শবেবরাত

                            শবেবরাত

আরবী শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে শবেবরাতবা লায়লাতুল বারাআত(ليلة
البراءة)
বলা হয়শবেবরাতশব্দটি ফারসীএর অর্থ হিস্সা বা নির্দেশ পাওয়ার রাত্রি দ্বিতীয় শব্দটি আরবীযার অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রিএদেশে শবেবরাত সৌভাগ্য রজনীহিসাবেই পালিত হয়এজন্য সরকারী ছুটি ঘোষিত হয় লোকেরা ধারণা করে যে, এ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়আয়ু ও রূযী বৃদ্ধি করা হয়সারা বছরের হায়াত-মউতের
ভাগ্যের রেজিষ্ট্রার লিখিত হয়এই রাতে রূহগুলো সব আত্মীয়-স্বজনের
সাথে
মুলাক্বাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে বিশেষ করে বিধবারা
মনে করেন যে
, তাদের স্বামীদের রূহ ঐ রাতে ঘরে ফেরে এজন্য ঘরের মধ্যে
আলো জ্বেলে বিধবাগণ সারা রাত মৃত
স্বামীর রূহের আগমনের আশায় বুক বেঁধে বসে থাকেনবাসগৃহ ধুপ-ধুনা, আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি দিয়ে আলোকিত করা
হয়
অগণিত বাল্ব
জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়
এজন্য সরকারী পুরস্কারও ঘোষণা
করা হয়
আত্মীয়রা সব দলে দলে গোরস্থানে ছুটে যায় হালুয়া-রুটির
হিড়িক পড়ে যায়
ছেলেরা পটকা ফাটিয়ে আতশবাজি করে হৈ-হুল্লোড়ে রাত কাটিয়ে দেয়যারা কখনো ছালাতে অভ্যস্ত নয়, তারাও ঐ রাতে মসজিদে গিয়ে ছালাতে আল্ফিয়াহ(الصلاة الألفية) বা ১০০ রাকআত ছালাত আদায়ে রত হয়, যেখানে প্রতি রাকআতে ১০ বার করে সূরায়ে ইখলাছ পড়া
হয়
সংক্ষেপে এই হল এদেশে শবেবরাতের
নামে
প্রচলিত ইসলামী পর্বের বাস্তব চিত্র

