পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে মুমিনের ১৬টি গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে কুরআনে ১০টি মুমিনের গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃত মুমিন হতে গেলে যে দু’টি গুণাবলী অপরিহার্য সেই সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوْا وَجَاهَدُوْا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيْلِ اللهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُوْنَ- (سورت الحجرات ১৫)- ‘প্রকৃত মুমিন তারাই, ১. যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। অতঃপর তাতে কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করে না এবং ২. তাদের মাল ও জান দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে। বস্তুতঃপক্ষে তারাই হ’ল সত্যনিষ্ঠ’ (হুজুরাত ৪৯/১৫)। আর সফলকাম মুমিন হতে গেলে নিচের গুণাবলীগুলো প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকতে হবে এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ- الَّذِينَ هُمْ فِي صَلاَتِهِمْ خَاشِعُوْنَ- وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ- وَالَّذِيْنَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُوْنَ- وَالَّذِيْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حَافِظُوْنَ- إِلاَّ عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُوْمِيْنَ- فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعَادُوْنَ- وَالَّذِيْنَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُوْنَ- وَالَّذِيْنَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ- أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُوْنَ- الَّذِيْنَ يَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُوْنَ- ‘সফলকাম হ’ল ঐসব মুমিন’ ৩. ‘যারা তাদের ছালাতে গভীরভাবে মনোযোগী’ ৪. ‘যারা অনর্থক ক্রিয়া-কর্ম এড়িয়ে চলে’ ৫. ‘যারা সঠিকভাবে যাকাত আদায় করে’ ৬. ‘যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে’ ৭. ‘নিজেদের স্ত্রী ও অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত। কেননা এসবে তারা নিন্দিত হবে না। অতঃপর এদের ব্যতীত যারা অন্যকে কামনা করে, তারা হ’ল সীমা লংঘনকারী’ ৮. ‘আর যারা তাদের আমানত ও অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করে’ ৯. ‘যারা তাদের ছালাত সমূহের হেফাযত করে’। ‘তারাই হ’ল উত্তরাধিকারী’। ‘যারা উত্তরাধিকারী হবে ফেরদৌসের। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (মুমিনূন ২৩/১-১১)। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللهِ ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। ১০. তোমরা ন্যায়ের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)।
অতঃপর মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ ৬টি গুণ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِى حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِى حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। (১) সে তার উপর যুলুম করবে না (২) তাকে লজ্জিত করবে না। (৩) আর যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকবে, আল্লাহ তার সাহায্যে থাকবেন। (৪) যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিনের বিপদ সমূহের একটি বড় বিপদ দূর করে দিবেন। (৫) যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন’ وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্যে অতক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে’ (৬) যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না ও বড়দের মর্যাদা বুঝে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ ।
ইমাম আবূদাঊদ (রহঃ) বলেন, ‘মানুষের দ্বীনের জন্য চারটি হাদীছ যথেষ্ট : (১) সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল (২) সুন্দর ইসলামের অন্যতম নিদর্শন হ’ল অনর্থক বিষয়সমূহ পরিহার করা (৩) কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য ঐ বস্তু ভালবাসে যা সে নিজের জন্য ভালবাসে এবং (৪) হালাল স্পষ্ট ও হারাম স্পষ্ট। এ দু’য়ের মধ্যে বহু বস্তু রয়েছে অস্পষ্ট। অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। অতএব যে ব্যক্তি সন্দিগ্ধ বিষয়ে পতিত হ’ল সে হারামে পতিত হ’ল’ ।
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, اتَّقِ السَّيِّئَاتِ، وَازْهَدْ، وَدَعْ مَا + لَيْسَ يَعْنِيكَ، وَاعْمَلَنَّ بِنِيَّةْ + عُمْدَةُ الدِّينِ عِنْدَنَا كَلِمَاتٌ + أَرْبَعٌ قَالَهُنَّ خَيْرُ الْبَرِيَّةْ ‘আমাদের নিকট দ্বীনের উত্তম বস্তু হ’ল চারটি কথা। যা বলেছেন সৃষ্টির সেরা ব্যক্তি (অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ) : (১) মন্দ থেকে বেঁচে থাক (২) দুনিয়াত্যাগী হও (৩) অনর্থক বিষয় পরিহার কর এবং (৪) সংকল্পের সাথে কাজ কর’ ।
মুমিন ব্যক্তির উচিৎ অনর্থক কথা ও কাজ এড়িয়ে চলা’। শিরক ও বিদ‘আতসহ সকল প্রকার পাপের কাজ ও বাজে কথাসমূহ এর মধ্যে শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِذَا مَرُّوْا بِاللَّغْوِ مَرُّوْا كِرَامًا ‘যখন তারা অসার ক্রিয়া-কলাপের সম্মুখীন হয়, তখন তারা সম্মান বাঁচিয়ে তা অতিক্রম করে’ (ফুরক্বান ২৫/৭১)। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لاَ يَعْنِيْهِ ‘মানুষের সুন্দর ইসলামের অন্যতম নিদর্শন হ’ল অনর্থক বিষয়সমূহ পরিহার করা’। (ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৬; মিশকাত হা/৪৮৩৯)
একজন মুসলিমের ঈমান এবং ইসলামের পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের সামগ্রিক রূপ হলো- সকল প্রকার অনর্থক অহেতুক কথাবার্তা এবং কর্ম বর্জন করা। সে আল্লাহর সকল নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অনুরূপ সে সকল নিষেধাজ্ঞা থেকে সর্বদার জন্য দূরে থাকবে। হাদীসে উল্লেখিত تَرْكُهٗ مَا لَا يَعْنِيهِ এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘আল্লামা গাযালী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ যেক্ষেত্রে তুমি নীরব থাকলে তোমার জীবন এবং সম্পদের কোন ক্ষতি হয় না, সেগুলোও বর্জন করে চলা। যেমন তুমি কোন বৈঠকে তোমার কোন সফরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তোমার দেখা নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, খানা-পিনা এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিদ্বানদের নানা ঘটনা প্রবাহ বর্ণনা করছ। তুমি যখন এগুলো বর্ণনা করবে তখন তাতে থাকবে অতিরঞ্জন, বাড়াবাড়ী, গীবত-নিন্দা ইত্যাদি। সর্বোপরি ঐ সময়টুকু তুমি তো আল্লাহর জিকর থেকে বিরত থাকলে, যা ছিল তোমার জন্য কল্যাণকর।
হাদীসে উল্লেখ আছে, জান্নাতীগণ দুনিয়ায় আল্লাহর জিকরবিহীন যে সময় কাটিয়েছে তার জন্য যেরূপ আফসোস করবে এরূপ আফসোস আর অন্য কিছুর জন্যই করবে না। সুতরাং কোন কথা না বলে চুপ থাকাই নিরাপদ। এটা ঈমানের হিফাযাত এবং তাকওয়া। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৩১৭)