আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন কে নিয়ে পরিবার গড়ে উঠে। একজন শিশু সন্তান
জন্মের পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পূর্বে ৪-৫ বছর পরিবারে বেড়ে ওঠে। এ
সময়টিতে তার মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠন হয়ে থাকে। শিশুর মায়ের কোল
তার শিক্ষার হাতে খড়ি। ফলে পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে।
পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। ছেলে-মেয়েদের জীবনে পারিবারিক
শিক্ষার মূল্য অনেক। সন্তানের মূল্যবোধ, আখলাক, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয়
পরিবার থেকেই। পিতা-মাতার সঠিক লালন-পালনে সন্তানরা সফল হতে পারে।
পিতা-মাতা যে আদর্শ লালন করেন তাদের সন্তানরাও তাই ধারণ করার চেষ্টা করে।
হাদীস শরীফে এসেছে,
«كل مولود يولد على الفطرة فأبواه يهودانه أو ينصراه أو يمجسانه».
“প্রত্যেক নবজাতক স্বভাবধর্মের (ইসলাম) ওপর জন্মগ্রহণ করে। অত:পর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজক বানান।”[1]
অন্য হাদীসে এসেছে,
«ما نحل والد ولدا من نحل أفضل من أدب حسن».
“উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষাদানের চেয়ে বড় দান কোনো পিতা তার সন্তানের জন্য করতে পারেনি।”[2]
আরবী কবি হাফেজ ইবরাহীম উত্তম জাতি গঠনে মায়ের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, মাতা
হলেন জ্ঞানালোকের প্রথম বাতি। তাকে যদি পড়তে পার, জন্ম নেবে সত্য জাতি।[3]
অতএব, অভিভাবকদের কর্তব্য হলো শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশ সাধনে ও নৈতিক চরিত্র গঠনে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পালন করা।
১. যত্নশীলতা, স্নেহ-মমতা, আদর-ভালোবাসা দেওয়া:
শিশুরা স্রষ্টার মহান আমানত। তারা নিষ্পাপ, অপ্রষ্ফুটিত পুষ্পকলির মতো
পবিত্র। পিতা-মাতা, অভিভাবকদের কাছে কোমলতা, মমতা, আদর সোহাগ পেলে তাদের
হৃদয় আনন্দে উচ্ছাসে ভরে ওঠে, যা শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য একটি অপরিহার্য
উপাদান। পক্ষান্তরে নিষ্ঠুরতা, অবহেলা ও সহিংসতাপূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশ ও
পারিপার্শ্বিকতা তাদের মধ্যে মানসিক জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
ক্রমান্বয়ে তাদের মানবিক গুণাবলী আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং পাশবিক চিন্তাধারা
সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরাই একদিন বড় হয়ে মানব সমাজের জন্য বিপজ্জনক ও ধ্বংসাত্মক
উপাদানে পরিণত হয়।
সন্তানের প্রতি মাতাপিতার হৃদয়জুড়ে অফুরন্ত ভালোবাসার যে ফাল্গুধারা আছে তা
একটি স্বতঃসিদ্ধ সহজাত সত্য হলেও আজকাল যান্ত্রিক সভ্যতা ও ভোগবাদী
বস্তুতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা মানুষকে হৃদয় মনহীন এমন এক যন্ত্রে রূপান্তরিত
করেছ যে, এক শ্রেণীর পিতা-মাতা অর্থ ও প্রাচুর্যের পাহাড় গড়তে গিয়ে
সন্তানের মানসিক ভবিষ্যৎ গড়ার কথা বে-মা‘লুম ভুলে যান। যে সময় সন্তানের
হৃদয় থাকে পিতা-মাতার স্নেহ মমতা ও আদর-সোহাগের প্রবল পিপাসা, তখন তারা
তাকে তুলে দেন কাজের মেয়ে কিংবা বেতনভোগী কর্মচারীদের হাতে।
ফলে পিতা-মাতার সান্নিধ্য সংস্পর্শ বঞ্চিত এসব শিশু মানসিক শূন্যতায়
ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এই শূন্যতা ঘোচানোর জন্য সে একসময় অসৎ, ভবঘুরে
বন্ধুদের সাহচর্য খুঁজে নেয়। সে জানে না যে, এরাই একদিন তাকে ধ্বংসের
দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে। এ জন্য আমরা দেখি যে, বখাটেদের মধ্যে এমন অনেকেই
রয়েছে, যারা মূলত ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। অর্থাভাব বা অন্য কিছু নয়,
শুধুমাত্র পিতা-মাতার উদাসীনতাই তাদের এই অধঃপতনের কারণ।
আসলে পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা একত্রিত করলেও পিতা-মাতার ভালোবাসা আত্মত্যাগ ও
উৎসর্গের কোনো বিকল্প খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্যই তো ইসলাম পারিবারিক
ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করেছে। যেন ভূমিষ্ঠ হওয়ার অব্যবহিত পরেই শিশু এমন
একটি জান্নাতী পরিমণ্ডলের আশ্রয় পায়, সেখানে সবাই তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
দিয়ে বরণ করে নেয়।
শিশু ও সন্তান-সন্ততির প্রতি দয়া-ভালোবাসা প্রদর্শনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে কত যত্নশীল ছিলেন, তা নিম্নোক্ত হাদীসগুলো থেকে
প্রমাণিত হয়। হাদীসে এসেছে,
«قبل رسول الله الحسن بن علي وعنده الأقرع بن حابس التميمي جالسا فقال
الأقرع إن لي عشرة من الولد ما قبلت منهم أحدا فنظر إليه رسول الله ثم قال
من لا يرحم لا يرحم».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাতি হাসান ইবন ‘আলীকে
চুমু দিচ্ছিলেন। তখন তাঁর কাছে আকরা ইবন হাবিছ আত-তাইমী নামে একজন সাহাবী
উপস্থিত ছিলেন। আকরা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম আমার দশটি সন্তান। আমি কোনো দিন তাদের কাউকে চুমু দেই নি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে (বিস্ময়ভরে) তাকালেন।
তারপর বললেন, যে ব্যক্তি দয়া প্রদর্শন করে না, সে দয়ার পাত্রও হতে পারে
না।”[4]
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের কান্না সহ্য করতে পারতেন
না। প্রয়োজনে সে কারণে সালাতকেও সংক্ষিপ্ত করতেন। হাদীসে এসেছে,
«إني لأقومُ في الصلاة أريدُ أن أطوِّل فيها ، فأسمعُ بكاءَ الصَّبيِّ فأتجوَّزُ في صلاتي ، كراهية أن أشقَّ على أُمِّه».