ধর্মীয় ভিত্তি :
মোটামুটি দুটি ধর্মীয় আক্বীদাই এর ভিত্তি হিসাবে কাজ করে থাকে১. ঐ রাতে
বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়
আগামী এক বছরের জন্য ভাল-মন্দ তাক্বদীর
নির্ধারিত হয় এবং এই রাতে কুরআন নাযিল হয়
২. ঐ রাতে রূহগুলি ছাড়া পেয়ে মর্ত্যে
নেমে আসে
হালুয়া-রুটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, এই দিনে আল্লাহর নবী (ছাঃ)-এর
দান্দান মুবারক ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল
ব্যথার জন্য তিনি নরম
খাদ্য হিসাবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন বিধায় আমাদেরও
সেই ব্যথায় সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য হালুয়া-রুটি খেতে হয়অথচ ওহোদের যুদ্ধ হয়েছিল ৩য়
হিজরীর
শাওয়াল মাসের ১১ তারিখ শনিবার সকাল বেলায়আর আমরা ব্যথা অনুভব করছি তার প্রায় দুমাস পূর্বে শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে…! এক্ষণে আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলির ধর্মীয় ভিত্তি
কতটুকু তা খুঁজে
দেখবপ্রথমটির সপক্ষে যে সব আয়াত ও হাদীছ পেশ করা হয়, তা নিম্নরূপ: ১. সূরায়ে দুখান-এর ৩ ও ৪ নং আয়াত- إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا
مُنْذِرِيْنَ- فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍحَكِيْمٍ-
অর্থ: (৩) আমরা তো
এটি অবতীর্ণ
করেছি এক মুবারক রজনীতে; আমরা তো সতর্ককারী (৪) এ
রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় স্থিরীকৃত হয়হাফেয ইবনে কাছীর (৭০১-৭৭৪
হিঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন
, ‘এখানে মুবারক রজনী অর্থ লায়লাতুল ক্বদরযেমন সূরায়ে ক্বদর
১ম আয়াতে আল্লাহ বলেন
 إِنَّا
اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ الْقَدْرِ
নিশ্চয়ই আমরা এটা নাযিল করেছি ক্বদরের
রাত্রিতে
আর সেটি হল রামাযান মাসেযেমন সূরায়ে বাক্বারাহর ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেনشَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ
أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْانُ،
এই সেই রামাযান মাস যার মধ্যে কুরআন
অবতীর্ণ
হয়েছেএই রাতে এক শাবান তে আরেক শাবান পর্যন্ত বান্দার রূযী, বিয়ে-শাদী,
জন্ম-মৃত্যু
ইত্যাদি
লিপিবদ্ধ হয় বলে যে হাদীছ প্রচারিত আছে, তা মুরসালও যঈফ এবং কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্যতিনি বলেন,
ক্বদর রজনীতেই লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত ভাগ্যলিপি হতে পৃথক করে আগামী এক বছরের নির্দেশাবলী তথা মৃত্যু, রিযিক ও অন্যান্য ঘটনাবলী যা সংঘটিত হবে, সেগুলি লেখক ফেরেশতাগণের নিকটে প্রদান করা হয়এরূপভাবেই বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ বিন ওমর, মুজাহিদ, আবু মালিক, যাহ্হাক প্রমুখ সালাফে ছালেহীনের নিকট তে
অতঃপর তাক্বদীরসম্পর্কে পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য হল-
وَكُلُّ شَيْءٍ فَعَلُوْهُ فِى الزُّبْرِ- وكُلُّ صَغِيْرٍ وَّكَبِيْرٍ
مُسْتَطَرٌ-
অর্থ: তাদের সমস্ত
কার্যকলাপ আছে আমলনামায়
, আছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সমস্ত কিছুই লিপিবদ্ধ
(ক্বামার ৫২-৫৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,كَتَبَ اللهُ مَقَادِيْرَ الخَلاَئِقِ قَبْلَ أنْ يَّخْلُقَ
السَّمَاوَاتِ  وَ الْأرْضَ بِخَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ.
আসমান সমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বৎসর পূর্বেই আল্লাহ তাআলা স্বীয়
মাখলূক্বাতের
তাক্বদীর লিখে রেখেছেন(মুসলিম হা/৬৬৯০) আবু হুরায়রাহ (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
তোমার ভাগ্যে যা
আছে তা
ঘটবে; এ বিষয়ে কলম শুকিয়ে গেছে’ (পুনরায় তাক্বদীর লিখিত হবে না)এক্ষণে শবেবরাতে প্রতিবছর ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয় বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে,
তার কোন ছহীহ ভিত্তি নেইবরং লায়লাতুল বারাআতবা ভাগ্যরজনী নামটিই সম্পূর্ণ বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতইসলামী শরীআতে এই নামের কোন
অস্তিত্ব খুঁজে
পাওয়া যায় না
বাকী রইল এই রাতে
গুনাহ
মাফ হওয়ার বিষয়সেজন্য দিনে ছিয়াম পালন ও রাতে ইবাদত
করতে হয়
অন্ততঃ ১০০ শত রাকআত ছালাত আদায় করতে হয় প্রতি রাকআতে সূরায়ে ফাতিহা
ও ১০ বার করে সূরায়ে
এখলাছ অর্থাৎ ক্বুল হুওয়াল্লা-হু আহাদপড়তে হয়এই ছালাতটি গোসল
করে আদায় করলে
গোসলের প্রতি ফোঁটা পানিতে ৭০০ শত রাকআত নফল ছালাতের
ছওয়াব পাওয়া যায় ইত্যাদি
এ সম্পর্কে প্রধান
যে
তিনটি দলীল পেশ করা হয়ে থাকে, তা নিম্নরূপ:
১. আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِذَا كَانَتْ لَيْلَةٌ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُوْمُوْا
لَيْلَهَا وَصُوْمُوْا نَهَارَهَا الخ-
মধ্য শাবান এলে তোমরা রাত্রিতে ইবাদত কর ও দিনে ছিয়াম পালন করকেননা আল্লাহ পাক ঐদিন সূর্যাস্তের পরে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন ও বলেন, আছ কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব; আছ কি কেউ রূযী প্রার্থী আমি তাকে রূযী দেবআছ কি কোন রোগী, আমি তাকে আরোগ্য দান করব
এই হাদীছটির সনদে ইবনু আবী সাব্রাহনামে একজন রাবী আছেন, যিনি হাদীছ জালকারীসে কারণে হাদীছটি মুহাদ্দেছীনের
নিকটে
যঈফ
দ্বিতীয়তঃ হাদীছটি
ছহীহ
হাদীছের বিরোধী হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য কেননা একই মর্মে
প্রসিদ্ধ
হাদীছে নুযূলইবনু মাজাহর ৯৮ পৃষ্ঠায় মা আয়েশা (রাঃ) হতে (হা/১৩৬৬) এবং
বুখারী শরীফের (মীরাট ছাপা
১৩২৮ হিঃ) ১৫৩, ৯৩৬ ও ১১১৬ পৃষ্ঠায় এবং কুতুবে সিত্তাহ
সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে সর্বমোট ৩০ জন ছাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছেসেখানে মধ্য শাবাননা বলে প্রতি রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশবলা হয়েছেঅতএব ছহীহ হাদীছ সমূহের বর্ণনানুযায়ী
আল্লাহপাক
প্রতি রাত্রির তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করে বান্দাকে ফজরের সময় পর্যন্ত উপরোক্ত আহবান করে থাকেন; শুধুমাত্র নির্দিষ্টভাবে মধ্য শাবানের একটি রাত্রিতে নয়
২. মা আয়েশা (রাঃ)
তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা রাত্রিতে একাকী মদীনার বাক্বীগোরস্থানে গিয়েছিলেনসেখানে তিনি এক পর্যায়ে আয়েশাকে লক্ষ্য করে বলেন, মধ্য শাবানের দিবাগত রাতে আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং কল্বগোত্রের ছাগল সমূহের লোম সংখ্যার চাইতে অধিক সংখ্যক
লোককে মাফ করে থাকেন
এই হাদীছটিতে হাজ্জাজ বিন আরত্বাতনামক একজন রাবী আছেন, যার সনদ মুনক্বাত্বাহওয়ার কারণে ইমাম বুখারী প্রমুখ
মুহাদ্দিছগণ হাদীছটিকে
যঈফবলেছেন
প্রকাশ থাকে যে,
নিছফে শাবান’-এর ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হতে কোন ছহীহ মরফূ হাদীছ নেই
৩. ইমরান বিন
হুছাইন
(রাঃ) বলেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক
ব্যক্তিকে বলেন যে
, তুমি কি সিরারে শাবানেরছিয়াম রেখেছ? লোকটি বললেন, ‘নাআল্লাহর নবী (ছাঃ) তাকে রামাযানের পরে
ছিয়াম দুটির ক্বাযা আদায় করতে বললেন
জমহূর বিদ্বানগণের
মতে
সিরারঅর্থ মাসের শেষউক্ত ব্যক্তি শাবানের শেষাবধি নির্ধারিত ছিয়াম পালনে অভ্যস্ত ছিলেন অথবা ঐটা তার মানতের ছিয়াম ছিলরামাযানের সঙ্গে
মিশিয়ে ফেলার
নিষেধাজ্ঞা লংঘনের ভয়ে তিনি শাবানের শেষের ছিয়াম
দু
টি বাদ দেনসেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ঐ ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করতে বলেনবুঝা গেল যে,
এই হাদীছটির সঙ্গে প্রচলিত শবেবরাতের কোন সম্পর্ক নেই
শবেবরাতের ছালাত :
এই রাত্রির ১০০ শত রাকআত ছালাত সম্পর্কে যে হাদীছ বলা হয়ে থাকে তা মওযূবা জালএই ছালাত ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে আবিষ্কৃত হয়যেমন মিশকাতুল মাছাবীহ-এর খ্যাতনামা আরবী ভাষ্যকার মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃঃ ১০১৪
হিঃ)
আল-লাআলীকিতাবের বরাতে বলেন, ‘জুমআ ও ঈদায়নের ছালাতের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে ছালাতে আল্ফিয়াহনামে এই রাতে যে ছালাত আদায় করা হয় এবং এর সপক্ষে যেসব হাদীছ ও আছার বলা হয়, তার সবই বানোয়াট ও মওযূ অথবা যঈফএই বিদআত ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম জেরুযালেমের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে প্রবর্তিত হয়মসজিদের মূর্খ ইমামগণ অন্যান্য ছালাতের সঙ্গে যুক্ত করে এই ছালাত চালু করেনএর মাধ্যমে তারা
জনসাধারণকে
একত্রিত করার এবং মাতববরী করা ও পেট পুর্তি করার একটা ফন্দি এঁটেছিল মাত্রএই বিদআতী ছালাতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে নেক্কার-পরহেযগার ব্যক্তিগণ আল্লাহর গযবে যমীন ধসে যাওয়ার
ভয়ে শহর ছেড়ে
জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন
এই রাতে মসজিদে
গিয়ে
একাকী বা জামাআত বদ্ধভাবে ছালাত আদায় করা, যিকর-আযকারে লিপ্ত
হওয়া সম্পর্কে জানা
যায় যে, শামের কিছু বিদ্বান এটা প্রথমে শুরু
করেন
তারা এই রাতে
সুন্দর পোষাক পরে
, আতর-সুরমা লাগিয়ে মসজিদে গিয়ে রাত্রি জাগরণ করতে থাকেনপরে বিষয়টি লোকদের
মধ্যে
ছড়িয়ে পড়ে মক্কা-মদীনার আলেমগণ এর তীব্র বিরোধিতা
করেন
কিন্তু শামের
বিদ্বানদের
দেখাদেখি কিছু লোক এগুলো করতে শুরু করেএইভাবে এটি
জনসাধারণ্যে ব্যপ্তি
লাভ করে
রূহের আগমন :
এই রাত্রিতে বাক্বীএ গারক্বাদ
নামক কবরস্থানে রাতের বেলায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিঃসঙ্গ অবস্থায় যেয়ারত করতে যাওয়ার হাদীছটি (ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৯) যে যঈফ ও মুনক্বাত্বাতা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছিএখন প্রশ্ন হলঃ এই রাতে সত্যি সত্যিই
রূহগুলো ইল্লীন বা সিজ্জীন হ
তে সাময়িকভাবে ছাড়া পেয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে কি-নাযাদের মাগফেরাত কামনার জন্য আমরা দলে দলে কবরস্থানের দিকে
ছুটে
যাইএমনকি মেয়েদের জন্য কবর যেয়ারত অসিদ্ধ হলেও তাদেরকেও এ রাতে কবরস্থানে দেখা যায়এ সম্পর্কে সাধারণতঃ সূরায়ে ক্বদর-এর ৪ ও ৫নং আয়াত দুটি পেশ করা হয়ে থাকে যেখানে বলা হয়েছে,
 تَنَزَّلُ الْمَلآئِكَةُ وَالرَّوْحُ
فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ سَلاَمٌ، هِىَ حَتَّى مَطْلِعِ
الْفَجْرِ-
সে রাত্রিতে ফিরিশতাগণ
ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের
প্রতিপালকের অনুমতিক্রমেসকল বিষয়ে কেবল
শান্তি
; ঊষার উদয়কাল পর্যন্ত এখানে সে রাত্রিবলতে লায়লাতুল
ক্বদর বা শবেক্বদরকে বুঝানো হয়েছে- যা এই
সূরার ১ম, ২য় ও ৩য় আয়াতে বলা হয়েছে
অত্র সূরায় রূহঅবতীর্ণ হয় কথাটি
রয়েছে বিধায়
হয়তবা অনেকে ধারণা করে নিয়েছেন যে, মৃত ব্যক্তিদের
রূহগুলি সব দুনিয়ায় নেমে আসে
অথচ এই অর্থ কোন বিদ্বান করেননিরূহশব্দটি একবচনএ সম্পর্কে হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে রূহ বলতে ফিরিশতাগণের সরদার জিবরাঈলকে বুঝানো হয়েছে
শাবান মাসের করণীয় :
রামাযানের আগের
মাস
হিসাবে শাবান মাসের প্রধান করণীয় হ অধিকহারে ছিয়াম
পালন করা
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে রামাযান ব্যতীত
অন্য কোন মাসে শা
বানের ন্যায় এত অধিক ছিয়াম পালন করতে দেখিনিশেষের দিকে তিনি
মাত্র কয়েকটি দিন ছিয়াম ত্যাগ
করতেনযারা শাবানের প্রথম থেকে
নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন
, তাদের জন্য শেষের পনের দিন ছিয়াম পালন করা উচিত নয়অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হন বা মানত করে থাকেন, তারা শেষের দিকেও ছিয়াম পালন করবেন
মোটকথা শাবান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম পালন করা সুন্নাত ছহীহ দলীল ব্যতীত কোন দিন বা রাতকে ছিয়াম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট
করা
সুন্নাতের বরখেলাফঅবশ্য যারা আইয়ামে বীয’-এর তিন দিন নফল ছিয়ামে অভ্যস্ত, তারা ১৩, ১৪ ও ১৫ই শাবানে উক্ত নিয়তেই ছিয়াম পালন করবেন, শবেবরাতের নিয়তে নয়নিয়তের গোলমাল হলে কেবল কষ্ট করাই সার হবে কেননা বিদআতী কোন আমল আল্লাহ পাক কবুল করেন না এবং সকল প্রকার বিদআতই ভ্রষ্টতা ও প্রত্যাখ্যাতআল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে
নিজ নিজ আমল সমূহ পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!!

