(লেখক : ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব)…..
১৫. হাদীছের অন্তর্নিহিত ফিক্বহ সম্পর্কে আলোকপাত :
শায়খ আলবানী স্বীয় গবেষণাকর্ম কেবল হাদীছ তাখরীজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং হাদীছের বিশুদ্ধতা সাব্যস্তের পর উক্ত হাদীছ থেকে উদ্ভূত শারঈ বিধান সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন। একই সাথে মতভেদপূর্ণ বিষয়গুলোতে বিশুদ্ধ দলীলের আলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে তাঁর গ্রন্থসমূহ ফিক্বহুল হাদীছ তথা হাদীছ ভিত্তিক ফিক্বহের ক্ষেত্রে গুরুতবপূর্ণ সংযোজন হিসাবে গৃহীত হয়।
যেমন আলী (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীছকে[1] ছহীহ সাব্যস্ত করার পর তিনি এর তিনটি ফায়েদা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। যার মূল বক্তব্য হ’ল- (১) মুসলমানদের জন্য তাদের মুশরিক আত্মীয়-স্বজনের দাফন কার্যে অংশগ্রহণ করা শরী‘আত সম্মত নয় (২) নিকটাত্মীয় হ’লেও কোন কাফেরকে গোসল দেওয়া, কাফন পরানো, জানাযা আদায় জায়েয নয় (৩) মুশরিক আত্মীয়ের জানাযা অনুসরণ করা জায়েয নয়। কেননা রাসূল (ছাঃ) স্বীয় চাচার ক্ষেত্রে তা করেননি। যদিও তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সবচেয়ে ভালোবাসার পাত্র ছিলেন।[2]
রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী- الأذنان من الرأس ‘দুই কান মাথার অংশ’। হাদীছটি ছহীহ সাব্যস্তের পর তিনি এর অন্তর্নিহিত ফিক্বহ বর্ণনা করে বলেন, ওলামায়ে কেরামের মতপার্থক্য রয়েছে এমন দু’টি ফিক্বহী মাসআলার দলীল হিসাবে হাদীছটি গৃহীত হবে। ১ম মাসআলাটি হ’ল, কর্ণদ্বয় মাসাহ করা কি ফরয না সুন্নাত? হাম্বলীগণ ফরযের দিকে অগ্রগামী হয়েছেন। তাদের দলীল আলোচ্য হাদীছটি। যেখানে কর্ণদ্বয় মাথার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আর হাদীছটি কেবল এটা বুঝানোর জন্যই বর্ণিত হয়েছে যে, মাসাহের ক্ষেত্রে কর্ণদ্বয়ের হুকুম মাথার হুকুমের মতই। অন্যদিকে জুমহূর বিদ্বানের মতে কর্ণদ্বয় মাসাহ করা সুন্নাত মাত্র। যেমনটি ‘আল-ফিক্বহু আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আহ’ গ্রন্থে (১/৫৬) এসেছে। কিন্তু আমরা উক্ত হাদীছের বিপরীত এ মতকে জায়েয করার ব্যাপারে তাদের পক্ষে কোন দলীল পাইনি, কেবল ইমাম নববী-এর একটি বক্তব্য ব্যতীত। যেখানে তিনি বলেছেন, সকল তুরুক বা সূত্রের নিরিখে উক্ত হাদীছটি যঈফ (আল-মাজমূ‘ ১/৪১৫)। অথচ হে পাঠক! যখন তুমি জানবে যে বিষয়টি এমন নয়। বরং হাদীছটির কিছু তুরুক ছহীহ এবং কিছু ছহীহ লি গায়রিহী, যা নববীর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। তখন তুমি জুমহূরের দলীলের দুর্বলতা সম্পর্কে বুঝতে পারবে। সাথে সাথে কর্ণদ্বয় মাসাহ ওয়াজিব হওয়া এবং তা মাথার অংশ হওয়ার ব্যাপারে হাদীছের নির্দেশনা আঁকড়ে ধরা ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টিও অবগত হবে।[3] অতএব এক্ষেত্রে কর্ণদ্বয় মাসাহ করা ফরয হওয়াটাই সঠিক।
একইভাবেإن الله زادكم صلاة وهي الوتر، فصلوها بين صلاة العشاء إلى صلاة الفجر ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য একটি অতিরিক্ত ছালাত বৃদ্ধি করেছেন, সেটি হ’ল বিতর। তোমরা তা এশা ও ফজর ছালাতের মধ্যবর্তী সময়ে আদায় কর’ মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ছহীহ সাব্যস্ত করার পর তার ফিক্বহী দিক তুলে ধরে আলবানী বলেন, হাদীছটির মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী فصلوها দ্বারা বাহ্যিকভাবে ছালাতুল বিতর ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়। এ মত পোষণ করেছেন হানাফীগণ। তবে তা জুমহূর বিদ্বানগণের বিপরীত। যদি ফরয ছালাত দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য দলীল না থাকতো, তাহ’লে হানাফীদের বক্তব্য সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। সেকারণে উক্ত ছালাতকে ওয়াজিব বলার উপায় নেই। বরং তা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ বা মুস্তাহাব সাব্যস্ত হবে।…তবে হানাফীগণ তাদের উক্ত বক্তব্যের ব্যাপারে বলে থাকেন যে, তারা বিতরকে ওয়াজিব সাব্যস্তকরণ দ্বারা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের মত ওয়াজিব বুঝাননি। বরং তা ফরয ও সুন্নাত ছালাতের মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে। অর্থাৎ ফরয ছালাতের চেয়ে দুর্বল এবং সুন্নাত ছালাতের চেয়ে শক্তিশালী।
কিন্তু জানা আবশ্যক যে, হানাফী মাযহাবের উক্ত বক্তব্য নব উদ্ভাবিত একটি পরিভাষার উপর ভিত্তিশীল। ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফগণ যে ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। তা হ’ল ফরয ও ওয়াজিবের মধ্যে প্রামাণ্যতা ও ছওয়াবগত পার্থক্য। যেমনটি তাদের গ্রন্থসমূহে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। অতএব হানাফী মাযহাবের ইজতিহাদী নীতি অনুযায়ী তাদের বক্তব্যের অর্থ হবে, বিতর ছালাত পরিত্যাগকারী ক্বিয়ামতের দিন ফরয ছালাত পরিত্যাগকারীর চেয়ে কম আযাব ভোগ করবে। অতএব তাদেরকে একথা বলা যায় যে, কিভাবে এটা ছহীহ হবে যখন রাসূল (ছাঃ) ফরয ব্যতীত অন্য কোন ছালাত আদায় করবে না বলে সংকল্পকারীর ব্যাপারে বলেন যে, সে সফলকাম হয়েছে। শাস্তির সাথে সফলতা কিভাবে একত্রিত হবে? অতএব বিতর ছালাত ওয়াজিব নয় এবং না হওয়ার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর উক্ত বক্তব্যই যথেষ্ট। সেকারণে অধিকাংশ বিদ্বান এটা সুন্নাত হওয়া এবং ওয়াজিব না হওয়ার ব্যাপারে একমত। আর এটাই সঠিক। তবে উক্ত হাদীছসহ অন্যান্য হাদীছের ভিত্তিতে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বিতর ছালাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করা ও তা আদায়ে অবহেলা না করা যরূরী।[4]
