মুহাররম মাসের বিদ‘আত সমূহ

——————– লিলবর আল-বারাদী

(১) শাহাদতে হুসাইনের শোক পালনের উদ্দেশ্যে ছিয়াম পালন করা : 

অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ ৯ ও ১০ই মুহাররম অথবা ১০ ও ১১ই মুহাররম ছিয়াম পালন করা। বর্তমান সমাজে উক্ত দু’টি ছিয়াম পালনের প্রচলন রয়েছে। তবে তা শাহাদতে হুসাইনের শোক পালনের উদ্দেশ্যেই পালিত হয়ে থাকে। যা সম্পূর্ণরূপে ছহীহ হাদীছ বিরোধী এবং স্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা এই ছিয়ামের সূচনা হয়েছে মূসা (আঃ)-এর সময় থেকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর জীবদ্দশাতেই মুহাররমের ছিয়াম পালন করেছেন। আর কারবালার ঘটনা ঘটেছে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৫০ বছর পরে ৬১ হিজরীতে। তাহ’লে কি করে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের কারণে এই ছিয়াম পালন করলেন? অতএব এসব নিছক ভিত্তিহীন কথা মাত্র। রাসূল (ছাঃ) আশূরার ছিয়াম পালন করেছিলেন অত্যাচারী শাসক ফেরাঊনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের আনন্দে আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ। পক্ষান্তরে আমরা আজ তা পালন করছি হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের শোক স্বরূপ। অথচ ওমর (রাঃ), ওছমান (রাঃ) সহ আরো অনেক ছাহাবী শাহাদত বরণ করেছেন। আমরা তাঁদের স্মরণে কিছুই করি না। যদি হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের কারণে শোক দিবস পালন করা হয়, তাহ’লে ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর শোক দিবস পালনের অধিক হক রাখে। 

বিদ‘আতীদের নিকট এ সমস্ত ছাহাবায়ে কেরামের শাহাদত বরণে শোক তো দূরের কথা; বরং আনন্দ দিবসে পরিণত হয়। যেমন- আববাসীয় খলীফা মুত্বী‘ বিন মুক্বতাদিরের সময়ে (৩৩৪-৩৬৩হিঃ/৯৪৬-৯৭৪ খৃঃ) তাঁর কট্টর শী‘আ আমীর আহমাদ বিন বূইয়া দায়লামী ওরফে মুইযযুদ্দৌলা ৩৫১ হিজরীর ১৮ই যিলহজ্জ তারিখে বাগদাদে ওছমান (রাঃ)-এর শাহাদত বরণের তারিখকে তাদের হিসাবে খুশীর দিন মনে করে ‘ঈদের দিন’ (عيد غدير خم) হিসাবে ঘোষণা করেন। শী‘আদের নিকটে এই দিনটি পরবর্তীতে ঈদুল আযহার চাইতেও গুরুত্ব পায়। অতঃপর ৩৫২ হিজরীর শুরুতে ১০ই মুহাররমকে তিনি হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদত বরণের ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করেন এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেন এবং মহিলাদেরকে শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে চলতে বাধ্য করেন। শহর ও গ্রামের সর্বত্র সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। শী‘আরা খুশী মনে এই নির্দেশ পালন করে। কিন্তু সুন্নীরা নিষ্ক্রিয় থাকেন। পরে সুন্নীদের উপরে এই ফরমান জারি করা হ’লে ৩৫৩ হিজরীতে উভয় দলে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে বাগদাদে তীব্র নাগরিক অসন্তোষ ও সামাজিক অশান্তির সৃষ্টি হয়।[1] আমরা বর্তমানে যে উদ্দেশ্যে আশূরার ছিয়াম পালন করছি তা শী‘আদের থেকে গৃহীত; যা অবশ্যই বর্জনীয়।