 

শবেবরাত

-আত-তাহরীক ডেস্ক

আরবী শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে ‘শবেবরাত’ বা ‘লায়লাতুল বারাআত’ (ليلة البراءة)
বলা হয়। ‘শবেবরাত’ শব্দটি ফারসী। এর অর্থ হিস্সা বা নির্দেশ পাওয়ার
রাত্রি। দ্বিতীয় শব্দটি আরবী। যার অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রি। এদেশে
শবেবরাত ‘সৌভাগ্য রজনী’ হিসাবেই পালিত হয়। এজন্য সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়।
লোকেরা ধারণা করে যে, এ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আয়ু ও রূযী বৃদ্ধি
করা হয়। সারা বছরের হায়াত-মউতের ও ভাগ্যের রেজিষ্ট্রার লিখিত হয়। এই রাতে
রূহগুলো সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে মুলাক্বাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে।
বিশেষ করে বিধবারা মনে করেন যে, তাদের স্বামীদের রূহ ঐ রাতে ঘরে ফেরে।
এজন্য ঘরের মধ্যে আলো জ্বেলে বিধবাগণ সারা রাত মৃত স্বামীর রূহের আগমনের
আশায় বুক বেঁধে বসে থাকেন। বাসগৃহ ধুপ-ধুনা, আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি
দিয়ে আলোকিত করা হয়। অগণিত বাল্ব জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। এজন্য সরকারী
পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। আত্মীয়রা সব দলে দলে গোরস্থানে ছুটে যায়।
হালুয়া-রুটির হিড়িক পড়ে যায়। ছেলেরা পটকা ফাটিয়ে আতশবাজি করে হৈ-হুল্লোড়ে
রাত কাটিয়ে দেয়। যারা কখনো ছালাতে অভ্যস্ত নয়, তারাও ঐ রাতে মসজিদে গিয়ে
‘ছালাতে আল্ফিয়াহ’ (الصلاة الألفية)
বা ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায়ে রত হয়, যেখানে প্রতি রাক‘আতে ১০ বার করে
সূরায়ে ইখলাছ পড়া হয়। সংক্ষেপে এই হ’ল এদেশে শবেবরাতের নামে প্রচলিত
ইসলামী পর্বের বাস্তব চিত্র।

