মা দিবস ও বৃদ্ধাশ্রম : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

লিলবর আল-বারাদী 
ভূমিকা : আমরা শিশুকালে এমন অসহায় মুখাপেক্ষী যে নিজে নিজে কোন কাজ করার শক্তি থাকেনা, আমাদের পিতামাতা আমাদের এই সময় আমাদের অতি যতেœ লালন পালন করেন, তারা কখনও বিরক্ত বোধ করেন না, যদি মনে রাগের ছায়া পড়ে পরক্ষণে বুকে আগলে আদও ও মমতার চাদরে আচ্ছাদিত করে সন্তানকে। আর কোমল পরশে শান্ত হয় সন্তান। পিতামাতা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান, নিজের প্রতি খেয়াল করে না সর্বদা তার সন্তানের চিন্তায় মগ্ন। কিভাবে আমার সন্তান ভূবনে মানুষের মত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠবে? পিতামাতা পৃথিবীর সকল কিছু ছাড় দেয় তার সন্তানের প্রতি লক্ষ্য রেখে।
অথচ আমরা কি করি? আমারা যখন নিজে নিজে চলতে শিখি তখন তাদেরকে ভুলে যায়। যেমনটি পশু পাখিরা করে থাকে। আমদের সংসারে পিতামাতা আমাদের জন্যে বোঝা হয়ে যায়। তাদের নিজেদের কাছে রাখতে চাইনা! তাদের উপর আমরা চরম অবহেলা করি, তাদেরকে আমরা আমাদের সমাজে চলার অযোগ্য মনে করি, আমাদের অফিসের বস/কলিগদের সাথে পরিচয় করে দিতেও লজ্জা বোধ করি। বিদেশী কুকুর আমাদের বাসায় স্থান পেলেও আমাদের পিতামাতার স্থান হয় না। কারণ খুঁজতে গেলে কলবর বেড়ে যাবে। তাই সংক্ষেপে পিতামাতা সেকেলের, তারা আয় করতে পারেনা, ভরন পোষন ও চিকিৎসা খরচ ব্যয় বহুল, তাদের চিন্তা চেতনা প্রগতিশীল নয়, তাদের সংস্পর্শে নতুন প্রজন্ম বড় হলে নিঁচু মনের হবে, সারাক্ষণ তারা এটা সেটার চাহিদা করে, সর্বদা বকবক করে, তারা সংসারের বোঝা, স্বামীর আয়ে একমাত্র স্ত্রীর কর্তৃত্ব, বাসায় রাখার মত যথেষ্ট ঘর নেই। এরকম সহ¯্র অযুহাতে অপদার্থ ছেলে মেয়েরা একটি নিরাপদ স্থানে ফেলে আসে। যে স্থানের নাম বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রমে রাখার পর তাদের কোনো খোঁজ-খবর রাখার প্রয়োজন বোধও করেন না। তাই এভাবে ধুকে ধুকে মাতাপিতা শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে তখন সন্তান তার অবহেলিত পিতা-মাতাকে বেশী বেশী মিস্ (গরংং) করে, যার ফলে গড়ে উঠেছে মা দিবস, বাবা দিবস। ইসলামে কোন দিবস পালনের মাসয়ালা আছে বলে আমার জানা নেই।

মা দিবসের সূচনা : ঐতিহাসিক ও গবেষকগণ লিখেছেন, মা দিবস উদযাপন প্রথম শুরু হয়েছে গ্রিসে। গ্রিকরা তাদের মাতা-দেবীর পূজা করত। যার নাম হল ‘রিয়া’। এটা তারা বসন্তকালীন উৎসবের একটি অংশ হিসাবে উদযাপন করত। প্রাচীন রোমেও এ রকম দিবস উদযাপন করা হতো ‘সাইবল’ দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস মতে ‘সাইবল’ হল সকল দেব-দেবীর মাতা। খৃষ্টপূর্ব প্রায় ২৫০ সালে রোমে ধর্মীয় উৎসব হিসাবে একটি দিবস পালন করা হত, যার নাম ছিল ‘হিলারিয়া’। অর্থাৎ দেবী মাতা ‘রিয়ার’ সম্মানে। এটা উদযাপনের সময় ছিল ১৫ই মার্চ থেকে ১৮ই মার্চ। গ্রিক ও রোমান পৌত্তলিক সমাজে দেব-দেবীর মায়ের প্রতি ধর্মীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানাতে এ সব দিবস পালন করা হত, এটাই পরবর্তীকালে মা দিবস হিসাবে চালু করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
গবেষকগণ তাদের গবেষণায় আরো দেখিয়েছেন যে, রোমানরা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করার ফলে যখন পৌত্তলিক ধর্ম পালনে বাধাগ্রস্ত হল, এবং তারাই খৃষ্টধর্মকে বিকৃত করে তাতে অনেক পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণা প্রবেশ করাল, তখন এরই অংশ হিসাবে খ্রিস্টান পাদ্রি ও ধর্মযাজকরা সংস্কার করে এ দিবসকে মাতা মেরী (মরিয়ম) এর প্রতি সম্মান জানানোর জন্য বরাদ্দ করে দিল। এ থেকে মায়ের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য খ্রিস্টান সমাজে একটি দিবসের প্রচলন শুরু হয়। ১৬০০ খৃষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের যুবক-যুবতীরা এ দিনটাকে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, তাদের জন্য উপহার সামগ্রী ক্রয় ও প্রদান করার জন্য বেছে নেয়। এটা হল ইংল্যান্ডের কথা। আর আমেরিকার ঘটনা একটু ভিন্ন। আমেরিকার এক নারী চিন্তাবিদ, নাম ‘অ্যানম জারাফস’। সে তার মাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। মায়ের ভালোবাসা অক্ষুণœ রাখতে জীবনে বিবাহ করেননি। সে পড়াশোনা করেছেন পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় চার্চ নিয়ন্ত্রিত একটি স্কুলে। তার মায়ের মৃত্যুর দু’বছর বছর পর, সে আন্দোলন শুরু করল যে, মায়ের স্মরণে একদিন সরকারী ছুটি দিতে হবে। তার অনুভূতি হল, মায়েরা সন্তানদের জন্য সারা জীবন যা  করেন, তা সন্তানেরা অনুভব করে না। তাই যদি এ উপলক্ষ্যে একটি ছুটি দেয়া হয়, একটি দিবস পালন করা হয়, তাহলে সন্তানদেরকে মায়ের ভূমিকা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া সম্ভব যাবে। তার আন্দোলনে আমেরিকান কংগ্রেসের অনেক রাজনীতিবিদ একাত্মতা ঘোষণা করে। এ ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালের ১০ই মে প্রাথমিকভাবে আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা, ওকালাহোমা ও পেনসালভানিয়াতে মা দিবস পালন শুরু হয়। ১৯১০ সালে এ সব অঙ্গরাজ্যে সরকারী ভাবে মা দিবস ও তাতে ছুটি পালন শুরু হয়। এটা হল আমেরিকায় মা দিবস পালনের সূচনা।
এরপর ১৯১১ সাল হতে সমগ্র আমেরিকায় সরকারী ভাবে মা দিবস পালিত হয়। আমেরিকান কংগ্রেস ১৯১৩ সালের ১০ই মে এটা সরকারী ভাবে অনুমোদন করে। তারা মে মাসের প্রথম রবিবারকে মা দিবস পালনের দিন হিসেবে নির্ধারণ করে। আমেরিকার অনুকরণে মেক্সিকো, কানাডা, ল্যাটিন আমেরিকা, চীন, জাপান ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শুরু হয় মা দিবস পালন। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রগতিশীল সম্প্রদায় এ দিবস ৮ মে পালনে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। (দৈনিক মানবকন্ঠ, ১২ মে ২০১৩; শিরোনাম: বিশ্ব মা দিবসের ইতিহাস)। আর ঐদিকে ১৯ জুন বিশ্ব পিতাদিবস পালিত হয়।
দেশে দেশে মা দিবস : যদিও আমেরিকায় এটা পালিত হয় মে মাসের প্রথম রবিবার, কিন্তু অন্যান্য দেশে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন, নরওয়েতে মা দিবস পালিত হয় মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার। আর্জেন্টিনায় পালিত হয় অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় রবিবারে। লেবাননে পালিত হয় বসন্তের প্রথম দিনে। দক্ষিণ আফ্রিকায় পালিত হয় মে মাসের প্রথম রবিবারে। ফ্রান্সে ও সুইডেনে পালিত হয় মে মাসের শেষ রবিবারে। জাপানে পালিত হয় মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে। (তদেব)। এখানে প্রতিয়মান হয় যে, তারিখে ভিন্নতা থাকলেও রবিবারে মা দিবস পালনে সকলের ঐক্যমত হয়েছে। এরই মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, এটা খ্রিস্টানদের নিজস্ব সংস্কৃতি। ইসলাম অনুসারীরা কখনো এটা অনুসরণ করতে পারে না। মনে রাখতে হবে আমরা মুসলমান হয়ে অন্য ধর্মালম্বীদের কাছে দায়বদ্ধ নই যে, সকল ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য, দাসত্ব ও অন্ধ অনুকরণ বজায় রাখতে হবে। যারা এ দিবস পালনের মানসিকতা রাখে কেবল তারাই তাদের দলভুক্ত, কিন্তু কোন মুসলমান কোন প্রকার দিবস পালনে উৎসুক হতে পারে না।
মা দিবস পালনের বিধান :
যারা মাকে সর্বদা গুরুত্ব দেয় না কেবল তারাই মা দিবস পালন করে থাকে। অন্যদিকে পিতার প্রতিও তেমন গুরুত্ব থাকে না। অথচ পিতামাতাকে সম্মান করা, ভালোবাসা, তাদের সাথে সদাচরণ করা ফরয। ইসলাম মাকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে অন্য কোন ধর্ম বা সমাজ ততটা দেয়নি। মায়ের জন্য একটি দিবস পালন করলে, তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ইসলাম পিতামাতার জন্য যে গুরুত্ব দিতে বলেছে, তা নিজের স্ত্রী, সন্তানদের চেয়েও বেশী। আর এই দিবস পালন ইসলামে কোন স্থান নেই। যদি স্থান থাকত তবে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের মাঝে সর্বপ্রথম দিবস পালনের রেওয়াজ প্রচলন থাকত। এসম্পর্কে কোন একটি হাদীছ পাওয়া যায় না। বরং যা হাদীছে নেই তা পালন না করার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘোষণা করেছেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا ، فَهْوَ رَدٌّ ‘যে কেউ এমন আমল করবে, যার ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’(বুখারী হা/২০, মুসলিম হা/১৮)। তিনি অন্যত্র বলেছেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ  ‘যে ব্যক্তি আমাদের এ ধর্মে এমন কিছুর প্রচলন করবে, যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’(বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০)।
