তখন আমি চালানটির কাছে গেলাম এবং চালানের মালিকের সাথে দরদাম করে এক দীনার দিয়ে দুইটি বকরী ক্রয় করলাম। বকরী দু’টি নিয়ে আসার পথে এক লোকের সাথে দেখা হয়। লোকটি আমার থেকে বকরী ক্রয় করার জন্য আমার সাথে দরদাম করল। তখন আমি তার নিকট এক দীনারের বিনিময়ে একটি বকরী বিক্রয় করলাম এবং একটি বকরী ও একটি দীনার নিয়ে চলে এলাম।

তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এই হচ্ছে আপনার দীনার এবং এই হচ্ছে আপনার বকরী। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, এটা করলে কিভাবে? উরওয়া বলেন, আমি তখন তাঁকে ঘটনাটি বললাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তার হাতের লেন-দেনে বরকত দিন’।[বুখারী হা/৩৬৪২; আবূদাঊদ হা/৩৩৮৪; তিরমিযী হা/১২৫৮]

উল্লেখ্য, উক্ত ছাহাবী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পক্ষে ১০০% লাভ করা সত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) তার জন্য বরকতের দো‘আ করেছেন এবং এ দো‘আর ফলে উক্ত ছাহাবী জীবনে প্রচুর বরকত লাভে ধন্য হয়েছেন। বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, উক্ত ছাহাবী মাটি ক্রয় করলেও তাতে লাভ হ’ত। সুতরাং মজুতদারী না করে, প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে ক্রেতার স্বাভাবিক ও স্বেচ্ছা সম্মতির ভিত্তিতে কোন পণ্য বিক্রি করে বিক্রেতা ১০০% লাভ করলেও শরী‘আতে কোন বাধা নেই। তবে এক্ষেত্রে ক্রেতা বা ভোক্তা যেন যুলুমের শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা যরূরী।

লাভের সর্বনিম্ন সীমা সম্পর্কে ইসলামী চিন্তাবিদগণ বলেছেন, সম্পদ ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে কমপক্ষে এতটুকু লাভ করা যায় যাতে ব্যবসায়ীর পরিবারের ভরণ-পোষণ, ব্যবসার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান ও ২.৫% যাকাত দেয়ার পর মূলধন অক্ষত থাকে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে দয়ার্দ্র, নম্র ও সদ্ব্যবহার পূর্বক ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করা অত্যন্ত নেক কাজ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, رَحِمَ اللهُ رَجُلاً سَمْحًا إِذَا بَاعَ، وَإِذَا اشْتَرَى، وَإِذَا اقْتَضَى ‘আল্লাহ ঐ মহানুভব মানুষের প্রতি দয়া করেন, যে ক্রয়-বিক্রয়ে এবং নিজের পাওনা আদায়ে নম্রতা ও সহনশীলতা প্রদর্শন করে’।[বুখারী হা/২০৭৬ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়; ইবনু মাজাহ হা/২২০৩; মিশকাত হা/২৭৯০]

… নগদ ও বাঁকীতে দুই ‍মূল্য :

নগদ ও বাঁকীতে বিক্রয়ে কম-বেশী দু ধরনের করা নিষেধ। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক বিক্রয়ের মধ্যে দুই বিক্রয় নিষেধ করেছেন’।[তিরমিযী হা/১২৩১; মুওয়াত্ত্বা হা/২৪৪৪; নাসাঈ হা/৪৬৩২; আহমাদ হা/৯৫৮২; মিশকাত হা/২৮৬৮, হাদীছ ছহীহ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-১১ ‘নিষিদ্ধ ব্যবসা’ অনুচ্ছেদ-৫]

