যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৭ম কিস্তি)

(লেখক : ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব)…..

বিধি-বিধান সংশ্লিষ্ট রচনাবলী

১. ছিফাতু ছালাতিন্নবী (ছাঃ) : এটি ছালাতের উপর বিশুদ্ধ হাদীছ ভিত্তিক রচিত বহুল প্রচারিত একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি তিনটি সংস্করণে প্রকাশিত হয়। প্রথমটি হ’ল- আছলু ছিফাতি ছালাতিন্নবী (ছাঃ) মিনাত তাকবীরে ইলাত তাসলীমে কাআন্নাকা তারাহা। ১২১৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি আলবানী (রহঃ) ১৯৫১ সালে রচনা করেন। এখানে তিনি আলোচনাকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। উপরাংশে কেবল হাদীছের মূল মতন এবং আলোচনা ধারাবাহিকভাবে বিন্যাসের জন্য কিছু বাক্য উল্লেখ করেছেন। আর নিম্নাংশটি মূল আলোচনার ব্যাখ্যা হিসাবে এনেছেন। এখানে তিনি বিস্তারিত তাখরীজ উপস্থাপন করে তা থেকে গ্রহণযোগ্য যে সিদ্ধান্ত বের করে এনেছেন, তা উপরাংশে বিবৃত করেছেন।[1] 

দ্বিতীয়টি হ’ল- ছিফাতু ছালাতিন্নবী (ছাঃ)। এটা প্রথমটির সংক্ষিপ্ত রূপ। এর নতুন ও পুরাতন দু’টি সংস্করণ রয়েছে। পুরাতনটি আল-মাকতাবুল ইসলামী থেকে এবং নতুনটি ১৯৯১ সালে মাকতাবাতুল মা‘আরেফ থেকে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে নতুনভাবে প্রকাশিত হয়। নতুনভাবে প্রকাশের কারণ ছিল এই যে, মাকতাবুল ইসলামীর পরিচালক শায়খ যুহাইর শাবীশ পুরাতন সংস্করণে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পাদনা ও সংযোজন-বিয়োজন করেছিলেন। এখানেও আলোচনা দু’ভাগে বিভক্ত। উপরাংশ পূর্বোক্ত বইয়ের অনুরূপ। আর নিম্নাংশে সংক্ষিপ্ত তাখরীজ, কঠিন শব্দাবলীর ব্যাখ্যা এবং বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তা‘লীক্ব পেশ করেছেন।[2]

তৃতীয়টি আরো সংক্ষিপ্ত। মাত্র ৩৬ পৃষ্ঠায় তিনি এটি রচনা করেন। সংক্ষিপ্ত হ’লেও এটিও বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। যেমন অধিকাংশ মাসআলার সাথে সেটির হুকুম তথা রুকন, ওয়াজিব না সুন্নাত তা বর্ণনা করেছেন।[3] বইটির উপসংহারে তিনি মুসলিম উম্মাহর প্রতি সঠিক পদ্ধতিতে ছালাত আদায়ের সাথে সাথে খুশূ-খুযূ সহকারে ছালাত আদায়ের আহবান জানিয়েছেন এবং একেই মহান প্রভুর সামনে বান্দার দন্ডায়মান হওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

উক্ত গ্রন্থটি রচনার ক্ষেত্রে তিনি যে নীতি অবলম্বন করেছেন তা হ’ল- (১) বিভিন্ন হাদীছগ্রন্থে সংকলিত হাদীছ থেকে বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কেবলমাত্র ছহীহ বর্ণনাগুলো সংকলন করেছেন। এমনকি দো‘আ-দরূদ বা ফাযায়েলের ক্ষেত্রেও তিনি কোন যঈফ হাদীছকে প্রশ্রয় দেননি। (২) নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের অনুসরণ করেননি।[4] (৩) যেসব ক্ষেত্রে কুরআন বা হাদীছের সরাসরি নির্দেশনা পাওয়া যায় না এবং যেসব হাদীছের ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে তিনি সালাফে ছালেহীন ও মুহাদ্দিছগণের মতামত থেকে সাহায্য নিয়েছেন।[5]

২. আহকামুল জানায়েয ও বিদ‘উহা : গ্রন্থটিতে শায়খ আলবানী জানাযা সংশ্লিষ্ট গোসল, ছালাত, কাফন, দাফন প্রভৃতি ফিক্বহী হুকুম-আহকাম সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। এখানে তিনি বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহের দলীল কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে অনুসন্ধানের প্রয়াস পেয়েছেন এবং ওলামায়ে কেরামের মতামতের উপর ভিত্তিশীল বিধানসমূহ এড়িয়ে গেছেন। গ্রন্থের শেষাংশে তিনি জানাযা কেন্দ্রিক সমাজে প্রচলিত মোট ২১৪টি বিদ‘আত সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।[6] মূল বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৫১। তবে পরবর্তীতে তিনি ১১৩ পৃষ্ঠার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি হাদীছের তাখরীজ ও তা‘লীক্বসমূহ বাদ দিয়েছেন।[7]

৩. আদাবুয যিফাফ ফিস সুন্নাতিল মুত্বাহহারাহ : বিবাহ সংশ্লিষ্ট উক্ত গ্রন্থটি ছোট পরিসরে রচিত গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। এখানে তিনি বিশুদ্ধ দলীলের আলোকে বাসর রাতে ও পরবর্তীতে স্বামী-স্ত্রীর জন্য করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং বিবাহের বিভিন্ন স্তরে কি কি সুন্নাত অনুসরণীয় ও কোন কোন বিদ‘আত বর্জনীয়, সে বিষয়ে বিশুদ্ধ হাদীছভিত্তিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন।[8] মিসরের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ‘আল্লামা মুহিববুদ্দীন খত্বীব[9] এ বইটির ভূমিকা লেখেন।

৪. হাজ্জাতুন নবী (ছাঃ) কামা রাওয়াহা আনহু জাবের (রাঃ) : ছিফাতু ছালাতিন্নবী-এর আদলে ‘ছিফাতু হাজ্জাতিন্নবী’ নামে এ গ্রন্থ লেখার ব্যাপারে বহু মানুষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আলবানী উক্ত গ্রন্থটি রচনা করেন। এক্ষেত্রে তিনি ১০ম হিজরীতে রাসূল (ছাঃ)-এর বিদায় হজ্জের বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটির সকল রেওয়ায়াত একত্রিত করেন এবং তার ভিত্তিতে হজ্জের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় দলীলসহ বর্ণনা করেন। ১৫২ পৃষ্ঠাব্যাপী এই বইটির শেষাংশে তিনি হজ্জব্রত পালনের সংকল্প করা থেকে শুরু করে হজ্জ শেষে দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত হাজীগণ যেসব বিদ‘আতে লিপ্ত হন, সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। এছাড়া মাসজিদুন নববী ও বায়তুল মুক্বাদ্দাস যিয়ারত সংক্রান্ত বিদ‘আতসহ এখানে মোট ১৭৫টি বিদ‘আত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বইটির ভূমিকায় তিনি পাঠক ও হজ্জপালনকারীদের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু উপদেশ পেশ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ‘মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল উমরাহ’ নামে ৬৪ পৃষ্ঠা ব্যাপী এর সংক্ষিপ্ত একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন। তবে সেখানে অতিরিক্ত কিছু তাখরীজ ও তা‘লীক্ব সংযুক্ত হয়েছে।