আজ আমরা অনুকরণ প্রিয় প্রগতিবাদ সুশীল সমাজের প্রগতিশীল মানুষ। বিজাতীয় অনৈতিক সাংস্কৃতিকে বুকে আগলে ধরে নিজেদের ইজ্জত সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিতে প্রস্তুত। মুসলমান হিসাবে ঐ সকল বিজাতীয় আচার অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে চলতে হবে। ছাহাবী আবু অকেদ (রাঃ) বলেন, أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَمَّا خَرَجَ إِلَى خَيْبَرَ مَرَّ بِشَجَرَةٍ لِلْمُشْرِكِينَ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ يُعَلِّقُونَ عَلَيْهَا أَسْلِحَتَهُمْ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ. فَقَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم  سُبْحَانَ اللَّهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى (اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ) وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ  ‘রাসূল (ছাঃ) খায়বার যাত্রায় মূর্তিপূজকদের একটি গাছ অতিক্রম করলেন। তাদের নিকট যে গাছটির নাম ছিল ‘জাতু আনওয়াত’। এর উপর তীর টানিয়ে রাখা হ’ত। এ দেখে কতক ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্যও এমন একটি ‘জাতু আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দিন। রাসূল (ছাঃ) ক্ষোভ  প্রকাশ করলেন, ‘সুবহানাল্লাহ, এ তো মূসা (আঃ)-এর জাতির মত কথা। আমাদের জন্য একজন প্রভু তৈরি করে দিন, তাদের প্রভুর ন্যায়। আমি নিশ্চিত, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমরা পূর্ববর্তীদের আচার-অনুষ্ঠানের অন্ধানুকরণ করবে’ (তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৪০৮)। আজ আমরা যদি মুসলমান হয়ে তাদের আচার-অনুষ্ঠান পালন করি বা অনুকরণ করি তবে আমরা আর মুসলমান থাকব না, আমরা তাদের দলভূক্ত হয়ে যাব। এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ   ‘যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুকরণ করবে, সে ব্যক্তি ঐ জাতিরই একজন বলে গণ্য হবে’ (আহমাদ, আবূ দাঊদ হা/৪৩৪৭)।
মুসলমান এমন একটি জাতি যাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অতিব উৎকৃষ্ট ও সাবলীল। অমুসলিমদের অনুকরণে মা দিবস পালন করার অর্থ হল তাদের আনুগত্য ও সাদৃশ্যতা অবলম্বন করা। যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ, তাদের কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান কিংবা কৃষ্টি-কালচার মুসলমানদের জন্য অনুসরণ করা বৈধ নয়।
বৃদ্ধাশ্রমের সূচনা : বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি বৃদ্ধ+আশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম হলো অবহেলিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জন্য শেষ আবাসস্থল বা শেষ আশ্রয়। তাদের সারাজীবনের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি, শেষ সময়ের সম্মান ও নিরাপত্তা দেয়া হয় এসব বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে তারা নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন। বৃদ্ধাশ্রমে চিকিৎসাসহ সকল সুবিধার ব্যবস্থা আছে। পৃথিবীর  প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘর ছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতারিত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থাই। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থা। ঐতিহাসিকগণ এই বৃদ্ধাশ্রমকে প্রাচীন চীনে গড়ে ওঠা সভ্যতারই অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে বর্তমানে চীন, জাপান ও তাইওয়ানের মত দেশের উচ্চবিত্ত সম্পদশালীরা তাদের পিতামাতাকে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন থেকে নারী কর্মী নিয়োগ করে তাদের তত্ত্বাবধানে রেখে পিতা-মাতার সেবা করেন। সাপ্তাহিক ছুটিতে তাদের পিতামাতাদের সাথে সঙ্গ দেয় এবং প্রয়োজনীয় খোঁজ খবর নেই। (দৈনিক বিজয় সংবাদ, ৩ জানুয়ারী ২০১৫; শিরোনাম: বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক পিতামাতার নিরাপদ আবাস)।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সমগ্র বিশ্বে জীবন প্রত্যাশার মান বৃদ্ধি করে জনমিতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে সারা বিশ্বে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের নর-নারীর গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। একবিংশ শতাব্দীকে কেউ কেউ বার্ধক্যের যুগ বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে বার্ধক্যের মোকাবেলা করা বিশ্ব সমাজের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম ও ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। বার্ধক্য বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ যার মোকাবেলা নিতান্তই কঠিন। জাতিসংঘ ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ হিসাবে জনসংখ্যার ৬.১ শতাংশ প্রবীণ নর-নারী। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ১০.১ শতাংশে। উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশে এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হয়ে দেখা দিবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ সাধারণ পরিবারে বসবাস করেন এবং তাদের ভরণপোষণ, চিকিৎসা ইত্যাদির ভার সন্তানদের ওপর বর্তায়। কিন্তু বর্তমান আধুনিক প্রগতিশীল বস্তুদাবী সমাজে মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবারে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে করে প্রবীণরা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণেরই কোন না কোন সন্তান বাইরে থাকে। অর্থাৎ এদের সঙ্গে পিতামাতার যোগাযোগ খুব কম হয়। এতে করে বৃদ্ধ পিতা-মাতারা আর্থ-সামাজিক সমস্যায় ভোগেন। বাংলাদেশে শতকরা ২০ জন হয় একাকী থাকেন অথবা স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে থাকেন। দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন। বর্তমান সরকার প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করেছে। এ কার্যক্রমের আওতায় ১৭ লাখ দরিদ্র প্রবীণ সাহায্য পাচ্ছে (বাংলাপিডিয়া)।
তবে পিতামাতার এই অবমাননার জন্য দায়ী তারা নিজেরাও। পিতা মাতা ও সন্তান উভয় পবিত্র কুরআন ও সুন্নাত লব্ধ জ্ঞান সন্তানকে যথার্থ শিক্ষা দিতে পারেন না। যে শিক্ষা তাদেরকে তাক্বওয়াশীল করে। পিতামাতার জন্ম নিয়ন্ত্রণের কুফল হিসাবে এ শাস্তি। যদি ঐ পিতামাতা একটি কিংবা দু’টির বেশী সন্তান গ্রহণ করতেন তা হলে তাদের মধ্য থেকে কোন না কোন সন্তান পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পরায়ন হত। সন্তানদের মধ্যে বৈষম্য করা। ইসলামী শরীয়াত মোতাবেক তাদের মধ্যে সুসম বন্টন না করে সন্তানদের মাঝে কম-বেশী করা। আজ যারা বৃদ্ধ তারা নিজেদের জীবনের সকল সময়, ধন সম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তারা পাচ্ছেন না। কখনও দেখা যায় সন্তান তার নিজের পরিবারের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই পিতা-মাতাকে মনে করছে বোঝা। নিজে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটু ভাল থাকার জন্য পিতামাতার ঠাঁই করে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার এমনও দেখা যায় যে সন্তানের টাকা পয়সার অভাব নেই, কিন্তু পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছেন না, বা বোঝা মনে করছেন। হয় নিজেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে, নয়ত অবহেলা দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছেন যেন তাদের পিতা-মাতা নিজেরাই সরে যান তার সাধের পরিবার থেকে। আবার এমনও হয়, টাকার অভাব না থাকলেও তার পর্যাপ্ত সময়ের অভাব, তাই পিতা-মাতার দেখাশুনা করা বা তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো যথেষ্ট সময় নেই। অতএব পন্ডিত সন্তান বৃদ্ধ পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে অন্যদের সঙ্গে একত্রে সময় কাটানোই সুযোগ করে দেয়। একবার বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সকল দায়মুক্ত। এভাবে নানা অজুহাতে পিতা-মাতাকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেক নামী-দামী বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী যারা এক সময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সন্তান বা আত্মীয়-স্বজন আর তাদের কোন খবরও নেন না। তাদের দেখতেও আসেন না, এমনকি প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা বা জিনিসপত্রও পাঠান না। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে বা ঈদের আনন্দের সময়ও পিতা-মাতাকে বাড়িতে নেন না। এমনও শোনা যায়, অনেকে পিতা বা মাতার মৃত্যুশয্যায় বা ইন্তেকালের পরও শেষবারের মতও দেখতে যান না। বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষই কবর দেয়াসহ সকল ব্যবস্থা করেন, অথচ তার প্রিয় সন্তানেরা কোন খবর রাখেন না।
কেইস স্টাডি :
১. সদ্য বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ঐ মা তার ছেলেকে চিঠি লিখেছেন- ‘খোকা তুই কেমন আছিসরে? বউমা আর আমাদের ছোটো দাদুভাই সবাই ভালো আছে তো? জানি তোদের তিন জনের ছোট সংসারে প্রত্যেকেরই খুব কাজ। তবুও তোদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ। একদিন একটু সময় করে এই বুড়ি মাকে দেখতে আয় না! কিরে, আসবি না? ও বুঝতে পেরেছি, এখনো আমার উপর থেকে তোদের অভিমান যায়নি। আমাকে  যেদিন বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলি, সেদিন ঝগড়া করেছিলাম বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমাকে নিতে আসা লোকজনদের সঙ্গে। জানি শেষ দিনটাতে একটু বেশি রকমেরই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম, তাছাড়া আর কী বা আমি করব বল। সময় মতো ওরা এসে আমার জিনিসপত্র সব জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিল, তারপর বারবার তাগাদা দিতে লাগল। আমি তোর সঙ্গে দেখা করে আসার জন্য তাদের কাছে সময় চেয়েছিলাম, তারা সময় দিলেও শেষ পর্যন্ত তুই আসিসনি। তুই কাজে এত ব্যস্ত থাকিস তখন আমার মনে ছিলনা। পরে মনে পড়েছিল, তাই তোর সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছি। তুই রাগ করিসনি তো? আর সেদিন আমার সেই জেদ দেখে বউমা তো রেগেই আগুন। তাছাড়া তার তো রাগবারই কথা। আমাকে নিয়ে যেতে যারা এসেছিলো, তাদের তড়িঘড়িতে পাশের বাড়ি থেকে কেউ কেউ উঁকি দিতে লাগলো। এতে তো বউমার একটু লজ্জাবোধ হবেই। সেদিন তোদের যে অপমান করে এসেছি তোরা সেসব ভুলে যাস কেমন করে? আমার কথা ভাবিস না। আমি খুব ভালো আছি। আর কেনই-বা ভালো থাকবনা বল? তোরা তো আমার ভালো থাকবারই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিস। তবে একটা কথা, আমার কথা যদি তোর কখনো-কোনোদিন মনে পড়ে; তখন যেন নিজেকে তুই শেষ করে দিস না। তুই এখনো একশ বছর বেঁচে থাক’।
২. বৃদ্ধাশ্রম থেকে একজন মায়ের চিঠি আমার আদর ও ভালোবাসা নিও। অনেক দিন তোমাকে দেখি না, আমার খুব কষ্ট হয়। তোমার ছোটবেলার একটি ছবি আমার কাছে রেখে দিয়েছি। ছবিটা দেখে দেখে মনে মনে ভাবি এটাই কি আমার সেই খোকা!’ কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়। আমার জন্য তোমার কী অনুভূতি আমি জানি না। তবে ছোটবেলায় তুমি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে না। আমি যদি কখনও তোমার চোখের আড়াল হতাম মা মা বলে চিৎকার করতে। মাকে ছাড়া কারও কোলে তুমি যেতে না। সাত বছর বয়সে তুমি আমগাছ থেকে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলে। তোমার বাবা হালের বলদ বিক্রি করে তোমার চিকিৎসা করিয়েছেন। তখন তিন দিন, তিন রাত তোমার পাশে না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, গোসল না করে কাটিয়েছিলাম। এগুলো তোমার মনে থাকার কথা নয়। তুমি একমুহূর্ত আমাকে না দেখে থাকতে পারতে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বিয়ের গয়না বিক্রি করে তোমার পড়ার খরচ জুগিয়েছি। হাঁটুর ব্যথাটা তোমার মাঝে মধ্যেই হতো। বাবা… এখনও কি তোমার সেই ব্যথাটা আছে? রাতের বেলায় তোমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে তুমি ঘুমাতে না। এখন তোমার কেমন ঘুম হয়? আমার কথা কি তোমার একবারও মনে হয় না? তুমি দুধ না খেয়ে ঘুমাতে না। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার কপালে যা লেখা আছে হবে। আমার জন্য তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি খুব ভালো আছি। কেবল তোমার চাঁদ মুখখানি দেখতে আমার খুব মন  চায়। তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। তোমার বোন…. তার খবরাখবর নিও। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলো আমি ভালো আছি। আমি দোয়া করি, তোমাকে যেন আমার মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে না হয়। কোনো এক জ্যোস্না ভরা রাতে আকাশ পানে তাকিয়ে জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভেবে নিও।  বিবেকের কাছে উত্তর পেয়ে যাবে। তোমার কাছে আমার শেষ একটা ইচ্ছা আছে। আমি আশা করি তুমি আমার শেষ ইচ্ছাটা রাখবে। আমি মারা গেলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আমাকে তোমার বাবার কবরের পাশে কবর দিও। এজন্য তোমাকে কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। তোমার বাবা বিয়ের সময় যে নাকফুলটা দিয়েছিল সেটা আমার কাপড়ের আঁচলে বেঁধে রেখেছি। নাকফুলটা বিক্রি করে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও।
৩। ২০০৬ সালে অবসর নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক (অব.) ড. এম আব্দুল আউয়ালের (৭০)। দীর্ঘ ১৭ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশা থেকে অবসরের পর কিছুদিন ভালোই চলছিলো তাঁর। অধ্যাপক আব্দুল আউয়ালের সংসারে দুই ছেলে, এক মেয়ে। তিন সন্তানের মধ্যে মেয়ে সবার বড়, নাম রেজিনা ইয়াসিন, আমেরিকা প্রবাসী। এরপর বড় ছেলে উইং কমান্ডার (অব.) ইফতেখার হাসান। সবার ছোট ছেলে রাকিব ইফতেখার হাসান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। জীবনে এতো কিছু থাকার পরও আজ তার দু’চোখে অন্ধকার। থাকেন আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে।
৪। আমেরিকার এক নামকরা ব্যবসায়ী ছিলো। তার টাকা পয়সা, ধন-সম্পদে কোন কিছুরই অভাব ছিলো না। কিন্তু তার মডার্ণ সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারতো না শুধু তার মায়ের জন্য। কারণ তার মা ছিলো অন্ধ ও দেখতে কদাকার। মায়ের মুখে ছিলো আগুনে পোড়া বিশ্রী কালো দাগ। আর মাথার চামড়া পুড়ে চুল ছিলো না। সব মিলিয়ে তার মা একজন কুশ্রী কদাকার সেকেলের মানুষ। তাই মডার্ণ সোসাইটিতে নিজের মান-সম্মান ও আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য মা’কে বাসা থেকে বের করে দিলো। বেচারি একেতো অন্ধ মানুষ তারপরে বৃদ্ধা। কেঁদে কেঁদে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি গাড়ি এসে ধাক্কা দিল, ছিটকে পড়ে বৃদ্ধা মা ঘটনাস্থলে ইন্তেকাল করেন। তার ছেলে জেনে-শুনে কষ্ট পেলো না, ভাবলো আপদ বিদায় হয়েছে । কিছুদিন পর ছেলে তার বিশেষ কিছু কাগজপত্র খুঁজতে খুঁজতে তার মা’র লেখা একটা ডাইরি পেলো । ডাইরিতে লেখা ছিলো; ০৫-১২-১৯৮০ আজ আমি সুন্দরী ‘মিস্ আমেরিকা’ এর খেতাব পেয়েছি। ০২-০৫-১৯৮৩ আজ আমার গর্ভপাত না ঘটানোর জন্য আমার প্রিয় স্বামী আমাকে তালাক দিয়েছে। ০৭-০৩-১৯৮৫ আজ আমার বাড়িতে আগুন লেগেছিলো। আমি বাহিরে ছিলাম। আর আমার কলিজার টুকরা ছেলে বাড়ির ভিতরে ছিলো। নিজের জীবন বাজি রেখে শুধু ছেলের জীবন বাঁচাতে গিয়ে আগুনে আমার চুল এবং মুখমন্ডলসহ আমার সমস্ত সৌন্দর্য ছাই হয়ে গেছে। তথাপী আমার কোন দুঃখ নেই। কিন্তু আমার কলিজার টুকরা ছেলের চোখদুটো আমি বাঁচাতে পারিনি। ০৭-৫-১৯৮৫ আজ আমার নিজের চোখ দুটো আমার ছেলে কে দিতে যাচ্ছি। আজকের পর থেকে আর কখনো ডাইরি লিখতে পারব না। ইতি
এই ডাইরিটি পড়ে ছেলে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে দেওয়ালে মাথা আছড়াতে লাগলো। হায় আজ আমি কি করেছি?