ধর্মীয় ভিত্তি :

মোটামুটি দু’টি ধর্মীয় আক্বীদাই এর ভিত্তি হিসাবে কাজ করে
থাকে। ১. ঐ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আগামী এক বছরের জন্য ভাল-মন্দ
তাক্বদীর নির্ধারিত হয় এবং এই রাতে কুরআন নাযিল হয়। ২. ঐ রাতে রূহগুলি
ছাড়া পেয়ে মর্ত্যে নেমে আসে। হালুয়া-রুটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, এই
দিনে আল্লাহর নবী (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল।
ব্যথার জন্য তিনি নরম খাদ্য হিসাবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন বিধায় আমাদেরও
সেই ব্যথায় সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য হালুয়া-রুটি খেতে হয়। অথচ ওহোদের
যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ১১ তারিখ শনিবার সকাল বেলায়। আর আমরা
ব্যথা অনুভব করছি তার প্রায় দু’মাস পূর্বে শা‘বানের ১৪ তারিখ দিবাগত
রাতে…! এক্ষণে আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলির ধর্মীয় ভিত্তি কতটুকু তা খুঁজে
দেখব। প্রথমটির সপক্ষে যে সব আয়াত ও হাদীছ পেশ করা হয়, তা নিম্নরূপ: ১.
সূরায়ে দুখান-এর ৩ ও ৪ নং আয়াত- إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِيْنَ- فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍحَكِيْمٍ-
অর্থ: (৩) আমরা তো এটি অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে; আমরা তো
সতর্ককারী (৪) এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’। হাফেয
ইবনে কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে মুবারক রজনী অর্থ
লায়লাতুল ক্বদর’। যেমন সূরায়ে ক্বদর ১ম আয়াতে আল্লাহ বলেন,   إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ الْقَدْرِ ‘নিশ্চয়ই আমরা এটা নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে’। আর সেটি হ’ল রামাযান মাসে। যেমন সূরায়ে বাক্বারাহর ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,  شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْانُ،
‘এই সেই রামাযান মাস যার মধ্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে’। এই রাতে এক শা‘বান
হ’তে আরেক শা‘বান পর্যন্ত বান্দার রূযী, বিয়ে-শাদী, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি
লিপিবদ্ধ হয় বলে যে হাদীছ প্রচারিত আছে, তা ‘মুরসাল’ ও যঈফ এবং কুরআন ও
ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, ক্বদর
রজনীতেই লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত ভাগ্যলিপি হ’তে পৃথক করে আগামী এক বছরের
নির্দেশাবলী তথা মৃত্যু, রিযিক ও অন্যান্য ঘটনাবলী যা সংঘটিত হবে, সেগুলি
লেখক ফেরেশতাগণের নিকটে প্রদান করা হয়। এরূপভাবেই বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ
বিন ওমর, মুজাহিদ, আবু মালিক, যাহ্হাক প্রমুখ সালাফে ছালেহীনের নিকট
হ’তে।

অতঃপর ‘তাক্বদীর’ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য হ’ল-

وَكُلُّ شَيْءٍ فَعَلُوْهُ فِى الزُّبْرِ- وكُلُّ صَغِيْرٍ وَّكَبِيْرٍ مُسْتَطَرٌ-

অর্থ: ‘তাদের সমস্ত কার্যকলাপ আছে আমলনামায়, আছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সমস্ত কিছুই লিপিবদ্ধ’ (ক্বামার ৫২-৫৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,كَتَبَ اللهُ مَقَادِيْرَ الخَلاَئِقِ قَبْلَ أنْ يَّخْلُقَ السَّمَاوَاتِ  وَ الْأرْضَ بِخَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ. ‘আসমান সমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বৎসর পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় মাখলূক্বাতের তাক্বদীর লিখে রেখেছেন’ (মুসলিম হা/৬৬৯০)
আবু হুরায়রাহ (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার ভাগ্যে যা আছে তা
ঘটবে; এ বিষয়ে কলম শুকিয়ে গেছে’ (পুনরায় তাক্বদীর লিখিত হবে না)। এক্ষণে
শবেবরাতে প্রতিবছর ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয় বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার কোন
ছহীহ ভিত্তি নেই। বরং ‘লায়লাতুল বারাআত’ বা ভাগ্যরজনী নামটিই সম্পূর্ণ
বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইসলামী শরী‘আতে এই নামের কোন অস্তিত্ব খুঁজে
পাওয়া যায় না।

বাকী রইল এই রাতে গুনাহ মাফ হওয়ার বিষয়। সেজন্য দিনে ছিয়াম
পালন ও রাতে ইবাদত করতে হয়। অন্ততঃ ১০০ শত রাক‘আত ছালাত আদায় করতে হয়।
প্রতি রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা ও ১০ বার করে সূরায়ে এখলাছ অর্থাৎ ‘ক্বুল
হুওয়াল্লা-হু আহাদ’ পড়তে হয়। এই ছালাতটি গোসল করে আদায় করলে গোসলের প্রতি
ফোঁটা পানিতে ৭০০ শত রাক‘আত নফল ছালাতের ছওয়াব পাওয়া যায় ইত্যাদি।

এ সম্পর্কে প্রধান যে তিনটি দলীল পেশ করা হয়ে থাকে, তা নিম্নরূপ:

১. আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِذَا كَانَتْ لَيْلَةٌ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُوْمُوْا لَيْلَهَا وَصُوْمُوْا نَهَارَهَا الخ- ‘মধ্য
শা‘বান এলে তোমরা রাত্রিতে ইবাদত কর ও দিনে ছিয়াম পালন কর। কেননা আল্লাহ
পাক ঐদিন সূর্যাস্তের পরে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন ও বলেন, আছ কি কেউ
ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব; আছ কি কেউ রূযী প্রার্থী
আমি তাকে রূযী দেব। আছ কি কোন রোগী, আমি তাকে আরোগ্য দান করব’।

এই হাদীছটির সনদে ‘ইবনু আবী সাব্রাহ’ নামে একজন রাবী আছেন, যিনি হাদীছ জালকারী। সে কারণে হাদীছটি মুহাদ্দেছীনের নিকটে ‘যঈফ’।