৫. তাহযীরুস সাজিদ মিন ইত্তিখাযিল কুবূরি মাসাজিদ : কবরপূজারীদের বিরুদ্ধে লিখিত এই বইটি তাঁর প্রথম জীবনের লেখনীসমূহের অন্যতম। ২৪০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে তিনি সেযুগে মানুষের মাঝে প্রচলিত কবর সংশ্লিষ্ট নিকৃষ্ট বিদ‘আত সমূহের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। যেমন- নেককার মানুষদের কবরকে বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা, তার উপর মসজিদ ও গম্বুজ নির্মাণ করা, সেদিকে ফিরে ছালাত আদায় করা ইত্যাদি। বইটি সম্পর্কে আলবানী বলেন, কবর কেন্দ্রিক এই মাসআলাই অধিকাংশ শায়খদের সাথে আমার পৃথক হওয়ার প্রথম কারণ ছিল। এক্ষেত্রে তারা আমার পিতার অনুসারী ছিলেন।[10] 

৬. তাহরীমু আলাতিত ত্বারাব : ২১৬ পৃষ্ঠার এই বইটিতে তিনি বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার বিষয়টি বিস্তারিত দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। মূলতঃ ১৩৭৩ হিজরীতে মাজাল্লাতু ইখওয়ানিল মুসলিমীন পত্রিকায় প্রসিদ্ধ একজন আযহারী বিদ্বান বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার জায়েয মর্মে ফৎওয়া প্রকাশ করায় তার প্রতিবাদে তিনি বইটির রচনায় উদ্বুদ্ধ হন। এছাড়া এখানে তিনি বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে ইবনু হাযম আন্দালুসী কর্তৃক শিথিলতা প্রদর্শনেরও দলীল ভিত্তিক খন্ডন করেছেন।

৭. তাওয়াসসুল আনওয়া‘উহূ ওয়া আহকামুহূ : ১৭৫ পৃষ্ঠার এ বইটি মূলতঃ চারটি অধ্যায় নিয়ে রচিত হয়েছে। (১) তাওয়াসসূলের আভিধানিক অর্থ (২) বৈষয়িক ও শারঈ মাধ্যমসমূহ (৩) শরী‘আতসম্মত অসীলা প্রার্থনা ও তার প্রকারসমূহ (৪) কিছু সংশয় ও তার জবাব।

৮. জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমাহ : ২৬০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে মুসলিম নারীর জন্য কি কি পোষাক পরা ওয়াজিব সে ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া নারীদের মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় ‘আওরাত বা পর্দার অন্তর্ভুক্ত কি-না, সে ব্যাপারে আলোচনা পেশ করা হয়েছে।

৯. আর-রাদ্দুল মুফহাম ‘আলা মান খা-লাফাল ওলামা : ‘জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমাহ’ বইটি প্রকাশ পাওয়ার পর সমসাময়িক অনেক বিদ্বান এই মাসআলার বিরোধিতা করেন। তাদের মতে আলবানীর পূর্বে কোন আলেম এরূপ মত পোষণ করেননি। যার প্রেক্ষিতে তিনি ১৮৪ পৃষ্ঠার এই বইটি রচনা করেন। এখানে তিনি কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে বিরোধীদের দলীলসমূহের জবাব দিয়েছেন এবং পূর্ববর্তী অনেক ওলামায়ে কেরাম যে এ ব্যাপারে মতামত পেশ করেছেন তা উল্লেখ করেছেন। আলোচনার শেষভাগে তিনি স্পষ্ট দলীল ছাড়াই আবেগের বশবর্তী হয়ে দ্বীনের কোন বিষয়ে কঠোরতা আরোপের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন এবং নারী-পুরুষদের সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিশুদ্ধ মানহাজের উপর গড়ে তোলার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম ও দাঈদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।

১০. আল-আজবিবাতুন নাফে‘আহ : ১৫১ পৃষ্ঠার এই বইটিতে তিনি মূলতঃ জুম‘আর ছালাতের মাসআলা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন এবং শেষাংশে জুম‘আ সম্পর্কিত মোট ৭৭টি বিদ‘আত সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।

এছাড়া শারঈ বিধি-বিধান সম্পর্কিত তিনি আরো কয়েকটি বই লিখেছেন। যেমন ছালাতুল কুসূফ বিষয়ে ছিফাতু ছালাতিন্নবী লি ছালাতিল কুসূফ, দাড়ির বিধান সম্পর্কে ‘আল-লিহইয়াতু ফী নাযরিদ দীন’, কুয়েতের ‘ফাইলাকা’ দ্বীপে খিযির (আঃ)-এর কথিত নিদর্শন সম্পর্কে ‘হুকমু তাতাববুএ আছারিল আম্বিয়া ওয়াছ ছালেহীন’, আল-ইসরা ওয়াল মি‘রাজ, হুকমু তা-রিকিছ ছালাত, ক্বিয়ামু রামাযান, ছালাতুত তারাবীহ, ছালাতুল ঈদায়েন ফিল মুছাল্লা খারিজিল বিলাদ, দিফা‘ আনিল হাদীছিন নববী, তাছহীহু ইফতারিছ ছায়েম ক্ববলা সাফারিহী বা‘দাল ফাজর ইত্যাদি।

অন্যান্য রচনাবলী

১. আয-যাববুল আহমাদ ‘আন মুসনাদিল ইমাম আহমাদ :

আব্দুল কুদ্দূস হাশেমী নামক জনৈক আলেম এক প্রবন্ধে মুসনাদে আহমাদ-কে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-এর রচনা হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, (১) ইমাম আহমাদের ছেলে আব্দুল্লাহ এর বর্ণনাসমূহে বৃদ্ধি করেছেন (২) ইমাম আহমাদের নিকট থেকে শ্রবণকারী মূল রাবী আবূ বকর কাতী‘ঈ[11]-এর নিকটে অপরিচিত সূত্রে এর বর্ণনাসমূহ পৌঁছেছে (৩) কাতী‘ঈ ছিলেন ভ্রান্ত আক্বীদা ও দুষ্ট চরিত্রের নিকৃষ্ট মানুষ। (৪) তিনি এর মধ্যে বহু মাওযূ‘ হাদীছ সংযুক্ত করেছেন। সঊদী আরবের তৎকালীন গ্রান্ড মুফতী শায়খ বিন বায (রহঃ) বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে শায়খ আলবানীকে এর প্রতিবাদে কিছু রচনার আহবান জানান। অতঃপর আলবানী মুসনাদে আহমাদে বিভিন্ন সংস্করণ গভীরভাবে অধ্যয়ন করে পূর্ণাঙ্গ গবেষণাকর্ম হিসাবে এই বইটি রচনা করেন।

আলবানী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে যা বলেছেন তার সংক্ষিপ্ত সার হ’ল- আহলে ইলমগণ মুসনাদে আহমাদকে ইমাম আহমাদের সংকলন হিসাবে কবুল করে নিয়েছেন, এর পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন এবং সুন্নাহর অন্যতম আবশ্যিক উৎস হিসাবে গণ্য করেছেন। যাদের মধ্যে আছেন হাফেয ইবনু আসাকির, যিয়াউদ্দীন মাক্বদেসী, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনু কাছীর, নববী, ইবনু হাজার আসক্বালানী, যায়লাঈ, ইরাক্বী, সুয়ূত্বীসহ বহু ওলামায়ে কেরাম। ফলে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মুফাসসির, মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহগণের রচিত অধিকাংশ গ্রন্থেই উক্ত মুসনাদ থেকে হাদীছ সংকলিত হয়েছে। এক্ষণে হয় বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয় এরূপ হাদীছ গ্রন্থের উপর নির্ভর করে বড় বড় আলেমগণ ভুল করেছেন অথবা হাশেমী বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন প্রান্তের এইসব বিদগ্ধ বিদ্বানগণের বিরোধিতা করে নিজেই ভ্রষ্টতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছেন।

