মৃত্যু অপ্রিয় সত্য

মৃত্যু অবধারিত এর কোন ছাড় নেই। এই পেয়ালা সকল প্রাণীকে পান করতে হবে। রাতের আধারে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে একটি বার চিন্তা করুন, গত হয়েগেছে কত শত প্রিয় আপনজন পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-ভগ্নী, কত বন্ধুবর ইত্যাদি। আমাকে আপনাকেও চলে যেতে হবে বিনা নোটিশে দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে নতুন জীবনে। সুতরাং মৃত্যু থেকে কেহ রেহায় পাবে না। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নবীকে বলেন, إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ ‘নিশ্চয়ই তুমি মরবে এবং তারাও মরবে’ (যুমার ৩৯/৩০)। মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ করা উচিৎ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ ‘তোমরা বেশী বেশী করে স্বাদ বিনষ্টকারী বস্ত্তটির কথা স্মরণ কর’(তিরমিযী হা/২৩০৭; ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৮; নাসাঈ হা/১৮২৪; মিশকাত হা/১৬০৭)।

অন্য হাদীছে এসেছে, সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, জিব্রীল এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যতদিন খুশী জীবন যাপন কর। কিন্তু মনে রেখ তুমি মৃত্যুবরণ করবে। যার সাথে খুশী বন্ধুত্ব কর। কিন্তু মনে রেখ তুমি তাকে ছেড়ে যাবে। যা খুশী তুমি আমল কর। কিন্তু মনে রেখ তুমি তার ফলাফল পাবে। জেনে রেখ, মুমিনের মর্যাদা হ’ল ইবাদতে রাত্রি জাগরণে এবং তার সম্মান হ’ল মানুষের মুখাপেক্ষী না হওয়ার মধ্যে’ (হাকেম হা/৭৯২১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮৩১)।

অন্যত্র, প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত স্থান নির্দিষ্ট করে রাখা আছে। আবু আযযা ইয়াসার ইবনে আবদুল্লাহ আল-হুযালী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ছা.) বলেন, إِنَّاللَّهَإِذَاأَرَادَقَبْضَعَبْدٍبِأَرْضٍ، جَعَلَ لَهُ بِهَا، أَوْ‏:‏ فِيهَا أ حَاجَةً‏.‏ আল্লাহ যখন তাঁর কোন বাদাকে নির্দিষ্ট কোন স্থানে মৃত্যুদান করতে চান, তখন সেখানে (যাওয়ার জন্য) সেই বান্দার কোন প্রয়োজন সৃষ্টি করে দেন’ (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৮৫)।

কবি বলেন,

বার্ধক্য হ’ল আযানের মতন

কবর পানে ডাকে,

মৃত্যু হ’ল ইকামতের মতন

জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

— কবি : লিলবর আল বারাদী

(বার্ধক্য ও যৌবন’ কবিতা থেকে নেয়া)

(১) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হি.) একদিন বাগদাদের বাজারে এলেন। অতঃপর এক বোঝা কাঠ খরিদ করে কাঁধে নিয়ে চলতে শুরু করলেন। অতঃপর যখন লোকেরা তাকে চিনে ফেলল, তখন ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে, দোকানদাররা দোকান ছেড়ে, পথিকরা পথ চলা বন্ধ করে তাঁর কাছে ছুটে এল ও সালাম দিয়ে বলতে লাগল, আমরা আপনার বোঝা বহন করব। তখন তাঁর হাত কেঁপে উঠল, চেহারা লাল হয়ে গেল, দু’চক্ষু বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। অতঃপর তিনি বারবার বলতে থাকলেন, আমরা মিসকীন। যদি আল্লাহ আমাদের পাপ ঢেকে না দেন, আমরা অবশ্যই সেদিন লাঞ্ছিত হব’ (উক্তি, পৃ. ২১-২২)।

(২) ফুযায়েল বিন মাসঊদ (মৃ. ১৮৭ হি.)-কে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমন আছেন? জওয়াবে তিনি বললেন, যদি তুমি আমার দুনিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, তবে আমি বলব যে, দুনিয়া আমাদেরকে যেখানে খুশী নিয়ে চলেছে। আর যদি আখেরাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে থাক, তাহ’লে ঐ ব্যক্তির অবস্থা কি জানবে যার পাপ বৃদ্ধি পেয়েছে ও নেক আমল কম হয়েছে। যার বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ তার পরকালের জন্য পাথেয় সঞ্চিত হয়নি। মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্ততি নেয়নি, তার জন্য বিনত হয়নি, তার জন্য পা বাড়ায়নি, তার জন্য আমলকে সৌন্দর্যমন্ডিত করেনি। অথচ দুনিয়ার জন্য সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে’? (উক্তি পৃ. ২৭)। আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৮/৮৫-৮৬।

আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে মুমিন মুসলমান হিসেবে মৃত্যু বরণ করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যে ব্যক্তি আমার কোন বন্ধুকে শত্রু ভাবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমি আমার বান্দার ওপর যা কিছু (’আমল) ফরয করেছি; তা দ্বারা আমার সান্নিধ্য অর্জন করা আমার নিকট বেশী প্রিয় অন্য কিছু (’আমল) দিয়ে সান্নিধ্য অর্জনের চাইতে। আর আমার বান্দা সর্বদা নফল ’ইবাদাতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য হাসিল করে। পরিশেষে আমি তাকে ভালবাসি এবং আমি যখন তাকে ভালবাসি- আমি হয়ে যাই তার কান, যা দিয়ে সে শুনে। আমি হয়ে যাই তার চোখ, যা দিয়ে সে দেখে। আমি হয়ে যাই তার হাত, যা দিয়ে সে ধরে (কাজ করে)। আমি হয়ে যাই তার পা, যা দিয়ে চলাফেরা করে। সে যদি আমার কাছে চায়, আমি তাকে দান করি। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায়, আমি তাকে আশ্রয় দেই। আর আমি যা করতে চাই, তা করতে আমি মু’মিন বান্দার রূহ কবয করার মতো ইতস্তত করি না। কেননা মু’মিন (স্বাভাবিকভাবে) মৃত্যুকে অপছন্দ করে, আর আমি অপছন্দ করি তাকে অসন্তুষ্ট করতে। কিন্তু মৃত্যু তার জন্য অত্যাবশ্যকীয়’ (বুখারী হা/৬৫০২; মিশকাত হা/২২৬৬)।


মানুষের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো আল্লাহর আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে যেহেতু সে এমন কোন কিছু শুনে না যা আল্লাহ অপছন্দ করেন, এমন কিছু দেখে না যা আল্লাহর অপছন্দনীয়, এমন কিছু ধরে না যা আল্লাহ অপছন্দ করেন, এমন দিকে পা বাড়ায় না যা তিনি অপছন্দ করেন। প্রিয় বান্দার গুণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে যার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আল্লাহর নির্দেশের বাহিরে তিল পরিমাণও অগ্রসর হয় না। বান্দা মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর ওদিকে আল্লাহ বলেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি ফিরে এসো তোমার রবের প্রতি সন্তুষ্টচিত্তে, সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (ফাজর ৮৯/২৭-৩০)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top