“আমি সালাতকে দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছা নিয়ে সালাত পড়তে দাঁড়াই। তারপর শিশুর
কান্নার শব্দ শুনতে পাই এবং তা তার মাকে বিচলিত করতে পারে এ আশংকায় আমি
সালাত সংক্ষিপ্ত করি।”
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
«دَخَلْ وَإِبْرَاهِيمُ يَجُودُ بِنَفْسِهِ ، فَجَعَلَتْ عَيْنَا رَسُولِ
اللَّهِ صلى الله عليه وسلم تَذْرِفَانِ . فَقَالَ لَهُ عَبْدُ الرَّحْمَنِ
بْنُ عَوْفٍ رضى الله عنه وَأَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَقَالَ « يَا
ابْنَ عَوْفٍ إِنَّهَا رَحْمَةٌ . ثُمَّ أَتْبَعَهَا بِأُخْرَى فَقَالَ صلى
الله عليه وسلم إِنَّ الْعَيْنَ تَدْمَعُ ، وَالْقَلْبَ يَحْزَنُ ، وَلاَ
نَقُولُ إِلاَّ مَا يَرْضَى رَبُّنَا ، وَإِنَّا بِفِرَاقِكَ يَا
إِبْرَاهِيمُ لَمَحْزُونُونَ ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পুত্র ইবরাহীম-এর কাছে
গেলেন। তিনি তখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু’চোখে অশ্রু ঝরতে থাকে। আব্দুর রহমান
ইবন আওফ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম)! আপনিও (কাঁদছেন)! তিনি বললেন, হে আওফের পুত্র! এটা হচ্ছে
মায়া-মমতা। এরপর তাঁর চোখ থেকে আবারও অশ্রু ঝরতে লাগল। তারপর তিনি বললেন,
হে চোখ অশ্রু ঝরাও, হৃদয় শোকার্ত হও, তবে আমরা আমাদের মুখে এমন কথাই বলব,
যাতে আমাদের রব সন্তুষ্ট হন। হে ইবরাহীম তোমার বিচ্ছেদে আমরা শোকাহত।”[5]
২. শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ:
বয়োঃপ্রাপ্ত হওয়ার পরে ইসলামের দৃষ্টিতে মানবসন্তানের ওপর বহুমুখী দায়িত্ব
অর্পিত হয়, যাকে শরী‘আতের পরিভাষায় বলা হয় তাকলীফ। তাকলীফ পর্যায়ে উপনীত
হয়ে যেন সে যথাযথ আপন কর্তব্য পালন করতে পারে, এজন্য শিশুর মধ্যে যখন থেকেই
ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বোধোদয় সূচিত হবে, জ্ঞান প্রথম আলোর উন্মেষ
ঘটতে শুরু করবে, তখন থেকেই শুরু হবে তার শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ।
ক. ঈমানের বিষয়সমূহ শিক্ষা:
আল্লাহ তা‘আলা, ফিরিশতা, নবী-রাসূল, তাকদীর, পরকাল, জান্নাত-জাহান্নাম,
হিসাব-নিকাশ ও অন্যান্য অপরিহার্য অদৃশ্য বিষয়সংক্রান্ত বিশ্বাস। হাদীসে
রয়েছে,
«افتحوا على صبيانكم أول كلمة بلا إله إلا الله ».
“তোমাদের সন্তানদের প্রথম কথা শিক্ষা দাও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”[6]
খ. আরকানুল ইসলাম:
তথা সালাত, সাওম ইত্যাদির প্রশিক্ষণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مُرُوا أَوْلاَدَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ
وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرِ سِنِينَ وَفَرِّقُوا
بَيْنَهُمْ فِى الْمَضَاجِعِ ».
“সাত বছরে পর্দাপণ করলেই তোমরা তোমাদের সন্তানদের সালাত পড়ার নির্দেশ দাও,
দশ বছরে পর্দাপণ করলে (তখনও যদি সালাত পড়ার অভ্যাস না হয়ে থাকে তবে)
তাদেরকে সালাত করার জন্য দৈহিক শাস্তি দাও এবং তাদের বিছানা পৃথক করে
দাও।”[7]
সালাত সম্পর্কিত নির্দেশ অন্যান্য আরকানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
গ. শরী‘আতের বিধি-বিধান:
তথা আক্বীদাহ, ইবাদাত, আখলাক, সর্বাত্মক ব্যবস্থাপনা ও বিধি-বিধান। এক কথায়
ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন সম্পর্কে তাদের মধ্যে মৌলিক ধারণা রোপন করা।
ঘ. কুরআন, সুন্নাহ, সীরাত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দান:
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَدِّبُوا أَوْلاَدَكُمْ عَلَى خِصَالٍ ثَلاَثٍ : عَلَى حُبِّ نَبِيِّكُمْ
، وَحُبِّ أَهْلِ بَيْتِهِ ، وَعَلَى قِرَاءَةِ الْقُرْآنِ ، فَإِنَّ
حَمَلَةَ الْقُرْآنِ فِي ظِلِّ اللهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ مَعَ
أَنْبِيَائِهِ وَأَصْفِيَائِهِ».
“তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে তিনটি বিষয়ে শিক্ষা দাও। (ক) তোমাদের নবীর
প্রতি ভালোবাসা (খ) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা এবং (গ) কুরআন
তিলাওয়াত। কুরআনের ধারকরা নবী-রাসুল ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সাথে
আল্লাহর ‘আরশের ছায়াতলে থাকবে, যখন তাঁর ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া থাকবে
না।”[8]
একদা উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর কাছে এসে জনৈক ব্যক্তি নিজের সন্তানের
অবাধ্যাচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। ওমর অভিযুক্ত সন্তানকে পিতার সাথে
অসদাচরণের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। সন্তান তখন বলল, হে আমীরুল মু’মিনীন,
সন্তানের কি পিতার উপর কোনো হক আছে? উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন,
হ্যাঁ, অবশ্যই। সে বলল, তাহলে তা কী? উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, পিতা
তার জন্য সৎ আদর্শ নারীকে মাতা হিসেবে গ্রহণ করবে, তার জন্য একটা সুন্দর
নাম রাখবে এবং তাকে কুরআন শিক্ষা দেবে। তখন সন্তান বলল, হে আমীরুল
মু’মিনীন, আমার পিতা ওগুলোতে একটিও করে নি। আমার মা হচ্ছেন ক্রীতদাসী। এক
সময় মূর্তিপূজারী ছিলেন, আমার নাম রেখেছে জু‘লান (অর্থাৎ গোবরে পোকা) আর
আমার বাবা আমাকে কুরআনের একটি বর্ণও শিক্ষা দেন নি। উমার তখন পিতার দিকে
তাকিয়ে বললেন, তুমি এসেছ সন্তানের অসদাচরণের বিরুদ্ধে নালিশ করতে। আরে তুমি
তো তার প্রতি আগেই অবিচার ও অসদাচরণ করেছ।[9]
সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদের
রাসূলের যুদ্ধের ইতিহাস শিক্ষা দিতাম, যেমনিভাবে তাদেরকে আমরা কুরআনের সূরা
শিক্ষা দিতাম।[10]
ইমাম গাযালী রহ. তাঁর ইহইয়াউ উলুমিদ্দীনের মধ্যে শিশুকে কুরআনুল কারীম,
হাদীস শরীফ, পূণ্যবানদের জীবনকথা ও তারপর দীনের বিধি-বিধান শিক্ষা দেওয়ার
ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন।[11]
ঙ. তাকওয়া ও আল্লাহভীতির চেতনা সঞ্চার করা:
সন্তানের মধ্যে আল্লাহর ভয় প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই
বলতে হবে তুমি যা কর এবং বল প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে, দিনের আলোতে কিংবা
রাতের অন্ধকারে, জলে কিংবা স্থলে সকল জায়গায়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে
পর্যবেক্ষণ করেন। অতএব, আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো অপরাধ করলেও আল্লাহ
তোমার কৃতকর্মের হিসাব অবশ্যই নেবেন। তোমাকে তাই সব সময় আল্লাহকে ভয় করে
আল্লাহর পথে চলতে হবে। সন্তানের মধ্যে খোদাভীতির এই চেতনা সঞ্চারিত করতে
পারলে সে আর কুপথে পা বাড়াবে না।
চ. চারিত্রিক প্রশিক্ষণ:
চারিত্রিক প্রশিক্ষণের গুরুত্ব প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ما نحل والد ولدا أفضل من أدب حسن».
“উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষাদানের চেয়ে বড় দান কোনো পিতা তার সন্তানের জন্য করতে পারে নি।”[12]
«أكرموا أولادكم وأحسنوا آدابهم» .
“তোমরা তোমাদের সন্তানদের ভালোবাসা দাও এবং তাদেরকে সর্বোত্তম শিষ্টাচারিতা ও নৈতিকতা শিক্ষা দাও।”[13]
«أن يحسن اسمه ويحسن أدبه».
“পিতার ওপর সন্তানের হক হলো, তার জন্য সুন্দর একটা নাম রাখবে এবং তাকে সর্বোত্তম শিক্ষা ও চরিত্রগুণে গড়ে তুলবে।”[14]
«لأن يؤدب الرجل ولده خير له من أن يتصدق بصاع» .
“সন্তানকে একটা উত্তম শিষ্টাচারিতা শিক্ষা দেওয়া আল্লাহর পথে এক সা‘ পরিমাণ বস্তু সদকা করার চেয়েও উত্তম।”[15]
৩. সদুপদেশ প্রদান:
মাতাপিতার সদুপদেশ সন্তানের জীবনপথের পাথেয় ও অন্ধকারে আলোকরশ্মি। তা
নিষ্পাপ শিশুর উর্বর হৃদয়ে তা অঙ্কিত হয়ে থাকে সারাজীবন। জীবনের গতিপথ
নির্ধারণের ক্ষেত্রে এগুলোই তাকে দেয় সঠিক নির্দেশনা।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
«كنت خلفت رسول الله صلى الله عليه و سلم يوما فقال يا غلام إني أعلمك
كلمات احفظ الله يحفظك احفظ الله تجده تجاهك إذا سألت فاسأل الله وإذا
استعنت فاستعن بالله واعلم أن الأمة لو اجتمعت على أن ينفعوك بشيء لم
ينفعوك إلا بشيء قد كتبه الله لك ولو اجتمعواعلى أن يضروك بشيء لم يضروك
إلا بشيء قد كتبه الله عليك رفعت الأقلام وجفت الصحف».
“আমি একদা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পেছনে আরোহণ
করেছিলাম। তিনি বললেন, হে বালক, আমি তোমাকে কিছু (মুল্যবান) কথা শিক্ষা
দেব:
* তুমি আল্লাহ তা‘আলার হক আদায়ের ব্যাপারে যত্নশীল হও, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের অনিষ্ট থেকে হিফাযত করবেন।
* যখন কিছু প্রার্থনা করবে, আল্লাহর কাছেই করবে।
* যখন সাহায্যের আবেদন করবে, তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই করবে।
* জেনে রাখ, যদি গোটা জাতি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তাহলে তারা ততটুকুই
করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য বরাদ্দ করেছেন। আর তারা যদি
তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তাহলে ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার
নামে বরাদ্দ করেছেন। কলম তুলে নেওয়া হয়েছে আর নিবন্ধন বই শুকিয়ে গেছে
অর্থাৎ তাকদীরে যা বরাদ্দ হবার তা হয়ে গেছে।[16]
ইবরাহীম ও ইয়াকুব আলাইহিমাস সালাম নিজ সন্তানদের উপদেশ সম্পর্কে কুরআনে এসেছে,
﴿وَوَصَّىٰ بِهَآ إِبۡرَٰهِۧمُ بَنِيهِ وَيَعۡقُوبُ يَٰبَنِيَّ إِنَّ
ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰ لَكُمُ ٱلدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم
مُّسۡلِمُونَ ١٣٢ ﴾ [البقرة: ١٣٢]
“এরই অসিয়ত করেছে ইবরাহীম তাঁর সন্তানদের এবং ইয়াকুবও যে, হে আমার
সন্তানগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্যে এ দীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই
তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনও মারা যেও না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৩২]
লোকমান হাকীম প্রদত্ত উপদেশ:
﴿وَإِذۡ قَالَ لُقۡمَٰنُ لِٱبۡنِهِۦ وَهُوَ يَعِظُهُۥ يَٰبُنَيَّ لَا
تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣ وَوَصَّيۡنَا
ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ وَهۡنًا عَلَىٰ وَهۡنٖ
وَفِصَٰلُهُۥ فِي عَامَيۡنِ أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ
ٱلۡمَصِيرُ١٤ وَإِن جَٰهَدَاكَ عَلَىٰٓ أَن تُشۡرِكَ بِي مَا لَيۡسَ لَكَ
بِهِۦ عِلۡمٞ فَلَا تُطِعۡهُمَاۖ وَصَاحِبۡهُمَا فِي ٱلدُّنۡيَا
مَعۡرُوفٗاۖ وَٱتَّبِعۡ سَبِيلَ مَنۡ أَنَابَ إِلَيَّۚ ثُمَّ إِلَيَّ
مَرۡجِعُكُمۡ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ١٥ يَٰبُنَيَّ
إِنَّهَآ إِن تَكُ مِثۡقَالَ حَبَّةٖ مِّنۡ خَرۡدَلٖ فَتَكُن فِي صَخۡرَةٍ
أَوۡ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ أَوۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ يَأۡتِ بِهَا ٱللَّهُۚ إِنَّ
ٱللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٞ١٦ يَٰبُنَيَّ أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ وَأۡمُرۡ
بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَٱنۡهَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَٱصۡبِرۡ عَلَىٰ مَآ أَصَابَكَۖ
إِنَّ ذَٰلِكَ مِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ ١٧ وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ
لِلنَّاسِ وَلَا تَمۡشِ فِي ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ
كُلَّ مُخۡتَالٖ فَخُورٖ ١٨ وَٱقۡصِدۡ فِي مَشۡيِكَ وَٱغۡضُضۡ مِن
صَوۡتِكَۚ إِنَّ أَنكَرَ ٱلۡأَصۡوَٰتِ لَصَوۡتُ ٱلۡحَمِيرِ١٩﴾ [لقمان: ١٣،
١٩]
“যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল, হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরীক করো
না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়। আর আমি মানুষকে তার
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর
কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধছাড়ানো দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে,
আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে
আসতে হবে। পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে
পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং
দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ
অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি
সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করব। হে বৎস, কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা
পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তত গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে
আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপনভেদ জানেন, সবকিছুর খবর
রাখেন। হে বৎস, সালাত কায়েম করো, সৎকাজের আদেশ দাও, মন্দকাজে থেকে নিষেধ
করো এবং বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ। অহংকারবশে
তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয়ই
আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করে না। পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন
করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা
অপ্রীতিকর।” [সূরা লোকমান, আয়াত: ১৩-১৯]
৪. সন্তানের কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করা:
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দো‘আ করেছিলেন,
﴿رَبِّ ٱجۡعَلۡنِي مُقِيمَ ٱلصَّلَوٰةِ وَمِن ذُرِّيَّتِيۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلۡ دُعَآءِ ٤٠﴾ [ابراهيم: ٤٠]
“হে আমার পালনকর্তা, আমাকে সালাত কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে
থেকেও। হে আমার পালনকর্তা, এবং কবুল করুন আমাদের দো‘আ।” [সূরা ইবরাহীম,
আয়াত: ৪০]
ইসলামের এ সুমহান নির্দেশনাবলীর আলোকে যারা প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
হবে, তারাই হবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
তারা কখনোই কাউকে উত্ত্যক্ত করতে পারে না। পিতা-মাতাগণ যদি তাঁদের
সন্তানদেরকে নৈতিকতার অনুশীলন বাড়িতেই নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে
অনাচারমুক্ত সভ্য সমাজ গঠন অসম্ভব হবে না।
৫. রাস্তার হক আদায় করা:
ইসলাম মানুষকে সার্বক্ষণিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে রাস্তাঘাটে বসতে নিষেধ করেছেন। একান্ত বসতে হলে
রাস্তার হক আদায় করতে হবে। আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
«إياكم والجلوس في الطرقات فقالوا يا رسول الله ما لنا من مجالسنا بدٌّ
نتحدث فيها فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فإذا أبيتم إلا المجلس
فأعطوا الطريق حقه قالوا وما حق الطريق يا رسول الله قال غض البصر وكف
الأذى ورد السلام والأمر بالمعروف والنهي عن المنكر»
“সাবধান, তোমরা রাস্তায় বসবে না। তখন সাহাবীগণ বললেন, আমাদের এ ছাড়া কোনো
উপায় নেই। আমরা রাস্তায় বসে পরস্পর দীনী আলোচনা করি। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তোমরা একান্তই রাস্তায় বসতে চাও তাহলে
রাস্তার হক আদায় করবে। সাহাবীগণ বললেন, রাস্তার হকসমূহ কী? আল্লাহর রাসূল
বললেন, ১. চক্ষু অবনমিত করে রাখা ২. কাউকে কষ্ট না দেওয়া ৩. সালামের উত্তর
দেওয়া ৪. সৎ কাজের আদেশ করা এবং ৫. মন্দ কাজে নিষেধ করা।”[17]
আমরা যদি আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে রাস্তায় চলাফেরার ক্ষেত্রে ইসলামের
নির্দেশনাকে অনুসরণের তাগাদা দিতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই রাস্তাঘাটের
অনাকাঙ্খিত ঘটনা থেকে আমাদের সন্তানরা নিরাপদ থাকতে পারবে।
৬. আল্লাহভীতি:
যার মধ্যে তাকওয়া কাজ করে তিনি কখনো খারাপ কাজ করতে পারেন না। একজন
মুত্তাকী মানুষ তার সকল কাজে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করেন। তিনি জানেন,
তাকে দেখছেন, শুনছেন, পর্যবেক্ষণ করছেন। আল্লাহর কাছে বান্দার গোপনীয়তা
বলতে কিছুই থাকে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لِّلَّهِ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۗ وَإِن تُبۡدُواْ مَا
فِيٓ أَنفُسِكُمۡ أَوۡ تُخۡفُوهُ يُحَاسِبۡكُم بِهِ ٱللَّهُۖ فَيَغۡفِرُ
لِمَن يَشَآءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَآءُۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ
قَدِيرٌ ٢٨٤﴾ [البقرة: ٢٨٤]
“যা কিছু আকাশসমূহে এবং যা কিছু জমিনে আছে, সব আল্লাহরই। যদি তোমরা মনের
কথা প্রকাশ কর কিংবা গোপন কর, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন।
অতঃপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দিবেন।”
[সূরা আল-বাকারা: ২৮৪]
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَقُولُواْ قَوۡلٗا سَدِيدٗا ٧٠﴾ [الاحزاب: ٧٠]
“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৭০]
আবু যর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«قال عبد الرحمن قال قلت: يا رسول الله أوصني قال اتق الله حيثما كنت واتبع السيئة الحسنة تمحها وخالق الناس بخلق حسن».
“আবদুর রহমান বলেছেন, হে আল্লাহর রাসূল আমাকে উপদেশ দিন। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করো। খারাপ কাজের পরপরই
ভালো কাজ করো এবং মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার কর।”[18]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿قُلۡ يَٰعِبَادِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمۡۚ لِلَّذِينَ
أَحۡسَنُواْ فِي هَٰذِهِ ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٞۗ وَأَرۡضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةٌۗ
إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ ١٠ ﴾ [الزمر:
١٠]
“বলুন, হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন করো।
যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে পূণ্য। আল্লাহর পৃথিবী
প্রশস্ত। যারা ধৈর্য ধারণকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।” [সূরা
আয-যুমার, আয়াত: ১০]
তিনি আরো বলেন,
«سبعة يظلهم الله في ظله الإمام العادل وشاب نشأ في عبادة ربه ورجل قلبه
معلق في المساجد ورجلان تحابا في الله اجتمعا عليه وتفرقا عليه ورجل طلبته
امرأة ذات منصب وجمال فقال إني أخاف الله ورجل تصدق اخفى حتى لا تعلم شماله
ما تنفق يمينه ورجل ذكر الله خاليا ففاضت عيناه».
“যেদিন (কিয়ামতের দিন) ‘আরশের ছায়া ছাড়া আর অন্য কোনো ছায়া থাকবে না সেদিন
সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দিবেন।
ন্যায়পরায়ণ নেতা,
ঐ যুবক, যে তাঁর যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন,
এমন ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে লটকানো থাকে, একবার মসজিদ থেকে বের হলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ব্যাকুল থাকে,
এমন দু’ব্যক্তি, যারা কেবল আল্লাহর মহব্বতে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথক হয়,
যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর ভয়ে চোখের অশ্রু ফেলে,
যে ব্যক্তিকে কোনো সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী রমণী ব্যভিচারে লিপ্ত
হওয়ার আহবান জানায় আর ঐ ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়েই বিরত থাকে এবং
যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কী দান করল বাম হাতও তা জানল না।”[19]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
«إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ ».
