পৃথিবীতে মানুষে মানুষে পার্থক্যের মানদণ্ড হ’ল ঈমান। যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী, তারা ইহকাল ও পরকালে সফল। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহতে অবিশ্বাসী, তারা ইহকাল ও পরকালে বিফল। ঈমানদারের সকল কাজ হয় আখিরাতমুখী। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীদের সকল কাজ হয় প্রবৃত্তিমুখী। দু’জনের জীবনধারা হয় সম্পূর্ণ পৃথক। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা রাসূলদের পাঠিয়ে থাকি এজন্য যে, তারা মানুষকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করবে। এক্ষণে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও নিজেকে সংশোধন করে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা কোনরূপ চিন্তান্বিত হবে না’। ‘পক্ষান্তরে যারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে, তাদের পাপাচারের কারণে তাদের উপর শাস্তি আপতিত হবে’ (আন‘আম ৬/৪৮-৪৯)।
ঈমানের পরিচয় :
‘ঈমান’ অর্থ নিশ্চিন্ত বিশ্বাস, নিরাপত্তা দেওয়া, যা ভীতির বিপরীত (জাওহারী, আছ-ছিহাহ ৫/২০৭১; ফিরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত, পৃঃ ১১৭৬)। অন্যত্র এসেছে, ‘ঈমান’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো অন্তরে বিশ্বান, মুখে স্বীকৃতি দেয়া, সত্যায়ন করা ইত্যাদি।
রাগেব আল-ইছফাহানী (রহঃ) বলেন, ‘ঈমানের মূল অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি এবং ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাওয়া’ (আল-মুফরাদাত, পৃঃ ৩৫)। সন্তান যেমন পিতা-মাতার কোলে নিশ্চিন্ত হয়, মুমিন তেমনি আল্লাহর উপরে ভরসা করে নিশ্চিন্ত হয়।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ ও আমলের মাধ্যমে (আছ-ছারিম আল-মাসলূল, পৃঃ ৫১৯)।
পারিভাষিক অর্থ : আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতে, ‘ঈমান’ হ’ল অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম, যা আনুগত্যে বৃদ্ধি হয় ও গুনাহে হ্রাস হয়। প্রথম দু’টি মূল ও শেষেরটি হ’ল শাখা, যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না (ইবনু মান্দাহ, কিতাবুল ঈমান ১/৩৩১; আহলেহাদীছ আন্দোলন মনোন্নয়ন সিলেবাস, পৃঃ ১১)।
উল্লেখ্য যে, ‘ঈমান’ ধারনকারী ব্যক্তিকে ঈমানদার বলা হয়। আর ঈমানদার ঐসকল ব্যক্তি যারা অদৃশের প্রতি না দেখেই অকপটে ইলাছের সাথে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। মুমিনের বিশ্বাসের ছয়টি ভিত্তি : যথা- أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ. ‘আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম (১) আল্লাহ উপরে (২) তাঁর ফেরেশতাগণের উপরে (৩) তাঁর প্রেরিত কিতাব সমূহের উপরে (৪) তাঁর রাসূলগণের উপরে (৫) ক্বিয়ামত দিবসের উপরে এবং (৬) আল্লাহ্র পক্ষ হ’তে নির্ধারিত তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে’ (হাদীছে জিব্রীল, মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২ ‘ঈমান’ অধ্যায়)।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ছাহাবীগণ বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মনের মধ্যে এমন কিছু চিন্তার উদ্রেক হয় যা সূর্য ঊদিত হওয়ার পরিধির মধ্যকার (মূল্যবান) সবকিছুর বিনিময়েও কথায় প্রকাশ করা আমরা মোটেও সমীচীন মনে করি না। তিনি জিজ্ঞেস করেন, وَقَدْ وَجَدْتُمُوهُ. ‘তোমরা কি তা অনুভব করো? তারা বলেন, হাঁ। তিনি বলেন, ذَاكَ صَرِيحُ الإِيمَانِ. ‘এটিই ঈমানের সুস্পষ্ট পরিচয়’(আদাবুল মুফরাদ হা/১২৯৬)।
মুমিন বান্দার পরিচয় :
ঈমানে স্বীকৃতির নাম মুমিন হলেও মুমিন ব্যক্তির গুণাবলী যথাযথ বিশ্বাস ও প্রতিপালনের মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি তথা তাক্বওয়াশীল বান্দা হিসেবে গণ্য হয়। মুমিন বান্দা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ- ‘মুমিন কেবল তারাই, যখন তাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করানো হয়, তখন তাদের অন্তর ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)। অন্যত্র এসেছে,وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ بِأَنَّ لَهُمْ مِنَ اللهِ فَضْلاً كَبِيرًا- ‘তুমি মুমিনদের সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে মহা অনুগ্রহ’ (আহযাব ৩৩/৪৭)।