ইসলামের আলোকে পিতা-মাতার গুরুত্ব :
ইসলাম গ্রগতিশীল (চৎড়মৎবংং) হয়েছে ১৪০০ বছর পূর্বে। মহান আল্লাহ সকল বিষয়গুলো বিবেচনা করে মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও সুন্নাত আমাদের জন্য শ্বাশত শারীয়তের বিধান তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের ভাবনা সমন্বয় রেখে ইসলামকে চিরন্তন ও সার্বজনীন প্রগতি হিসাবে আমাদের জন্য মনোনীত ও পূর্ণাঙ্গ করেছেন। আর সেই প্রগতির অংশ বিশেষ হ’ল পিতা-মাতার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ফরয। কেননা মহান আল্লাহ বলেন, وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً ‘আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে’ (আনকাবূত ২৯/৮)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন, وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيْماً، وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْراً-  ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হ’লে তাদেরকে ‘উফ’ বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল’, মমতাবশে তাদের প্রতি ন¤্রতার সাথে পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! দয়া কর তাদের প্রতি যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছিলেন’ (ইসরা ১৭/২৩-২৪)।
পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে হাদীছে অনেক নির্দেশ এসেছে। আর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে বড় গোনাহ বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ. ثَلاَثًا. قَالُوْا بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ. قَالَ الإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ. وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِئًا فَقَالَ أَلاَ وَقَوْلُ  الزُّوْرِ‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহগুলো সম্পর্কে অবহিত করব না? সকলে বললেন, হ্যাঁ, বলুন হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্যতা। অতঃপর তিনি হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসলেন। এরপর বললেন, সাবধান, মিথ্যা কথা বলা’। (বুখারী হা/২৬৫৪; মুসলিম হা/৮৭ তিরমিযী হা/১৯০১)। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, এক বেদুইন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কবীরা গুনাহসমূহ কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, اَلْإِشْرَاكُ بِاللهِ. قَالَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ ثُمَّ عُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ. قَالَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ الْيَمِيْنُ الْغَمُوْسُ. قُلْتُ وَمَا الْيَمِيْنُ الْغَمُوْسُ؟ قَالَ الَّذِىْ يَقْتَطِعُ مَالَ امْرِئٍ مُسْلِمٍ هُوَ فِيْهَا   كَاذِبٌ ‘আল্লাহর সাথে শরীক করা’। সে বলল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘পিতামাতার অবাধ্যতা। সে বলল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘মিথ্যা শপথ করা’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিথ্যা শপথ কি? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা (শপথের সাহায্যে) মুসলিমের ধন-সম্পদ হরণ করে  নেয়’। (বুখারী হা/৬৯২০; আবু দাউদ হা/২৮৭৫)। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম,أَىُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ قَالَ الصَّلاَةُ عَلَى وَقْتِهَا. قَالَ ثُمَّ أَىُّ قَالَ ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ. قَالَ ثُمَّ أَىُّ قَالَ الْجِهَادُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ. ‘কোন আমল আল্লাহর নিকটে অধিক প্রিয়। তিনি বললেন, যথাসময়ে ছালাত আদায় করা। ইবনু মাসউদ (রাঃ) বললেন, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, অতঃপর পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। তিনি বললেন, অতঃপর কোনটি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’। (বুখারী হা/৫২৭; মুসলিম হা/৮৫)। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বললেন, رَغِمَ أَنْفُ ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ. قِيلَ مَنْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَنْ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَيْهِمَا فَلَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ. ‘তার নাক ধূলায় ধুসরিত হোক। তার নাক ধূলায় ধুসরিত হোক। তার নাক ধূলায় ধুসরিত হোক’। বলা হ’ল, কার হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতামাতার একজনকে অথবা উভয়কে বার্ধক্যে পেল, কিন্তু (তাদের সেবা করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না’। (মুসলিম হা/২৫৫১)। এজন্যই বলা হয় পিতামাতা জান্নাতের দরজা। যে ব্যক্তি তাদের আদর-যতœ ও সম্মান করবে, সে জান্নাতের অধিবাসী হবে। পিতামাতা যদি কাফির-মুশরিকদের মত চলাফেরা করে তারপরেও তাদের সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ এবং ইসলামে তা বৈধ। এমর্মে মহান আল্লাহ বলেন, وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوْفًا ‘তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে’ (লোক্বমান ৩১/১৫)। আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, قَدِمَتْ عَلَىَّ أُمِّىْ وَهْىَ مُشْرِكَةٌ، فِىْ عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم، فَاسْتَفْتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قُلْتُ إِنَّ أُمِّىْ قَدِمَتْ وَهِىَ رَاغِبَةٌ، أَفَأَصِلُ أُمِّىْ، قَالَ نَعَمْ صِلِى أُمَّكِ. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট আসলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ফৎওয়া জিজ্ঞেস করলাম, আমার মা আমার নিকটে এসেছেন, তিনি আমার প্রতি (ভাল ব্যবহার পেতে) খুবই আগ্রহী, এমতাবস্থায় আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করব? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তোমার মায়ের সাথে সদাচরণ কর’। (বুখারী হা/২৬২০; মুসলিম হা/১০০৩)।
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুলল্লাহ (ছাঃ) এর দরবারে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসুলুল্ল¬াহ! আমার সুন্দর আচরণের বেশি হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবারও জিজ্ঞেস করল এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা (বুখারী হা/ )।  পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশী যা সন্তান তার সারা জীবন তাদের পেছনে অতিবাহিত করলেও এই দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারবে না। তাই আমাদের শ্লোগান হোক ‘ মা আমার মা, বৃদ্ধাশ্রমে যাবে না’।
শেষ কথা :
ইসলাম সার্বজনীন, চিরন্তন এবং শ্বাশত প্রগতিশীল এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার নামে ধর্মনিরোপেক্ষতাবাদ প্রগতি, তা পরিত্যাজ্য। আর ধ্বজাধারী প্রগতিশীল কিছু মানুষ বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে সন্তানকে তার পিতামাতার নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে সকল কিছু প্রাপ্তির মাঝেও যা পাওয়া যায় না তা হলো নিজের পরিবারের সান্নিধ্য। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তার সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চান। তাদের সঙ্গে জীবনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। সারাজীবনের কর্মব্যস্ত সময়ের পর অবসরে তাদের একমাত্র অবলম্বন এই আনন্দটুকুই। বলা যায় এর জন্যই মানুষ সারা জীবন অপেক্ষা করে থাকে। যারা অবহেলা করে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে ভুলে যান, তাদের স্মরণ রাখা দরকার, এমন সময় তাদের জীবনেও আসতে পারে। যে পিতামাতা একসময় নিজে না খেয়েও সন্তানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায় কেমন আছেন সেই খবর নেয়ার সময় যার নেই তার নিজের সন্তানও হয়ত একদিন তার সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। ঈদের দিনে যখন তারা তাদের সন্তানদের কাছে পান না, এমনকি সন্তানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নীরবে অশ্রুপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এমনকি সেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে কামনা করেন, তার সন্তান তার সঙ্গে যে আচরণ করল, ভবিষ্যতে তার সন্তানও যেন একই আচরণ করে। মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামীদিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে পিতামাতার যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। যদি কোন সন্তান তা পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে সে ইহকালিন শান্তি ও পরোকালিন মুক্তি হরাবে। কারণ ইলম অর্জন কিংবা ইসলামী অনুশাষন ব্যতীত এই ভয়াবহ পরিণতির সমাধান কখনও সম্ভবপর নয়। সন্তানের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজীবন বৃদ্ধ পিতামাতা গোপনে নিরবে নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দিবেন। মনে রেখ, হে আদম সন্তান! পিতামাতা যখন সন্তানের জন্য ভালো/মন্দ দো’আ করেন তখন মহান আল্লাহ ও তাদের মধ্যে কোন পর্দা থাকে না। আজকের এই ধ্বজাধারী আধুনিক প্রগতিশীল সকল সন্তান তথা গোটা জাতীর কাছে প্রশ্ন, মা দিবস, পিতা দিবস পালন কিংবা বৃদ্ধ পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ও তাদেরকে কাঁদানোটা কি প্রগতির নামে প্রহসন নয়?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top