অতঃপর তিনি হাশেমীর বক্তব্যের খন্ডনে ইলমী আলোচনা পেশ করেছেন এবং যুক্তিপূর্ণ ও দলীল সমৃদ্ধ রচনার মাধ্যমে তার দাবীকে ভুল সাব্যস্ত করেছেন। বইটি ১৩৯৯ হিজরীতে প্রকাশিত হয়। তবে পরবর্তীতে অনেকবার তিনি বইটি পরিমার্জন করেন এবং বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ টীকা সংযোজন করেন।[12]

২. নাছবুল মাজানিক লিনাসাফি কিছছাতিল গারানীক :

এই বইটি আলবানী (রহঃ) ইসলাম বিদ্বেষীদের অতি লোভনীয় হাতিয়ার গারানীক্ব কাহিনীর অসারতা প্রমাণে রচনা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান থেকে একদল ওলামায়ে কেরাম আলবানীর নিকটে উক্ত কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে জানতে চেয়ে পত্র লিখলে তিনি তার জবাবে উক্ত বইটির রচনা করেন। এ সম্পর্কিত ঘটনাটি হ’ল, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বা চত্বরে ছালাত আদায় করেন। সেখানে তিনি সরবে সূরা নাজম পাঠ করেন। সূরার শেষে তিনি সিজদা করেন। তখন উপস্থিত মুসলিম-মুশরিক সবাই সিজদায় পড়ে যায়।[13] কাফিরদের সিজদা করার উক্ত ঘটনা সত্য এবং এটি ছিল নিঃসন্দেহে সূরা নাজমের অশ্রুতপূর্ব আসমানী খবর ও অনন্য সাধারণ ভাষালংকারের অপূর্ব দ্যোতনার বাস্তব ফলশ্রুতি। ভাষাগর্বী নেতারা যার সামনে অবচেতনভাবে মুহ্যমান হয়ে পড়ে ও নবীর সাথে সাথে সিজদায় পড়ে যায়। কারণ উক্ত সূরার শেষ আয়াতটি ছিল, فَاسْجُدُوا لِلَّهِ وَاعْبُدُوا ‘অতএব তোমরা আল্লাহর জন্য সিজদা কর ও তাঁর ইবাদত কর’।[14]

অথচ এর প্রেক্ষাপট হিসাবে বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে যে, উক্ত সূরার ১৯ ও ২০ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, أَفَرَأَيْتُمُ اللاَّتَ وَالْعُزَّى- وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ ‘লাত’ ও ‘উযযা’ সম্বন্ধে?’ ‘এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে?’ এরপরেই শয়তান গায়েবী আওয়ায দিয়ে বলে, تِلْكَ الْغَرَانِيقُ الْعُلَى + وَإِنَّ شَفَاعَتَهُنَّ لَتُرْتَجَى ‘ঐগুলো হ’ল মহান শ্বেত-শুভ্র উপাস্য। আর তাদের সুফারিশ অবশ্যই কামনা করা হয়’। এতে কাফেররা বলে যে, ইতিপূর্বে মুহাম্মাদ কখনো আমাদের উপাস্যদের ভাল বলেনি, আজ বলেছে। অতএব তারা খুশী হয়ে তাঁর সাথে সিজদায় পড়ে যায়’।[15]

হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) উক্ত কাহিনীকে মিথ্যা সাব্যস্ত করলেও হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) একে শক্তিশালী সাব্যস্ত করেছেন। উক্ত গ্রন্থে আলবানী ইবনু হাজারের সিদ্ধান্ত খন্ডন করেন এবং বিভিন্ন দলীলের ভিত্তিতে গারানীক্ব কাহিনী পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রমাণ করেন। তাঁর মতে, এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে মিথ্যা তোহমত চাপানো হয়েছে মাত্র।[16]

৩. আর-রাদ্দু ‘আলা রিসালাতি ইবাহাতিত তাহাল্লি বিয যাহাবিল মুহাল্লাক : শায়খ ইসমাঈল আনছারী[17] রচিত বইয়ের প্রতিবাদে লিখিত উক্ত আলোচনাটি তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্র মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম শায়বানী রচিত ‘হায়াতুল আলবানী’ গ্রন্থের সাথে প্রকাশিত হয়েছে। আলবানী স্বীয় ‘আদাবুয যিফাফ’ বইয়ে নারীদের জন্য স্বর্ণালংকার ব্যবহার হারাম সাব্যস্ত করে যে আলোচনা পেশ করেছেন, তার জবাবে শায়খ আনছারী একটি রিসালা লিখে আলবানীর নিকটে পাঠান। তিনি এর জবাবে ভিন্ন আঙ্গিকে এবং কিছু অতিরিক্ত আলোচনাসহ পুনরায় এই বইটি রচনা করেন।

৪. কাশফুন নিক্বাব ‘আম্মা ফী কিতাবি আবী গুদ্দাহ :

শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ (১৯১৭-১৯৯৭ খৃ.) সিরিয়ার একজন বিশিষ্ট আলেম হওয়া সত্ত্বেও কট্টর হানাফী হিসাবে বিভিন্ন গ্রন্থে তিনি সালাফীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন। বিশেষত শায়খ আলবানী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব, ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িমসহ অনেকের বিরুদ্ধে তিনি গুরুতর অভিযোগ ও মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেন। যেমন তার মতে, ‘নজদ থেকে ফিৎনা ছড়িয়ে পড়বে’ মর্মে বর্ণিত হাদীছ দ্বারা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবকে বুঝানো হয়েছে’। এছাড়া বিভিন্ন বিতর্কিত ফৎওয়া যেমন মাদক দ্বারা চিকিৎসা করা জায়েয ইত্যাদি ফৎওয়া প্রদান করেন। আলবানী তার এসব বাতিল মতামত ও মিথ্যারোপ থেকে জনগণকে সাবধান করার লক্ষ্যে কলম ধরেন এবং বইটি রচনা করেন।

৫. মুখতাছার ছহীহুল বুখারী :

ইমাম বুখারী (রহঃ) সংকলিত ছহীহুল বুখারীর সংক্ষিপ্ত এই সংকলনটি প্রভূত ফায়েদা ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কারণে আলবানী তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কর্ম হিসাবে গণ্য করেছেন। সংক্ষিপ্ত অথচ ওলামায়ে কেরাম ও তালিবুল ইলমদের জন্য দারুণ উপকারী এরূপ বৈশিষ্ট্যে পূর্ববর্তী কোন মুহাদ্দিছ ছহীহ বুখারীর সংক্ষেপণ করেননি। সংকলনটির অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হ’ল- (১) তিনি কেবল বর্ণনাকারী ছাহাবী ব্যতীত হাদীছের বাকী সনদ বাদ দিয়েছেন (২) ছহীহ মুসলিমের সংকলনপদ্ধতির অনুসরণে বিভিন্ন রেওয়ায়াতে বর্ণিত হাদীছসমূহ পুনরাবৃত্তি ছাড়াই একই অধ্যায়ে জমা করেছেন। অর্থাৎ অন্য সনদে অতিরিক্ত কিছু থাকলে বন্ধনীর মধ্যে একই মতনের সাথে উল্লেখ করেছেন অথবা ‘অন্য বর্ণনায় রয়েছে’ বা ‘অন্য তুরুকে এসেছে’ এরূপ বলে অতিরিক্ত অংশটুকু মূল হাদীছের নীচে এনেছেন[18] (৩) বুখারীর বাবসমূহ তিনি স্ব অবস্থায় রেখেছেন (৪) মূল হাদীছ ব্যতীত বিভিন্ন অধ্যায়, বাব ও হাদীছের সাথে সংযুক্ত ছহীহ হওয়ার শর্তমুক্ত মু‘আল্লাক্ব হাদীছ ও আছারসমূহের সংক্ষিপ্ত তাহক্বীক্বসহ হুকুম বর্ণনা করেছেন (৫) কঠিন ও দুর্বোধ্য শব্দসমূহ ব্যাখ্যা করেছেন (৬) মুসনাদ ও মু‘আল্লাক্ব হাদীছ ও আছারসমূহ অধ্যায় ও অনুচ্ছেদভিত্তিক সাজিয়েছেন। ১৩৯৯ হিজরীতে তিনি কাজটি সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৪১৬ হিজরীতে তিনি এটি পুনরায় সংস্কার করেন। প্রথমে একত্রে বৃহৎ একটি খন্ডে প্রকাশ হলেও পরবর্তীতে তা চার খন্ডে প্রকাশিত হয়।[19] 