১৬. সমাজ সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি :
আলবানী সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে হাদীছের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের ময়দানে অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি হাদীছকে জীবনবিধান হিসাবে বিশুদ্ধরূপে উপস্থাপনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর একনিষ্ঠ লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের আক্বীদা-বিশ্বাসকে যুগপরিক্রমায় অনুপ্রবিষ্ট নানা প্রকার শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা। তাফসীরকে যাবতীয় জাল-যঈফ ও ভিত্তিহীন হাদীছ ও ইসরাঈলী বর্ণনার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করা। ফিক্বহকে যঈফ ও জাল হাদীছ ভিত্তিক মাসআলা-মাসায়েল এবং ছহীহ হাদীছ বিরোধী ইজতিহাদ থেকে মুক্ত করে বিশুদ্ধ হাদীছ ভিত্তিক শারঈ বিধি-বিধান দ্বারা সুশোভিত করা। অতঃপর ভবিষ্যত প্রজন্মকে যাবতীয় কুফরী সংস্কৃতির প্রভাব থেকে দূরে রেখে বিশুদ্ধ ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাস ও বিধি-বিধানের ভিত্তিতে গড়ে তোলা। তাঁর মতে, এরূপ সর্বব্যাপী সংস্কার ব্যতীত মুসলমানদের মধ্যে কাংখিত শান্তি, নিরাপত্তা ও হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে আনার কোন উপায় নেই।[5]
সেকারণ তাঁর যাবতীয় কর্মতৎপরতার পিছনে ছহীহ সুন্নাহকে মানুষের নিকটে পৌঁছে দেওয়া ও শিরক-বিদ‘আত থেকে সতর্ক করা এবং তদনুযায়ী সমাজের মানুষকে পরিশুদ্ধ করার মহৎ প্রতিজ্ঞা কাজ করেছে। তাহক্বীক্ব ও তাখরীজসহ তাঁর যাবতীয় কর্মতৎপরতার পরতে পরতে যার প্রতিফলন দেখা যায়। সাথে সাথে একজন দরদী সমাজ সংস্কারকের প্রতিচ্ছবিও তাঁর মধ্যে ফুটে ওঠে।
যেমন- (ক) শারীদ ইবনু সুওয়াইদ আছ-ছাক্বাফী বর্ণিত হাদীছ, একবার কারণবশত তিনি জনৈক দাসীকে মুক্ত করার জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে অনুমতি চাইলে তিনি বলেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তারপর তাকে আনা হলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমি কে? সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,أعةقها فإنها مؤمنة ‘তুমি ওকে মুক্ত করে দাও। কেননা সে একজন মুমিনা নারী’।[6]
আক্বীদাগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ হাদীছটির তাখরীজে ২৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী দীর্ঘ আলোচনার শুরুতে আলবানী এটির সংকলনকারী মোট ৮টি হাদীছ গ্রন্থের উদ্ধৃতি পৃষ্ঠা নম্বরসহ উল্লেখ করেছেন এবং হাদীছটিকে ‘হাসান’ সাব্যস্ত করেছেন। অতঃপর বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থ থেকে হাদীছটির অন্যান্য সূত্র, মুতাবা‘আত ও শাওয়াহেদসমূহ উল্লেখ করে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা পেশ করেছেন এবং প্রত্যেকটি সূত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং দলীল হিসাবে সেগুলির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেছেন। অতঃপর শায়খ আব্দুল্লাহ গুমারী, মুহাম্মাদ যাহিদ আল-কাওছারী, হাসান সাক্কাফসহ যেসব বিদ্বান ‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’ মর্মে তাঁদের আক্বীদা বিরোধী হওয়ায় উক্ত হাদীছের উপর সমালোচনা পেশ করেছেন এবং হাদীছটি এ শব্দে যঈফ এবং অন্য শব্দে ছহীহ প্রমাণ করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, আলবানী তাদের বক্তব্য তুলে ধরে তা খন্ডনে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেছেন। অতঃপর ‘আরশে ‘আযীমে’ আল্লাহ তা‘আলার অবস্থানে ব্যাপারে জাহমিয়া ও মু‘তাযিলাদের ভ্রান্তবিশ্বাস ও এ ব্যাপারে সঠিক আক্বীদা সুস্পষ্ট ও সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।[7]
(খ)الدنيا حرام على أهل الآخرة، والآخرة حرام على أهل الدنيا، والدنيا والآخرة حرام على أهل الله ‘আখেরাতের অধিবাসীদের জন্য দুনিয়া হারাম এবং দুনিয়ার অধিবাসীদের জন্য আখেরাত হারাম। আর দুনিয়া ও আখেরাত দু’টিই হারাম আল্লাহ ওয়ালাদের জন্য’।
উক্ত হাদীছটি সম্পর্কে মুহাদ্দিছগণের বক্তব্য উল্লেখ শেষে হাদীছটি জাল সাব্যস্ত করার পর তিনি বলেন, সত্যিই যিনি এ হাদীছ বর্ণনা করবেন, তিনি ছিক্বাহ হবেন না। বরং তিনি হবেন নিকৃষ্ট মিথ্যাবাদী। কারণ এটি বাতিল হওয়ার ব্যাপারে কোন বিবেকবান মুমিনের সন্দেহ থাকতে পারে না। আর কিভাবেই বা রাসূল (ছাঃ) আখেরাতের অধিবাসী মুমিনদের জন্য দুনিয়াকে হারাম করবেন, যার উত্তম বস্ত্ত দ্বারা উপকৃত হওয়াকে তাদের জন্য স্বয়ং আল্লাহ হালাল করে দিয়েছেন। যিনি বলেছেন, هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য যমীনের সব কিছুকে সৃষ্টি করেছেন (বাক্বারাহ ২/২৯)। যিনি বলেছেন, قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘আপনি বলে দিন, আল্লাহর সাজ-সজ্জা, যা তিনি বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যসমূহকে কে হারাম করেছে? বলে দাও, এসব নে‘মত তো খালেছভাবে কেবল মুমিনদের জন্যই পার্থিব জীবনে এবং ক্বিয়ামত দিবসে…’ (আ‘রাফ ৭/৩২)।