দ্বিতীয়তঃ হাদীছটি ছহীহ হাদীছের বিরোধী হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য।
কেননা একই মর্মে প্রসিদ্ধ ‘হাদীছে নুযূল’ ইবনু মাজাহর ৯৮ পৃষ্ঠায় মা
আয়েশা (রাঃ) হ’তে (হা/১৩৬৬) এবং বুখারী শরীফের (মীরাট ছাপা ১৩২৮ হিঃ) ১৫৩,
৯৩৬ ও ১১১৬ পৃষ্ঠায় এবং ‘কুতুবে সিত্তাহ’ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে
সর্বমোট ৩০ জন ছাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সেখানে ‘মধ্য শা‘বান’ না বলে
‘প্রতি রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ’ বলা হয়েছে। অতএব ছহীহ হাদীছ সমূহের
বর্ণনানুযায়ী আল্লাহপাক প্রতি রাত্রির তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করে
বান্দাকে ফজরের সময় পর্যন্ত উপরোক্ত আহবান করে থাকেন; শুধুমাত্র
নির্দিষ্টভাবে মধ্য শা‘বানের একটি রাত্রিতে নয়।

২. মা আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা
রাত্রিতে একাকী মদীনার ‘বাক্বী’ গোরস্থানে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি এক
পর্যায়ে আয়েশাকে লক্ষ্য করে বলেন, মধ্য শা‘বানের দিবাগত রাতে আল্লাহ
দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং ‘কল্ব’ গোত্রের ছাগল সমূহের লোম সংখ্যার
চাইতে অধিক সংখ্যক লোককে মাফ করে থাকেন’। এই হাদীছটিতে ‘হাজ্জাজ বিন
আরত্বাত’ নামক একজন রাবী আছেন, যার সনদ ‘মুনক্বাত্বা’ হওয়ার কারণে ইমাম
বুখারী প্রমুখ মুহাদ্দিছগণ হাদীছটিকে ‘যঈফ’ বলেছেন।

প্রকাশ থাকে যে, ‘নিছফে শা‘বান’-এর ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে কোন ছহীহ মরফূ হাদীছ নেই।

৩. ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) বলেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে বলেন যে, তুমি কি ‘সিরারে শা‘বানের’ ছিয়াম রেখেছ?
লোকটি বললেন, ‘না’। আল্লাহর নবী (ছাঃ) তাকে রামাযানের পরে ছিয়াম দু’টির
ক্বাযা আদায় করতে বললেন’।

জমহূর বিদ্বানগণের মতে ‘সিরার’ অর্থ মাসের শেষ। উক্ত
ব্যক্তি শা‘বানের শেষাবধি নির্ধারিত ছিয়াম পালনে অভ্যস্ত ছিলেন অথবা ঐটা
তার মানতের ছিয়াম ছিল। রামাযানের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার নিষেধাজ্ঞা লংঘনের
ভয়ে তিনি শা‘বানের শেষের ছিয়াম দু’টি বাদ দেন। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
তাকে ঐ ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করতে বলেন। বুঝা গেল যে, এই হাদীছটির সঙ্গে
প্রচলিত শবেবরাতের কোন সম্পর্ক নেই।

শবেবরাতের ছালাত :

এই রাত্রির ১০০ শত রাক‘আত ছালাত সম্পর্কে যে হাদীছ বলা হয়ে
থাকে তা ‘মওযূ’ বা জাল। এই ছালাত ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম বায়তুল
মুক্বাদ্দাস মসজিদে আবিষ্কৃত হয়। যেমন মিশকাতুল মাছাবীহ-এর খ্যাতনামা আরবী
ভাষ্যকার মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃঃ ১০১৪ হিঃ) ‘আল-লাআলী’ কিতাবের
বরাতে বলেন, ‘জুম‘আ ও ঈদায়নের ছালাতের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে ‘ছালাতে
আল্ফিয়াহ’ নামে এই রাতে যে ছালাত আদায় করা হয় এবং এর সপক্ষে যেসব হাদীছ ও
আছার বলা হয়, তার সবই বানোয়াট ও মওযূ অথবা যঈফ। এই বিদ‘আত ৪৪৮ হিজরীতে
সর্বপ্রথম জেরুযালেমের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে প্রবর্তিত হয়। মসজিদের
মূর্খ ইমামগণ অন্যান্য ছালাতের সঙ্গে যুক্ত করে এই ছালাত চালু করেন। এর
মাধ্যমে তারা জনসাধারণকে একত্রিত করার এবং মাতববরী করা ও পেট পুর্তি করার
একটা ফন্দি এঁটেছিল মাত্র। এই বিদ‘আতী ছালাতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে
নেক্কার-পরহেযগার ব্যক্তিগণ আল্লাহর গযবে যমীন ধসে যাওয়ার ভয়ে শহর ছেড়ে
জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন’।

এই রাতে মসজিদে গিয়ে একাকী বা জামা‘আত বদ্ধভাবে ছালাত আদায়
করা, যিকর-আযকারে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জানা যায় যে, শামের কিছু বিদ্বান
এটা প্রথমে শুরু করেন। তারা এই রাতে সুন্দর পোষাক পরে, আতর-সুরমা লাগিয়ে
মসজিদে গিয়ে রাত্রি জাগরণ করতে থাকেন। পরে বিষয়টি লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
মক্কা-মদীনার আলেমগণ এর তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু শামের বিদ্বানদের
দেখাদেখি কিছু লোক এগুলো করতে শুরু করে। এইভাবে এটি জনসাধারণ্যে ব্যপ্তি
লাভ করে।

রূহের আগমন :

এই রাত্রিতে ‘বাক্বী‘এ গারক্বাদ’ নামক কবরস্থানে রাতের বেলায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিঃসঙ্গ অবস্থায় যেয়ারত করতে যাওয়ার হাদীছটি (ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৯)
যে যঈফ ও মুনক্বাত্বা‘ তা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছি। এখন প্রশ্ন হ’লঃ এই
রাতে সত্যি সত্যিই রূহগুলো ইল্লীন বা সিজ্জীন হ’তে সাময়িকভাবে ছাড়া পেয়ে
পৃথিবীতে নেমে আসে কি-না। যাদের মাগফেরাত কামনার জন্য আমরা দলে দলে
কবরস্থানের দিকে ছুটে যাই। এমনকি মেয়েদের জন্য কবর যেয়ারত অসিদ্ধ হ’লেও
তাদেরকেও এ রাতে কবরস্থানে দেখা যায়। এ সম্পর্কে সাধারণতঃ সূরায়ে ক্বদর-এর
৪ ও ৫নং আয়াত দু’টি পেশ করা হয়ে থাকে। যেখানে বলা হয়েছে,

 تَنَزَّلُ الْمَلآئِكَةُ وَالرَّوْحُ فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ سَلاَمٌ، هِىَ حَتَّى مَطْلِعِ الْفَجْرِ-

‘সে রাত্রিতে ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের
প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। সকল বিষয়ে কেবল শান্তি; ঊষার উদয়কাল পর্যন্ত’।
এখানে ‘সে রাত্রি’ বলতে লায়লাতুল ক্বদর বা শবেক্বদরকে বুঝানো হয়েছে- যা এই
সূরার ১ম, ২য় ও ৩য় আয়াতে বলা হয়েছে।