৬. মুখতাছার ছহীহ মুসলিম লিল মুনযিরী :

এটি হাফেয মুনযিরী (রহঃ) কৃত মুখতাছার ছহীহ মুসলিমের উপর আলবানীকৃত তাহক্বীক্ব। এখানে তিনি তাহক্বীক্বের সাথে সাথে এর হাদীছসমূহ নতুনভাবে সাজিয়েছেন, দুর্বোধ্য শব্দগুলোর ব্যাখ্যা করেছেন এবং অনেক উপকারী টীকা সংযোজন করেছেন। মুনযিরীকৃত মুখতাছারটির মধ্যে কিছু ভুল-ত্রুটি এবং ঘাটতি দেখে তিনি এটি পুনরায় তাহক্বীক্ব করার সিদ্ধান্ত নেন এবং আল্লাহর রহমতে সে সুযোগও পেয়ে যান। ১৩৮৯/১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকজন ওলামায়ে কেরামের সাথে তিনি গ্রেফতার হন এবং দামেশকের কিল‘আ কারাগারে বন্দী হন। কয়েক মাস পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হলেও পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং কয়েকমাস কারান্তরীণ রাখার জন্য একটি দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়। অতঃপর এখানে বসেই তিনি কাজটি সুসম্পন্ন করেন।[20] উল্লেখ্য যে, প্রথমবার কারান্তরীণ হওয়ার পর তিনি মুনযিরীকৃত মুখতাছারটি নয় বরং পৃথকভাবে ছহীহ বুখারীর ন্যায় ছহীহ মুসলিম সংক্ষেপনের কাজ সম্পন্ন করেন। তবে এর মূল পান্ডুলিপি পরবর্তীকালে হারিয়ে যায়।[21] 

৭. মুখতাছার শামায়েলে মুহাম্মাদী লিত তিরমিযী :

এটি ইমাম তিরমিযী (রহঃ)-এর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘শামায়েলে মুহাম্মাদী’-এর তাহক্বীক্বসহ সংক্ষিপ্ত সংস্করণ।

৮. ফিহরিসু মাখতূতাতিয যাহেরিয়া ফী ইলমিল হাদীছ :

আলবানী স্বীয় গবেষণাকর্মের পাদপীঠ দামেশকের মাকতাবাতুয যাহেরিয়ায় সংরক্ষিত ইলমে হাদীছ সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ ও পান্ডুলিপি সম্পর্কে পরবর্তীদের জ্ঞাতার্থে বহুদিনের পরিশ্রমে এই সূচীটি রচনা করেন। সূচীপত্র রচনার ক্ষেত্রে শায়খ আলবানীর বিশেষ কোন দক্ষতা ছিল না। এছাড়া হাদীছ শাস্ত্রে নিরন্তর গবেষণায় লিপ্ত থাকায় এক্ষেত্রে কিছু করার মত বিস্তর সময়ও তাঁর ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কাউকে দিয়ে কিছু করাতে চাইলে তার জন্য কারণ সৃষ্টি করে দেন। উক্ত সূচীটি রচনার পিছনেও মোড় পরিবর্তনকারী এক অনন্য সাধারণ প্রেক্ষাপট ছিল। যা ‘একটি হারানো পৃষ্ঠার কাহিনী’ হিসাবে খুবই প্রসিদ্ধ।[22]

৯. ছওতুল ‘আরাব তাসআল ওয়া মুহাদ্দিছুশ শাম ইউজীব : এটি আলবানীর নিকট থেকে দামেশকের ছাওতুল ‘আরাব পত্রিকা কর্তৃক গৃহীত একটি সাক্ষাৎকার। যেখানে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের[23] আওক্বাফ মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত হাদীছ পরিষদ সম্পর্কে নানা আলোচনা, মুহিববুদ্দীন আল-খাত্বীব, মুহাম্মাদ আল-গাযালী, আব্দুর রাযযাক আল-‘আফীফী প্রমূখ বিদ্বানের সাক্ষাৎ লাভ; কায়রোর বিভিন্ন লাইব্রেরীতে পান্ডুলিপি অধ্যয়ন, নিজের ঘড়ি মেরামতের পেশায় জড়িত থাকার কারণ, ৪০ খন্ডের হাদীছ সংকলন সম্পন্ন হওয়াসহ জীবন ও সমাজের নানা দিক উঠে এসেছে।

প্রবন্ধসমূহ

গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি আলবানী অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যা সমকালীন ‘আত-তামাদ্দুনুল ইসলামী’ ও ‘আল-মুসলিমূন’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে ১৯টি প্রবন্ধ পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ পায়। গবেষক নূরুদ্দীন আবূ তালিব এগুলো জমা করে ‘মাক্বালাতুল আলবানী’ নামে পৃথক বই সংকলন করেছেন।

অপ্রকাশিত, অসমাপ্ত ও অপ্রাপ্ত পান্ডুলিপিসমূহ

শায়খ আলবানী তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সকল গ্রন্থ ও পান্ডুলিপি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে যান। তাঁর মৃত্যুর পর সেখানকার অনেক পান্ডুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। তবে এখনও এমন অনেক অসমাপ্ত পান্ডুলিপি রয়েছে, যা পরবর্তীতে আর প্রকাশিত হয়নি। এছাড়া তাঁর আরো অনেক গ্রন্থ সম্পর্কে জানা যায়, যা বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে। নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গ্রন্থ সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল-

১. আল-আহাদীছুয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ ফী উম্মাহাতিল কুতুবিল ফিক্বহিইয়াহ :

ফিক্বহের মৌলিক গ্রন্থসমূহের মধ্যে যে সমস্ত যঈফ ও জাল হাদীছ রয়েছে, সেগুলির সমন্বয়ে আলবানী একটি গ্রন্থ রচনা করার মনস্থ করেছিলেন। মৌলিক পাঁচটি গ্রন্থের উপর তিনি কাজটি করতে চেয়েছিলেন। যথা- (১) হানাফী ফিক্বহের বিখ্যাত গ্রন্থ বুরহানুদ্দীন মারগেনানী রচিত ‘আল-হেদায়া’ (২) মালেকী ফিক্বহের উপর আব্দুর রহমান বিন আবুল কাসেম উতাক্বীর ‘আল-মুদাউওয়ানা’ (৩) শাফেঈ ফিক্বহের উপর মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম আর-রাফে‘ঈর লিখিত ‘শারহুল ওয়াজীয’ (৪) হাম্বলী ফিক্বহের উপর ইবনু কুদামা রচিত ‘আল-মুগনী’ (৫) তুলনামূলক ফিক্বহের উপর ইবনু রুশদের লিখিত ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’। গ্রন্থটিতে তিনি ছয় হাযার পর্যন্ত হাদীছ জমা করেছেন এবং দীর্ঘ একটি ভূমিকা লিখেছেন। কিন্তু তা সমাপ্ত করতে পারেননি।[24]