তাই কিভাবেই বা বলা সম্ভব যে, রাসূল (ছাঃ) দুনিয়া ও আখেরাতকে একসাথে হারাম করে দিয়েছেন আল্লাহ ওয়ালাদের উপর? অথচ আল্লাহ ওয়ালারাই হচ্ছেন কুরআনের প্রকৃত অনুসারী। যারা তার বিধানকে প্রতিষ্ঠা করে এবং তাঁর নির্দেশাবলীর উপর আমল করে। আর আখেরাত হ’ল জান্নাত অথবা জাহান্নাম। আল্লাহ তাঁর প্রতি একনিষ্ঠদের উপর জাহান্নামকে হারাম করে দিয়েছেন। এ সংবাদ তিনি নিজেই দিয়েছেন, যেমনভাবে মুমিনদের জন্য জান্নাতকে তিনি ওয়াজিব করে দিয়েছেন। অথচ কিভাবে এই মিথ্যাবাদী বলে যে, রাসূল (ছাঃ) আখেরাতকে তাদের উপর হারাম করে দিয়েছেন? অথচ আখেরাতেই রয়েছে জান্নাত, যা মুত্তাক্বীদের জন্য ওয়াদা করা হয়েছে।
আমার ধারণায় উক্ত হাদীছটির জালকারী একজন অজ্ঞ ছূফী। তিনি এ দ্বারা মুসলমানদের মাঝে ছূফী আক্বীদা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। যেখানে আত্মিক পরিশুদ্ধিতার নামে আল্লাহর হালালকৃত বস্ত্তকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।[8]
(গ) اخةلاف أمةي رحمة ‘আমার উম্মতের মধ্যে মতভেদ রহমত স্বরূপ’ মর্মে বর্ণিত হাদীছটির ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, হাদীছটি ছহীহ নয়, বরং বাতিল ও ভিত্তিহীন। ইমাম সুবকীর ভাষায় ‘আমি হাদীছটির ছহীহ, যঈফ, মাওযূ‘ কোন প্রকার সনদই খুজে পাইনি’। আলবানী বলেন, ‘… যঈফ হওয়ার সাথে সাথে হাদীছটি কুরআনের বিরোধী। কেননা আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে দ্বীনের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন। … সুতরাং সনদ ও মতন উভয় দিক দিয়েই হাদীছটি যঈফ’।
অতঃপর এ ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে তিনি বলেন, ছাহাবায়ে কেরাম সর্বদাই ইখতেলাফ অপসন্দ করতেন। যেকোন উপায়ে তা থেকে দূরে থাকতেন। দ্বীনের শাখাগত কিছু বিষয়ে তাদের মাঝে প্রসিদ্ধ মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও বাহ্যিক ঐক্যকে তারা কঠোরভাবে রক্ষা করতেন। মুসলমানদের কালেমার মাঝে বিভেদ সৃষ্টি এবং ঐক্য বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ থেকে তারা সর্বদা দূরে থাকতেন। উদাহরণস্বরূপ তাদের মধ্যে কেউ ছালাতের মধ্যে বিসমিল্লাহ সরবে বলাকে শরী‘আত সম্মত মনে করতেন, কেউ তা শরী‘আত বহির্ভূত মনে করতেন। কেউ রাফ‘ঊল ইয়াদাইনকে মুস্তাহাব মনে করতেন, কেউ করতেন না। কেউ নারীদেহ স্পর্শ্বে ওযূ ভেঙ্গে যাবে মনে করতেন, কেউ তা মনে করতেন না। এরপরেও তারা একত্রে এক ইমামের পিছনে ছালাত আদায় করতেন। মতবিরোধের কারণে কেউ কোন ইমামের পিছনে ছালাত আদায় থেকে বিরত থাকতেন না।[9]
মুসলিম বিশ্বে শায়খ আলবানীর গবেষণার প্রভাব
১. তাখরীজুল হাদীছ ও ফিক্বহুল মুক্বারিন-এর একাডেমিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠাকরণ :
আলবানীর কর্মতৎপরতার ফলে আধুনিক যুগে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘তাখরীজুল হাদীছ’-এর সুদৃঢ় একাডেমিক ভিত্তি তৈরী হয়েছে। যেমন মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানকালে তিনি ‘ইলমুল ইসনাদ’ নামে হাদীছের সনদ সম্পর্কে শিক্ষাদানের জন্য পৃথক একটি বিষয় সিলেবাসভুক্ত করেন। যেখানে তিনি হাদীছ তাখরীজ এবং রাবীদের সমালোচনার পদ্ধতি সম্পর্কে হাতে-কলমে শিক্ষাদান করতেন। সেসময় মিসরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইলমুল ইসনাদ’ বিষয়ে পাঠদান করা হ’ত না। ফলে প্রথমবারের মত আলবানীর মাধ্যমে বিষয়টির উপর পাঠদান শুরু হয় এবং সময়ের ব্যবধানে বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথকভাবে পাঠদানের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।[10]
ফিক্বহী ময়দানে আলবানীর যাবতীয় গবেষণা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল বিশুদ্ধ দলীলভিত্তিক ফিক্বহ চর্চার উপর দন্ডায়মান। ফলে সময়ের ব্যবধানে উক্ত পদ্ধতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে الفقه المقارن বা তুলনামূলক ফিক্বহ নামে পৃথক একটি সিলেবাসে রূপ লাভ করে। তুলনামূলক ও দলীলভিত্তিক এই ফিক্বহ চর্চার মধ্য দিয়েই আধুনিক বিশ্বে ইজতিহাদের দুয়ার অধিকতর উন্মুক্ত হয়েছে। ফলে মুসলিম উম্মাহ বহু বিধানের ক্ষেত্রে মাযহাবী গোঁড়ামীপূর্ণ একপেশে সিদ্ধান্তের বেড়াজাল থেকে মুক্তি লাভ করেছে।
শায়খ ওসামা শাহহাযা বলেন, ‘ছহীহ হাদীছসমূহ পৃথকীকরণ এবং বহু ফক্বীহের নিকটে অজ্ঞাত থাকা আমলী সুন্নাতসমূহ ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ‘ফিক্বহুল মুক্বারিন’ বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে শায়খ আলবানীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ফলে হাদীছের উপর নির্ভরশীলতা আধুনিক গবেষণার মৌলিক ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এমন ফিক্বহী গবেষণা পাওয়া বিরল হয়ে গেছে, যেখানে মৌলিক বা সহায়ক হিসাবে আলবানীর তাখরীজের উপর নির্ভর করা হয়নি।[11]
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হাদীছের তাখরীজ, তাহক্বীক্ব ও তাদরীসে বিশেষ অবদান রাখায় সঊদী সরকার কর্তৃক ‘বাদশাহ ফয়ছাল’ পুরস্কারে ভূষিত হন। এসময় পুরস্কার প্রদান কমিটি যে লিখিত স্বীকৃতি প্রদান করে, সেখানে বলা হয়েছে যে,…ويعد الشيخ الألباني شخصية علمية رائدة وصاحب مدرسة مةميزة وله عطاء حديثي أغنى الحقل العلمي وأصبحة جهوده وأعماله مراجع لطلاب العلم وعونًا لدارسي السنة النبوية- ‘…শায়খ আলবানী শীর্ষস্থানীয় জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব ও বিশেষ ইলমী ধারার অগ্রদূত হিসাবে পরিগণিত। ইলমুল হাদীছে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তা জ্ঞানের ময়দানকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। সাথে সাথে তাঁর প্রচেষ্টা ও রচনাসমূহ জ্ঞানান্বেষীদের কেন্দ্রস্থল ও হাদীছ শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক হিসাবে পরিণত হয়েছে।[12]
২. সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ছহীহ হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণের আগ্রহ বৃদ্ধি :
হাদীছের বিশুদ্ধতা নিরূপণের ক্ষেত্রে শায়খ আলবানীর মৌলিক লক্ষ্য ছিল ‘সুন্নাহকে উম্মতের নাগালের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া’। এর পেছনেই তিনি তাঁর যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। প্রসিদ্ধ হাদীছগ্রন্থসমূহ তাখরীজ করে ছহীহ ও যঈফ হাদীছসমূহ পৃথক ভাগে সংকলন করেছেন। ছহীহ বুখারী ও মুসলিমকে সংক্ষিপ্ত করে পুনরাবৃত্তি ছাড়া ভিন্ন রীতিতে সংকলন করেছেন। পূর্ববর্তী মুহাদ্দিছগণের হাদীছভিত্তিক বহু রচনা তাহক্বীক্ব ও তাখরীজ করে সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশ করেছেন। এসবের পিছনে একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল- মানুষ যেন খুব সহজেই ছহীহ হাদীছের নাগাল পায়। মাযহাবী তাক্বলীদের বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়ার কারণে হাদীছের উপর মাযহাবী সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যে নিন্দনীয় প্রবণতা মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত ছিল, তা থেকে যেন তারা বেরিয়ে আসতে পারে। তারা যেন কেবল বরকতের আশায় হাদীছ অধ্যয়ন না করে বরং তা থেকে দলীল গ্রহণে অভ্যস্ত হয়। সর্বোপরি তাদের মধ্যে যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিশুদ্ধ বাণীকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
এভাবে তিনি মানুষের মাঝে সরাসরি হাদীছ থেকে জীবনবিধান গ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। ফলে আক্বীদা ও আমলসহ সর্বক্ষেত্রে ছহীহ হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণের পথ জনসাধারণের মাঝে আরো উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ ড. আব্দুল মুহসিন আববাদ বলেন, ‘শায়খ আলবানী সুন্নাহ ও হাদীছের ময়দানে অসাধারণ খেদমত পেশ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণ প্রচেষ্টা ছিল সুন্নাহর দিকে পৌঁছানোর পথকে সহজ করা এবং তা জ্ঞানান্বেষীদের নাগালের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া’।[13]
গবেষক ড. আব্দুর রাযযাক আসওয়াদ বলেন, আলবানী কেবল হাদীছের তাখরীজ করেই ক্ষান্ত হননি। বরং আলেম থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষের মনোজগতে হাদীছের প্রতি গুরুত্ববোধ পুনর্জীবিত করেছেন। তিনি হাদীছ কেবল পড়া বা বরকত হাছিলের মাধ্যম হিসাবে নয় বরং হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করা ও তার উপর আমলের প্রতি গুরুত্ববোধকে আবশ্যিক করে তুলেছেন। এটাই শায়খ আলবানীর কৃতিত্ব। যার সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় যে, শাম অঞ্চলে তিনিই ইলমে হাদীছকে পুনর্জীবিত করেছেন। তিনি বলেন, আলবানীর দৃষ্টিভঙ্গি ও গৃহীত নীতির মাধ্যমে মিসর, জর্দান, সঊদী আরব, আরব আমিরাতসহ আরব বিশ্বের বহু মানুষ প্রভাবিত হয়েছেন।[14]
৩. বিপুল পরিমাণ গ্রন্থে আলবানীর তাখরীজ ও সিদ্ধান্তকে দলীল হিসাবে গ্রহণ :
বিশ্বব্যাপী আলবানীর গ্রহণযোগ্যতার আরেকটি দলীল হ’ল, বিপুল পরিমাণ গ্রন্থে বিশুদ্ধতা নিরূপণকারী মুহাদ্দিছ হিসাবে আলবানীর নামের ব্যবহার। মুসলিম সমাজে ধর্মীয় বিষয়ে প্রকাশিত যেকোন গ্রন্থে ছহীহাইন বাদে কোন হাদীছ উল্লেখ করা হ’লে তার বিশুদ্ধতার আলোচনায় صححه الألباني ‘আলবানী একে ছহীহ বলেছেন’ বা ضعفه الألباني ‘আলবানী একে যঈফ বলেছেন’ উল্লেখ করা যেন বর্তমানে প্রায় আবশ্যিক বিষয় হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। অধিকাংশ মুহাক্কিক আলেম তাদের তাহক্বীক্বকৃত হাদীছ, তাফসীর ও ফিক্বহের গ্রন্থসমূহে যেকোন হাদীছ সম্পর্কে আলবানীর মন্তব্য উল্লেখ করছেন। আম জনসাধারণও বর্তমানে কোন হাদীছ সম্পর্কে আলবানীর মন্তব্য জানার গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুভব করে থাকেন। সর্বোপরি হাদীছের বিশুদ্ধতা বা দুর্বলতার আলোচনায় আলবানীর নাম আবশ্যকীয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।
৪. শারঈ বিষয়ে যে কোন রচনার ক্ষেত্রে তাখরীজুল হাদীছের ব্যাপক প্রচলন :
আলবানীর দাওয়াতের মাধ্যমে সর্বশ্রেণীর মানুষের মাঝে হাদীছ গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে যেমন সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি শারঈ বিষয়ে বিদ্বানদের লিখিত গ্রন্থাবলীতেও হাদীছসমূহ তাখরীজসহ উল্লেখ করার রীতি বর্তমানে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক খন্ডে বিভক্ত বৃহদায়তন গ্রন্থ থেকে শুরু করে কয়েক পৃষ্ঠার ছোট পুস্তিকাতেও এখন বিস্তারিত বা সংক্ষিপ্ত তাখরীজের অপরিহার্য ব্যবহার দেখা যায়। বৃহত্তর তাফসীর গ্রন্থসমূহও বর্তমানে বিস্তারিত তাখরীজসহ প্রকাশিত হচ্ছে। সর্বোপরি আলবানীর কর্মতৎপরতার মাধ্যমে সর্বশ্রেণীর মানুষ সহ লেখকদের মাঝে তাখরীজুল হাদীছের প্রতি গুরুত্বারোপ যে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
৫. হাদীছভিত্তিক রচনাবলীর ব্যাপক প্রসার :