মুখে স্বীকৃতি দেয়া ব্যক্তি মুমিন। মু‘আবিয়াহ ইবনুল হাকাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললাম, ‘আমার এক দাসী ছিল। সে ওহোদ ও জাওয়ানিয়্যাহ এলাকায় আমার বকরী চরাত। একদিন আমি হঠাৎ সেখানে গিয়ে দেখলাম, বকরীপাল থেকে একটি বকরী নেকড়ে নিয়ে গেছে। আমি তো অন্যান্য আদম সন্তানের মতো একজন মানুষ। তাদের মতো আমিও রাগে তাকে চপেটাঘাত করলাম। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে আসলাম (এবং সব কথা বললাম)। কেননা বিষয়টি আমার কাছে খুবই গুরুতর মনে হ’ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি কি তাকে (দাসীকে) মুক্ত করে দিব? তিনি বললেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো। সুতরাং আমি তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে হাযির করলাম। তিনি তাকে (দাসীকে) জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আকাশে। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আমি কে? সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, তুমি তাকে মুক্ত করে দাও, কেননা সে একজন মুমিনা নারী’(মুসলিম হা/৫৩৭, ‘মাসজিদ ও ছালাতের স্থান সমূহ’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৩৩০৩)।
হাদীসে বলা হয়েছে, ’’যে ব্যক্তি কোনো কারণ ছাড়া তার গোলামকে মারধর করে অথবা চপেটাঘাত করে…..’’ এখানে ঈমানদার গোলামকে মারধরের কথা নেই। বরং গোলাম যেই হোক না কেন তাকে কারণ ছাড়া প্রহার করলে সেই গোলামকে আযাদ বা মুক্ত করে দেয়ার মাধ্যমেই এ থেকে নিষ্কৃতি হবে। (শারহে মুসলিম ৫/৬ খন্ড, হাঃ ৫৩৭; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পূর্ণাঙ্গ মু’মিন হতে গেলে আমানাতদারী, ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যবাদিতা থাকতে হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَالمُؤْمِنُ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَى دِمَائِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ- ‘(প্রকৃত) মুমিন সে ব্যক্তি যার থেকে মানুষ নিজের জীবন ও সম্পদকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করে’ (তিরমিযী হা/২৬২৭; নাসাঈ হা/৪৯৯৫; মিশকাত হা/৩৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৭১০)।
পূর্ণাঙ্গ মু’মিন সেই যার মধ্যে আমানাতদারী, ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যবাদিতা প্রকাশ পায়। যার ফলে তার ব্যাপারে মানুষের এ আশংকা থাকে না যে, সে তাদের মাল বিনষ্ট করবে। এ গুণ অর্জন ছাড়া ঈমানের মধ্যে পরিপূর্ণতা আসে না। এ গুণ অর্জন না করে কেউ পূর্ণ মু’মিনও হতে পারে না। তবে এর দ্বারা এটা উদ্দেশ্য নয় যে, এ গুণ অর্জিত হলেই সে পূর্ণ মু’মিন হয়ে যাবে যদিও সে সালাত পরিত্যাগ করে বা অনুরূপ কোন ফরয ‘ইবাদাত পালন করা থেকে বিরত থাকে।
কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি মু’মিন নয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَسْرِقُ السَّارِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيهَا أَبْصَارَهُمْ حِينَ يَنْتَهِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ، ‘ ‘যিনাকারী যখন যিনা করে তখন আর সে ঈমানদার থাকে না। চোর যখন চুরি করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। মদ্যপ যখন মদ পান করে তখন তার আর ঈমান থাকে না। যখন ডাকাত এভাবে ডাকাতি করে যে, যখন চোখ তোলে তাকিয়ে থাকে তখন তার ঈমান থাকে না। এভাবে কেউ যখন গনীমাতের মালে খিয়ানাত করে, তখন তার ঈমান থাকে না। অতএব সাবধান! (বুখারী হা/২৪৭৫, ৫৫৭৮; মুসলিম হা/৫৭; মিশকাত হা/৫৩ )।