২. মুখতাছারু তুহফাতিল মাওদূদ ফী আহকামিল মাওলূদ : আলবানী নবজাতকের বিধি-বিধান সম্পর্কে ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর লিখিত বৃহদায়তন এই গ্রন্থটি সংক্ষিপ্তকরণের কাজ শুরু করে সূচীপত্রসহ ৩১৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত কাজ করে গেছেন।

৩. ওয়াছফু রিহলাতিল ঊলা ইলাল হেজাযি ওয়ার রিয়ায : ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ফিলিস্তীন যুদ্ধের পর সঊদী সেনাবাহিনী স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় আলবানী উক্ত বাহিনীর সাথে হেজায ও রিয়াদ সফর করেন। অতঃপর সফরের বর্ণনায় এই বইটি রচনা করেন। তবে মূল পান্ডুলিপি অতি বিবর্ণ আকার ধারণ করায় তা পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

৪. আত-তা‘লীকাতুল জিয়াদ ‘আলা যাদিল মা‘আদ : এটি ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর বিখ্যাত গ্রন্থ যাদুল মা‘আদের বিস্তারিত তাখরীজ ও তা‘লীক্ব। কিন্তু পরবর্তীতে তা হারিয়ে যায়।

৫. আল-মুগনী ফী হামলিল আসফার : ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন-এর তাখরীজে হাফেয ইরাক্বীকৃত উক্ত গ্রন্থটি আলবানী তার প্রথম জীবনে নিজ হাতে হুবহু কপি করেন। প্রথমে অর্ধেক পর্যন্ত করার পর পুনরায় সংক্ষিপ্ত টীকা ও দুর্বোধ্য শব্দসমূহ বিশ্লেষণসহ প্রথম থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত অনুলিপি করেন।[25] আলবানীর ছাত্র শায়খ মাজযূব বলেন, শায়খ আমাকে এর নুসখাটি দেখিয়েছিলেন। হাতে লেখা মূল পান্ডুলিপিটি ছিল ৩ খন্ডে ২০১২ পৃষ্ঠা।[26]

৬. তাখরীজু আহাদীছিল বুয়ূ‘ ও আছারিহী : ব্যবসা-বানিজ্যের উপর বর্ণিত হাদীছ ও আছারসমূহের তাখরীজ সংক্রান্ত এই বইটি তিনি দামেশক বিশ্ববিদ্যালয়ের কুল্লিয়া শার‘ঈয়াহ-এর উদ্যোগে প্রকাশিতব্য ‘মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিল ইসলামী’-এর জন্য রচনা করছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা এই উদ্যোগ থেকে সরে আসলে তিনিও কাজটি বন্ধ করে দেন। ফলে কাজটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

৭. মু‘জামুল হাদীছিন নববী : প্রায় ৪০ খন্ডে রচিত উক্ত গ্রন্থটির প্রতি খন্ডে ৪০০ পৃষ্ঠা এবং প্রতি পৃষ্ঠায় ১টি করে হাদীছ তাখরীজসহ উল্লেখ করা হয়েছে। আলবানী এভাবে প্রায় ১৬ হাযার হাদীছ আরবী বর্ণমালার ক্রম অনুযায়ী সাজিয়েছেন। এসব হাদীছ তিনি দামেশকের ‘মাকতাবা যাহেরিয়াহ’ হলবের ‘মাকতাবাতুল আওক্বাফ আল-ইসলামিইয়াহ, মসজিদে নববীর ‘মাকতাবা মাহমূদিয়াহ, মদীনার ‘মাকতাবা আরিফ হিকমত’ প্রভৃতি লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত পান্ডুলিপিসমূহ থেকে সংকলন করেন।[27] শায়বানী বলেন, শায়খ আমাকে এর পান্ডুলিপি দেখিয়েছিলেন।[28] তবে অপর এক গবেষকের মতে, উক্ত সংকলনটি ৪৯ খন্ডে সমাপ্ত এবং আলবানী ৩০ বছর যাবৎ এটি সংকলন করেন।[29]

৮. আত-তা‘লীকুর রাগীব ‘আলাত তারগীব ওয়াত-তারহীব : এটি ছহীহ ও যঈফ তারগীব নয়। বরং পৃথক একটি সংকলন। আলবানী এখানে অনেক বিস্তারিত তাখরীজ পেশ করেছেন। তবে তা আজও প্রকাশিত হয়নি। 

বিভিন্ন রচনা ও বক্তব্য থেকে সংকলিত রচনাবলী

১. আত-তাওহীদ আউয়ালান ইয়া দু‘আতাল ইসলাম :

এটা মূলতঃ রেকর্ডকৃত একটি টেপ থেকে সংকলিত বই। ‘মুসলমানদের নবজাগরণের পথ কি এবং কোন পথে চললে আল্লাহ রাববুল আলামীন তাদেরকে বিভিন্ন জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করবেন?’ মর্মে একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি উত্তরটি প্রদান করেন।[30]

২. আত-তাছফিইয়াহ ওয়াত-তারবিয়াহ ওয়া হা-জাতুল মুসলিমীনা ইলাইহিমা :

এটিও রেকর্ডকৃত বক্তব্য থেকে সংকলিত বই : ১৩৯০ হিজরীতে আম্মানের একটি শরী‘আহ ইন্সটিটিউটে তিনি এই বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এখানে তিনি মুসলমানদের জন্য অনুসরণীয় বিশুদ্ধ মানহাজ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। আর এজন্য তিনি দু’টি শব্দ উল্লেখ করেছেন। (১) তাছফিয়াহ বা বিশুদ্ধকরণ (২) তারবিয়াহ বা প্রশিক্ষণ। অর্থাৎ ইসলামী আক্বীদাকে সকল বাতিল মতবাদ, শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে হবে; জাল, ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও দুর্বল হাদীছ থেকে ছহীহ ও হাসান হাদীছসমূহকে পৃথক করে সুন্নাহকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে এবং ফিক্বহকে বিশুদ্ধ দলীল বিরোধী মতামত থেকে মুক্ত করতে হবে। অতঃপর বিশুদ্ধ আক্বীদা-আমলের ভিত্তিতে প্রথমে নিজেকে অতঃপর অন্যদেরকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। আলবানী নিজের পুরো জীবন ও সার্বিক কর্মকান্ড এই নীতির উপরেই পরিচালিত করেছেন।

৩. উজূবুল আখযি বি হাদীছিল আহাদি ফিল আক্বীদাতি ওয়াল আহকাম : বইটি ১৩৭৭ হিজরীতে দামেশকে আয়োজিত একটি যুবসম্মেলনে আলবানী প্রদত্ত ভাষণের অনুলিপি। যা পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশিত হয়। বইটিতে খবরে ওয়াহেদ পর্যায়ের হাদীছ যে কেবল আহকামগত বিষয়ে নয় বরং আক্বীদাগত বিষয়েও দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য, তা অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণ করা হয়েছে। সাথে সাথে এর বিরোধীদের দলীলসমূহ খন্ডন ও তার ক্ষতিকর দিকসমূহ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