আলবানী একদিকে আক্বীদা ও আমল সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ হাদীছসহ প্রসিদ্ধ হাদীছ গ্রন্থসমূহ যেমন সুনানুল আরবা‘আহ, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, আল-আদাবুল মুফরাদ, আল-জামি‘উছ ছাগীর ইত্যাদির তাখরীজ সম্পন্ন করেছেন। অন্যদিকে বিশুদ্ধ হাদীছের ভিত্তিতে ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত সহ ফিক্বহী বিষয়ক বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিশেষত ছালাত বিষয়ে প্রতিটি হাদীছের বিস্তারিত তাখরীজসহ বিশুদ্ধ হাদীছের আলোকে ১২১৮ পৃষ্ঠাব্যাপী যে গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন, তা বর্তমান যুগে তাক্বলীদী বেড়াজালমুক্তভাবে হাদীছ ভিত্তিক ফিক্বহ গ্রন্থ রচয়িতাদের জন্য আলোকবর্তিকা হিসাবে বিবেচিত হয়। পূর্ব থেকেই বিদ্বানদের মাঝে এরূপ রচনার ধারাবাহিকতা চলে আসলেও আলবানীর রচনার ফলে আধুনিক যুগে অধিকাংশ হাদীছ হুকুম সহ আম জনসাধারণের মাঝে সহজলভ্য হয়ে গেছে। ফলে সর্বশ্রেণীর লেখকদের মাঝে হাদীছভিত্তিক রচনার ব্যাপক প্রসার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
৬. বাতিল আক্বীদা ও আমলের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি :
আলবানীর কার্যক্রমের মাধ্যমে বাতিল আক্বীদা ও আমলের ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে বিশেষ সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ হাদীছ তাখরীজের ক্ষেত্রে আলবানীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুসলিম উম্মাহর আক্বীদা-বিশ্বাসকে যুগপরিক্রমায় অনুপ্রবিষ্ট নানা প্রকার শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা। তাই তাখরীজের ক্ষেত্রে যেসব হাদীছ দ্বারা বিভিন্ন বাতিল মতবাদপন্থীরা তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা-আমল সাব্যস্তের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে, তিনি সেগুলো বিশেষভাবে সংকলন করেছেন। ফলে শী‘আ, রাফেযী, আশা‘ইরাহ, জাহমিইয়াহ, খারেজী, ছূফী, কার্রামিয়াহ, মাতুরীদিইয়াহ, মুরজিয়াহ, মু‘তাযিলা, কাদিয়ানী, আহলে কুরআন প্রভৃতি বাতিল ফিরক্বাগুলি যঈফ ও জাল হাদীছের মাধ্যমে ও ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করে যেসব ভ্রান্ত আক্বীদা-আমলের প্রসার ঘটিয়েছে, তিনি সেসবের অসারতা প্রমাণের প্রয়াস পেয়েছেন। বিশেষত শী‘আ ও রাফেযীরা নিজেদের ভ্রান্ত বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠাদানের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নামে যে সব হাদীছ রচনা করেছে, সূক্ষ্ম ও বিস্তারিত তাখরীজের মাধ্যমে আলবানী তার অসারতা প্রমাণ করেছেন এবং যেসব ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করে তারা নিজেদের মতবাদের পক্ষে ব্যবহার করেছে, প্রজ্ঞাপূর্ণ পর্যালোচনার মাধ্যমে আলবানী তা খন্ডন করে সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন।[15]
যেমন لا مهدي إلا عيسى ‘ঈসা (আ.)-ই হ’লেন মাহদী’। ইবনু মাজাহ ও হাকেম সংকলিত উক্ত হাদীছটিকে আলবানী ‘মুনকার’ সাব্যস্তের পর তার কারণসমূহ মুহাদ্দিছগণের মতামতসহ বিস্তারিতভাবে পেশ করেছেন। অতঃপর আলোচনার শেষে তিনি বলেন, ক্বাদিয়ানী সম্প্রদায় তাদের নেতা মিথ্যা নবুঅতের দাবীদার মির্যা গোলাম আহমাদ ক্বাদিয়ানীকে নবী সাব্যস্তকরণের ক্ষেত্রে এ হাদীছটি ব্যবহার করে। একই সাথে তারা তাকে ঈসা ইবনু মারইয়াম বলে দাবী করে, শেষ যামানায় যার আগমনের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। কেননা এই মুনকার হাদীছটির দ্বারা ঈসা (আ.)-ই যে ইমাম মাহদী, তারও প্রমাণ পেশ করা যায়।[16]
একইভাবে সমাজে প্রচলিত নানা প্রকার বিদ‘আতী আমলসমূহের অসারতা প্রমাণেও তিনি সদা তৎপর ছিলেন। তাঁর মতে, এসব বিদ‘আতী আমলসমূহ ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম মাধ্যম হ’ল যঈফ ও জাল হাদীছ দ্বারা আমল সাব্যস্তকরণ এবং শারঈ বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে তা থেকে দলীলগ্রহণ। তাই বহু হাদীছ তাখরীজের ক্ষেত্রে তিনি তার দুর্বলতা সাব্যস্তের সাথে সাথে মুসলিম উম্মাহর উপর তার কুপ্রভাব ও তা থেকে প্রচলিত বিদ‘আতী কর্মসমূহ থেকে সতর্ক করেছেন। একইভাবে কোন হাদীছের বিশুদ্ধতা সাব্যস্তের পর তা দ্বারা সমাজে প্রচলিত কোন বিদ‘আত অপনোদনের প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন- মসজিদে গোলাকার হয়ে বসে যিকরকারী একদল মানুষের কার্যক্রমকে আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) কর্তৃক বিদ‘আত সাব্যস্তকরণ সম্পর্কিত একটি আছারকে[17] ছহীহ সাব্যস্ত করার পর আলবানী বলেন, ইবনু মাস‘ঊদের এ ঘটনার মধ্যে তরীক্বাপন্থী ও সুন্নাহবিরোধী পদ্ধতিতে হালক্বায়ে যিকরকারীদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। …এ হাদীছ থেকে আরো শিক্ষা অর্জন করা যায় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর কথা ও কর্ম দ্বারা যিকরের প্রমাণিত সুন্নাত হল, আঙ্গুল দ্বারা তাসবীহ গণনা করা। যেমনটি আমার ‘আর-রাদ্দু ‘আলাল হাবাশী’ সহ অন্যান্য গ্রন্থে এসেছে।
উক্ত হাদীছ থেকে আরো ফায়েদা গ্রহণ করা যায় যে, অধিক ইবাদতের কোন গুরুত্ব নেই। বরং সুন্নাহ সম্মত হওয়া ও বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকাই গুরুত্বপূর্ণ। যেদিকে নির্দেশনা দিয়ে ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেছেন, সুন্নাত পালনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা বিদ‘আতী আমলে অধিক পরিশ্রম করার চেয়ে উত্তম’। আরেকটি ফায়েদা হল, ছোট বিদ‘আত বড় বিদ‘আতের দিকে ধাবিতকারী। সেকারণ তুমি দেখছ যে, ঐ হালক্বায়ে যিকরকারীরা পরবর্তীতে খারেজী হয়ে যায়, যাদেরকে আলী (রাঃ) হত্যা করেন।[18]
