লেখক : ড. নূরুল ইসলাম, ভাইস প্রিন্সিপাল, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী।
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (১৮৬৮-১৯৪৮) উপমহাদেশের একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমে দ্বীন, অবিসংবাদিত ধর্মতাত্ত্বিক, অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুনাযির, অনলবর্ষী বাগ্মী, মুহাদ্দিছ, মুফাস্সির, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সংগঠক, সম্পাদক ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। তবে মুনাযির বা তার্কিক হিসাবেই তাঁর খ্যাতি বিশ্বময়। ‘শেরে পাঞ্জাব’ (পাঞ্জাবের সিংহ) ও ‘ফাতিহে কাদিয়ান’ (কাদিয়ান বিজয়ী) মুনাযির খ্যাত মাওলানা অমৃতসরী বাহাছ-মুনাযারার ইমাম ও মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন। এক হাযারের অধিক মুনাযারায় অংশগ্রহণ করে তিনি এক বিরল নযীর স্থাপন করেছিলেন। খ্রিষ্টান, কাদিয়ানী সহ যেকোন বাতিল ফিরক্বা ও ইসলাম বিরোধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে যে নির্ভীক সৈনিকটি সর্বাগ্রে ময়দানে আবির্ভূত হতেন তিনি হলেন মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী। বলা হয়ে থাকে, ইসলামের বিরুদ্ধে রাত্রির গভীর অন্ধকারে যদি কোন ফিরক্বার আবির্ভাব ঘটে তাহলে সকাল বেলায় অমৃতসরী তার জবাব দেয়ার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যান। বক্তব্য, লেখনী ও মুনাযারার মাধ্যমে তিনি ভন্ড নবী মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী (১৮৩৫-১৯০৮) ও তার বশংবদদের বিরুদ্ধে হিমাদ্রিসম ঈমানী দৃঢ়তা ও অসীম সাহসিকতার সাথে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর এক অমূল্য রত্ন ও সম্পদ ছিলেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ১৮৬৮ সালে (১২৮৭ হিঃ) ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষের আদি ভিটা ছিল কাশ্মীরের ইসলামাবাদ যেলার (বর্তমানে অনন্তনাগ) ডোর এলাকায়। তাঁর পিতা খিযির জূ পশমী কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৮৬০ সালের দিকে তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে অথবা কাশ্মীরের ডোগরা রাজা রণবীর সিং-এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অমৃতসরে বসতি গড়েন।[মাওলানা আব্দুল মজীদ খাদেম সোহদারাভী, সীরাতে ছানাঈ (দিল্লী : আল-কিতাব ইন্টারন্যাশনাল, ১ম প্রকাশ, মে ১৯৮৯), পৃঃ ৯০; মুহাম্মাদ মুর্তাযা বিন আয়েশ মুহাম্মাদ, আশ-শায়খ ছানাউল্লাহ আল-আমরিতসারী ওয়া জুহূদুহু আদ-দা‘বিয়াহ, অপ্রকাশিত মাস্টার্স থিসিস, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদ, ১৪১৭ হিঃ/১৯৯৬ খৃঃ, পৃঃ ১৪।]
ছানাউল্লাহ অমৃতসরী নিজেই বলেছেন, ‘আমি পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসরে জন্মগ্রহণ করি। আমার পিতা খিযির জূ ও আমার চাচা আকরাম জূ কাশ্মীরের শ্রীনগরের ইসলামাবাদ যেলা (বর্তমানে অনন্তনাগ) থেকে অমৃতসরে হিজরত করেন। পশমী কাপড়ের ব্যবসা করার জন্য তাঁরা দু’জন এ শহরে আসতেন। কাশ্মীরী পরিবারগুলোর মধ্যে একটি পরিবারকে ‘মিন্টু’ বলা হত। এটি ব্রাহ্মণদের একটি শাখা। তাঁরা (অর্থাৎ আমার পিতা ও চাচা) এই পরিবারের সন্তান’।[আব্দুল মুবীন নাদভী, আশ-শায়খ আল-আল্লামা আবুল অফা ছানাউল্লাহ আল-আমরিতসারী জুহূদুহু আদ-দা‘বিয়াহ ওয়া আছারুহু আল-ইলমিইয়াহ (বেনারস : জামে‘আ সালাফিইয়াহ, ২০১৬), পৃঃ ৫১। গৃহীত : নেদায়ে মদীনা, কানপুর, ‘শায়খুল ইসলাম মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী’ সংখ্যা, ১৯৪৯, পৃঃ ২৪] কাশ্মীরী পন্ডিতদের অপর শাখা ‘নেহরু’-এর মতো ‘মিন্টু’কেও সমাজের মানুষ অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখত।
অমৃতসরীর পূর্বপুরুষের মধ্যে সর্বপ্রথম কে এবং কখন ইসলাম গ্রহণ করে তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। ধারণা করা হয়, কাশ্মীরের মুসলিম গভর্ণর যয়নুল আবেদীন শাহের (মৃঃ ৮৭৭ হিঃ) শাসনামলে তাঁর পরিবার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। ‘নুযহাতুল খাওয়াতির’ গ্রন্থে বলা হয়েছে,أسلم آباؤه في القديم ‘তাঁর পূর্বপুরুষ প্রাচীনকালে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন’।[নুযহাতুল খাওয়াতির ৮/১২০৫ (মাকতাবা শামেলা)]
দুঃখের অথৈ সাগরে ভাসমান জীবন তরী :
৭ বছর বয়সে ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর দগদগে ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই কিছুদিন পর পিতৃত্বের শূন্যতা পূরণে যৎকিঞ্চিৎ সচেষ্ট চাচা মুহাম্মাদ আকরামও পরপারে পাড়ি জমান। পিতা ও চাচার মৃত্যুতে শিশু অমৃতসরীর জীবনে ঘোর অমানিশা নেমে আসে। তখন পরিবারে তার একমাত্র সহায় ছিল বড় ভাই মুহাম্মাদ ইবরাহীম। কিন্তু তার অবস্থাও খুব একটা ভাল ছিল না। কাপড় রিফু করে কোন মতে তার দিন চলত। এরূপ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় জীবন-জীবিকার তাগিদে তিনি বড় ভাইয়ের কাছে রিফু করা শেখেন এবং এতে পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেন। ১৪ বছর বয়সে মাতার জীবন প্রদীপও নিভে যায়। ফলে স্নেহ-মমতার পরশের শেষ আশ্রয়স্থল ও সুতোটাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অভাব-অনটন ও দুঃখের অথৈ সাগরে ভাসমান নিজের জীবনের নিষ্করুণ দৃশ্যকল্প তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে এভাবে এঁকেছেন, ‘আমার বয়স যখন ৭ বছর তখন আমার পিতা মারা যান। অতঃপর আমার চাচাও মারা যান। আমার বড় ভাই মুহাম্মাদ ইবরাহীম কাপড় রিফু করার কাজ করতেন। তিনি আমাকে এই কাজ শেখান। আমি যখন ১৪ বছরে উপনীত হই তখন আমার মাও মারা যান। আমার পিতার আমরা চার সন্তান ছিলাম। তিন ভাই ইবরাহীম, ইসহাক ও ছানাউল্লাহ এবং এক বোন’।[আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৫। গৃহীত: নেদায়ে মদীনা, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪]
