বই : রামাযান ও ছিয়াম
লেখক : মুহাম্মাদ লিলবর আল-বারাদী
একজন মুমিন সারা বছর চাতকের মত রামাযানের প্রতীক্ষায় থাকে। অন্যদিকে রামাযান মাসের শেষ দশকে আগমনে ‘লায়লাতুল ক্বদর’ তথা ক্বদরের রাত্রী তালাশে ব্যাকুল হয়ে থাকে। ক্বদরের রাত একটি মহিমান্বিত ও বরকতময় রজনী। মহান আল্লাহ তা‘আলার কৃপায় এ রাতে সাধ্যমত ইবাদত করা এবং পাপ মোচন করিয়ে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এ রাত শেষে দশকের বিজোড় রাত্রীতে তালাশ করতে হয়।
লায়লাতুল ক্বদরের নামকরণ :
‘ক্বদর’ (اَلْقَدْرُ) অর্থ সম্মান, মর্যাদা। আর لَيْلَةُ الْقَدْرِ অর্থ মর্যাদার রাত্রি, বা মহিমান্বিত রজনী। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِيْنَ- فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيْمٍ- أَمْرًا مِنْ عِنْدِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِيْنَ. ‘আমরা একে নাযিল করেছি বরকতময় রাত্রিতে। আর আমরা তো সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। আমাদের আদেশক্রমে। আর আমরাই তো প্রেরণকারী’ (দুখান ৪৪/৩-৫)।
ক্বদরের রাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে একটি সূরা নাযিল করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ (১) وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (২) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ (৩) تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ (৪) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (৫)
‘আমরা একে নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে। তুমি কি জানো ক্বদরের রাত্রি কি? ক্বদরের রাত্রি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে অবতরণ করে ফেরেশতাগণ এবং রূহ, তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে বিভিন্ন নির্দেশনা সহকারেএ রাতে কেবলই শান্তি বর্ষণ। যা চলতে থাকে ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত’ (সূরা ক্বদর ৯৭/১-৫)।
ছিয়াম পালন করলে মানুষের কৃত গোনাহ সমূহ মাফ হয়ে যায়। অনুরূপভাবে লাইলাতুল ক্বদরের রাতেও ক্ষমার সৌভাগ্য অর্জন করে। এমর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ،
وَمَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ،
وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ-
(১)‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়।
(২) যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্বের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়।
(৩) যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রি ইবাদাতে কাটায় তার পূর্ববর্তী গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৯৫৮।
এ মাসে ক্বদরের রাত্রি বঞ্চিত হলো সে সমস্ত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। إِنَّ هَذَا الشَّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلَّهُ وَلاَ يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلاَّ مَحْرُومٌ. রামযান মাস শুরু হলে রসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের নিকট এ মাস সমুপস্থিত। এতে রয়েছে এমন এক রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ থেকে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হলো সে সমস্ত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। কেবল বঞ্চিত ব্যক্তিরাই তা থেকে বঞ্চিত হয় (হাসান ছহীহ, ছহীহ তারগীব হা/৯৮৯, ৯৯০)।
শুধু লাইলাতুল কদরের রাতে নয়, প্রত্যেক রাতেই মহান আল্লাহ নিম্ন আসমানে নেমে আসেন এবং অনেক বান্দাকে ক্ষমা করেন মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِى فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِى فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ لَهُ ‘আল্লাহ প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করেন এবং ফজর পর্যন্ত বান্দাদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, আছ কি কোন আহবানকারী, আমি তার আহবানে সাড়া দেব। আছ কি কেউ সাহায্য প্রার্থনাকারী, আমি তাকে তা দিব। আছ কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করব’(বুখারী হা/১১৪৫; মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩)।
এ থেকে বুঝা যায়, রাতে প্রথম অংশে ঘুমিয়ে শেষ রাতে ইবাদত করলেই কঠিন পরিশ্রমী ব্যক্তিদের পক্ষে ক্বদরের রাত্রি জাগরণ সহজ হয়।
লাইলাতুল ক্বদরের আলামতসমূহ :
(১) “আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন: লাইলাতুল ক্বদরের রাত উজ্জ্বল। অন্য এক বর্ণনায় আছে, নাতিশীতোষ্ণ; না ঠাণ্ডা, না গরম।” (মুসনাদ আহমদ, ত্বাবারানী, ইবনে খুযাইমাহ)
(২) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, “আমরা আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) উপস্থিতিতে লাইলাতুল ক্বদর নিয়ে আলোচনা করছিলাম অতঃপর তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে (ঐ রাত) মনে করতে পার যেদিন ‘চাঁদ অর্ধ থালার মত উঠেছিল? (মুসলিম)
(৩) “লাইলাতুল ক্বদরের রাতে উল্কা ছুটে না।” (মুসনাদ আহমদ, ত্বাবারানী, ইবনে খুযাইমাহ)
(৪) “মুসলিম ইবনু ইবরাহীম (রহ), আবু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) কে (লাইলাতুল-ক্বদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা) করলাম, তিনি বললেন, একখন্ড মেঘ এসে এমন ভাবে বর্ষণ শুরু করল যে, যার ফলে (মসজিদে নববীর) ছাদ দিয়ে পানি পড়া শুরু হল। কেননা, (তখন মসজিদের) ছাদ ছিল খেজুরের ডালের তৈরী। এমন সময় ছালাতের ইকামত দেওয়া হল, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পানি ও কাদার উপর সিজদা করতে দেখলাম, এমন কি আমি তাঁর কপালেও কাদার চিহ্ন দেখতে পেলাম।” (ছহীহ বুখারী)
(৫) “ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, “লাইলাতুল ক্বদর বা ক্বদরের রাত্রিটি হল প্রশান্ত ও আনন্দময়, না গরম আর না ঠান্ডা এবং ভোরের সূর্য উদিত হয় দূর্বল ও লাল হয়ে।” (ইবন খুযাইমাহ – হাদিছটি হাসান)
(৬) “আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) বলেন: সে রাতের প্রভাতের সূর্য উপরে না উঠা পর্যন্ত অনুজ্বল থাকবে (মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ)
রামাযান মাসের তাৎপর্য সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘সেই ব্যক্তির নাক মাটিতে মিশে যাক, যে রামাযান পেল, অথচ নিজেকে ক্ষমা করে নিতে পারল না’(তিরমিযী, মিশকাত হা/৯২৭ ‘ছালাত’ অধ্যায়)।