অত্র সূরায় ‘রূহ’ অবতীর্ণ হয় কথাটি রয়েছে বিধায় হয়তবা
অনেকে ধারণা করে নিয়েছেন যে, মৃত ব্যক্তিদের রূহগুলি সব দুনিয়ায় নেমে আসে।
অথচ এই অর্থ কোন বিদ্বান করেননি। ‘রূহ’ শব্দটি একবচন। এ সম্পর্কে হাফেয
ইবনে কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে রূহ বলতে ফিরিশতাগণের সরদার
জিবরাঈলকে বুঝানো হয়েছে।

শা‘বান মাসের করণীয় :

রামাযানের আগের মাস হিসাবে শা‘বান মাসের প্রধান করণীয় হ’ল
অধিকহারে ছিয়াম পালন করা। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে
রামাযান ব্যতীত অন্য কোন মাসে শা‘বানের ন্যায় এত অধিক ছিয়াম পালন করতে
দেখিনি। শেষের দিকে তিনি মাত্র কয়েকটি দিন ছিয়াম ত্যাগ করতেন’। যারা
শা‘বানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন, তাদের জন্য শেষের পনের দিন
ছিয়াম পালন করা উচিত নয়। অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হন বা মানত করে থাকেন, তারা
শেষের দিকেও ছিয়াম পালন করবেন।

মোটকথা শা‘বান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম পালন করা সুন্নাত।
ছহীহ দলীল ব্যতীত কোন দিন বা রাতকে ছিয়াম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা
সুন্নাতের বরখেলাফ। অবশ্য যারা ‘আইয়ামে বীয’-এর তিন দিন নফল ছিয়ামে
অভ্যস্ত, তারা ১৩, ১৪ ও ১৫ই শা‘বানে উক্ত নিয়তেই ছিয়াম পালন করবেন,
শবেবরাতের নিয়তে নয়। নিয়তের গোলমাল হ’লে কেবল কষ্ট করাই সার হবে। কেননা
বিদ‘আতী কোন আমল আল্লাহ পাক কবুল করেন না এবং সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা ও
প্রত্যাখ্যাত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে
নিজ নিজ আমল সমূহ পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!!

 

– See more at: http://at-tahreek.com/june2013/article0501.html#sthash.Iu5HnU40.dpuf

শবেবরাত

-আত-তাহরীক ডেস্ক

আরবী শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে ‘শবেবরাত’ বা ‘লায়লাতুল বারাআত’ (ليلة البراءة)
বলা হয়। ‘শবেবরাত’ শব্দটি ফারসী। এর অর্থ হিস্সা বা নির্দেশ পাওয়ার
রাত্রি। দ্বিতীয় শব্দটি আরবী। যার অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রি। এদেশে
শবেবরাত ‘সৌভাগ্য রজনী’ হিসাবেই পালিত হয়। এজন্য সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়।
লোকেরা ধারণা করে যে, এ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আয়ু ও রূযী বৃদ্ধি
করা হয়। সারা বছরের হায়াত-মউতের ও ভাগ্যের রেজিষ্ট্রার লিখিত হয়। এই রাতে
রূহগুলো সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে মুলাক্বাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে।
বিশেষ করে বিধবারা মনে করেন যে, তাদের স্বামীদের রূহ ঐ রাতে ঘরে ফেরে।
এজন্য ঘরের মধ্যে আলো জ্বেলে বিধবাগণ সারা রাত মৃত স্বামীর রূহের আগমনের
আশায় বুক বেঁধে বসে থাকেন। বাসগৃহ ধুপ-ধুনা, আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি
দিয়ে আলোকিত করা হয়। অগণিত বাল্ব জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। এজন্য সরকারী
পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। আত্মীয়রা সব দলে দলে গোরস্থানে ছুটে যায়।
হালুয়া-রুটির হিড়িক পড়ে যায়। ছেলেরা পটকা ফাটিয়ে আতশবাজি করে হৈ-হুল্লোড়ে
রাত কাটিয়ে দেয়। যারা কখনো ছালাতে অভ্যস্ত নয়, তারাও ঐ রাতে মসজিদে গিয়ে
‘ছালাতে আল্ফিয়াহ’ (الصلاة الألفية)
বা ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায়ে রত হয়, যেখানে প্রতি রাক‘আতে ১০ বার করে
সূরায়ে ইখলাছ পড়া হয়। সংক্ষেপে এই হ’ল এদেশে শবেবরাতের নামে প্রচলিত
ইসলামী পর্বের বাস্তব চিত্র।

ধর্মীয় ভিত্তি :

মোটামুটি দু’টি ধর্মীয় আক্বীদাই এর ভিত্তি হিসাবে কাজ করে
থাকে। ১. ঐ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আগামী এক বছরের জন্য ভাল-মন্দ
তাক্বদীর নির্ধারিত হয় এবং এই রাতে কুরআন নাযিল হয়। ২. ঐ রাতে রূহগুলি
ছাড়া পেয়ে মর্ত্যে নেমে আসে। হালুয়া-রুটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, এই
দিনে আল্লাহর নবী (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল।
ব্যথার জন্য তিনি নরম খাদ্য হিসাবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন বিধায় আমাদেরও
সেই ব্যথায় সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য হালুয়া-রুটি খেতে হয়। অথচ ওহোদের
যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ১১ তারিখ শনিবার সকাল বেলায়। আর আমরা
ব্যথা অনুভব করছি তার প্রায় দু’মাস পূর্বে শা‘বানের ১৪ তারিখ দিবাগত
রাতে…! এক্ষণে আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলির ধর্মীয় ভিত্তি কতটুকু তা খুঁজে
দেখব। প্রথমটির সপক্ষে যে সব আয়াত ও হাদীছ পেশ করা হয়, তা নিম্নরূপ: ১.
সূরায়ে দুখান-এর ৩ ও ৪ নং আয়াত- إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِيْنَ- فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍحَكِيْمٍ-
অর্থ: (৩) আমরা তো এটি অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে; আমরা তো
সতর্ককারী (৪) এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’। হাফেয
ইবনে কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে মুবারক রজনী অর্থ
লায়লাতুল ক্বদর’। যেমন সূরায়ে ক্বদর ১ম আয়াতে আল্লাহ বলেন,   إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ الْقَدْرِ ‘নিশ্চয়ই আমরা এটা নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে’। আর সেটি হ’ল রামাযান মাসে। যেমন সূরায়ে বাক্বারাহর ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,  شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْانُ،
‘এই সেই রামাযান মাস যার মধ্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে’। এই রাতে এক শা‘বান
হ’তে আরেক শা‘বান পর্যন্ত বান্দার রূযী, বিয়ে-শাদী, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি
লিপিবদ্ধ হয় বলে যে হাদীছ প্রচারিত আছে, তা ‘মুরসাল’ ও যঈফ এবং কুরআন ও
ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, ক্বদর
রজনীতেই লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত ভাগ্যলিপি হ’তে পৃথক করে আগামী এক বছরের
নির্দেশাবলী তথা মৃত্যু, রিযিক ও অন্যান্য ঘটনাবলী যা সংঘটিত হবে, সেগুলি
লেখক ফেরেশতাগণের নিকটে প্রদান করা হয়। এরূপভাবেই বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ
বিন ওমর, মুজাহিদ, আবু মালিক, যাহ্হাক প্রমুখ সালাফে ছালেহীনের নিকট
হ’তে।