জীবনের মোড় পরিবর্তন :
একদিন ছানাউল্লাহ অমৃতসরী দোকানে কাপড় রিফু করছিলেন। ইত্যবসরে একজন আলেম একটি দামী জুববা রিফু করার জন্য নিয়ে আসেন। তিনি সময়মতো জুববাটি রিফু করে ফেরৎ দিলে সেই আলেম তার কাজের দক্ষতা দেখে খুব খুশী হন। এ সময় কিছু দ্বীনী আলোচনাও হয়। মাওলানা ছাহেব যুবক অমৃতসরীকে কিছু প্রশ্ন করেন। তিনি সেগুলোর যুক্তিসংগত উত্তর প্রদান করেন। মাওলানা তার উত্তর শুনে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান এবং কৌতূহলবশতঃ জিজ্ঞাসা করেন, ‘বৎস! তুমি কতদূর পড়াশোনা করেছ’? এ প্রশ্ন শুনে তার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। তিনি ভগ্নহৃদয়ে উত্তর দেন, ‘আমি লেখাপড়া কিছুই জানি না। আমার পিতা-মাতা মারা গেছেন। এখন না আছে পড়ানোর মতো কেউ আর না আছে উপার্জন করে দু’লোকমা মুখে তুলে দেওয়ার মতো কেউ। জামা-কাপড় রিফু করে যে দু’চার পয়সা কামাই করি তা দিয়ে কোনমতে দিন চলে যায়’।
একথা শুনে মাওলানা ছাহেব একজন দক্ষ জহুরির ন্যায় উপদেশের সুরে তাকে বললেন, ‘তুমি অবশ্যই পড়াশুনা করবে। তোমার মেধা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তুমি যদি লেখাপড়া না করো তাহলে নিজের নফসের উপরে যুলুম করবে’। একথা বলে তিনি চলে গেলেন। তাঁর নছীহত যুবক অমৃতসরীর মানসপটে গভীরভাবে রেখাপাত করল। তিনি রিফু করার পাশাপাশি পড়াশোনা আরম্ভ করে দিলেন।
আসলে আল্লাহর হিকমত ও ফায়ছালা ছিল অন্য রকম। অমৃতসরী মানুষের ছেঁড়া কাপড় রিফু করার পরিবর্তে মুসলিম উম্মাহর ঈমানের জীর্ণ-শীর্ণ পোষাক রিফু করবেন এবং ইসলামের উপর আগত মুহুর্মুহু হামলা থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন- এমনটিই তাঁর ভাগ্যলিপি ছিল। এজন্য মহা প্রজ্ঞাময় আল্লাহ রববুল আলামীন তাঁর সামনে জ্ঞানার্জনের পথকে প্রশস্ত করে দেন। এটি ছিল আল্লাহ তা‘আলার এক অপার অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা সেই অনুগ্রহে সিক্ত করেন।[সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ১০৭-১০৮; ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ১৮-১৯] মহান আল্লাহ বলেন,وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ آتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِين ‘অতঃপর যখন সে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে গেল, তখন আমরা তাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করলাম। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি’ (ইউসুফ ১২/২২)।
জ্ঞানার্জনের পথে অমৃতসরী :
তিনি কতিপয় ফার্সী কিতাব পড়ার পর সমকালীন খ্যাতিমান আহলেহাদীছ আলেম মাওলানা আহমাদুল্লাহ অমৃতসরীর (মৃ: ১৯১৬) দরসে হাযির হন। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে নিজের শিক্ষা জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, ‘চৌদ্দ বছর বয়সে আমার পড়ার আগ্রহ জন্মায়। প্রাথমিক ফার্সী কিতাবপত্র পড়ার পর অমৃতসরের ধনাঢ্য ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব মাওলানা আহমাদুল্লাহ ছাহেবের নিকট পৌঁছি। রিফুগিরির কাজ করতে থাকি এবং মরহূমের নিকট সবকও পড়তে থাকি। শরহে জামী ও কুতবী পর্যন্ত মৌলভী ছাহেবের কাছে পড়ি। অতঃপর হাদীছের জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে উস্তাদে পাঞ্জাব মাওলানা হাফেয আব্দুল মান্নান ওয়াযীরাবাদীর খিদমতে হাযির হই। ওখানে সিলেবাসভুক্ত কিতাব সমূহ পড়ে সনদ হাছিল করি। এটি ১৩০৭ হিঃ মোতাবেক ১৮৮৯ সালের ঘটনা। এরপর শামসুল ওলামা মাওলানা সাইয়িদ নাযীর হুসাইন ছাহেবের (রহঃ) খিদমতে হাযির হই। পূর্বোক্ত সনদ দেখিয়ে তাঁর নিকট থেকে ‘ইজাযত’ বা পাঠদানের অনুমতি হাছিল করি। অতঃপর কয়েকদিন (মাযাহিরুল উলূম মাদরাসা) সাহারানপুরে অবস্থান করে (১৩০৭ হিজরীতেই) দেওবন্দে পৌঁছি। সেখানে মা‘কূল ও মানকূল-এর সিলেবাসভুক্ত সব ধরনের বই পড়ি। মা‘কূলের কিতাব সমূহের মধ্যে কাযী মুবারক, মীর যাহেদ, ছদরার উমূরে ‘আম্মাহ, শামসে বাযেগাহ প্রভৃতি এবং মানকূলাতের মধ্যে হেদায়া, তাওযীহ, মুসাল্লামুছ ছুবূত প্রভৃতি, অংক শাস্ত্রের শরহে চগমনী প্রভৃতিও পড়ি এবং দাওরায়ে হাদীছে অংশগ্রহণ করি। উস্তাদে পাঞ্জাব-এর দরসে হাদীছ এবং দেওবন্দের শিক্ষকমন্ডলীর দরসে হাদীছ দু’টোর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা থেকে উপকৃত হই। দেওবন্দের সনদ আমার জন্য গর্বের বিষয়, যেটি আমার নিকট মওজূদ রয়েছে’।[ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ১৯-২০। গৃহীত: খোদনবিশ্ত সাওয়ানিহে হায়াত, পৃঃ ৭৫; আহলেহাদীছ, অমৃতসর, ২৩শে জানুয়ারী ১৯৪২; নূরে তাওহীদ, পৃঃ ৩৯-৪০।]