৪. মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম : বইটি ১৩৯২ হিজরী রামাযান মাসে দোহায় প্রদত্ত একটি ভাষণ। যেখানে ইসলামী শরী‘আতে হাদীছের গুরুত্ব, কুরআনের বাণী প্রচারে সুন্নাহর ভূমিকা, কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে সুন্নাহর প্রয়োজনীয়তা, আহলে কুরআনের ভ্রষ্টতা ইত্যাদি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

৫. আল-হাদীছু হুজ্জাতুন বিনাফসিহী ফিল ‘আক্বায়েদে ওয়াল আহকাম : বইটি ১৯৭২ সালে স্পেনের গ্রানাডা শহরে আয়োজিত এক সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণের অনুলিপি। এখানে তিনি সুন্নাহ বা হাদীছের প্রতি একজন মুসলিমের নীতি, হাদীছের মর্যাদা ও প্রামাণিকতা, তাক্বলীদের অনিষ্টকারিতা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

৬. কিছছাতুল মাসিহিদ দাজ্জাল : শেষ যামানায় দাজ্জালের ফিৎনার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন হাদীছের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মাদীকে সতর্ক করলেও এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষ ও বড় বড় বিদ্বানদের মাঝে অবহেলা, অবিশ্বাস এবং অমনযোগিতা লক্ষ্য করে আলবানী বইটি রচনার পরিকল্পনা করেন।[31] উক্ত বইয়ে তিনি দাজ্জালের আগমন ও ঈসা (আঃ)-এর কাহিনী সম্পর্কিত আবূ উমামা বাহেলী (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটির বিভিন্ন তুরুক একত্রে জমা করেছেন। অতঃপর বিভিন্ন রাবী কর্তৃক বর্ণিত এই বিষয়ে সকল বিশুদ্ধ বর্ণনা একত্রিত করে তাহক্বীক্বসহ ধারাবাহিক ভাবে উল্লেখ করেছেন। ১৪২১ হিজরীতে ‘মাকতাবুল ইসলামী’ থেকে প্রকাশিত এই বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬৬।

৭. সাওয়াল ওয়া জাওয়াব হাওলা ফিক্বহিল ওয়াক্বে‘ :

রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী অনুযায়ী শেষ যামানায় মুসলিম জাতি সংখ্যায় বেশী হলেও দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও মৃত্যুকে অপসন্দ করার কারণে তাদের হৃদয়ে দুর্বলতা চেপে বসবে। সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে মুসলমানদের অবস্থা যার সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। এরূপ প্রেক্ষিতে তাদের করণীয় কি হ’তে পারে, উক্ত বইটি সে ব্যাপারে আলবানী প্রদত্ত জবাবের লিখিত রূপ। ৫৪ পৃষ্ঠার এই বইটিতে তিনি মুসলমানদের বর্তমান অবস্থার কারণ, করণীয়, আল্লাহর সাহায্য কিভাবে আসবে, দাঈদের করণীয়, আধুনিক রাজনীতির ক্ষতিকর দিক প্রভৃতি বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন। রেকর্ডকৃত এই জবাবটি তাঁর প্রিয় ছাত্র আলী হাসান হালাবী লিখিতরূপে সংকলন করার পর আলবানী তা পুনর্নিরীক্ষণ করেন এবং প্রকাশ উপযোগী করে দেন।

৮. কাইফা ইয়াজিবু আলাইনা আন নুফাসসিরুল কুরআন :

বইটি অডিও টেপ থেকে অনুলিখনের পর আলবানী কিছুটা সংস্কার করেন। এখানে তিনি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের তাফসীর করার ক্ষেত্রে একজন তাফসীরকারের জন্য কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা ওয়াজিব তা বর্ণনা করেছেন। বিশেষত তাফসীরের ক্ষেত্রে হাদীছের সাহায্য গ্রহণের আবশ্যকতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ‘নয়টি প্রশ্নের উত্তর নামে’ বইটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

৯. হাযা দা‘ওয়াতুনা : অডিও টেপ থেকে অনুলিখিত এই বইটিতে আলবানী শারঈ ইলমের পরিচয়, সালাফী দাওয়াতের রুকন, বিভিন্ন বাতিল ফিরক্বা উদ্ভবের কারণ, কুরআন-হাদীছ ছাহাবায়ে কেরামের বুঝ অনুযায়ী অনুধাবনের গুরুত্ব প্রভৃতি বিষয়ে সংক্ষেপে সুন্দরভাবে আলোকপাত করেছেন।

১০. ফিৎনাতুত তাকফীর : খারেজীদের তাকফীরী মতবাদের বিরুদ্ধে রচিত এই বইটি মূলতঃ ১৯৯৩ সালে আলবানীর রেকর্ডকৃত একটি বক্তব্যের লিখিতরূপ।

১১. শারহু উছূলিদ দাওয়াহ আস-সালাফিইয়াহ :

আমর আব্দুল মুন‘ঈম সালীম সংকলিত উক্ত গ্রন্থটি সালাফী দাওয়াতের মূলনীতি সম্পর্কে আলবানী প্রদত্ত একটি বক্তব্যের লিখিত রূপ ও তার ব্যাখ্যা। এখানে আলবানী সালাফী দাওয়াতের পরিচয়, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতিমালা, সালাফদের অনুসরণ ওয়াজিব হওয়ার কারণ, তাক্বলীদের উৎপত্তি, দ্বীনের মধ্যে মতবিরোধের কারণ, খবরে ওয়াহেদ হাদীছের প্রামাণিকতা, আল্লাহর ছিফাতী নামসমূহের ব্যাপারে বিভিন্ন আক্বীদা গোষ্ঠীর নানা মতভেদ এবং এ ব্যাপারে সালাফদের সিদ্ধান্ত প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সংকলক এর সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তারিত টীকা সংযোজন করে পাঠকের জন্য বইটি অধিক উপকারী হিসাবে তুলে ধরেছেন।

১২. কামূসুল বিদ‘ (قاموسُ البدع) : আলবানী জীবদ্দশায় সমাজে প্রচলিত নানা বিদ‘আতী কর্মকান্ড নিয়ে উক্ত নামে একটি গ্রন্থ রচনার সংকল্প করেছিলেন এবং ফিক্বহী অধ্যায় অনুসারে কয়েক পৃষ্ঠা লিখেছিলেন। কিন্তু তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্র আবূ ওবায়দা মাশহূর ইবনু হাসান আলবানী লিখিত এবং তাহক্বীক্ব ও তা‘লীক্বকৃত ১১৯টি বই ও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে বিভিন্ন বিদ‘আতের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ও বক্তব্যসমূহ সংকলন করে বইটি প্রকাশ করেন। কাতারের ‘দারুল ইমাম বুখারী’ থেকে প্রকাশিত এর একটি সংস্করণের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৩৮।

১৩. সাওয়ালাতু লিল আল্লামা আল-আলবানী : মিসরীয় বিদ্বান শায়খ আবূ আব্দুল্লাহ আহমাদ রচিত উক্ত বইটি হাসান হাদীছ কেন্দ্রিক সংশয় এবং ইলমে হাদীছ ও জারহ-তা‘দীলের বিধি-বিধান সম্পর্কে শায়খ আলবানীর একটি সাক্ষাৎকার। এখানে আলবানী ইলমে হাদীছ বিষয়ক বহু প্রশ্ন ও সংশয়ের জবাব দিয়েছেন এবং বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থে মুহাদ্দিছীনে কেরামের নীতিমালা ও বিভিন্ন মন্তব্যের উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। মোট ৭টি মজলিসে তিনি এই সাক্ষাৎকারটি প্রদান করেন। এর কয়েকমাস পরেই আলবানী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অবশেষে ইন্তেকাল করেন। কায়রোর মাহবাতুল অহী থেকে প্রকাশিত উক্ত বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯২।