এভাবে তিনি স্বীয় তাখরীজের বিভিন্ন স্থানে খুঁটিনাটি বিদ‘আতী কর্মসমূহ তুলে ধরেছেন এবং তার অসারতা প্রমাণ করেছেন। শায়খ আবু ‘উবায়দা মাশহূর ইবনু হাসান আলবানী ১১৯টি গ্রন্থের ভিত্তিতে সহস্রাধিক বিদ‘আতের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনীসমূহ সংকলন করে قاموس البدع নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
একইভাবে তিনি ছালাত, হজ্জ, জানাযা, তাওয়াসসুল প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে একদিকে ঐ সম্পর্কিত হাদীছসমূহ তাখরীজ সহ উল্লেখ করেছেন, অন্যদিকে ওইসব আমলের ক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত খুঁটিনাটি বিদ‘আতসমূহ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। ফলে সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিদ‘আতী আক্বীদা ও আমলের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে।
৭. বিশ্বব্যাপী সালাফী দাওয়াতের ভিত্তি মযবূতীকরণ :
হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে শিরক ও বিদ‘আতের ভয়াবহ আগ্রাসনে জাহেলিয়াতের যে গাঢ় তমিস্রা ছড়িয়ে পড়েছিল, সেসময় ইসলামের পুনর্জন্মবার্তা নিয়ে ‘সালাফী আন্দোলন’ তথা ইসলামের বিশুদ্ধ রূপের দিকে প্রত্যাবর্তন ও সংস্কারবাদী এক মহতী আন্দোলনের জন্ম হয়। যে আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব আত-তায়মী (১৭০৩-১৭৬১ খ্রি.) রাহিমাহুল্লাহ। যার বিকীর্ণ আলোকচ্ছটা আরব মরুর ঊষরভূমি পেরিয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত পথের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের আহবানকারী হিসাবে এটি পরবর্তীতে ‘সালাফী আন্দোলন’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে।
এ আন্দোলন ছিল মুসলিম বিশ্বে শিরক, বিদ‘আত অর্থাৎ ইসলামী শরী‘আতের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট নবসৃষ্ট বিধি-বিধান, বিজাতীয় সংস্পর্শ থেকে আগত যাবতীয় শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম একটি সংগঠিত ও সফল আন্দোলন, যা মধ্যযুগীয় অবক্ষয়কালীন দুর্যোগ কাটিয়ে ইসলামের নবতর বিকাশের জন্য এক যুগান্তকারী মাইলফলকে পরিণত হয়। আধুনিক যুগের সকল ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলনের আদর্শিক প্রেরণা হ’ল এই আন্দোলন।[19]
শায়খ আলবানী ছিলেন বিংশ শতাব্দীতে উক্ত সালাফী আন্দোলনের ধারক-বাহক ও যুগসংস্কারক ব্যক্তিত্ব। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা মানুষের সার্বিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে ঢেলে সাজানোর আহবান নিয়ে যে সালাফী আন্দোলন চলমান রয়েছে, তার পিছনে আলবানীর গবেষণাকর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।[20]
উক্ত আন্দোলনের ফলে হাদীছে নববীর ভিত্তি জনসাধারণ্যে বহুগুণ মযবূতী লাভ করেছে। এছাড়া তাঁর নিকট শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে এবং তাঁর গ্রন্থরাজির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে বিপুল পরিমাণ দা‘ঈ ইলাল্লাহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশুদ্ধ দাওয়াতের প্রচার ও প্রসারে ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিয়ে চলেছেন। ফলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণের পথ সাধারণ মানুষের জন্য সহজতর হয়েছে।[21]
ড. মুহাম্মাদ হাসসানীন হাসান বলেন,فهو مجدد هذا العـصر في الحـديث بـلا منازع. فإذا كان الشيخ ابن عبد الوهاب قد جدد عقيدة توحيـد، والـشيخ الشوكاني جدد الفقه، فإن الشيخ الألباني مجدد الحديث النبوي- ‘শায়খ আলবানী বর্তমান যুগে ইলমে হাদীছের অবিসংবাদিত মুজাদ্দিদ। যেমন শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল ওয়াহহাব তাওহীদ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাজদীদ এনেছেন, শায়খ শাওক্বানী ফিক্বহী ময়দানে তাজদীদ সৃষ্টি করেছেন। তেমনি শায়খ আলবানী হাদীছে নববীর ক্ষেত্রে মুজাদ্দিদ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন’।[22]
৮. গবেষকদের উপর প্রভাব :
শায়খ আলবানীর বিপুল কর্মযজ্ঞ মুসলিম বিশ্বে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর সম্পর্কে পরবর্তী গবেষকদের বিপুল পরিমাণ লেখনী থেকে। তাঁর জীবন, রচনাবলী, কর্মনীতি, অবদান ও চিন্তাধারা সম্পর্কে এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। যার এক-তৃতীয়াংশ রয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত গবেষণাকর্ম। এছাড়া তাখরীজ, হাদীছ, ফিক্বহ, তাফসীর ও সীরাত সহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলীর সমালোচনা ও তার প্রতিউত্তরে এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