অতঃপর ‘তাক্বদীর’ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য হ’ল-

وَكُلُّ شَيْءٍ فَعَلُوْهُ فِى الزُّبْرِ- وكُلُّ صَغِيْرٍ وَّكَبِيْرٍ مُسْتَطَرٌ-

অর্থ: ‘তাদের সমস্ত কার্যকলাপ আছে আমলনামায়, আছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সমস্ত কিছুই লিপিবদ্ধ’ (ক্বামার ৫২-৫৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,كَتَبَ اللهُ مَقَادِيْرَ الخَلاَئِقِ قَبْلَ أنْ يَّخْلُقَ السَّمَاوَاتِ  وَ الْأرْضَ بِخَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ. ‘আসমান সমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বৎসর পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় মাখলূক্বাতের তাক্বদীর লিখে রেখেছেন’ (মুসলিম হা/৬৬৯০)
আবু হুরায়রাহ (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার ভাগ্যে যা আছে তা
ঘটবে; এ বিষয়ে কলম শুকিয়ে গেছে’ (পুনরায় তাক্বদীর লিখিত হবে না)। এক্ষণে
শবেবরাতে প্রতিবছর ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয় বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার কোন
ছহীহ ভিত্তি নেই। বরং ‘লায়লাতুল বারাআত’ বা ভাগ্যরজনী নামটিই সম্পূর্ণ
বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইসলামী শরী‘আতে এই নামের কোন অস্তিত্ব খুঁজে
পাওয়া যায় না।

বাকী রইল এই রাতে গুনাহ মাফ হওয়ার বিষয়। সেজন্য দিনে ছিয়াম
পালন ও রাতে ইবাদত করতে হয়। অন্ততঃ ১০০ শত রাক‘আত ছালাত আদায় করতে হয়।
প্রতি রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা ও ১০ বার করে সূরায়ে এখলাছ অর্থাৎ ‘ক্বুল
হুওয়াল্লা-হু আহাদ’ পড়তে হয়। এই ছালাতটি গোসল করে আদায় করলে গোসলের প্রতি
ফোঁটা পানিতে ৭০০ শত রাক‘আত নফল ছালাতের ছওয়াব পাওয়া যায় ইত্যাদি।

এ সম্পর্কে প্রধান যে তিনটি দলীল পেশ করা হয়ে থাকে, তা নিম্নরূপ:

১. আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِذَا كَانَتْ لَيْلَةٌ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُوْمُوْا لَيْلَهَا وَصُوْمُوْا نَهَارَهَا الخ- ‘মধ্য
শা‘বান এলে তোমরা রাত্রিতে ইবাদত কর ও দিনে ছিয়াম পালন কর। কেননা আল্লাহ
পাক ঐদিন সূর্যাস্তের পরে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন ও বলেন, আছ কি কেউ
ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব; আছ কি কেউ রূযী প্রার্থী
আমি তাকে রূযী দেব। আছ কি কোন রোগী, আমি তাকে আরোগ্য দান করব’।

এই হাদীছটির সনদে ‘ইবনু আবী সাব্রাহ’ নামে একজন রাবী আছেন, যিনি হাদীছ জালকারী। সে কারণে হাদীছটি মুহাদ্দেছীনের নিকটে ‘যঈফ’।

দ্বিতীয়তঃ হাদীছটি ছহীহ হাদীছের বিরোধী হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য।
কেননা একই মর্মে প্রসিদ্ধ ‘হাদীছে নুযূল’ ইবনু মাজাহর ৯৮ পৃষ্ঠায় মা
আয়েশা (রাঃ) হ’তে (হা/১৩৬৬) এবং বুখারী শরীফের (মীরাট ছাপা ১৩২৮ হিঃ) ১৫৩,
৯৩৬ ও ১১১৬ পৃষ্ঠায় এবং ‘কুতুবে সিত্তাহ’ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে
সর্বমোট ৩০ জন ছাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সেখানে ‘মধ্য শা‘বান’ না বলে
‘প্রতি রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ’ বলা হয়েছে। অতএব ছহীহ হাদীছ সমূহের
বর্ণনানুযায়ী আল্লাহপাক প্রতি রাত্রির তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করে
বান্দাকে ফজরের সময় পর্যন্ত উপরোক্ত আহবান করে থাকেন; শুধুমাত্র
নির্দিষ্টভাবে মধ্য শা‘বানের একটি রাত্রিতে নয়।

২. মা আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা
রাত্রিতে একাকী মদীনার ‘বাক্বী’ গোরস্থানে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি এক
পর্যায়ে আয়েশাকে লক্ষ্য করে বলেন, মধ্য শা‘বানের দিবাগত রাতে আল্লাহ
দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং ‘কল্ব’ গোত্রের ছাগল সমূহের লোম সংখ্যার
চাইতে অধিক সংখ্যক লোককে মাফ করে থাকেন’। এই হাদীছটিতে ‘হাজ্জাজ বিন
আরত্বাত’ নামক একজন রাবী আছেন, যার সনদ ‘মুনক্বাত্বা’ হওয়ার কারণে ইমাম
বুখারী প্রমুখ মুহাদ্দিছগণ হাদীছটিকে ‘যঈফ’ বলেছেন।

প্রকাশ থাকে যে, ‘নিছফে শা‘বান’-এর ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে কোন ছহীহ মরফূ হাদীছ নেই।

৩. ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) বলেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে বলেন যে, তুমি কি ‘সিরারে শা‘বানের’ ছিয়াম রেখেছ?
লোকটি বললেন, ‘না’। আল্লাহর নবী (ছাঃ) তাকে রামাযানের পরে ছিয়াম দু’টির
ক্বাযা আদায় করতে বললেন’।

জমহূর বিদ্বানগণের মতে ‘সিরার’ অর্থ মাসের শেষ। উক্ত
ব্যক্তি শা‘বানের শেষাবধি নির্ধারিত ছিয়াম পালনে অভ্যস্ত ছিলেন অথবা ঐটা
তার মানতের ছিয়াম ছিল। রামাযানের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার নিষেধাজ্ঞা লংঘনের
ভয়ে তিনি শা‘বানের শেষের ছিয়াম দু’টি বাদ দেন। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
তাকে ঐ ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করতে বলেন। বুঝা গেল যে, এই হাদীছটির সঙ্গে
প্রচলিত শবেবরাতের কোন সম্পর্ক নেই।