অমৃতসরীর প্রতি শায়খুল হাদীছ ওয়াযীরাবাদীর স্নেহাশিস :
উসতাদে পাঞ্জাব খ্যাত হাফেয মাওলানা আব্দুল মান্নান ওয়াযীরাবাদী একবার বলেছিলেন, আল্লাহ আমাকে কিয়ামতের দিন যখন জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করেছ? তখন আমি বলব, আমি মাওলানা ছানাউল্লাহকে মুহাদ্দিছ বানিয়েছি। সে আমার নিকট থেকে ইলম হাছিল করে সমগ্র দেশে ইলমে হাদীছের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। হাদীছের ভাষ্য অনুযায়ী এটাই তো উপকারী ইলম, মৃত্যুর পরেও যার ছওয়াব জারী থাকে।[মুসলিম হা/১৬৩১; মিশকাত হা/২০৩]
মেধাবীর প্রতি হিংসা : একটি শিক্ষণীয় ঘটনা
ছানাউল্লাহ অমৃতসরী দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান শিক্ষক শায়খুল হাদীছ মাওলানা মাহমূদুল হাসান দেওবন্দীর (১৮৫১-১৯৩০) নিকট প্রত্যেকটি কিতাব পড়ার সময় অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ক্লাসে নানাবিধ প্রশ্নের অবতারণা করতেন। উসতাদকে ঠেকানো তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং অধিক জ্ঞান হাছিল ও বিষয়ের গভীরে পৌঁছার জন্যই তিনি তা করতেন। বেশী প্রশ্ন করার কারণে মাওলানা ছাহেব বিরক্ত হতেন না। বরং মমত্বপূর্ণ ভাষায় হাসিমুখে তাঁর উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদান করতেন। এতে অমৃতসরীর পেছনে তাঁর অনেক সময় ব্যয় হত। দেওবন্দ থেকে ফারেগ হওয়ার পর তিনি তাঁর সাথে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে যান। দুপুর ১১-১২টার মাঝামাঝি সময়। মাওলানা মাহমূদুল হাসান তখন তাঁর মসজিদের দক্ষিণ দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে একাকী বসা ছিলেন। তিনি অমৃতসরীকে বিদায় দেয়ার সময় বলেন, ‘তোমার অনেক সহপাঠী তোমার বিরুদ্ধে আমার নিকট অভিযোগ করত যে, তুমি প্রশ্ন করে অনেক সময় নষ্ট করে দাও। আমি বলতাম, কোন ছাত্র প্রশ্ন করতে চাইলে করুক। তার প্রশ্নগুলো ঠিক হোক বা বেঠিক কিছু তো জিজ্ঞাসা করুক। তোমারও খুশী হওয়া উচিত। কারণ আল্লাহ কাউকে কিছু দিলে মানুষেরা সে বিষয়ে তার প্রতি হিংসা করে’। একথা শুনে অমৃতসরীর দু’চোক্ষ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তিনি জীবনে কোনদিন এই ঘটনা ভুলেননি। বরং যখন সমকালীন ব্যক্তিদের নিকট থেকে দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন তখন উসতাদে মুহতারামের এই বাণী চিরন্তন তাঁর সকল মনোবেদনা দূর করে দিয়েছে। এই ঘটনাটি যখনই তাঁর মনে পড়ত তখনই তিনি এই কবিতাটি আওড়াতেন,
هُمْ يَحْسُدُوْنِيْ وَشَرُّ النَّاسِ كُلِّهِمْ
مَنْ عَاشَ فِي النَّاسِ يَوْمًا غَيْرَ مَحْسُوْدِ-
‘তারা আমার প্রতি হিংসা করে। অথচ তারা সবাই নিকৃষ্ট প্রকৃতির মানুষ। এমন কে আছে যে হিংসার শিকার হওয়া ছাড়া একদিন মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে পারে’।[ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ২০-২১; দুর্রে মুখতার ১/৪৫। গৃহীত : আহলেহাদীছ, অমৃতসর, ৭ই নভেম্বর ১৯২৪।] এইসব হিংসুকদের থেকে ইমাম বুখারীও (রহঃ) রক্ষা পাননি। এজন্যই বলা হয়, هَلْ مَاتَ الْبُخَارِىُّ رَحِمَهُ اللهُ إِلاَّ مَحْسُوْدًا ‘ইমাম বুখারী (রহঃ)ও কি মৃত্যুবরণ করেছেন হিংসার শিকার না হয়ে’?
তাঁর সংগ্রামী জীবনের পরতে পরতে আমাদের জন্য শিক্ষার বার্তা রয়েছে। তিনি ছিলেন উত্তম আচরণের অধিকারী এবং অত্যন্ত বিনয়ী। নিম্নে তাঁর জীবনের কতিপয় শিক্ষণীয় ঘটনা তুলে ধরা হ’ল-
(১) ‘যতদিন দেহে প্রাণ আছে ততদিন তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে যাব’ :
একদিন এক ইসলামী জালসায় মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) তাওহীদ ও রিসালাতের উপরে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। শ্রোতামন্ডলী অত্যন্ত আগ্রহভরে তার বক্তব্য শুনছিল। ইত্যবসরে স্টেজের এক প্রান্ত থেকে নিক্ষিপ্ত একটি ইটের টুকরা তাঁর একেবারে নিকটে এসে পড়ে। এভাবে তিন তিনবার স্টেজে ইটের টুকরা নিক্ষেপ করা হয়। আল্লাহর রহমতে একবারও ইট তাঁর শরীরে লাগেনি। বিরোধীরা তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে গালিগালাজ শুরু করে দেয়। তিনি বিদ‘আতীদের এরূপ আচরণে ক্ষুব্ধ না হয়ে বরং মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, ‘বন্ধুরা! আমি ইটের জওয়াব ইট দিয়ে দিতে চাই না। আমি বরং দো‘আ করি, আল্লাহ যেন আপনাদের উপরে রহম করেন! আপনাদেরকে তাওহীদের নে‘মত দান করেন এবং শিরক ও বিদ‘আত থেকে বাঁচান। ভ্রাতৃমন্ডলী! ইট তো দূরের কথা, আপনারা যদি আমার উপর তরবারি চালান, তবুও আমি দাওয়াত ও তাবলীগ থেকে বিরত হব না। যতদিন দেহে প্রাণ আছে ততদিন তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে যাব’।1
(২) এক হিন্দু যুবকের অবিস্মরণীয় স্বীকারোক্তি :