১৪. আদ-দাওয়াহ আস-সালাফিইয়াহ আহদাফুহা ওয়া মাওক্বিফুহা মিনাল মুখালিফীনা লাহা : এটি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত না হ’লেও পরবর্তীতে তাঁর ছাত্র ‘ইছাম মূসা হাদী তাঁর বিভিন্ন বই ও অডিও রেকর্ড থেকে সংকলন করে একই নামে একটি বই প্রকাশ করেন। যেখানে সালাফী দাওয়াতের পরিচয়, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতিমালা ইত্যাদি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়েছে।

১৫. তারাজু‘উল আল্লামা আলবানী ফীমা নাছছা আলাইহি তাছহীহাহ ওয়া তাযঈফান : কোন বিষয়ে সত্য উদ্ভাসিত হলে পূর্বেকৃত ভুল থেকে ফিরে আসাই যুগে যুগে সালাফে ছালেহীন, আইম্মায়ে ‘এযাম ও মুহাদ্দিছীনের অনুসৃত নীতি। শায়খ আলবানীও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি হাযার হাযার হাদীছের তাহক্বীক্ব ও তাখরীজ করেছেন এবং হুকুম প্রদান করেছেন। এর মধ্যে অনেক হাদীছের ক্ষেত্রে তিনি প্রথমে একটি হুকুম প্রদান করেছেন। পরবর্তীতে সুনির্দিষ্ট কারণে মত পরিবর্তন করে ভিন্ন হুকুম প্রদান করেছেন। যেমন কোন গ্রন্থে কোন হাদীছকে ‘যঈফ’ বলেছেন। পরবর্তীতে তাঁর রচিত অন্য গ্রন্থে বা উক্ত গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে তা পরিবর্তন করে ‘ছহীহ’ বলেছেন। এরূপ মত পরিবর্তনের ব্যাপারে তিনি প্রায় ক্ষেত্রেই নিজে সেটা উল্লেখ করেছেন। আর বাকীগুলো পরবর্তী গবেষকগণ একত্রিত করেছেন। আবুল হাসান মুহাম্মাদ হাসান আশ-শায়খ সংকলিত ও সম্পাদিত ২ খন্ডে রচিত উক্ত বইটিতে এরূপ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকৃত মোট ৬২১টি হাদীছ জমা করা হয়েছে।

১৬. আত-তাম্বীহাতুল মালীহাহ ‘আলা মা তারাজা‘আ আনহুল আল্লামা মুহাদ্দিছ আলবানী মিনাল আহাদীছিয যঈফাহ আবিছ ছহীহাহ : শায়খ আব্দুল বাসিত আল-গারীব সংকলিত উক্ত গ্রন্থটিতে আলবানীর তাখরীজ সংশ্লিষ্ট মোট ২৮টি গ্রন্থ পর্যালোচনা করে হুকুম পরিবর্তনকৃত মোট ৪৭৩ টি হাদীছ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া গ্রন্থের শুরুতে তিনি আলবানীর ব্যাপারে চরম বিদ্বেষী হাসান সাক্কাফ এর একটি বই সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করেছেন এবং উক্ত বইয়ে তিনি আলবানীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পেশ করতে গিয়ে যেসব প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন, তা সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন।[32]

১৭. ফিক্বহুল আলবানী বাইনাস সাওয়ালি ওয়াল জাওয়াব : বৃহদায়তন এই গ্রন্থটিতে আলবানীর বিভিন্ন বই থেকে ফিক্বহী মাসআলাসমূহ সংকলন করে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর আকারে সাজানো হয়েছে। আলবানীর শেষ জীবনের ছাত্র ড. আবূ ইবরাহীম আহমাদ ইবনু নাছরুল্লাহ ছাবরী কাজটি সম্পন্ন করেন। মিসরের দারুছ ছাহাবা লিত তুরাছ ৪ খন্ডে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫৪৮।

১৮. আর রওযুদ দানী ফিল ফারাইদিল হাদীছিইয়াহ :

এটা আলবানীর ঘনিষ্ট ছাত্র ইছাম মূসা হাদী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থ। দুই শতাধিক পৃষ্ঠার এই বইটিতে তিনি আলবানীর বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে ইলমে হাদীছ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা সমূহ জমা করেছেন। এখানে হাদীছ গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে গৃহীত নীতি, তাহক্বীক্বের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী মুহাদ্দিছগণের নীতি-পদ্ধতি, হাদীছের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা তথা ইল্লত সংশ্লিষ্ট আলোচনা, হাদীছের বিভিন্ন পরিভাষা ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ইলমে হাদীছের ছাত্রদের জন্য বইটি খুবই উপকারী।

১৯. আল-জামেউল মুফাহরাস লি আত্বরাফিল আহাদীছ ওয়াল আছার আল্লাতি খাররাজাহাল আলবানী :

এটি আলবানীর প্রকাশিত বইসমূহে তাখরীজকৃত হাদীছ ও আছারসমূহের একটি সূচীপত্র। ২ খন্ডে প্রকাশিত এই বইটি শায়খ আবূ উসামা সালীম ইবনু ‘ঈদ আল-হেলালী সংকলন করেন। এখানে আলবানীর মোট ৬৭টি গ্রন্থে প্রায় ৪০ হাযার তাখরীজকৃত হাদীছ আরবী বর্ণমালার ধারাবাহিকতায় সাজানো হয়েছে এবং প্রতিটি হাদীছ তাঁর কোন গ্রন্থের কত নম্বর বা কোন পৃষ্ঠায় রয়েছে, সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর সংকলিত সুনানুল আরবা‘আহ-এর তাখরীজ, মুখতাছার ছহীহুল বুখারী এবং মুখতাছার ছহীহ মুসলিমের হাদীছসমূহ উক্ত সংকলন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

(ক্রমশঃ)

[1]. আলবানী, আছলু ছিফাতি ছালাতিন্নবী, পৃ. ১৯-২০।

[2]. হিন্দাকানী, আল-ইখতিয়ারাতুল ফিক্বহিইয়াহ লিল আলবানী মিন খিলালি কিতাবি ছিফাতি ছালাতিন্নবী (রিয়াদ : দারুল মা‘আরেফ, ১ম প্রকাশ, ২০০৬ খ্রি.), পৃ. ৫৪-৫৫।

[3]. আলবানী, তালখীছু ছিফাতি ছালাতিন্নবী (দামেশক : আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, ৫ম প্রকাশ, ১৯৮৪ খ্রি.), পৃ. ৪।

[4]. ছিফাতু ছালাতিন্নবী, পৃ. ৪৩-৪৪।

[5]. ছিফাতু ছালাতিন্নবী, পৃ. ৬৯।

[6]. গ্রন্থটি রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলবানী বলেন, একবার জনৈক ব্যক্তি তার আত্মীয় মারা যাওয়ার প্রেক্ষিতে আমার কাছে জানাযার ইসলামী আদব সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু লিখে দেওয়ার আবেদন করেন। ফলে বিষয়টি নিয়ে আমি ইস্তিখারা করলাম। অতঃপর পেশাগত সামান্য কাজ ও প্রয়োজনীয় ঘুম ব্যতীত প্রায় তিনমাস যাবৎ একাধারে এ বিষয়ের উপর গবেষণা ও পর্যালোচনার মাঝে ডুবে রইলাম এবং রাত-দিন কাজ করে গেলাম। ফলে গ্রন্থটি রচনা করতে সক্ষম হলাম’। দ্র. আলবানী, আহকামুল জানায়েয ওয়া বিদ‘উহা (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরেফ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯২ খ্রি.), পৃ. ৮-৯।