এছাড়া শায়খ আলবানীর রেখে যাওয়া ইলমী আমানতের উপর সবচেয়ে বড় যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে তা হ’ল- موسوعة العلامة الإمام مجدد العصر محمد ناصر الدين الألباني। ইয়ামনের ছান‘আয় অবস্থিত مركز النعمان للبحوث والدراساة الإسلامية وةحقيق الةراث والةرجمة থেকে শায়খ শাদী বিন মুহাম্মাদ আলে নু‘মান এর নেতৃত্বে কাজটি চলমান রয়েছে। এর মাধ্যমে আলবানীর লিখিত ও প্রকাশিত মোট ১১৬টি গ্রন্থ বিশ্লেষণ করে ও কয়েক হাযার ঘন্টাব্যাপী রেকর্ডকৃত ক্যাসেটসমূহ লেখ্যরূপে রূপান্তর করে বিষয়, অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা শুরু হয়েছে। যার বেশ কিছু খন্ড ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন আলবানীর আক্বীদা বিষয়ক যাবতীয় রচনা ও বক্তব্য নিয়ে প্রকাশিত হয় جامع ةراث العلامة الألباني في العقيدة। ৯ খন্ডের বিশালায়তন গ্রন্থটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৯০০। মানহাজগত বিষয় ও সমসাময়িক সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে তাঁর লেখনী ও বক্তব্যসমূহের সংকলন جامع تراث العلامة الألباني في المنهج والأحداث الكبرى। ১২ খন্ডে প্রকাশিত গ্রন্থটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৬৮৮। যেখানে সালাফী দাওয়াতের স্বরূপ ও নীতিমালা, মাযহাবী গোঁড়ামি, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড, মানহাজগত বিষয়ে বিরোধীদের জবাব, দাওয়াতী নীতি-পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ইসলামী দল ও বাতিল মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা সংকলিত হয়েছে। সাথে সাথে সমকালীন বিভিন্ন সংকট যেমন দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, ফিলিস্তীন, বসনিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে যুদ্ধ-সংঘাত ও মুসলমানদের অবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ক আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে।
ফিক্বহ সংক্রান্ত তাঁর যাবতীয় রচনা ও বক্তব্য নিয়ে جامع تراث العلامة الألباني في الفقه প্রকাশিত হয়েছে। ১৮ খন্ডে প্রকাশিত গ্রন্থটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯৫৫০। এখানে ফিক্বহী অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজানোর সাথে সাথে প্রয়োজনমত বহু নতুন নতুন বিষয় সংযোজন করা হয়েছে।
বর্তমানে তাফসীর, হাদীছসহ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলবানীর লেখনী ও বক্তব্যসমূহ থেকে নিয়ে আরো অনেকগুলো সংকলন নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে।
মৌলিক এ বিষয়গুলো ছাড়াও আলবানীর জীবনী, রচনাবলী, অন্যান্য ফিক্বহবিদদের সাথে আলবানীর মতামতের তুলনামূলক আলোচনা ইত্যাদি কর্মকান্ড ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া এ সবকিছু ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ, চায়না, তুর্কী, স্প্যানিশ, মালয়, বাংলা প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ করার প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।
সারকথা :
পরিশেষে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, শায়খ আলবানী (রহঃ) মুহাদ্দিছীনে কেরামের সহস্র বছরের অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টার সার নির্যাসকে মুসলিম উম্মাহর সম্মুখে অত্যন্ত স্বার্থকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে ‘ইলমুল হাদীছের ময়দানে যে অমূল্য অবদান পেশ করেছেন, তা এককথায় অতুলনীয়। তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্বের যথাযথ পুরস্কার হিসাবেই হয়ত আল্লাহর বিশেষ রহমতে বিশ্ববাসীর নিকটে তাঁর এমন গ্রহণযোগ্যতা তৈরী হয়েছে যে, নিকটবর্তী-দূরবর্তী, বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে সকলে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁর তাখরীজ ও তাহক্বীক্ব থেকে ইলমী খেদমত গ্রহণ করছেন। তাঁর এই অনন্যসাধারণ খেদমত মুসলিম উম্মাহকে কেবল যঈফ ও জাল হাদীছের বৃত্ত থেকে মুক্ত করেনি, বরং সরাসরি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার মহান সুযোগ লাভে ধন্য করেছে। ফলে শায়খ আলবানী (রহঃ) বর্তমান বিশ্বে মুসলিম উম্মাহর একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাঊস নছীব করুন এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য তাঁর খেদমতকে আরো গ্রহণযোগ্য করে দিন। আমীন! (ক্রমশঃ)
[1]. আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁর পিতা আবূ তালিব মারা যাওয়ার পর তিনি রাসূল (ছা.)-কে বললেন, আপনার পথভ্রষ্ট বৃদ্ধ চাচা আবূ তালিব মৃত্যুবরণ করেছে। রাসূল (রাঃ) বললেন, যাও তোমার পিতাকে দাফন করে এস। আলী (রাঃ) বললেন, না আমি যাবো না। রাসূল (ছা.) আবারো তাকে একই নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, আমার কাছে ফিরে আসার আগে অন্য কিছু করো না। আলী (রাঃ) বলেন, এরপর আমি পিতাকে মাটি দিয়ে সরাসরি তাঁর কাছে ফিরে আসি। অতঃপর তাঁর নির্দেশে আমি গোসল করলাম। তারপর তিনি আমার জন্য দো‘আ করলেন। দ্র. আবুদাঊদ, হা/৩২১৬।
[2]. সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৬১।
[3]. সিলসিলা ছহীহাহ, ১/৯৩।
[4]. সিলসিলা ছহীহাহ, ১/২২২।
[5]. আলবানী, ফিক্বহুল ওয়াকে‘ (জর্দান : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ২য় প্রকাশ, ১৪২২ হি.), পৃ, ৪০-৪১।
[6]. মুসলিম, ১/৩৮১, হা/৫৩৭।
[7]. সিলসিলা ছহীহাহ, ৭/৪৫৬-৪৮০।
[8]. সিলসিলা যঈফাহ, ১/১০৬, হা/৩২।
[9]. আছলু ছিফাতি ছালাতিন্নবী, পৃ. ৩৯, ৪৫।
[10]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, ১/৬১-৬২।
[11]. মুহাদ্দিছুল ‘আছর আশ-শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রিয়াদ : মাজাল্লাতুল বায়ান, প্রকাশকাল : ১৮.০২.২০১৩ খ্রি., লিংক- http://albayan.co.uk/article2.aspx?id=2614
[12]. ড. আবূ উসামা সালীম বিন ‘ঈদ আল-হিলালী, ইমাম আলবানী শায়খুল ইসলাম ও ইমামু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ ফী ‘উয়ূনি আ‘লামিল ‘উলামা ও ফুহূলিল উদাবা, পৃ. ৩৬-৩৭; https://kingfaisalprize.org/ar/sheikh-mohammad-nasir-ad-din-al-albani, 16.03.2019.