একবার মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে হিন্দুদের সাথে বিতর্ক করার জন্য দাওয়াত দেওয়া হয়। বিতর্কে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে তিনি ট্রেনে যাত্রা শুরু করেন। তার সাথে একজন হিন্দু যুবক ট্রেনে চড়ে। সফরে দু’জন মুসাফিরের পরিচিত হওয়ার ন্যায় তারা পরিচিত হন। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ট্রেনে সার্বক্ষণিক দো‘আ ও যিকির-আযকারে ব্যস্ত ছিলেন। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে তিনি যেসব দো‘আ পাঠ করছিলেন হিন্দু যুবক সেগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল এবং তাঁর কাছ থেকে পঠিত দো‘আগুলির অর্থ জেনে নিচ্ছিল। এভাবে এক পর্যায়ে তারা রেল স্টেশনে এসে নামেন। অমৃতসরীর জন্য স্টেশনে গাড়ি অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সেই হিন্দু যুবককে কেউ রিসিভ করতে আসেনি। অমৃতসরী তাকে ডাকলেন এবং নিজের গাড়িতে বসালেন। যাত্রা শুরু করার পূর্বে অমৃতসরী যানবাহনে চড়ার দো‘আ পাঠ করে নিলেন। যুবকটি এর অর্থ জানতে চাইল। তখন তিনি তাকে পঠিত দো‘আর অর্থ বুঝিয়ে দিলেন। দো‘আর অর্থ যুবকটির মনে গভীরভাবে রেখাপাত করল। পরের দিন নির্ধারিত সময়ে বিতর্ক শুরু হল। অমৃতসরী বিতর্ক মঞ্চে এসে দেখলেন, গতকালের ঐ হিন্দু যুবক তার সাথে বিতর্ক করতে এসেছে। যুবকটি অমৃতসরীকে দেখে তাঁর দিকে এগিয়ে আসল এবং তাঁর সাথে করমর্দন করল। অতঃপর হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বিতর্কের আয়োজকবৃন্দ, প্রশাসনিক লোকজন এবং আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীর সামনে যুবকটি ঘোষণা দিল, ‘ইনি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তি। ইনি আল্লাহকে অত্যধিক স্মরণ করেন। তার মতো ব্যক্তির সাথে আমার মতো অকিঞ্চনের বিতর্ক করা আমার দৃষ্টিতে অপরাধ। তার মতো উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কোন ব্যক্তি তাঁর সাথে বিতর্ক করবে। আর আমি আমার সমপর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে বিতর্ক করব। আমিও আমার স্রষ্টাকে স্মরণ করি। কিন্তু এই ব্যক্তির ধারে-কাছেও আমি যেতে পারব না’। ভরা মজলিসে হিন্দু যুবকের এই স্বীকারোক্তির সাথে সাথেই বিতর্ক সমাপ্ত হল। জনগণ কৃতজ্ঞচিত্তে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।2
(৩) হজ্জ সফরেও অমৃতসরীর হাত থেকে রেহাই পেল না কাদিয়ানীরা :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ১৯২৬ সালে হজ্জব্রত পালন করার জন্য মক্কায় গমন করেন। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি কাদিয়ানীদের ভ্রান্ত মতবাদ খন্ডনে আরবীতে একটি প্রবন্ধ লিখেন। অমৃতসরীর নিজের ভাষায়, ‘আমি মক্কা মুকাররমায় মিসরীয় ‘আল-মানার’ পত্রিকায় দেখি সেখানে কাদিয়ানী মতবাদের খন্ডনে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধটি দেখা মাত্রই আমার ভিতরে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হ’ল। কারণ এটা একেবারেই অসম্ভব যে, কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে আমি কোন বিষয় দেখব আর তাতে নাক গলাব না। চাই আমি মক্কা মুকাররমায় থাকি অথবা মদীনা মুনাওয়ারায়। তাই আমি আরবীতে একটি প্রবন্ধ লিখলাম এবং ‘আল-মানার’ পত্রিকার সম্পাদক শায়খ রশীদ রিযা মিসরীর নিকট পত্রিকায় ছাপানোর জন্য সেটি পাঠালাম। ২৭তম বর্ষ ৩য় সংখ্যা ৩০শে যুল‘ক্বাদাহ ১৩৪৪হিঃ/১১ই জুন ১৯২৬ সালেأمْرُ الْقَادِيَانِيِّ قَدْ فُصِلَ ‘গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়ছালা হয়ে গেছে’ শিরোনামে সেটি প্রকাশিত হয়’।3
(৪) ‘আমাকে হাজী বলবেন না’ :
হজ্জ সম্পাদন করার পর সমাজে হাজীদেরকে হাজী ছাহেব, আলহাজ প্রভৃতি লকব দেওয়া হয়। অনেকে তাদের নামের আগে আলহাজ না বললে বা না লিখলে ক্রুদ্ধ হন। ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ছিলেন এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কেউ তাকে হাজী বা আলহাজ বলুক এটা তিনি একেবারেই অপসন্দ করতেন। তিনি একে ‘রিয়া’ বা লৌকিকতা এবং নিজের ফরয আমলকে বরবাদ করার নামান্তর মনে করতেন। এমনকি তিনি সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকায় একবার এই ঘোষণা দেন, ‘হাজী লকবের বিষয়ে আমি অনেকবার বন্ধুদের নিকট আরয করেছি যে, আমাকে হাজী বলবেন না। চিঠিপত্র ও জালসার পোস্টারে যেন আমার নামের আগে হাজী লেখা না হয়। অন্যথা ভবিষ্যতে আমি এরূপ কোন পত্রের জবাব দিব না এবং এমন কোন জালসাতেও অংশগ্রহণ করব না’।4
(৫) বড়দের প্রতি সম্মানবোধ :
মাওলানা সাইয়িদ সুলায়মান নাদভী (১৮৮৪-১৯৫৩) বলেন, একবার মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী দারুল উলূম নাদওয়াতুল ওলামা লাক্ষ্ণৌয়ে আসেন। আমি তখন দারসে ছিলাম। তাঁকে আসতে দেখে দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু তিনি আমার পরিবর্তে আমার শিক্ষক শামসুল ওলামা মাওলানা হাফীযুল্লাহ (রহঃ)-এর দিকে অগ্রসর হলেন এবং হাদীছের এই অংশটুকু পাঠ করলেন, كَبِّرِ الْكُبْرَ ‘তুমি বড়দের সম্মান করবে’ (বুখারী হা/৬১৪২)।5
(৬) ঘাতকের পরিবারের ব্যয় নির্বাহ :
১৯৩৭ সালের ৪ঠা নভেম্বর মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী এক জালসায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে অমৃতসরের মসজিদে মুবারকে গমন করেন। সেখানে পৌঁছার পর ‘টাঙ্গা’ (ঘোড়াবাহিত দুই চাকার গাড়ি) থেকে নামার সাথে সাথেই কামার বেগ নামক জনৈক ব্রেলভী তরুণ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ শ্লোগান দিয়ে ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। ঘটনার প্রায় তিন মাস পর ঘাতক কলকাতায় গ্রেফতার হয়। ১৯৩৮ সালের ৬ই এপ্রিল আদালত তাকে চার বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করে। অমৃতসরী এতে খুশী হওয়ার পরিবর্তে দুঃখিত হন। তিনি সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকায় একবার লিখেন, ‘সত্য বলছি, আমি ঠান্ডা জায়গায় ফ্যানের বাতাস খাওয়ার সময় এবং ঠান্ডা পানি পান করার সময় অপরাধীর প্রতি দয়ার উদ্রেক হয়। মনে মনে ভাবি, সে জেলের মধ্যে কিভাবে সময় কাটাচ্ছে। আল্লাহ তাকে তওবার তৌফিক দিন’।6