শির্ক ব্যতীত অন্য কোন কবীরা গুনাহগার ব্যক্তিকে কাফির বলা যাবে না। বরং এমন ব্যক্তি মু’মিন, তবে তাদের ঈমান অসম্পূর্ণ। যদি তারা তাওবাহ্ করে তবে শাস্তি থেকে রেহাই পাবে। আর যদি তাওবাহ্ ব্যতীত কবীরা গুনাহে লিপ্ত থেকেই মারা যায়, তাহলে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে ক্ষমা করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন। তবে কোন ব্যক্তি শারঈ বিধান তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কুফরীতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
ঈমানের দ্বীপ্ততার কারণে আল্লাহ্ তাঁর ক্ষীণ ঈমানদার বান্দাদেরকে জাহান্নাম থেকে জান্নাতে নিবেন। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘জান্নাতবাসীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের বলবেন, ‘যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান আছে, তাকে জাহান্নাম হ’তে বের করে আনো। তারপর তাদের জাহান্নাম হ’তে এমন অবস্থায় বের করা হবে, তারা পুড়ে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। অতঃপর তাদের বৃষ্টিতে বা হায়াতের নদীতে নিক্ষেপ করা হবে। ফলে তারা সতেজ হয়ে উঠবে, যেমন নদীর তীরে ঘাসের বীজ গজিয়ে উঠে। তুমি কি দেখতে পাও না সেগুলো কেমন হলুদ বর্ণের হয় এবং ঘন হয়ে গজায়’? (বুখারী হা/২২, অধ্যায় : ‘ঈমান ও আমলের ফযীলত’; ছহীহুল জামি‘ হা/১৪০৩৩)।
ইসলামের পরিচয় :
ইসলাম শব্দের অর্থ মেনে নেয়া, আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্য করা, সম্পাদন করা ইত্যাদি। ইসলামের মূল স্তম্ভ বা খুঁটি হলো ৫টি। যথা- মুখে স্বীকৃতি, ছালাত আদায় করা, ছিয়াম পালন করা, যাকাত প্রদান করা ও হজ্জ সম্পাদন করা।
উল্লেখ্য যে, ইসলামের ঐ পাঁচটি মূল স্তম্ভকে যথাযথভাবে প্রতিপালনকারী ব্যক্তিকে মুসলিম বলা হয়। আর মুসলিম ঐসকল ব্যক্তি যারা অদৃশের প্রতি না দেখেই অকপটে ইলাছের সাথে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এবং ইসলামের ঐ পাঁচটি মূল স্তম্ভ যথাসাধ্য প্রতিপালন করে থাকেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ ، وَالْحَجِّ ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ. ‘ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি। ১. আল্লাহ্ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল-এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। ২. ছালাত কায়িম করা। ৩. যাকাত আদায় করা। ৪. হজ্জ সম্পাদন করা এবং ৫. রমাযানের ছিয়াম পালন করা (বুখারী হা/৮; মুসলিম হা/১৬; মিশকাত হা/৪)।
দ্বীনের প্রতি প্রত্যেক আত্মসমর্পণকারী মুমিনকেই মুসলিম হয়। অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘আলা বিধান তথা আদেশ নিষেধ যথাযথভাবে পালনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে মুসলিম বলা হয়।
ঈমান ও ইসলাম শব্দদ্বয় একই সঙ্গে আবার পৃথকভাবে ব্যবহৃত হয়। তখন আবার পৃথক পৃথক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তখন অভ্যন্তরীণ ইখলাছপূর্ণ বিশ্বাসকে ঈমান বলা হয়, আর বাহ্যিক আমলকে ইসলাম বলা হয় এবং ইসলাম পালনকারী হলো মুসলিম।
এখানে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। ঈমান দ্বারা অভ্যন্তরীণ আমল তথা অদৃশ্যের প্রতি অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসকে বুঝানো হয়েছে । আবার ইসলামকে বাহ্যিক আমল অর্থাৎ মুখের স্বীকারোক্তি ও যথাযথ শারীরিক ও আর্থিক আমলকে বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: ‘বেদুঈনরা বলে, ‘আমারা ঈমান আনলাম’। বলুন, ‘তোমরা ঈমান আননি, বরং তোমারা বল, ‘আমরা আত্মসমর্পণ করেছি’ (অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করেছি)। কারণ ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি। আর যদি তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো তবে তিনি তোমাদের আমলসমূহের ছওয়াব সামান্য পরিমাণও লাঘব করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১৪)।
