শহীদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য

শহীদের পরিচয় :

শহীদ আরবী: شهيد‎‎ (šahīd) বহুবচনে: شُهَدَاء শুহাদাʾ ; শব্দটি হলো কুরআনের আরবী শব্দ। যার অর্থ হলো সাক্ষী। এছাড়াও এর অন্য অর্থ হলো আত্ম-উৎসর্গ করা। ইসলামী বিশ্বাসের সাক্ষ্যদানে যে সচেতনভাবে গ্রহণযোগ্য মৃত্যু কামনা করে এবং আত্ম-উৎসর্গ করে তার উপাধি স্বরূপ শহীদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

মদ্দা কথা, যারা তাওহীদের কালেমাকে সমুন্নত করার খালেছ নিয়তে আল্লাহর পথে লড়াই করে মারা যাবে, তারাই হচ্ছে প্রকৃত শহীদ। আর শহীদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য হবে এই যে, সে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে লড়াই করবে না, তাকে বাহাদুর বলা হবে এ উদ্দেশ্যে বা লোককে শুনানোর উদ্দেশ্যে লড়াই করবে না’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৩১৬; মুসলিম, মিশকাত হা/২০৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করে অথবা নিহত হয়, সে ব্যক্তি জান্নাতী এবং শহীদ (আহমাদ হা/২৮৫, ১০৭৭২; ইবনু মাজাহ হা/২৯১০; মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১১)। অন্যত্র, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে মুসলমান আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে লড়াই করবে, কেবলমাত্র সেই-ই আল্লাহর পথে লড়াই করল’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৮১৪)। 

শহীদ ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা :

মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত শহীদের মর্যাদা অন্য কোন ব্যক্তি পাবেনা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে মুসলমান (১) তার দ্বীনের জন্য নিহত হ’ল, সে শহীদ (২) যে তার জীবন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (৩) যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (৪) যে ব্যক্তি তার পরিবার রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ।[1]

তিনি বলেন, (৫) যে ব্যক্তি মহামারীতে মারা যায়, সে শহীদ, (৬) যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় (কলেরা, ডায়রিয়া) মারা যায়, সে শহীদ, (৭) যে ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়, সে শহীদ’।[2] তিনি আরও বলেন, (৮) যে ব্যক্তি মযলূম অবস্থায় নিহত হয়, সে শহীদ’।[3] (৯) যে ব্যক্তি তার ন্যায্য অধিকার রক্ষায় নিহত হয়, সে শহীদ’।[4]

রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তি ছাড়াও আরও সাত জন ‘শহীদ’ রয়েছে। তারা হ’ল : (১) মহামারীতে মৃত (মুমিন) ব্যক্তি (২) পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি (৩) ‘যাতুল জাম্ব’ নামক কঠিন রোগে মৃত ব্যক্তি[5] (৪) (কলেরা বা অনুরূপ) পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি (৫) আগুনে পুড়ে মৃত ব্যক্তি (৬) ধ্বসে চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি ও (৭) গর্ভাবস্থায় মৃত মহিলা’।[6] উল্লেখ্য যে, ঐ সকল মুমিন ব্যক্তি আখেরাতে শহীদের নেকী পাবেন। যদিও দুনিয়াতে তাদের গোসল ও জানাযা করা হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে নিহত শহীদের গোসল নেই। তিনি ঐ অবস্থায় ক্বিয়ামতের দিন উঠবেন।[7]

শহীদগণ তিন শ্রেণীর : (১) যারা দুনিয়া ও আখেরাতে শহীদ। এঁরা হ’লেন, কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত মুমিন ব্যক্তি (২) আখেরাতে শহীদ। তারা হ’লেন উপরে বর্ণিত অন্যান্য শহীদগণ (৩) দুনিয়াতে শহীদ, আখেরাতে নয়। তারা হ’ল, যুদ্ধের ময়দানে গণীমতের মাল আত্মসাৎকারী অথবা জিহাদ থেকে পলাতক অবস্থায় নিহত ব্যক্তি’।[8] অর্থাৎ লোক দেখানো কপট শহীদ।

পরস্পরে মারামারি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ মানুষ ও পশু-পক্ষী সকল প্রাণীর স্বভাবগত বিষয়। স্ব স্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য মানুষ পরস্পরে যুদ্ধ করে। ধর্মীয় স্বার্থে হ’লে তখন সেটা ‘ধর্মযুদ্ধে’ পরিণত হয়। সেকারণ প্রত্যেক ধর্মেই যুদ্ধ একটি স্বীকৃত বিধান। ইসলাম আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ দ্বীন। যা সকল মানুষের কল্যাণে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন সহ সকল মানবরচিত ধর্ম এবং ইহূদী-নাছারা সহ পূর্ববর্তী সকল এলাহী ধর্ম, যা এখন মানসূখ বা হুকুমরহিত হিসাবে গণ্য; এসব ধর্ম রক্ষার জন্য লড়াই করাকে ‘জিহাদ’ বলা হবে না। বরং ঐসব ধর্মের অনুসারীদের হামলা থেকে ইসলামকে রক্ষা করার লড়াইকে ‘জিহাদ’ বলা হবে। ইসলামে জিহাদ বা যুদ্ধবিধান সম্পূর্ণরূপে দ্বীনের নিরিখে রচিত। এই বিধান সর্বব্যাপী ও সার্বজনীনভাবে কল্যাণময়। স্থান-কাল ও পাত্র বিবেচনায় এই বিধানের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগবিধি রয়েছে।

__________________________________________

[1]. তিরমিযী হা/১৪২১, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৫২৯ ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়।

[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১১; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪৪৯।

[3]. আহমাদ হা/২৭৮০, ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪৪৭।

[4]. মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৬৭৭৫; সনদ হাসান।

[5]. এটি সে যুগে একটি কঠিন মরণব্যাধি হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল। নামটি স্ত্রীলিঙ্গ হওয়ায় রোগটি মেয়েদের মধ্যেই অধিকহারে হ’ত বলে ধারণা করা হয়। যেসব গর্ভবর্তী মেয়েদের পেটে বাচ্চা মারা যায় এবং সেকারণে মাও মারা যায়, ঐ মেয়েকে যাতুল জাম্ব-এর রোগিনী বলা হয়। ইবনু হাজার বলেন, এটিই প্রসিদ্ধ (ফাৎহুল বারী হা/২৮২৯-এর ব্যাখ্যা, ৬/৫১ পৃঃ)।

[6]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৫৬১, সনদ ছহীহ।

[7]. বুখারী হা/৪০৭৯; মিশকাত হা/১৬৬৫; মির‘আত হা/১৬৭৯, ৫/৪০০ পৃঃ।

[8]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৯১।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top