কামার বেগ তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়। জনৈক ব্যক্তির মাধ্যমে জেলখানা থেকেই সে অমৃতসরীর কাছে ক্ষমা চায়। এদিকে অমৃতসরী জানতে পারেন যে, কামার বেগের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তার অনুপস্থিতিতে তার পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করার মতো কেউ নেই। ফলে সে জেলে থাকা অবস্থায় তিনি অত্যন্ত গোপনে পুরা চার বছর তার পরিবারের খরচ বহন করেন। কামার বেগ এ কথা জানার পর অত্যন্ত লজ্জিত হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী হিজরত করে পাকিস্তানের সারগোদাতে চলে আসেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। কামার বেগও সারগোদায় হিজরত করেন। তিনি প্রত্যেক দিন সকালে অমৃতসরীর কবরে গিয়ে তাঁর মাগফিরাতের জন্য দো‘আ করতেন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন।7
(৭) এক হিন্দুর চিকিৎসা খরচ বহন :
একবার অমৃতসরের এক হিন্দু অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী তাকে দেখতে যান এবং দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন বলে তাকে সান্ত্বনা প্রদান করেন। যখন অমৃতসরী জানতে পারেন যে, তার নিকটে চিকিৎসা করার মতো কোন টাকা-পয়সা নেই, তখন তার জন্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন এবং জনৈক আতর বিক্রেতাকে বলেন, এই ব্যক্তির যে ঔষধ লাগবে তার ব্যবস্থা করবে এবং আমার নামে তার মূল্য লিখে রাখবে।8
(৮) হালাক রিযিকের প্রতি গুরুত্বারোপ :
একদা এক ব্যক্তি পিঠে জ্বালানী কাঠের বোঝা নিয়ে সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকার দফতরে আসে। মাওলানা অমৃতসরী তাকে দেখেই মুচকি হাসি দেন এবং এই হাদীছটি পাঠ করেন,لأَنْ يَحْتَطِبَ أَحَدُكُمْ حُزْمَةً عَلَى ظَهْرِهِ خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ أَحَدًا ، فَيُعْطِيَهُ أَوْ يَمْنَعَهُ ‘তোমাদের কারো পক্ষে এক বোঝা লাকড়ি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নেয়া কারো নিকট চাওয়ার চেয়ে উত্তম। কেউ তাকে দিতেও পারে, আবার নাও দিতে পারে’ (বুখারী হা/২০৭৪)।
হাদীছটি শুনে বহনকারী নিজে এবং অন্যরা হেসে ওঠে। কিন্তু অমৃতসরী দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘হালাল উপার্জন বাস্তবিকই ভিক্ষাবৃত্তির চেয়ে উত্তম। আর ভিক্ষুক সর্বদা অপমানিত হয়’।9
(৯) খেয়ানতকারীর পক্ষাবলম্বন করা ঠিক নয় :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী অত্যন্ত পরহেযগার ও আমানতদার ছিলেন। লোকজন তার নিকট মূল্যবান অলংকার, নগদ অর্থ প্রভৃতি জমা রাখত এবং যখন প্রয়োজন হত নিয়ে যেত। তিনি তার বক্তব্যে মুসলমানদেরকে পরহেযগারিতা অবলম্বনের এবং অন্যের আমানত ফিরিয়ে দেয়ার জোর তাগিদ দিতেন। খেয়ানতকারীকে তিনি মোটেই প্রশ্রয় দিতেন না। বরং তাকে সর্বদা এড়িয়ে চলতেন এবং বলতেন, وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِيْنَ خَصِيْمًا ‘আর তুমি খেয়ানতকারীদের পক্ষে বাদী হয়ো না’ (নিসা ৪/১০৫) অনুযায়ী খেয়ানতকারীদের পক্ষাবলম্বন করা ঠিক নয়।
একবার এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এক হাযার টাকা আমানত রেখে যান। একদিন তিনি সেই টাকা ফেরৎ নেওয়ার জন্য আসেন। কিন্তু সেদিন অমৃতসরী অফিসে ছিলেন না। তার সেক্রেটারী লোকটিকে বলেন, অন্য কোন দিন আসুন! মাওলানার অনুমতি ছাড়া টাকা দেওয়া যাবে না।
অন্য একদিন ঐ ব্যক্তি এসে মাওলানাকে বলেন, ইতিপূর্বে আমি আপনার নিকট এসেছিলাম। কিন্তু আপনি সেদিন অফিসে ছিলেন না। তাই আপনার সেক্রেটারী আমাকে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। একথা শুনে অমৃতসরী সেক্রেটারীকে বলেন, তুমি যেহেতু আমার হিসাব রাখো এবং তুমি জানতে যে, এই ব্যক্তি টাকা আমানত রেখে গেছেন, তাহলে কেন তার আমানত তাকে ফিরিয়ে দিলে না? স্মরণ রাখ আল্লাহর বাণী وَلَا تُجَادِلْ عَنِ الَّذِينَ يَخْتَانُونَ أَنْفُسَهُمْ إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ خَوَّانًا أَثِيْمًا ‘আর যারা নিজেদের মধ্যে খেয়ানত করে, তুমি তাদের পক্ষে বিতর্ক করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন খেয়ানতকারী পাপীকে ভালবাসেন না’ (নিসা ৪/১০৭)।
(১০) আমানত আদায় করার তাগিদ প্রদান :
একবার তিনি দু’জন মুসলমানকে ঝগড়া করতে দেখেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে, একজন আরেকজনের কাছে কিছু টাকা আমানত রেখেছিল। কিন্তু সে তা ফেরৎ দিতে চাচ্ছে না। এমনকি অস্বীকার করছে। তখন অমৃতসরী তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এই হাদীছটি শুনান, أَدِّ الأَمَانَةَ إِلَى مَنِ ائْتَمَنَكَ وَلاَ تَخُنْ مَنْ خَانَكَ ‘যে তোমার কাছে কিছু আমানত রেখেছে তা ফিরিয়ে দাও। আর যে তোমার খেয়ানত করেছে তুমি তার খেয়ানত করো না’ (তিরমিযী হা/১২৬৪; মিশকাত হা/২৯৩৪)।10
(১১) নিজের কাফের ঘোষণাকারীর জন্য সুফারিশ!
মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মীর ওয়ায়েয নামক এক ব্যক্তি বিভিন্ন জালসা ও মাহফিলে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে কাফের ঘোষণা করতেন। একদা এই ব্যক্তি মালেরকোটলায় অমৃতসরীকে কাফের ঘোষণা করেন। মালেরকোটলার গভর্ণর বিষয়টি জানতে পেরে তাকে সতর্ক করে দেন এবং দ্বিতীয়বার যেন তিনি এই শহরে প্রবেশ না করেন সেজন্য ফরমান জারী করেন। অনেকদিন পর গভর্ণরের দাওয়াতে অমৃতসরী এক জালসায় বক্তব্য প্রদানের জন্য মালেরকোটলায় আসেন। তার বক্তব্য শোনার জন্য স্বয়ং গভর্ণর জালসা ময়দানে উপস্থিত হন। তিনি অমৃতসরীর বক্তব্য শুনে অত্যন্ত খুশী হন ও তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। অতঃপর গভর্ণর অমৃতসরীকে বলেন, আপনার যদি কোন প্রয়োজন থাকে বা কোন প্রস্তাব থাকে তাহলে আমাকে বলতে পারেন। তখন অমৃতসরী তাকে বলেন, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মীর ওয়ায়েযকে মাফ করে দিন এবং তার উপর থেকে এই শহরে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিন। গভর্ণর অমৃতসরীর এই আবেদন গ্রহণ করেন এবং মীর ওয়ায়েযকে টেলিগ্রাম করে বিষয়টি জানিয়ে দেন।11
(১২) এক কৃপণকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান :
অমৃতসরের এক ধনাঢ্য মুসলিম একবার একটি ভালো কাজে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। একদিন এক মজলিসে মাওলানা অমৃতসরী তার উপস্থিতিতে কৃপণতা ও দানশীলতার উপরে সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেন এবং নিম্নোক্ত হাদীছটি পাঠ করেন, مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيهِ إِلاَّ مَلَكَانِ يَنْزِلاَنِ فَيَقُولُ أَحَدُهُمَا اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا، وَيَقُولُ الآخَرُ اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا ‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাঁদের একজন বলেন, ‘হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ কৃপণকে ধ্বংস করে দিন’ (বুখারী হা/১৪৪২)। অমৃতসরীর বক্তব্য শুনে ঐ কৃপণ ধনী অত্যন্ত লজ্জিত হয় এবং বড় অংকের চাঁদা প্রদান করে।12
(১৩) যাকাতের মাল ছুঁয়েও দেখলেন না অমৃতসরী :
দেশ বিভাগকালীন দাঙ্গায় মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর একমাত্র পুত্র সন্তান মাওলানা আতাউল্লাহ শাহাদাত বরণ করেন। নিজের সহায়-সম্পত্তি, প্রেস, মূল্যবান লাইব্রেরী সবকিছু রেখে মাত্র ৫০ রূপিয়া নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় তিনি স্বপরিবারে হিজরত করে চলে আসেন পাকিস্তানে। এ সময় একদিন চিনিউট (যেলা ঝাংগ)-এর আহলেহাদীছ জামা‘আত যাকাতের পনেরশ টাকা জমা করে তার নিকট পাঠান। তিনি টাকার অংক দেখে বলেন, কি বলব? অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। খুব কষ্টে আছি। কিন্তু তাই বলে যাকাতের মাল খাব তা হতে পারে না। একথা বলে তিনি টাকাগুলো নিতে অস্বীকার করেন এবং খুব কষ্টে দিনাতিপাত করতে থাকেন।13
(১৪) উদারতা :
একবার লুধিয়ানার হানাফীদের সাথে কতিপয় মাসআলায় মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর ঝগড়া হয়। মতদ্বৈততা এতদূর গড়ায় যে, সেখানকার হানাফীরা তাঁর সাথে কথা না বলার এবং দেখা-সাক্ষাৎ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই হানাফীরা লুধিয়ানায় একটি জালসার আয়োজন করেন এবং এক ব্রেলভীর সাথে মুনাযারা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। লুধিয়ানার হানাফীরা মুনাযারার জন্য অমৃতসরীর কাছে টেলিগ্রাম পাঠান। তাদের ধারণা ছিল না যে, তিনি তাদের দাওয়াতে সাড়া দিবেন। হানাফীরা মুনাযারার বিষয়ে অত্যন্ত চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। মাওলানা অমৃতসরী টেলিগ্রাম পাওয়া মাত্রই লুধিয়ানায় এসে হাযির হন এবং হানাফীদের সাথে মু‘আনাকা করেন। এভাবে উদারতার পরিচয় দিয়ে তিনি তাদের হৃদয় জয় করে নেন।14
(১৫) মাওলানা অমৃতসরী ও জুনাগড়ীর রসবোধ :
মৌনাথভঞ্জনে অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স-এর অধিবেশন উপলক্ষ্যে আয়োজকবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন যে, আমন্ত্রিত ওলামায়ে কেরাম ও আলোচকবৃন্দের যার যে বাহন পসন্দ তার জন্য সেই বাহনেরই ব্যবস্থা করা হবে। উক্ত অধিবেশনে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ও মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী অংশগ্রহণ করেন। স্টেশনে গাড়ি থেকে নামার পর তাদেরকে তাদের পসন্দের বাহন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। অমৃতসরী পালকি আর জুনাগড়ী হাতি পসন্দ করেন। যখন তাঁরা নিজ নিজ বাহনে বসে গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করেন তখন মাওলানা জুনাগড়ী মাহুতকে বলেন, মাওলানা অমৃতসরী পালকিতে বসে আগে চলে গেলেন। তুমি হাতিকে একটু দ্রুত হাঁকাও এবং তার পালকিকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাও। মাহুত তার নির্দেশ মতো দ্রুত হাতি হাঁকায়। হাতি যখন অমৃতসরীর পালকির নিকট দিয়ে যাচ্ছিল তখন জুনাগড়ী উচ্চৈঃস্বরে বলেন, وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ ‘আমি আপনার মর্যাদাকে সমুন্নত করেছি’ (শরহ ৪)। অমৃতসরী দ্রুত জবাব দেন,أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ ‘তুমি কি শোনো নি, তোমার প্রভু হস্তীওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন?’ (ফীল ১)।15
(১৬) মজলিসের আদব ও অমৃতসরীর কথার প্রভাব :