ঈমানকে অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কেননা ইসলামের থেকে ঈমান মর্যাদার দিক দিয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। কারণ ইসলামের মাধ্যমে মুমিন ও মুনাফিক্বদের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়ে থাকে। আবার যখন ঈমান ও ইসলাম একে অপর থেকে পৃথকভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন কিন্তু এরা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যখন কেহ যদি বলে, ‘আমি মুমিন’ অথবা ‘আমি মুসলিম’ এখানে দু’য়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই দিক দিয়ে প্রত্যেক মুমিনই মুসলিম এবং প্রত্যেক মুসলিমই হলো মুমিন।
আর যাঁরা মুমিন ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য করেন, তাঁরা বলেন, প্রত্যেক মুমিন হল মুসলিম, কিন্তু প্রত্যেক মুসলিম মুমিন নাও হতে পারে। যদিও ঈমান ও ইসলাম শব্দদ্বয় একই বাক্যে আসে তাহলে ‘ঈমান’ অর্থ হবে আভ্যন্তরীণ বিষয়াদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার নাম হলো ঈমান। আবার ‘ইসলাম’ অর্থ হবে প্রকাশ্যে শারঈ বিধি-বিধান ও ফরয কার্যাদি পালন করার নাম হলো ইসলাম। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা অবশ্যই মুসলিম না হয়ে মরো না’ (আলে ইমরান ৩/১০২)। আরো এসেছে, وَأُمِرْتُ لِأَنْ أَكُونَ أَوَّلَ الْمُسْلِمِينَ- ‘আর আমি আদিষ্ট হয়েছি যেন আমি মুসলিমদের প্রথম হই’ (যুমার ৩৯/১২)।
এখানে মুমিন, মুত্তাক্বী ও মুসলিম তিনটি বিষয় এসেছে। প্রথম দু’টি হৃদয়ে বিশ্বাসগত কমবেশীর সাথে সম্পর্কিত এবং শেষেরটি বাহ্যিক আমলের সাথে সম্পর্কিত। যা অবশ্যই কঠিন। আলোচ্য আয়াতে হৃদয়ের বিশ্বাসকে আল্লাহভীতি ও যথাযথভাবে আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এক্ষণে উপরোক্ত আলে ইমরান ১০২ আয়াতে মুমিনদেরকে বলা হয়েছে যে, তোমরা ইসলামের বিধি-বিধান সমূহ পরিপূর্ণভাবে পালন কর, যেন এর উপরেই তোমরা মৃত্যুবরণ করতে পার’ (ইবনু কাছীর, ঐ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ)। ঈমানের কমবেশীর বিষয়টি আল্লাহ দেখবেন।
মুসলিম বান্দার পরিচয় :
আল্লাহর বিধান যথাযথ পালনকারী ব্যক্তিদের জাতিগত নাম হচ্ছে ‘মুসলিম’। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন,مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ، ‘তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের ধর্মের উপর (তোমরা দৃঢ় থাক)। তিনি (আল্লাহ) তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’ (হজ্জ ২২/৭৮)। অন্যত্র বলেন,قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ مِنْ رَبِّكَ بِالْحَقِّ لِيُثَبِّتَ الَّذِينَ آمَنُوا وَهُدًى وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ- ‘বলে দাও, এটি তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে পবিত্র রূহ (জিব্রীল) যথার্থভাবে নাযিল করেছেন। যাতে তিনি মুমিনদের দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এটি মুসলমানদের জন্য পথনির্দেশ ও সুসংবাদ স্বরূপ’ (নাহল ১৬/১০২)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহকে ভয় কর এবং অবশ্যই মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না’ (আলে ইমরান ৩/১০২)। পবিত্র কুরআনে আরো এসেছে, وَأُمِرْتُ لِأَنْ أَكُونَ أَوَّلَ الْمُسْلِمِينَ- ‘আর আমি আদিষ্ট হয়েছি যেন আমি মুসলিমদের প্রথম হই’ (যুমার ৩৯/১২)।
লোকজনের বাহ্যিক বিষয়ই ধর্তব্য, আভ্যন্তরীণ বিষয় ধর্তব্য নয়। অতএব যে ব্যক্তি ধর্মীয় নিদর্শনের প্রকাশ ঘটাবে তার প্রতি সে ধর্মের বিধিবিধান কার্যকরী হবে। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَلَّى صَلاَتَنَا، وَاسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنَا، وَأَكَلَ ذَبِيحَتَنَا، فَذَلِكَ الْمُسْلِمُ ‘যে ব্যক্তি আমাদের ন্যায় ছালাত আদায় করে, আমাদের কিবলামুখী হয় আর আমাদের যবেহকৃত প্রাণী খায়, সে-ই মুসলিম’ (বুখারী হা/৩৯১-৯৩; মিশকাত হা/১৩)।