(২) ১০ই মুহাররমকে আনন্দ উৎসবে পরিণত করা : 
রাফেযীরা (কট্টর শী‘আ) হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের শোক স্বরূপ শোক দিবস পালন করে। পক্ষান্তরে একটি গোষ্ঠী রাফেযীদের বিরোধিতা করার লক্ষ্যে এ দিনটিকে আনন্দ উৎসবে পরিণত করে। এ দিনে রাফেযীদের শোক দিবস যেমন বিদ‘আত; তেমনি তাদের বিরোধিতার লক্ষ্যে এ দিনে আনন্দ উৎসব করাও বিদ‘আত। এটা যেন বিদ‘আত দিয়ে বিদ‘আত এবং মিথ্যা দিয়ে মিথ্যা প্রতিহত করার চেষ্টা। অথচ উচিত ছিল সুন্নাত দিয়ে বিদ‘আত প্রতিহত করা। সত্য দিয়ে মিথ্যা প্রতিহত করা। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম এ দিনটিকে শোক দিবস হিসাবেও পালন করেননি। আবার আনন্দ উৎসবেও পরিণত করেননি। তাঁরা শুধুমাত্র ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ ছিয়াম পালন করেছেন।[2] 
(৩) তা‘যিয়া : 
তা‘যিয়া অর্থ বিপদে সান্ত্বনা দেওয়া। যেটা বর্তমানে শাহাদাতে হোসাইনের শোক মিছিলে রূপ নিয়েছে। অথচ ইসলামে কারো মৃত্যুতে তিন দিনের অধিক শোক পালন করা নিষেধ।[3] কিন্তু বাগদাদের গোঁড়া শী‘আ আমীর মু‘ইযযুদ্দৌলা ৩৫২ হিজরীর ১০ই মুহাররমকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেন এবং শহর ও গ্রামের সকলকে তা‘যিয়া মিছিলে যোগদানের নির্দেশ দেন। সেদিন থেকেই এই বিদ‘আতী প্রথা চালু হয়েছে। শী‘আদের উদ্ভাবিত এই বিদ‘আতী প্রথার অনুসরণেই বাংলাদেশের বিদ‘আতীরা ১০ই মুহাররমে মিছিল বের করে থাকে। প্রত্যেক আল্লাহভীরু মুসলমানের এই সব বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকা আবশ্যক।
(৪) ১০ই মুহাররমে চোখে সুরমা লাগানো : 
অনেকেই আশুরার দিন বা ১০ই মুহাররমে বিশেষ ফযীলতের আশায় চোখে সুরমা লাগিয়ে থাকে; যা সুস্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম আশূরার দিনে চোখে সুরমা লাগাননি এবং এর কোন ফযীলত বর্ণনা করেননি। ‘আশূরার দিনে চোখে ইছমিদ সুরমা লাগালে কখনোই চোখে রোগ হবে না’ মর্মে প্রচলিত হাদীছটি মাওযূ বা জাল।[4]
(৫) ১০ই মুহাররমে বিশেষ ফযীলতের আশায় বিশেষ পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করা : 
১০ই মুহাররমে বিশেষ ফযীলতের আশায় বিশেষ পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করা হয়ে থাকে; যা সুস্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বিশেষ কোন ছালাত আদায় করেছেন মর্মে কোন ছহীহ দলীল পাওয়া যায় না। এ সম্পর্কে যা পাওয়া যায় তার সবগুলিই জাল বা বানোয়াট। যেমন-
(ক) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আশূরার দিনে যে ব্যক্তি চার রাক‘আত ছালাত আদায় করবে এবং প্রত্যেক রাক‘আতে একবার সূরা ফাতিহা ও পঞ্চাশবার সূরা ইখলাছ তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার অতীতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ এবং ভবিষ্যতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন’। উল্লিখিত হাদীছটি জাল বা বানোয়াট।[5] 
(খ) রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আশূরার দিনে যোহর ও আছরের ছালাতের মাঝখানে চল্লিশ রাক‘আত ছালাত আদায় করবে। প্রত্যেক রাক‘আতে একবার সূরা ফাতিহা, দশবার আয়াতুল কুরসী, দশবার সূরা ইখলাছ, পাঁচবার সূরা ফালাক্ব এবং পাঁচবার সূরা নাস তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করবেন’। অত্র হাদীছটিও জাল বা বানোয়াট।[6]
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,ليس في حديث عاشوراء حديث صحيح غير الصوم، وما يروي في فضل صلاة معينة فيه فهذا كله كذب موضوع باتفاق أهل المعرفة، ولم ينقل هذه الأحاديث أحد من أئمة أهل العلم في كتبهم- ‘ছিয়াম ব্যতীত আশূরা সম্পর্কিত কোন ছহীহ হাদীছ নেই। এই দিনে নির্দিষ্ট ছালাতের ফযীলত সম্পর্কে যে বর্ণনা এসেছে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছগণের ঐক্যমতে তার সবগুলিই মিথ্যা ও বানোয়াট। মুহাক্কিক আলেমদের কেউই তাদের কিতাব সমূহে এ সমস্ত হাদীছ সংকলন করেননি।[7] 