এক জালসায় সভাপতি ছাহেব শ্রোতামন্ডলীকে জায়গা প্রশস্ত করে বসতে বলেন। কিন্তু লোকজন সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে পূর্বের মতোই বসে থাকে। জনগণের এ অবস্থা দেখে মাওলানা অমৃতসরী উঠে দাঁড়ান এবং বলেন, সম্মানিত ভ্রাতৃমন্ডলী! কমপক্ষে কুরআনী বিধান তো আপনাদের মনে রাখা উচিত। মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قِيلَ لَكُمْ تَفَسَّحُوا فِي الْمَجَالِسِ فَافْسَحُوا يَفْسَحِ اللهُ لَكُمْ وَإِذَا قِيلَ انْشُزُوا فَانْشُزُوا يَرْفَعِ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমাদের বলা হয় মজলিস প্রশস্ত করে দাও, তখন তোমরা সেটি কর। আল্লাহ তোমাদের জন্য প্রশস্ত করে দিবেন। আর যখন বলা হয়, উঠে যাও, তখন উঠে যাও। তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা ভালভাবে খবর রাখেন’ (মুজাদালা ৫৮/১১)। এ আয়াত শুনে মানুষজন জায়গা প্রশস্ত করে বসে।16
(১৭) এক শিখের সাথে উত্তম আচরণ :
একবার এক জালসায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে তিনি ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণীতে সফর করছিলেন। একই বগিতে এক শিখ যাত্রী ছিলেন। তিনি নিজ আসন থেকে উঠার সময় ট্রেনের ছাদের সাথে প্রচন্ড ধাক্কা লাগে। এর ফলে ঐ ব্যক্তি মাথা ঘুরে পড়ে যান এবং ব্যথায় কাতরাতে থাকেন। তার এ অবস্থা দেখে মাওলানা অমৃতসরী তার কাছে ছুটে যান, তাকে উঠিয়ে বসান এবং সিটের উপর শুইয়ে দেন। তারপর তার মাথা ও পা টিপে দেন এবং শরীর মালিশ করে দেন। অথচ ঐ শিখ মাওলানাকে এসব করতে নিষেধ করছিলেন। অমৃতসরী তাকে জবাব দেন, ‘সরদার ছাহেব! ইসলাম শুধু মুসলমানদের খিদমত করার নির্দেশ দেয়নি; বরং সকল বনু আদম ও সকল ধর্মের অনুসারীদের সাথে সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। তাই আমি দয়াপরবশ হয়ে আপনার সাথে সদাচরণ করেছি তা নয়। বরং এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,ارْحَمُوا مَنْ فِى الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ ‘তোমরা যমীনবাসীর উপর দয়া করো, তাহ’লে আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের উপর দয়া করবেন’ (তিরমিযী হা/১৯২৪; মিশকাত হা/৪৯৬৯)।17
(১৮) আতিথেয়তা :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী অত্যন্ত বিনয়ী ও অতিথিপরায়ণ ছিলেন। এ সম্পর্কে অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটি হ’ল, দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে তাঁর সহপাঠী ছিলেন মাওলানা খায়রুদ্দীন হানাফী দেওবন্দী। তিনি মূলতঃ আফগানিস্তানের গযনীর অধিবাসী ছিলেন। সেখান থেকে হিজরত করে বিহারের গয়ায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মাওলানা খায়রুদ্দীন বলেন, আমি আমার প্রিয় জন্মভূমি আফগানিস্তানের গযনীতে বেড়াতে যাই। ফেরার পথে মাওলানা ছানাউল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা পোষণ করি। কিন্তু মনে মনে ভাবি, তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ। চতুর্দিকে তার সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। হয়ত তিনি আমাকে চিনতে পারবেন না।
এসব সাতপাঁচ ভাবার পরও আমি মাওলানার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে অমৃতসরে অবতরণ করি এবং তাঁর বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করি। তাঁর বাড়িতে পৌঁছার পর দরজার নিকট এক ব্যক্তির সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। আমি তার মাধ্যমে মাওলানার কাছে খবর পাঠায় যে, গয়ার মাওলানা খায়রুদ্দীন আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। কিছুক্ষণ পরেই দেখি, মাওলানা ছাহেব হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি আমাকে সালাম দিলেন এবং আমার সাথে মুছাহাফা ও কোলাকুলি করলেন। আমাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে তার কামরায় নিয়ে গেলেন এবং দারুণ আতিথেয়তা প্রদান করলেন। আমার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায় তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং কিছুদিন তার বাড়ীতে থাকার জন্য বললেন। কিন্তু তার অনুরোধ রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। এদিকে গয়ায় যাওয়ার ট্রেনের টিকিট কাটা থাকায় আমি ট্রেন ধরার সময় হাতে রেখে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনের দিকে রওয়ানা হলাম। ট্রেন আসতে বিলম্ব হওয়ায় ওয়েটিং রুমে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দেখি মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী একজন ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি বাড়ী থেকে আমার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছেন এবং আমাকে তা খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলেন। অতঃপর তিনি আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। তাঁর আন্তরিকতা, ভালবাসা ও আতিথেয়তায় আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হলাম। অথচ তিনি ছিলেন অত্যন্ত ব্যস্ত ও একজন প্রসিদ্ধ আলেমে দ্বীন। এই বিনয়-নম্রতা তার উচ্চ মর্যাদার এক অনন্য নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর উপরে রহম করুন’।18
(১৯) এক বিদ‘আতী মৌলভীর প্রশ্ন :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী একবার আঞ্জুমানে ইসলামিয়া জম্মুর বার্ষিক জালসায় শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেন এবং গায়রুল্লাহর পূজাকারী মুসলমানদেরকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেন। জালসা শেষ হওয়ার পর তিনি নিজ অবস্থানস্থলে ফিরে এলে বহু মানুষের সামনে এক বিদ‘আতী মৌলভী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, মাওলানা ছাহেব! কুরআন মাজীদে আল্লাহর অলীগণকে জীবিত বলা হয়েছে। অথচ আপনি জীবিত ব্যক্তির নিকট সাহায্য চাওয়া এবং মনস্কামনা পূরণের নিবেদন জানানোকে নিষেধ করছেন?