[13]. আব্দুল মুহসিন আল-‘আববাদ, শারহু আবী দাঊদ, ২৩/৪৪০।
[14]. আল-ইত্তিজাহাতুল মু‘আছারাহ ফী দিরাসাতিস সুন্নাহ, পৃ. ৩৬৬।
[15]. সিলসিলা ছহীহাহ, ৬/৭৩৮, হা/২৭১০; সিলসিলা যঈফাহ, ১/৬৭ ও ৫২৫, ২/৭২, ৩/১৬২-৬৩ ও ৬৪০, ৪/৫৩০, হা/১৯০৪, ৬/৫২, ১১/৫০৫।
[16]. সিলসিলা যঈফাহ, ১/১৭৫।
[17]. আছারটি হ’ল, আমর ইবনু ইয়াহ্ইয়া হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে তার পিতা হ’তে হাদীছ বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিন ফজর ছালাতের পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর বাড়ির দরজার নিকট গিয়ে বসে থাকতাম। তিনি যখন বের হতেন তখন আমরা তাঁর সাথে মসজিদে যেতাম। আমাদের বসে থাকা অবস্থায় একদিন আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) আমাদের নিকট এসে বললেন, আবূ আব্দুর রহমান (ইবনু মাস‘ঊদ) কি তোমাদের নিকটে বের হয়েছিলেন? আমরা বললাম, না এখনো বের হননি। ইবনু মাস‘ঊদ বের না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদের সাথে বসে থাকলেন। তিনি বের হ’লে আমরা সবাই তার নিকটে গেলাম।
আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) তাকে বললেন, হে আবূ আব্দুর রহমান! আমি এখনই মসজিদে এমন কিছু দেখলাম যা আমার নিকট অপসন্দনীয় মনে হলো। তবে আলহামদুলিল্লাহ, তা (বাহ্যিক দৃষ্টিতে) আমার কাছে ভালোই মনে হ’ল। তিনি বললেন, সেটা কী? উত্তরে আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বললেন, জীবিত থাকলে আপনি অচিরেই তা দেখবেন। এরপর তিনি বললেন, আমি মসজিদে গোলাকার হয়ে কিছু লোককে বসে থাকতে দেখলাম, যারা ছালাতের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক হালাকায় একজন বিশেষ লোক রয়েছে। আর তাদের প্রত্যেকের হাতে নুড়ি-পাথর রয়েছে। লোকটি বলছে, তোমরা একশ’ বার ‘আল্লাহু আকবার’ পাঠ কর। তারা একশবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলছে। এরপর সে বলছে, তোমরা একশ’ বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লহ’ বল। তারা একশ’ বার তা বলছে। সে একশ’ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলতে বললে তারা একশ’ বার তা বলছে।
ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বললেন, আপনি তাদেরকে কী বলেছেন? তিনি বললেন, আমি আপনার মতামত ও নির্দেশের অপেক্ষায় কিছুই বলিনি। তখন তিনি বললেন, আপনি তাদের গুনাহ সমূহ গণনা করে রাখতে বলেননি কেন? আর আপনি তাদের নিশ্চয়তা দিতেন যে, এভাবে গণনা না করাতে তাদের নেকী সমূহ বিনষ্ট হবে না। অতঃপর তিনি পথ চলা শুরু করলে আমরা তাঁর সাথে পথ চলতে লাগলাম। অবশেষে তিনি একটি হালাকার নিকট পৌঁছে বললেন, আমি তোমাদেরকে যা করতে দেখছি তা কী? তারা বলল, হে আবূ আব্দুর রহমান! এগুলো নুড়ি-পাথর। এর দ্বারা আমরা তাকবীর, তাহলীল ও তাসবীহ গণনা করছি।
তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের গুনাহসমূহ গণনা কর আর আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, এভাবে গণনা না করলেও তোমাদের ছওয়াবসমূহ বিনষ্ট হবে না। ‘হে মুহাম্মাদের উম্মতগণ! কত দ্রুত তোমাদের ধ্বংস এসে গেল’? তোমাদের নবী (ছা.)-এর বহু ছাহাবী এখনও জীবিত আছেন। এটি তাঁর (মুহাম্মাদ (ছা.)-এর পোশাক, যা পুরাতন হয়নি এবং এটা পানপাত্র, যা ভেঙ্গে যায়নি। যার হাতে আমার প্রাণ সেই প্রভূর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই তোমরা হয় এমন এক মিল্লাতের উপর আছ, যা মুহাম্মাদ (ছা.)-এর এর মিল্লাত অপেক্ষা অধিকতর সঠিক! অথবা তোমরা পথভ্রষ্টতার দুয়ার উন্মোচনকারী! তারা বলল, হে আবূ আব্দুর রহমান! আল্লাহর কসম! আমরা এর দ্বারা কেবল ভালো উদ্দেশ্য করছিলাম।
তখন তিনি বললেন, বহু লোক নেকী অর্জনের ইচ্ছা করে কিন্তু আদৌ তাদের নেকী অর্জিত হয় না। রাসূল (ছা.) আমাদের নিকট হাদীছ বর্ণনা করেছেন যে, এমন বহু মানুষ থাকবে যারা কুরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু তা তাদের গলদেশ অতিক্রম করবে না। (অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়)। আল্লাহর কসম! আমি জানি না তোমাদের অধিকাংশই তারা কি-না? অতঃপর তিনি চলে গেলেন। আমর ইবনু সালামা বলেন, হালাকার বহু লোককে আমি নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করতে দেখেছি। দ্র. সিলসিলা ছহীহাহ, ৫/১২-১৩, হা/২০০৫।
[18]. সিলসিলা ছহীহাহ, ৫/১৩-১৪, হা/২০০৫।
[19]. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব (রাজশাহী : মাসিক আত-তাহরীক, ১৪তম বর্ষ, ৯ম সংখ্যা, জুন ২০১১ খ্রি.), পৃ. ২৯।
[20]. Jacob Olidort, In Defense of Tradition: Muḥammad Nāṣir Al-Dīn al-Albānī and the Salafī Method (Ph.D Thesis), New Jersey : Princeton University, 2015. web link : https://dataspace .princeton.edu/jspui/ handle/88435/dsp01n z8062003 (10.06.2019)
[21]. ড. আল-মানজী বোসনীনাহ, মাওসূ‘আতু আ‘লামিল ‘উলামা ওয়াল উদাবাইল ‘আরাব ওয়াল মুসলিমীন, পৃ. ৩০৩।
[22]. তাজদীদুদ দ্বীন; মাফহূমুহু ওয়া যাওয়াবিতুহূ ওয়া আছারুহূ, পৃ. ২৩১।