অতএব এ উপলক্ষে আশূরার দু’টি ছিয়াম ব্যতীত অন্য কোন ইবাদত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম, ইমাম চতুষ্টয়ের কেউ কখনোই করেননি। আর তাঁরা ছিয়াম দু’টি পালন করেছেন কেবল ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ; শাহাদতে হুসাইনের শোক স্বরূপ নয়। সুতরাং বর্তমানে আশূরা উপলক্ষে যা হচ্ছে তার সবগুলিই পরবর্তী যূগের বিদ‘আতীদের আবিষ্কার; যা অবশ্যই বর্জনীয়।
(৬) তাবেঈ ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়া-কে ‘মালঊন’ বা অভিশপ্ত বলে গালি দেওয়া :
ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়াকে ‘মালঊন’ বা অভিশপ্ত বলে গালি দেওয়া আদৌ ঠিক নয়। বরং সকল মুসলমানের ন্যায় তার মাগফেরাতের জন্য দো‘আ করা উচিত। কেননা মানুষ হিসাবে তার কিছু ভুল-ত্রুটি থাকলেও কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার জন্য তিনি দায়ী নন। এজন্য মূলতঃ দায়ী বিশ্বাসঘাতক কূফাবাসী ও নিষ্ঠুর গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ। কেননা ইয়াযীদ কেবল হুসাইন (রাঃ)-এর আনুগত্য চেয়েছিলেন, তাঁর খুন চাননি। হুসাইন (রাঃ) সে আনুগত্য দিতেও প্রস্ত্তত ছিলেন। ইয়াযীদ স্বীয় পিতার অছিয়ত অনুযায়ী হুসাইনকে সর্বদা সম্মান করেছেন এবং তখনও করতেন। হুসাইন (রাঃ)-এর ছিন্ন মস্তক ইয়াযীদের সামনে রাখা হ’লে তিনি কেঁদে বলে ওঠেন, ‘ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের উপর আল্লাহ লা‘নত করুন। আল্লাহর কসম! যদি হুসাইনের সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক থাকত, তাহ’লে সে কিছুতেই তাঁকে হত্যা করত না। তিনি আরো বলেন, হুসাইনের খুন ছাড়াও আমি ইরাকীদেরকে আমার আনুগত্যে রাযী করাতে পারতাম’।[8] 
কূফার নেতাদের লিখিত ১৫০টি পত্র পেয়ে হুসাইন (রাঃ) কূফায় আসলে বছরার গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ কূফার গভর্ণর মুসলিম বিন আকীলকে গ্রেফতার করে হত্যা করে। এদিকে হুসাইন (রাঃ) প্রদত্ত তিনটি প্রস্তাবের কোনটি গ্রহণ না করায় দুষ্টমতি ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের সাথে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এতে হুসাইন (রাঃ) সপরিবারে নিহত হন।[9] 
উপসংহার : 
সম্মানিত পাঠক! পরিপূর্ণভাবে ইসলামের উপর টিকে থাকতে হ’লে ফিরে যেতে হবে একমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দিকে। মুসলিম জাতি আজ কুরআন-সুন্নাহ থেকে ছিটকে পড়েছে। ফলে বিদ‘আতের কাল মেঘে আচ্ছাদিত হয়েছে ইসলামী শরী‘আতের স্বচ্ছ আকাশ। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শারঈ জ্ঞানার্জন অপরিহার্য। মুহাররম মাসে রাসূল (ছাঃ) কি করেছেন আর আমরা কি করছি তা মিলিয়ে দেখতে হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সাথে। কারবালার ঘটনা সম্পর্কে সকল প্রকার আবেগ ও বাড়াবাড়ি হ’তে দূরে থাকতে হবে এবং আশূরা উপলক্ষে প্রচলিত শিরক ও বিদ‘আতী আক্বীদা-বিশ্বাস ও রসম-রেওয়াজ পরিহার করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে বিদ‘আত মুক্ত জীবন-যাপন করার তওফীক্ব দান করুন- আমীন! 
________________________________________
[1]. ইবনুল আছীর, তারীখ ৮/১৮৪ পৃঃ; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আশূরায়ে মুহাররম ও আমাদের করণীয়, পৃঃ ৬-৭।
[2]. ড. সুলাইমান ইবনে সালেম আস-সুহাইমী, আল-আ‘ইয়াদ ওয়া আছারুহা, পৃঃ ২৭৩।
[3]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৪৪৬৩ ‘চুল অাঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ।
[4]. ইবনুল জাওযী, আল-মাওযূ‘আত পৃঃ ২/২০৩; মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফূ‘আহ, পৃঃ ৪৪।
[5]. আল-মাওযূ‘আত পৃঃ ২/১২২ ।
[6]. আল-মাওযূ‘আত পৃঃ ২/১২২-১২৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ পৃঃ ৪৮ ।
[7]. শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/১১৬ ।
[8]. ইবনু তায়মিয়া, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ, ১/৩৫০; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/১৭৩; আশূরায়ে মুহাররম ও আমাদের করণীয়, পৃঃ ৭-১০।
[9]. ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ ২/২৫২; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৮/১৫৪, ১৭১।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top