মুসলমানদেরকে খেজুর গাছের পাতার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ مِنَ الشَّجَرِ شَجَرَةً لاَ يَسْقُطُ وَرَقُهَا، وَإِنَّهَا مَثَلُ الْمُسْلِمِ، ‘গাছগাছালির মধ্যে এমন একটি গাছ রয়েছে তার পাতা ঝরে পড়ে না। আর এটাই মুসলিমের উদাহরণ’ (বুখারী হা/৬১, ৭২; মুসলিম হা/২৮১১; আহমাদ হা/৬৪৭৭)।
যার কষ্ট থেকে মানুষ নিরাপদে থাকে সে উত্তম মুসলিম এবং পরিপূর্ণ মুসলিম। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন ‘পূর্ণাঙ্গ মুসলিম সে ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ হতে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে। আর প্রকৃত মুহাজির হলো সে ব্যক্তি, যে সকল কাজ পরিত্যাগ করেছে যেসব কাজ করতে আল্লাহ বারণ করেছেন। হাদীসের শব্দগুলো সহীহুল বুখারীর। আর মুসলিম এ শব্দে বর্ণনা করেছেনঃ জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রশ্ন করলো, মুসলিমদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, যার জিহ্বা ও হাতের অনিষ্ট হতে অন্য মুসলিমগণ নিরাপদে থাকে’ (বুখারী হা/১০, ৬৪৮৪; মুসলিম হা/৪০; মিশকাত হা/৬)।
ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর হক্ব ও মুসলিমদের হক্ব আদায় করার স্বভাব একত্র করতে পেরেছে সেই উত্তম মুসলিম। এটাও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, এর দ্বারা মুসলিমের এমন নিদর্শন বুঝা যায় যা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর সেই নিদর্শন হলো মুসলিমের হাত ও জিহবার অনিষ্ট হতে নিরাপদ থাকা। যেমনটি মুনাফিক্বের নিদর্শন উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসের মধ্যে ‘মুসলিমকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা’ কথাটি আধিক্য বুঝানোর জন্য বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমও এর আওতাভুক্ত। কেননা কোন মুসলিম ভাইকে কষ্ট দেয়া হতে বিরত থেকে তাকে সংরক্ষণ করার বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অমুসলিমও যে এ নির্দেশের আওতাভুক্ত তার সত্যতা পাওয়া যায় ইবনু হিব্বান-এর বর্ণনা থেকে। তাতে আছে ‘‘যার থেকে লোকেরা নিরাপদে থাকলো’’।
হাদীসে বিশেষভাবে হাত ও জিহবার উল্লেখ এজন্য করা হয়েছে যে, অধিকাংশ কষ্ট এ দু’টো অঙ্গ দ্বারাই হয়ে থাকে। অথবা এর দ্বারা উদাহরণ দেয়া উদ্দেশ্য। এজন্যই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসসান ইবনু সাবিতকে বলতেনঃ মুশরিকদের দোষ বর্ণনা কর। কেননা তা তাদের উপর তীর নিক্ষেপ করার চাইতেও কষ্টদায়ক। আর তা এ জন্য যে এর দ্বারা জীবিত ও মৃত সবাইকে লক্ষবস্তুতে পরিণত করা যায়।
দ্বীনের মূল স্তর তিনটি :
(১) ঈমান, যা ছয়টি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর উপরে বিশ্বাস, ফেরেশতাগণ, আসমানী কিতাবসমূহ, নবী ও রাসূলগণ, ক্বিয়ামত দিবস এবং তাক্বদীরের ভালো-মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।
(২) ইসলাম, যা পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। কালেমা শাহাদত, ছালাত, যাকাত, ছিয়াম ও হজ্জ।
(৩) ইহসান, যা একনিষ্ঠচিত্তে ও পূর্ণ ইখলাছের সাথে আল্লাহর ইবাদত করাকে বুঝায়। অর্থাৎ এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা যেন বান্দা আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছে অথবা আল্লাহ স্বীয় বান্দাকে দেখছেন। পূর্ণ ঈমানের সাথে সকল প্রকার সৎকর্ম ইসলাম ও ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। আর সেগুলি পূর্ণ ইখলাছের সাথে সম্পাদন করা ইহসানের অন্তর্ভুক্ত। এটিই হ’ল দ্বীনের সর্বোচ্চ স্তর। উল্লিখিত তিনটি বিষয় হাদীছে জিব্রীলে বর্ণিত হয়েছে (বুখারী হা/৫০, মুসলিম হা/৯; মিশকাত হা/২)।
অধিক তাক্বওয়াশীল ব্যক্তি ব্যতীত প্রকৃত মুমিন-মুসলমান হতে পারে না। মুমিন হতে গেলে মুমিনের সকল গুণাবলীর প্রতি যত্নশীল হতে হবে এবং প্রকৃত মুসলিম হতে গেলে শারীয়তের বাহ্যিক আমলগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং বিধি-নিষেধের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রকৃত মুমিন ও মুসলিম হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।