মানুষ আল্লাহর কাংখিত সৃষ্টির সেরা জীব। সুতরাং একজন আরেকজনকে তুচ্ছজ্ঞান বা হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে না। যখন কোন ব্যক্তি কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করে তখন স্বভাবতই সে নিজেকে তার চেয়ে শ্রেয় মনে করে,যা অহংকারের পর্যায়ভুক্ত। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীছে জনৈক ছাহাবীর এক প্রশ্নের উত্তরে অহংকারের ব্যাখ্যা দিয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, اَلْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَ غَمْطُ النَّاسِ. ‘অহংকার হচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করা এবং লোকদের নীচুজ্ঞান করা’(মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৮)। এজন্য কথা, কর্ম বা আচরণের মাধ্যমে কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করা বা হেয় প্রতিপন্ন করা নিষেধ। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, بِحَسْبِ امْرِءٍ مِّنَ الشَّرِّ أَنْ يُّحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ. ‘এক ব্যক্তি গোনাহগার হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে নীচুজ্ঞান করবে’ (মুসলিম, হা/২৫৬৪)। অপর হাদীছে আছে, وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَيَحْقِرُهُ ‘কোন মুসলমান অপর মুসলমানকে না অপমান করবে, আর না তুচ্ছজ্ঞান করবে’(মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৫৯)।
আয়েশা (রাঃ) মত একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী এবং রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীর প্রতি মিথ্যে অপবাদ দিয়েছিল একদল কুচক্রীরা। আর তা বলে বেড়াত তাঁর বোন হামনা (রাঃ) অপবাদ রটনাকারীদের মতো অপবাদ ছড়াচ্ছিল। যা অনেক পীড়াদায়ক। যখন কোন আত্মীয়-স্বজন এহেন কর্ম করে তা ভিষণ কষ্ট দেয়। বর্তমানে এমন অপবাদ অহরহ বলে বেড়ায় নিজের আত্মীয়-স্বজনরাই। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এ অবস্থা কেটে গেলে তিনি হাসিমুখে প্রথম যে কথা উচ্চারণ করলেন সেটা হ’ল, হে আয়েশা! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দিয়েছেন। তিনি [আয়েশা (রাঃ)] বলেন, এ কথা শুনে আমার মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি সম্মান কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি তাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত কারো প্রশংসা করব না। আয়েশা (রাঃ) বললেন, আল্লাহ (আমার পবিত্রতার ব্যাপারে) যে দশটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন, তা হ’ল, ‘যারা এ অপবাদ রটনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি যে, এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ? তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাচারী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে, তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে। অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। আর এ কথা শোনামাত্র তোমরা কেন বললে না যে, এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের জন্য উচিত নয়? আল্লাহ পবিত্র মহান! এ তো এক গুরুতর অপবাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহ’লে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না; আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখেরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেতে না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু’ (নূর ২৪/১১-২০)। আল্লাহ তাঁর তাক্বওয়ার কারণে তাঁকে রক্ষা করেছেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, অথচ তাঁর বোন হামনা (রাঃ) অপবাদ রটনাকারীদের মতো অপবাদ ছড়াচ্ছিল। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেলেন (বুখারী হা/৪১৪১)।
মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করে কষ্ট দেওয়া অনুচিৎ। এ কাজ মুমিন ব্যক্তির আদর্শে শোভা পায় না। রাসূল (ছাঃ) এ ধরনের কর্ম থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
১. তোমরা পরস্পর হিংসা করো না,
২. পরস্পর ধোঁকাবাজি করো না,
৩. পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না,
৪. একে অপরের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে অগোচরে শত্রুতা করো না
৫. একে অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করবে না।
৬. তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে থাকো।
৭. এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই।
৮. সে তার উপর অত্যাচার করবে না,
৯. তাকে অপদস্ত করবে না এবং হেয় প্রতিপন্ন করবে না।
তাক্বওয়া এখানে, এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনবার স্বীয় বক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করলেন।
১০. একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে হেয় জ্ঞান করে।
১১. কোন মুসলিমের উপর প্রত্যেক মুসলিমের জান-মাল ও ইয্যত-আব্রু হারাম’ (মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৮৫)। অন্যত্র বলেন, إِنَّ مِنْ أَرْبَى الرِّبَا اسْتِطَالَةَ الْمَرْءِ فِي عِرْضِ أَخِيهِ. ‘সবচেয়ে বড় সূদ হ’ল অন্যায়ভাবে কোন মুসলিমের মানহানি করা’ (আবূদাঊদ হা/৪৮৭৬; ছহীহাহ হা/১৪৩৩, ৩৯৫০; ছহীহুল জামে‘ হা/২২০৩, ২৫৩১; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৩৩)।
কিয়ামতের দিন সকলে বিভিষিকার মধ্যে থাকবে। সেই দিন কিছু মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাবে সওয়াবের দিক দিয়ে। তাই সেই দিন আসার পূর্বে পাওনাদারের নিকট থেকে মাফ করিয়ে নিন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার কোন মুসলমান ভাইয়ের প্রতি সম্মান কিংবা অন্য কোন বিষয়ে যুলুম করেছে, সে যেন আজই তার নিকট থেকে তা মাফ করে নেয়; ঐদিন আসার পূর্বে যেদিন তার নিকটে কোন দিরহাম ও দীনার থাকবে না। যদি তার নিকট নেক আমল থাকে, তবে তাত্থেকে তার যুলুম পরিমাণ নেকী নেওয়া হবে, আর যদি তার কাছে নেকী না থাকে, তবে মাযলূম ব্যক্তির গোনাহ তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে’(বুখারী, মিশকাত, হা/৫১২৬)।
মুসলমানের মান-সম্মানের প্রতি হস্তক্ষেপ করা, হেয় প্রতিপন্ন বা তুচ্ছজ্ঞান করা থেকে বিরত থাকি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ও বুঝ দান করুন, আমীন।