বিদ‘আতী মৌলভীর এ প্রশ্ন শুনে অমৃতসরী চিরাচরিত মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, মৌলভী ছাহেব! আপনার আপত্তি সম্পূর্ণ যৌক্তিক। আমরা মৃত ব্যক্তিদের ইবাদত করা ও তাদের নিকট সাহায্য চাওয়া থেকে এজন্য নিষেধ করি যে, আমাদের আক্বীদা অনুযায়ী তাদের শরীর, গোশত, হাড্ডি, চামড়া জীবিত নয়। স্রেফ তাদের রূহ সমূহ, তাদের নাম ও কর্ম জীবিত। কুরআনের পরিভাষায় শহীদগণ, অলিগণ, সত্যবাদীগণ এবং নবী-রাসূলগণের অমর জীবনের মর্ম হল, তারা আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের জন্য যে কাজ ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেজন্য তাদের নাম চিরদিন জীবিত ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাছাড়া মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু তোমরা তা বুঝ না’ (বাক্বারাহ ২/১৫৪)। সেই জীবনের স্বরূপই যখন আপনার জানা নেই তখন দুনিয়াবী জীবনের সাথে তুলনা করছেন কেন? আপনি যদি দৈহিকভাবে জীবিত থাকার কারণে মনস্কামনা ও প্রয়োজন পূরণের জন্য তাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করেন এবং তাদের কাছে মাথা নত করেন, তাহলে তো আপনাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবাণু থেকে শুরু করে বৃহদাকার হাতির পূজা করতে হবে। বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞান তো প্রমাণ করছে যে, উদ্ভিদ ও জড় বস্ত্তর মধ্যেও জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে। যেসব জিনিস বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমরা প্রাণহীন মনে করি সেগুলিরও জীবন আছে। আর এ কারণেই এগুলি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তাহলে আপনি কি এখন পাথর ও গাছের পূজা করবেন? মুশরিকদের মতো তাদেরকেও প্রয়োজন পূরণকারী মনে করুন। আপনাকে কে বাধা দিবে? তবে এজন্য আপনাকে সর্বাগ্রে কুরআন মাজীদ থেকে তাওহীদের আয়াতগুলিকে বাদ দিতে হবে এবংوَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে…’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৫) এ জাতীয় বিধান ও মাসআলাগুলিকে কুরআন থেকে অপসারণ করতে হবে। বিদ‘আতী মৌলভী অমৃতসরীর এই সমুচিত জবাব শুনে লা-জওয়াব হয়ে অপমানের ঘাম মুছতে মুছতে সেখান থেকে প্রস্থান করে।19
(২০) ‘যখন দু’জন মুসলমান পরস্পর জগড়া করে তখন আমি খুব কষ্ট পাই’ :
একবার মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী একটি জালসায় অংশগ্রহণ করেন। জালসা শেষে তিনি বিশ্রামস্থলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় দু’জন আলেম পরস্পর ঝগড়া শুরু করে দেন। ঝগড়া এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, তারা পরস্পর মারমুখী হয়ে উঠেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি দ্রুত খাট থেকে নেমে আসেন এবং তাদের দু’জনের মাঝে বসে বলেন, ভাই ঝগড়া করবেন না। যা বলার আমাকে বলুন! যখন দু’জন মুসলমান পরস্পর ঝগড়া করে তখন আমি খুব কষ্ট পাই। আমার ভয় হয় পূর্ববর্তী জাতি সমূহের মতো মুসলমানরাও যেন পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ ও মারামারি করে ধ্বংস হয়ে না যায়। তিনি দু’জনের মাঝে মীমাংসা করে দেন এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সেখান থেকে উঠেননি যতক্ষণ না তারা ভবিষ্যতে পরস্পর মিল-মহববতের সাথে থাকার অঙ্গীকার করেন। এরপর তিনি তার জায়গায় ফিরে আসেন।
এ সময় এক ব্যক্তি অমৃতসরীকে বলে, মাওলানা আপনি অযথা মেহনত করে এদের দু’জনের মধ্যে মীমাংসা করে দিলেন। আমাদেরকে তামাশা দেখতে দিলেন না। তার এ কথা শুনে মাওলানা অমৃতসরী তাজ্জব বনে গেলেন এবং তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি যদি শিক্ষিত না হতেন তাহলে আমি আপনাকে মূর্খ বলতাম। আপনি কোন কিসিমের মানুষ যে, দু’জন মুসলমানের ঝগড়াকে ‘তামাশা’ বলছেন এবং আগ্রহ সহকারে তাদের ঝগড়া দেখছেন। অথচ তাদের সামান্য ঝগড়াও মুসলিম উম্মাহর জন্য দুর্বলতা, বিশৃঙ্খলা, নিফাক ও দলাদলির কারণ হতে পারে। যখন মুসলমানরা পরস্পর ঝগড়া করবে তখন আল্লাহর নির্দেশ হল,وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ، ‘তোমরা পরস্পরে আপোষ মীমাংসা করে নাও। আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (আনফাল ৮/১)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ‘যদি মুমিনদের দুই দল পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহ’লে তোমরা তাদের মধ্যে সন্ধি করে দাও’ (হুজুরাত ৪৯/৯)। সুতরাং যে ব্যক্তি মুসলমানদের আপোষে লড়াই দেখে খুশী হয়, তাদেরকে বাধা দেয় না এবং তাদের মাঝে আপোষ মীমাংসা করে দেয় না, সে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের আনুগত্যকারী নয় এবং পূর্ণ মুসলমানও নয়। সে কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধিতা করে’।20
পরিশেষে বলা যায়, মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী জ্ঞানে-গুণে একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিনয়-নম্রতা, কোমলতা, আতিথেয়তা, সাহসিকতা, আমানতদারিতা, আল্লাহভীরুতা প্রভৃতি গুণে তিনি বিভূষিত ছিলেন। তাঁর জীবনের উল্লেখিত ঘটনাগুলো এর প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।
————————————————————————————-
1. সীরাতে ছানাঈ, পঃ ৩২৬-৩২৭।
2. আল-মানার, মিসর, ৩১.১২.১৯৩৩, পৃঃ ৬৩৯-৬৪০; আব্দুল মুবীন নাদভী, আবুল অফা ছানাউল্লাহ আল-আমরিতসারী, পৃঃ ৮৮-৮৯।
3. আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৮১-২৮৩।
4. সাপ্তাহিক আহলেহাদীছ, ২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯২৬; সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ২৯৯-৩০০।
5. ইয়াদে রফতেগাঁ, পৃঃ ৩৬৯-৩৭০।
6. আহলেহাদীছ, অমৃতসর, ৩রা জুন ১৯৩৮, পৃঃ ১৪।
7. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ৭৮-৮২; সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৩২৮-৩৩২; রাসায়েলে ছানাইয়াহ, পৃঃ ১০৭, ১৬৭-১৭৮।
8. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ১৭৪।
9. ঐ, পৃঃ ১৮০।
10. ঐ, পৃঃ ১৮২-১৮৩।
11. নুকূশে আবুল অফা, পৃঃ ৭৬-৭৭।
12. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ১৮৫।
13. ঐ, পৃঃ ৪৭৫।
14. ঐ, পৃঃ ২৮৬।
15. ঐ, পৃঃ ১৬২-১৬৩।
16. ঐ, পৃঃ ১৭৫।
17. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ১৭১-১৭২; আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৪-৮৫।
18. আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৭-৭৮। গৃহীত: দাঊদ রায, হায়াতে ছানাঈ, পৃঃ ১২২-১২৩।
19. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ১৫১-১৫৩।
20. ঐ, পৃঃ ১৭৮-১৭৯।