অর্থাৎ এক ব্যবসায়ে দুই ধরনের বিক্রয়। অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ بَاعَ بَيْعَتَيْنِ فِى بَيْعَةٍ فَلَهُ أَوْكَسُهُمَا أَوِ الرِّبَا ‘যে ব্যক্তি একটি ব্যবসায়ে দু’টি বিক্রয় করে সে কম মূল্যেরটা নিবে অথবা সূদ নিবে’।[আবুদাঊদ হা/৩৪৬১; হাকেম হা/২২৯২; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৪৬২৯; ছহীহাহ হা/২৩২৬; শিরোনাম : ‘অধিক মূল্যে বাকীতে বিক্রি’]

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,إِذَا اسْتَقَمْتَ بِنَقْدٍ، وَبِعْتَ بِنَقْدٍ، فَلا بَأْسَ بِهِ، وَإِذَا اسْتَقَمْتَ بِنَقْدٍ، فَبِعْتَ بِنَسِيئَةٍ، فَلا، إِنَّمَا ذَلِكَ وَرِقٌ بِوَرِقٍ ‘যখন তুমি নগদে এক দাম নির্ধারণ করবে এবং নগদে এক দামে বিক্রি করবে, তাতে কোন দোষ নেই। আর যখন তুমি নগদে এক দাম ও বাকীতে আরেক দাম নির্ধারণ করবে, সেটা হবে না। কেননা ওটা রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রয় মাত্র’।[মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৫০২৮; আল-ক্বাওলুল ফাছল ২৮-২৯ পৃ.] অর্থাৎ যদি বলা হয়, এই মালটি ১০০ টাকায় নগদ বিক্রি হবে। কিন্তু এক বছরের বাকীতে ১২০ টাকা দিতে হবে। তখন সেটা হারাম হবে অপেক্ষার বিনিময় দাবীর কারণে।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,صَفْقَتَانِ فِي صَفْقَةٍ رِبًا، إِلاَّ أَنْ يَقُولَ الرَّجُلُ : إِنْ كَانَ بِنَقْدٍ فَبِكَذَا، وَإِنْ كَانَ بِنَسِيئَةٍ فَبِكَذَا ‘এক ব্যবসায়ের মধ্যে দুই বিক্রি হ’ল সূদ। আর তা হ’ল, বিক্রেতা বলবে, নগদে এত টাকা এবং বাকীতে এত টাকা’।[মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/২০৪৫৪; ছহীহ ইবনু হিববান হা/১০৫৩, ৫০২৫; সনদ ছহীহ, ইরওয়া হা/১৩০৭, ৫/১৪৮।]

ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,إذَا قَالَ : هَذَا يُسَاوِي السَّاعَةَ كَذَا وَكَذَا وَأَنَا أَبِيعُكَهُ بِكَذَا أَكْثَرُ مِنْهُ إلَى أَجَلٍ، فَهَذَا رِبًا. كَمَا قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- ‘যখন কেউ বলে, এই মালটি এখন এত দরে বিক্রি হবে। তবে আমি তোমার নিকট এ মাল বাকীতে বিক্রি করব অধিক দামে, তাহ’লে এটি হবে ‘রিবা’ বা সূদ। যেমন ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন। [ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খৃ.), মজমূ‘ ফাতাওয়া ২৯/৩০৬-০৭; আল-ক্বাওলুল ফাছল ২৮-২৯ পৃ.]

মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হি./৬৫৩-৭২৯ খৃ.) :

أَنَّهُ كَانَ يَكْرَهُ أَنْ يَقُولَ : أَبِيعُكَ بِعَشَرَةِ دَنَانِيرَ نَقْدًا، أَوْ بِخَمْسَةَ عَشَرَ إِلَى أَجَلٍ ‘তিনি একথা বলা অপসন্দ করতেন যে, আমি তোমার নিকট নগদে ১০ দীনারে বিক্রি করলাম অথবা বাকীতে ১৫ দীনারে বিক্রি করলাম’।[মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৪৬৩০; সনদ ছহীহ]

আসুন! আমরা হালাল ব্যবসাকে কৌশল ও চাতুরতার উপায় অবলম্বণ করে হারামে পরিণত না করি। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top