[7]. জুহূদুশ শায়খ আলবানী ফিল হাদীছ, পৃ. ৫০।

[8]. বইটি রচনার প্রেক্ষাপট হ’ল- আলবানীর নিকটতম বন্ধু প্রফেসর আব্দুর রহমান আলবানী তার বিবাহ উপলক্ষে এ বিষয়ে কিছু লেখার জন্য আহবান জানালে তিনি বইটি রচনা করেন। অতঃপর তিনি তা প্রকাশ করেন এবং বিবাহের পর মানুষের মাঝে মিষ্টি বিতরণের পরিবর্তে উক্ত বইটি বিতরণ করেন’। দ্র. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী : মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ, পৃ. ৫৯।

[9]. মুহীববুদ্দীন খত্বীব (১৮৮৬-১৯৬৯ খৃ.) মিসরের প্রখ্যাত সালাফী লেখক, সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ‘মাজাল্লাতুল ফাৎহ’ ও ‘যাহরা’ নামে দু’টি পত্রিকা চালু করেন এবং কিছুকাল ‘আযহার’ ও ‘আহরাম’ পত্রিকায় সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ‘জম‘ঈয়াতুশ শুববানিল মুসলিমীন’ নামে একটি সংগঠনের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি মাতবা‘আতুস সালাফিইয়াহ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর বইসহ বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেন। দ্র. আল-আ‘লাম, ৫/২৮১-৮২।

[10]ওলামা ওয়া মুফাক্কিরূন ‘আরাফতুহুম, ১ম/২৮৯।

[11]. আবূ বকর আহমাদ ইবনু জা‘ফর আল-কাতী‘ঈ (৮৮৭-৯৭৯ খ্রি.)। বাগদাদে জন্মগ্রহণকারী এই মুহাদ্দিছ সম্পর্কে ইমাম দারাকুৎনী বলেন, তিনি দুনিয়াবিমুখ ছিক্বাহ রাবী। আমি শুনেছি তার দো‘আ কবুল করা হয়। দ্র. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১২/২৬৩।

[12]. আলবানী : মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ, পৃ. ৭৫।

[13]. বুখারী, হা/৪৮৬৩; মুসলিম হা/৫৭৬; মিশকাত হা/১০৩৭।

[14]. সূরা নাজম ৬২।

[15]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৫/৪৪২; সূরা হজ্জ ৫২।

[16]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছা.), ৩য় প্রকাশ ২০১৬ খ্রি., পৃ. ১৫২-১৫৫।

[17]. শায়খ ইসমাঈল আনছারী (রহঃ) ১৩৪০ হিজরীতে আফ্রিকার মরু এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় ওলামায়ে কেরামের নিকটে প্রাথমিক জ্ঞানার্জনের পর ১৩৬৮ হিজরীতে তিনি সঊদী আরবে হিজরত করেন এবং সেখানেই পড়াশুনা শেষ করেন। কর্মজীবনে তিনি সঊদী আরবের দারুল ইফতা এবং হাইআতু কিবারিল উলামা-র সদস্য ও গবেষক, রিয়াদের উচ্চ আদালতের বিচারক এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন এবং বেশ কিছু গ্রন্থের তাখরীজ করেন। ১৪২১ হিজরীতে তিনি রাজধানী রিয়াদে মৃত্যুবরণ করেন। দ্র. ইসমাঈল আনছারী, তাছহীহু হাদীছিত তারাবীহ ইশরীনা রাক‘আতান (রিয়াদ : মাকতাবাতুল ইমাম শাফেঈ, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮৮ খ্রি.), পৃ. ১৫৪-৫৯।

[18]. যেমন বুখারী ১২৭৭ হাদীছের যে মতন, তার চেয়ে কিছু বেশী রয়েছে ২০৯৩ ও ৬০৩৬ নং হাদীছের মতনে। আলবানী ১২৭৭ নং হাদীছটি উল্লেখ করে বাকি দুটি বর্ণনায় যা অতিরিক্ত রয়েছে, তা একত্রিত করেছেন এবং তা মোটা অক্ষরে চিহ্নিত করেছেন।

[19]. নাছিরুদ্দীন আলবানী, মুখতাছার ছহীহুল বুখারী, ১/১০-১৬।

[20]আলবানী বলেন, প্রায় তিন মাস আমি একাজেই নিবিষ্ট ছিলাম। কোন ক্লান্তি ও বিরক্তি ছাড়া দিন-রাত আমি কাজ করে যেতাম। ফলে কারান্তরীণ করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর শত্রুরা আমার উপর যে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল, তা আমার জন্য নে‘মতে পরিণত হল। …অতএব সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যার অনুগ্রহে সকল শুভ কাজসমূহ সম্পন্ন হয়ে থাকে। দ্র. মুখতাছার ছহীহুল ইমাম আল-বুখারী, ভূমিকা দ্র. ১/৮-৯

[21]ইমাম আলবানী হায়াতুহু ওয়া দা‘ওয়াতুহু, পৃ. ৩৭-৩৯; নাছিরুদ্দীন আলবানী; মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ, পৃ. ২৮।

[22]. আলবানী, ফিহরিসু মাখতূতাতি দারিল কুতুবিয যাহিরিইয়াহ ফী ইলমিল হাদীছ (রিয়াদ : মাকতাবুল মা‘আরেফ, ১ম প্রকাশ, ২০০১ খ্রি.), পৃ. ৮-১২।

[23]. এটি ১৯৫৮ সালে মিসর, সিরিয়া ও উত্তর ইয়ামন নিয়ে গঠিত একটি কনফেডারেশন। মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাছের ছিলেন এর প্রধান। ১৯৬১ সালে এই প্রজাতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে।

[24]. মুহাম্মাদ খায়ের রামাযান ইউসুফ, মু‘জামুল মুওয়াল্লিফীন আল-মু‘আছিরীন (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মালিক ফাহাদ আল-ওয়াতানিইয়া, ১ম প্রকাশ, ২০০৪ খ্রি.), পৃ. ৭৩০-৩১।

[25]. ইমাম আলবানী হায়াতুহু ওয়া দা‘ওয়াতুহু, পৃ. ১২-১৩; হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু ওয়া ছানাউল ওলামা ‘আলাইহি, পৃ. ৪৭।

[26]. ওলামা ওয়া মুফাক্কিরূন ‘আরাফতুহুম, ১/২৯২।

[27]. ইরওয়াউল গালীল, ৮/৩০৮; ছহীহুল জামি‘ঈছ ছগীর, ১/১৭।

[28]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, পৃ. ৫৭৮।

[29]. আব্দুল বারী ফাৎহুল্লাহ মাদানী, মুকাম্মাল নামাযে নববী (আহলেহাদীছ সোসাইটি, ইউপি ইন্ডিয়া, ২০০২ খ্রি.), পৃ. ২৭।

[30]. আলবানী, তাওহীদ আউয়ালান ইয়া দু‘আতাল ইসলাম (মানছূরাহ, মিসর : দারুল হুদা আন-নববী, ১ম প্রকাশ, ১৪২০ হি.), পৃ. ৪।

[31]. আলবানী, কিছছাতুল মাসীহিদ দাজ্জাল (আম্মান : আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ১৪২১ হি.), পৃ. ৬-৭।

[32]. আব্দুল বাসিত আল-গারীব, আত-তাম্বীহাতুল মালীহাহ ‘আলা মা তারাজা‘আ আনহুল আল্লামা মুহাদ্দিছ আলবানী মিনাল আহাদীছিয যঈফাহ আবিছ ছহীহাহ, পৃ. ৯-১৪।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top