শবেবরাতের ছালাত :

এই রাত্রির ১০০ শত রাক‘আত ছালাত সম্পর্কে যে হাদীছ বলা হয়ে
থাকে তা ‘মওযূ’ বা জাল। এই ছালাত ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম বায়তুল
মুক্বাদ্দাস মসজিদে আবিষ্কৃত হয়। যেমন মিশকাতুল মাছাবীহ-এর খ্যাতনামা আরবী
ভাষ্যকার মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃঃ ১০১৪ হিঃ) ‘আল-লাআলী’ কিতাবের
বরাতে বলেন, ‘জুম‘আ ও ঈদায়নের ছালাতের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে ‘ছালাতে
আল্ফিয়াহ’ নামে এই রাতে যে ছালাত আদায় করা হয় এবং এর সপক্ষে যেসব হাদীছ ও
আছার বলা হয়, তার সবই বানোয়াট ও মওযূ অথবা যঈফ। এই বিদ‘আত ৪৪৮ হিজরীতে
সর্বপ্রথম জেরুযালেমের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে প্রবর্তিত হয়। মসজিদের
মূর্খ ইমামগণ অন্যান্য ছালাতের সঙ্গে যুক্ত করে এই ছালাত চালু করেন। এর
মাধ্যমে তারা জনসাধারণকে একত্রিত করার এবং মাতববরী করা ও পেট পুর্তি করার
একটা ফন্দি এঁটেছিল মাত্র। এই বিদ‘আতী ছালাতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে
নেক্কার-পরহেযগার ব্যক্তিগণ আল্লাহর গযবে যমীন ধসে যাওয়ার ভয়ে শহর ছেড়ে
জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন’।

এই রাতে মসজিদে গিয়ে একাকী বা জামা‘আত বদ্ধভাবে ছালাত আদায়
করা, যিকর-আযকারে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জানা যায় যে, শামের কিছু বিদ্বান
এটা প্রথমে শুরু করেন। তারা এই রাতে সুন্দর পোষাক পরে, আতর-সুরমা লাগিয়ে
মসজিদে গিয়ে রাত্রি জাগরণ করতে থাকেন। পরে বিষয়টি লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
মক্কা-মদীনার আলেমগণ এর তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু শামের বিদ্বানদের
দেখাদেখি কিছু লোক এগুলো করতে শুরু করে। এইভাবে এটি জনসাধারণ্যে ব্যপ্তি
লাভ করে।

রূহের আগমন :

এই রাত্রিতে ‘বাক্বী‘এ গারক্বাদ’ নামক কবরস্থানে রাতের বেলায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিঃসঙ্গ অবস্থায় যেয়ারত করতে যাওয়ার হাদীছটি (ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৯)
যে যঈফ ও মুনক্বাত্বা‘ তা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছি। এখন প্রশ্ন হ’লঃ এই
রাতে সত্যি সত্যিই রূহগুলো ইল্লীন বা সিজ্জীন হ’তে সাময়িকভাবে ছাড়া পেয়ে
পৃথিবীতে নেমে আসে কি-না। যাদের মাগফেরাত কামনার জন্য আমরা দলে দলে
কবরস্থানের দিকে ছুটে যাই। এমনকি মেয়েদের জন্য কবর যেয়ারত অসিদ্ধ হ’লেও
তাদেরকেও এ রাতে কবরস্থানে দেখা যায়। এ সম্পর্কে সাধারণতঃ সূরায়ে ক্বদর-এর
৪ ও ৫নং আয়াত দু’টি পেশ করা হয়ে থাকে। যেখানে বলা হয়েছে,

 تَنَزَّلُ الْمَلآئِكَةُ وَالرَّوْحُ فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ سَلاَمٌ، هِىَ حَتَّى مَطْلِعِ الْفَجْرِ-

‘সে রাত্রিতে ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের
প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। সকল বিষয়ে কেবল শান্তি; ঊষার উদয়কাল পর্যন্ত’।
এখানে ‘সে রাত্রি’ বলতে লায়লাতুল ক্বদর বা শবেক্বদরকে বুঝানো হয়েছে- যা এই
সূরার ১ম, ২য় ও ৩য় আয়াতে বলা হয়েছে।

অত্র সূরায় ‘রূহ’ অবতীর্ণ হয় কথাটি রয়েছে বিধায় হয়তবা
অনেকে ধারণা করে নিয়েছেন যে, মৃত ব্যক্তিদের রূহগুলি সব দুনিয়ায় নেমে আসে।
অথচ এই অর্থ কোন বিদ্বান করেননি। ‘রূহ’ শব্দটি একবচন। এ সম্পর্কে হাফেয
ইবনে কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে রূহ বলতে ফিরিশতাগণের সরদার
জিবরাঈলকে বুঝানো হয়েছে।

শা‘বান মাসের করণীয় :

রামাযানের আগের মাস হিসাবে শা‘বান মাসের প্রধান করণীয় হ’ল
অধিকহারে ছিয়াম পালন করা। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে
রামাযান ব্যতীত অন্য কোন মাসে শা‘বানের ন্যায় এত অধিক ছিয়াম পালন করতে
দেখিনি। শেষের দিকে তিনি মাত্র কয়েকটি দিন ছিয়াম ত্যাগ করতেন’। যারা
শা‘বানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন, তাদের জন্য শেষের পনের দিন
ছিয়াম পালন করা উচিত নয়। অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হন বা মানত করে থাকেন, তারা
শেষের দিকেও ছিয়াম পালন করবেন।

মোটকথা শা‘বান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম পালন করা সুন্নাত।
ছহীহ দলীল ব্যতীত কোন দিন বা রাতকে ছিয়াম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা
সুন্নাতের বরখেলাফ। অবশ্য যারা ‘আইয়ামে বীয’-এর তিন দিন নফল ছিয়ামে
অভ্যস্ত, তারা ১৩, ১৪ ও ১৫ই শা‘বানে উক্ত নিয়তেই ছিয়াম পালন করবেন,
শবেবরাতের নিয়তে নয়। নিয়তের গোলমাল হ’লে কেবল কষ্ট করাই সার হবে। কেননা
বিদ‘আতী কোন আমল আল্লাহ পাক কবুল করেন না এবং সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা ও
প্রত্যাখ্যাত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে
নিজ নিজ আমল সমূহ পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!!

 

– See more at: http://at-tahreek.com/june2013/article0501.html#sthash.Iu5HnU40.dpuf

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top