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না; কিন্তু তিনি তোমাদের অন্তর ও কর্মের দিকে তাকান।”[20]
৭. আখিরাতের বিশ্বাস:
পরকালীন দিবসের ওপর বিশ্বাস মানুষকে পাপকর্ম থেকে বিরত রাখে। একজন মুমিন
ব্যক্তি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, এ দুনিয়া অস্থায়ী, পরকালীন জীবন
স্থায়ী। সেখানে দুনিয়ার সকল কর্মের হিসাব নেওয়া হবে। কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড়
দেওয়া হবে না। যিদি উত্তম কর্ম করেছেন, তিনি উত্তম প্রতিদান পাবেন আর যিনি
অন্যায় কর্ম করেছেন তিনি কঠিন শাস্তি ভোগ করবেন। এ বিশ্বাসই তাকে ভালো
কাজে প্রেরণা যোগায় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা
করেছেন,
﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ﴾ [الزلزلة: ٧، ٨]
“অত:পর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে। [সূরা আয-যিলযাল, আয়াত: ৭-৮]
﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَا كُفۡرَانَ لِسَعۡيِهِۦ وَإِنَّا لَهُۥ كَٰتِبُونَ ٩٤﴾ [الانبياء: ٩٤]
“অত:পর যে বিশ্বাসী অবস্থায় সৎকর্ম সম্পাদন করে, তার প্রচেষ্টা অস্বীকৃত
হবে না এবং আমি তা লিপিবদ্ধ করে রাখি।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৯৪]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تِلۡكَ ٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ نَجۡعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ
عُلُوّٗا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فَسَادٗاۚ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلۡمُتَّقِينَ ٨٣
مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ خَيۡرٞ مِّنۡهَاۖ وَمَن جَآءَ
بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَى ٱلَّذِينَ عَمِلُواْ ٱلسَّئَِّاتِ إِلَّا
مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٨٤ ﴾ [القصص: ٨٣، ٨٤]
“ঐ আখিরাতের ঘর তো আমি তাদের জন্য খাস করে দেব, যারা পৃথিবীতে নিজেদের
বড়ত্ব চায় না এবং ফাসাদও সৃষ্টি করতে চায় না। আর ভালো পরিণাম তো
মুত্তাকীদের জন্যই রয়েছে। যে ভালো ‘আমল নিয়ে আসে তার জন্য এর চেয়েও ভালো ফল
রয়েছে। আর যে মন্দ আমল নিয়ে আসে, তার জানা উচিত যে, মন্দ আমলকারীরা যেমন
কাজ করত তেমন ফলই পাবে।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮৩-৮৪]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا هَٰذِهِ ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا لَهۡوٞ وَلَعِبٞۚ وَإِنَّ
ٱلدَّارَ ٱلۡأٓخِرَةَ لَهِيَ ٱلۡحَيَوَانُۚ لَوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ٦٤﴾
[العنكبوت: ٦٤]
“এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া কৌতুক বৈ কিছু নয়। পরকালের গৃহই প্রকৃত জীবন; যদি তারা জানত।” [সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ৬৪]
তিনি আরো বলেন,
﴿وَلَدَارُ ٱلۡأٓخِرَةِ خَيۡرٞۚ وَلَنِعۡمَ دَارُ ٱلۡمُتَّقِينَ ٣٠ ﴾ [النحل: ٣٠]
“এবং পরকালের গৃহ আরও উত্তম। মুত্তাকীদের ঘর কী চমৎকার! [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩০]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ
حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ
شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ
أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ ».
“কিয়ামতের দিন আদম সন্তানের পা (স্বস্থান থেকে) একটুও নড়াতে পারবে না যতক্ষণ না পাঁচটি ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে:
তার জীবনকাল কী কাজে শেষ করেছে?
তার যৌবনকাল কী কাজে নিয়েজিত রেখেছে?
তার ধন-সম্পদ কোন উৎস থেকে উপার্জন করেছে?
কোন কাজে তা ব্যয় করেছে এবং
সে অর্জিত জ্ঞানানুযায়ী কতটা আমল করেছে?”[21]
৮. শালীন পোশাক পরিধান করা
পশুদের লজ্জা নেই, পোশাক নেই। ওরা উলঙ্গ থাকে, যা ইচ্ছা তাই করে। মানুষ পশু
নয়; মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। পোশাক মানুষের জন্য আল্লাহর অনন্য দান।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ قَدۡ أَنزَلۡنَا عَلَيۡكُمۡ لِبَاسٗا يُوَٰرِي
سَوۡءَٰتِكُمۡ وَرِيشٗاۖ وَلِبَاسُ ٱلتَّقۡوَىٰ ذَٰلِكَ خَيۡرٞۚ ذَٰلِكَ
مِنۡ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ لَعَلَّهُمۡ يَذَّكَّرُونَ ٢٦ يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ لَا
يَفۡتِنَنَّكُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ كَمَآ أَخۡرَجَ أَبَوَيۡكُم مِّنَ
ٱلۡجَنَّةِ يَنزِعُ عَنۡهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوۡءَٰتِهِمَآۚ
إِنَّهُۥ يَرَىٰكُمۡ هُوَ وَقَبِيلُهُۥ مِنۡ حَيۡثُ لَا تَرَوۡنَهُمۡۗ
إِنَّا جَعَلۡنَا ٱلشَّيَٰطِينَ أَوۡلِيَآءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ
٢٧ ﴾ [الاعراف: ٢٦، ٢٧]
“হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের প্রতি পোশাক নাযিল করেছি, যাতে তোমাদের শরীরের
লজ্জাস্থান ঢাকা যায় এবং শরীরের হিফাযত ও সাজসজ্জা হয়। আর তাকওয়ার পোশাকই
সবচেয়ে ভালো। এটা আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম নিদর্শন। হয়তো লোকেরা এ
থেকে উপদেশ নেবে। হে আদম সন্তান! শয়তান যেন তোমাদেরকে তেমনিভাবে ফিতনায় না
ফেলে, যেমনিভাবে সে তোমাদের (আদি) পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল
এবং তাদের শরীর থেকে তাদের পোশাক খুলিয়ে ফেলেছিল, যাতে তাদের লজ্জাস্থান
একে অপরের সামনে খুলে যায়। সে এবং তার সাথী তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখতে
পায়, যেখান থেকে তোমরা তাকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না তাদের জন্য
আমি এ শয়তানদেরকে অভিভাবক বানিয়ে দিয়েছি।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২৬]
যিনি শালীন পোশাক পরেন তিনি অশালীন কাজ করতে পারেন না। নারীরা শালীন পোশাক
পরলে শয়তানের কু-দৃষ্টি তাদের দিকে পড়ে না। আল্লাহ নারীদেরকে জাহেলী যুগের
মতো চলাফেরা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
﴿وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ ﴾ [الاحزاب: ٣٣]
“তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান কর এবং জাহেলিয়াত যুগের নারীদের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন করে চলাফেরা করো না।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৩]
৯. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ:
আমাদেরকে সব সময় সৎ কাজের আদেশ দিতে হবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করতে হবে। এ
কাজ থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ
وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ ١١٠ ﴾ [ال عمران:
١١٠]
“তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব
ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং
আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।”[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“তোমাদের মধ্যে কেউ অন্যায় কাজ দেখলে সে যেন তার হাত দিয়ে তা প্রতিহত করে,
যদি তা না করতে পারে, সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করে, যদি তাও না করতে পারে,
সে যেন অন্তত অন্তর দিয়ে হলেও প্রতিবাদ করে। আর সেটি হচ্ছে ঈমানের
দুর্বলতম অবস্থা।”[22]
মুসলিম সমাজের প্রত্যেক সদস্য একে অপরকে সৎ কাজের আদেশ দেবেন এবং খারাপ
কাজে বাঁধা দেবেন। আমরা যদি এ কাজটি করতে পারি তাহলে আমাদের সমাজ থেকে অনেক
অঘটন উঠে যাবে। আমাদেরকে যারা উত্ত্যোক্ততার শিকার হচ্ছেন তাদের পাশে
দাঁড়াতে হবে এবং উত্ত্যেক্তকারীকে প্রতিহত করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى
ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ
ٱلۡعِقَابِ ٢ ﴾ [المائدة: ٢]
“সৎকর্ম ও তাকওয়ার কাজে তোমরা একে অন্যের সাহায্য করো। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের
ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ২]
১০. সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«كلكم راعٍ وكلكم مسؤولٌ عن رعيته».
“তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন রাখাল এবং তোমরা প্রত্যেকেই তোমাদের অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”[23]
আমরা সবাই আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের অধীনদের সম্পর্কে
কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করবেন। একটি সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির অধীনে কেউ না
কেউ পরিচালিত হন। তিনি যদি তার অধীনদের খোঁজ-খবর রাখেন, মন্দ কাজে বাধা
দেন, তাহলে সমাজের কেউ অপরাধমূলক কর্মে জড়াতে পারে না। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
«مثل القائم في حدود الله والواقع فيها كمثل قوم استهموا على سفينة، فصار
بعضهم أعلاها، وبعضهم أسلفها، وكان الذين في أسفلها إذا استقوا من الماء
مروا على من فوقهم فقالوا: لو أنا خرقنا في نصيبنا خرقاً ولم نؤذ من فوقنا،
فإن تركوهم وما أرادوا هلكوا جميعاً، وإن أخذوا على أيديهم نجوا ونجوا
جميعاً».
“যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলেন এবং যারা মেনে চলে না, তাদের উদাহরণ হচ্ছে ঐ
কওমের মতো, যারা একটি নৌকা নিয়ে লটারী ধরেছে। অতঃপর তাদের একাংশ নৌকার
উপরের অংশে ভাগে পেয়েছে এবং অন্য অংশ পেয়েছে নৌকার নিচের অংশ। যারা নৌকার
নিচের তলায় থাকতেন তারা তাদের পানীয় পানির প্রয়োজন মেটাতে নৌকার
উপরতলাবাসীদের কাছে যেতেন। এক পর্যায়ে তারা বলল, আমরা আমাদের অংশে ছিদ্র
করে পানির প্রয়োজন মেটালে আর উপরতলাবাসীকে কষ্ট দিতে হয় না। এখন যদি
উপরতলার বাসিন্দারা নিচতলাবাসীদেরকে নৌকা ছিদ্র করার জন্য সুযোগ দেন, তাহলে
উপরতলা ও নিচতলার সবাই পানিতে ডুবে মারা যাবে। আর যদি তারা নিচতলাবাসীকে
তাদের এ কর্মে বাধা দেয় তাহলে নিচতলার বাসিন্দারাও বেঁচে যাবে এবং উপরতলার
বাসিন্দারাও বেঁচে যাবে।”[24]
আল্লাহর রাসূলের উক্ত হাদীসের আলোকে যদি সমাজের সকল মানুষ দায়িত্ববান হয় তাহলে অনেক অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগই কমে আসবে।
১১. সহশিক্ষা বর্জন করা:
সহশিক্ষা ইসলামী শরী‘আতের সরাসরি লঙ্ঘন। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইসলামে
হারাম। সহশিক্ষার কুফল অনেক। সহশিক্ষা পর্দার লঙ্ঘন হয়, লজ্জা কমে যায়,
পশুবৃত্তি জাগ্রত হয়, কু-চিন্তা, কু-বাসনায় পেয়ে বসে, যার পরিণতি ভালো নয়।
ইভটিজিং, যেনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা সবই সহশিক্ষার কুফল।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটের সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রীদের পর্নো-সিডি বাজারে বিভিন্ন সাংকেতিক নামে পাওয়া যায়। কোনো কোনো
মিনি পতিতালয়ে গড়ে উঠেছে নামী-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে।
সম্প্রতি ইডেন কলেজের কেলেঙ্কারি কারো অজানা নয়। এসবই সহশিক্ষার কুফল।
ইভটিজিংসহ নানারকম ফিতনা-ফাসাদ ও বালা-মুসিবত থেকে আমাদের সন্তাদের রক্ষা
করতে সহশিক্ষা বাদ দিতে হবে। নর ও নারীর জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে
তুলতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি
পরীক্ষার রেজাল্ট গবেষণা করে দেখা গেছে যে, সহশিক্ষাযুক্ত প্রতিষ্ঠানের
চেয়ে সহশিক্ষামুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছে।
১২. লজ্জা:
লজ্জা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূষণ। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ লজ্জাশীল পুরুষ ছিলেন। লজ্জাহীন মানুষ
পশুতুল্য। পশুর লজ্জা নেই। তাই ওরা যেখানে সেখানে যা ইচ্ছা তাই করে। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلَامِ النُّبُوَّةِ : إِذَا لَمْ تَسْتَحِ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ».
“মানুষের কাছে পৌঁছা নবুওয়াতের প্রথম বাণী হচ্ছে, তুমি লজ্জাহীন হলে যা ইচ্ছা তাই করতে পারো।”[25]
তিনি আরো বলেন,
«الْحَيَاءُ لاَ يَأْتِي إِلاَّ بِخَيْرٍ».
“লজ্জা কল্যাণ বৈ কিছুই বয়ে আনে না।”[26]
অতএব, আমাদেরকে লজ্জার গুণ অর্জন করতে হবে। সন্তানদেরকে লজ্জাশীলতা শেখাতে
হবে। যেসব অভিভাবক ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে একত্রে অশালীন সিনেমা, নাটক আর গান
দেখেন তাদেরকে বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।
১৩. ছোটদের স্নেহ ও বড়দের শ্রদ্ধা করা:
আমাদের সন্তানদেরকে বড়দের শ্রদ্ধা আর ছোটদেরকে স্নেহ করার আদর্শ শেখাতে
হবে। যারা এ গুণ অর্জন করবে তারা কখনোই রাস্তায় কোনো খারাপ কাজ করতে পারে
না। কেননা তার তখন স্মরণ হবে সব নারীই কারো না কারোর মা, বোন, স্ত্রী কিংবা
আত্মীয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ليس منا من لم يرحم صغيرنا ويوقر كبيرنا».
“সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে ছোটদের স্নেহ এবং বড়দের শ্রদ্ধা করে না।”[27]
১৪. সচ্চরিত্র:
সুশীলসমাজ গঠন করতে চাইলে সচ্চরিত্রের বিকল্প নেই। আমাদের সন্তানদেরকে সকল
প্রকার উত্তম চরিত্র শিক্ষা দিতে হবে। একজন বিনয়ী, নম্র, ভদ্র এবং
সচ্চরিত্রবান ছেলে কখনোই কোনো নারীকে উত্ত্যক্ত করতে পারে না। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إن من خياركم أحسنكم أخلاقا».
“নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে উত্তম ঐ ব্যক্তি যার চরিত্র উত্তম।”[28]
আমাদের সন্তানদের চরিত্র বদলাতে হবে। রাসূলের চরিত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ
يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١ ﴾
[الاحزاب: ٢١]
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের
জন্যে রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]
১৫. সৎসঙ্গ:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مثل الجليس الصالح والسوء كحامل المسك ونافخ الكير فحامل المسك إما أن
يحذيك وإما أن تبتاع منه وإما أن تجد منه ريحا طيبة ونافخ الكير إما أن
يحرق ثيابك وإما أن تجد ريحا خبيثة».
“সৎবন্ধু এবং অসৎ বন্ধুর তুলনা হচ্ছে, সুগন্ধী বহনকারী ও কামারের সাথে।
সুগন্ধি বহনকারী তোমাকে হয়তো সুগন্ধি উপহার দেবে; না হয় তুমি তার থেকে
সুগন্ধি কিনে নেবে আর না হয় তুমি তার থেকে সুবাস পাবে। আর কামারের কাছে
গেলে আগুনের ফুলকি তোমার বস্ত্রকে ছিদ্র করবে অথবা খারাপ গন্ধ পাবে।”[29]
১৭. মোবাইল, ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের অপব্যবহার রোধ:
মোবাইল, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান
সময়ে চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এগুলো
ব্যবহার হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সাইট আছে লক্ষ লক্ষ।
আমাদের যুবসমাজ ইন্টারনেটকে গবেষণামূলক কাজে ব্যবহার না করে বন্ধুত্ব
স্থাপন, চ্যাটিং, অশ্লীল দৃশ্য ও অপরাধের কাজেই বেশি ব্যবহার করছে। আধুনিক
প্রযুক্তির অবৈধ ব্যবহার বন্ধে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদেরকে তাই আমাদের সন্তানদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। তারা কাদের সাথে
বন্ধুত্ব করছে, খোঁজ রাখা উচিৎ। বাজে বন্ধুর খপ্পরে পড়ে আপনার আমার ছেলেরা
মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে। পরিণত হতে পারে মদখোর, জুয়াখোর, নেশাগ্রস্ত,
ইভটিজার, সন্ত্রাসী কিংবা চোর ডাকাতে।
১৮. পর্দার অনুশীলন:
পর্দার বিধান মেনে চলা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরয। ইসলামী শরী‘আতের এ বিধান
মেনে চলতে পারলেই দুনিয়ার বহু অনিষ্টতা থেকে সহজেই রেহাই পাওয়া সম্ভব।
১৯. নারীর পর্দা:
আল্লাহ তা‘আলা নারীদেরকে উত্ত্যেক্তকারীদের হাত থেকে রেহাই পেতে পর্দার
বিধান মেনে চলতে বলেছেন। পবিত্র কুরআনে নিম্নের এ আয়াতে বখাটেদের
উত্ত্যেক্ততা থেকে রেহাই পেতে নারীদের সরাসরি কৌশল বাতলে দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ
ٱلۡمُؤۡمِنِينَ يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ذَٰلِكَ
أَدۡنَىٰٓ أَن يُعۡرَفۡنَ فَلَا يُؤۡذَيۡنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا
رَّحِيمٗا ٥٩ ﴾ [الاحزاب: ٥٩]
“হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন,
তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে
(সম্ভ্রান্ত বলে) চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্ত্যেক্ত করা হবে না। আল্লাহ
ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৯]
পর্দার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা যদি নর-নারীরা পালন
করেন, তাহলে খারাপ কোনো চিত্র রাস্তা-ঘাটে দৃশ্যমান হবে না। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
﴿قُل لِّلۡمُؤۡمِنِينَ يَغُضُّواْ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِمۡ وَيَحۡفَظُواْ
فُرُوجَهُمۡۚ ذَٰلِكَ أَزۡكَىٰ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا
يَصۡنَعُونَ ٣٠ وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ
وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ
مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ ٣١ ﴾ [النور:
٣٠، ٣١]
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের
হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ
তা অবহিত আছেন। ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে
এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া
তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের ওড়না মাথার বক্ষদেশে
ফেলে রাখে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩০-৩১]
আল্লাহ তা‘আলা নারীদেরকে পর্দাহীন চলাফেরা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
﴿وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ﴾ [الاحزاب: ٣٣]
“তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান কর এবং জাহিলিয়াত যুগের নারীদের মতো সৌন্দর্য
প্রদর্শন করে ঘোরাফেরা করো না।’’ [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৩]
হিজাব নারীকে হেফাযত করে, রক্ষা করে তার ইজ্জত-অবরুকে। বাংলাদেশের যে
নারীরা রাস্তায় হিজাব পরে চলেন, পর্দার ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম মানেন, তারা
ইভটিজিং, এসিড সন্ত্রাস এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এ খবর সাধারণত পাওয়া যায়
না।
কোনো ফলের খোসা ছিড়ে খোলা জায়গায় ঢাকনাবিহীন রেখে দিলে তা মাছি ও জীবানু
থেকে যেমন রক্ষা করা যায় না, তেমনি পর্দাবিহীন কোনো নারী রাস্তায় নিরাপদ
নয়। শয়তান ও দুষ্টলোকের কুদৃষ্টি তার দিকে পড়বেই। তাই নারীকে বাঁচাতে,
ইভটিজিং থেকে রক্ষা করতে নারীকেই আল্লাহর নির্দেশ মেনে পর্দা করে চলতে হবে
-এর কোনো বিকল্প নেই।
নারীর পর্দার কতিপয় দিক
একজন মুসলিম নারী পর্দার বিধান মেনে চলতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে
চলবেন। না হয় তার পর্দার বিধান পুরোপুরি মেনে চলা হবে না। আল্লাহর বিধান
পরিপূর্ণভাবে না মানলে দুনিয়াবী ফিতনা ফাসাদ থেকে মুক্ত থাকাও সম্ভব নয়।
১. সতর ঢাকা:
নারীর দেহ আবৃত করে রাখাই পর্দার উদ্দেশ্য। কোনোভাবেই নারীদেহ প্রদর্শন করা যাবে না।
কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষ প্রয়োজনে তার শরীর থেকে এমন কিছু অংশ সতরের বহির্ভুত
হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা প্রকাশ না করলেই নয়। এ মর্মে কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ ﴾ [النور: ٣١]
“তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে
এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত:
৩১]
এখানে যা সাধারণত প্রকাশমান দ্বারা অধিকাংশ শরী‘আহ বিশেষজ্ঞের মতে, হাতের
তালু এবং বহিরাবরণকে বোঝানো হয়েছে। এগুলো সে আজনবীদের সামনে প্রকাশ করতে
পারবে।
২. পরপুরুষের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ না করা:
পরপুরুষের সামনে কোনো মুসলিম নারী তার সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ ﴾ [النور: ٣١]
“তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে
এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত:
৩১]
শুধু দৈহিক সৌন্দর্য প্রদর্শন থেকে বিরত থাকলেই চলবে না বরং কণ্ঠের সৌন্দর্যকেও পরপুরুষ থেকে দূরে রাখতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِنِ ٱتَّقَيۡتُنَّۚ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِٱلۡقَوۡلِ فَيَطۡمَعَ ٱلَّذِي
فِي قَلۡبِهِۦ مَرَضٞ وَقُلۡنَ قَوۡلٗا مَّعۡرُوفٗا ٣٢ ﴾ [الاحزاب: ٣٢]
“যদি তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয়
ভঙ্গিতে করা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি
রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কর্থাবার্তা বলবে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩২]
নারীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা নীরবে পথ চলতে বলেছেন, যাতে দুষ্ট লোকেরা তাদের পায়ের আওয়াজ শুনে ব্যাকুল হয়ে না ওঠে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلَا يَضۡرِبۡنَ بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّۚ ﴾ [النور: ٣١]
“তারা যেন পদযুগল এমনভাবে স্থাপন করে, যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য টের পাওয়া যায়।” [সূরা আন-নুর, আয়াত: ৩১]
বর্তমানে অধিকাংশ নারীগণ রাস্তায় বের হলে তাদের রূপ-সৌন্দর্যকে মানুষের
সামনে তুলে ধরতে প্রায় মরিয়া। নানা ধরনের পারফিউম, সাজগোজ, পায়ে ঝুমকা,
বাহারি ডিজাইনের পোশাক পরিধান করে তারা একদিকে যেমন আল্লাহর বিধানকে লঙ্ঘন
করছে, পাশাপাশি পুরুষদের যৌন ক্ষুধা বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে
আনছে।
বর্তমানে বোরকাও ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। নানা ডিজাইনের বোরকা আধুনিক নারীদের
সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলছে। বোরকা যদি পর্যার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন না করতে
পারে তাহলে তার পরিধান করা অর্থহীন। আমাদের মা বোনদের বোরকা এমন হওয়া উচিত,
যা তাদের সৌন্দর্যকে আবৃত করবে। বোরকার সৌন্দর্য যেন পুরুষদের আকর্ষণ না
করে।
৩. নর-নারীর নির্জন সাক্ষাৎ বর্জন:
ইসলামে নর-নারীর নির্জন সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ। এটি অত্যন্ত ভয়ানক। নারী-পুরুষের
নির্জনে সাক্ষাৎ কিংবা গোপন সম্পর্ক, যখন উভয়ের মধ্যে কোনো পর্দা বা আড়ালও
থাকে না। এরূপ পরিস্থিতিতে এমন কোনো বাহ্যিক চাপ থাকে না, যা মানুষকে আবেগ
উত্তেজনার কাছে পরাভূত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। নর-নারীর সম্পর্ক
ইসলামের দৃষ্টিতে নিছক দৈহিক লালসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর উপর আবর্তিত হয়
অনেক দায়-দায়িত্ব। তাই এ সম্পর্কের সাথে সামাজিক বন্ধন ও স্বীকৃতি থাকা
অত্যাবশ্যক, যেন এই দায়-দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমাজ ব্যক্তির সাহায্যে
এগিয়ে আসে। আর যদি ব্যক্তি তা পালন করতে অবহেলা করে বা পাশ কাটিয়ে যেতে চায়
তাহলে তাকে জবাবদিহির জন্য পাকড়াও করতে পারে। এই বন্ধন বা বাধ্য-বাধকতাই
তার বিপথগামিতার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে নর-নারী কারো অধিকার
বিনষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। মানুষের এই দুর্বলতার কথা বিবেচনা করে
বেগানা নারী-পুরুষের নির্জন দেখা সাক্ষাৎ ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।[30]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“তোমাদের কেউ যেন কোনো বেগানা নারীর সাথে একান্তে সাক্ষাৎ না করে, তবে তার সাথে তার কোনো মাহরাম পুরুষ আত্মীয় থাকলে ভিন্ন কথা।”[31]
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নর-নারীর নির্জন আড্ডা থেকে সর্তক করে বলেন,
«لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلاَّ كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ».
“একান্ত নির্জনে বেগানা নর-নারী যখন কথাবার্তা বলে, শয়তান তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে যায়।”[32]
আল্লাহ তা‘আলা বরেন,
﴿وَلَا مُتَّخِذَٰتِ أَخۡدَانٖۚ﴾ [النساء: ٢٥]
“মেয়েরা গোপনে বা চুপিসারে বন্ধুত্ব করবে না।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৫]
অনুরূপ ছেলেদেরকে বলা হয়েছে,
﴿وَلَا مُتَّخِذِيٓ أَخۡدَانٖ٥ ﴾ [المائدة: ٥]
“পুরুষেরাও গোপনে বা চুপিসারে বন্ধুত্ব করবে না।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৫]
৪. পুরুষদের মতো পোশাক পরিধান না করা:
নারীদের জন্য পুরুষের পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম সে সকল নারীদের অভিসম্পাত করেছেন, যারা পুরুষের পোশাক পরিধান
করে। হাদীসে এসেছে,
«لعن النبي صلى الله عليه وسلم المتشبهين من الرجال بالنساء والمتشبهات من النساء بالرجال».
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের অনুকরণকারী পুরুষদের এবং পুরুষদের অনুকরণকারী নারীদের অভিসম্পাত করেছেন।”[33]
৫. পাতলা স্কিন টাইট কিংবা পুরো দেহ আবৃত করে না এমন পোশাক পরিধান:
আবু হোরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ
كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ
عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ
الْمَائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ رِيحَهَا وَإِنَّ
رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا ».
“জাহান্নামীদের এমন দুটি দল রয়েছে, যাদের আমি দেখিনি। তাদের এক দলের হাতে
গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, যা দিয়ে তারা লোকদেরকে মারবে। আর একদল
নারীদেরকে। তারা পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা সত্ত্বেও উলঙ্গ, বিচুৎতকারিণী ও
স্বয়ং বিচ্যুত। বুখতী উটের উচু কুঁজের মতো তাদের চুলের খোপা। এসব নারী কখনো
জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ
জান্নাতের সুগন্ধি অনেক অনেক দূর থেকে পাওয়া যাবে।”[34]
ইসলাম নগ্নতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জ চালচলন নিষিদ্ধ করে অবাধ যৌনচর্চার
দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, অবাধ যৌনচর্চা মানবতার মহাসর্বনাশ সাধন করতে
পারে। এর ফলে যুবশক্তির ধ্বংস সাধনসহ মারাত্মক যৌনব্যাধি, শারীরিক শক্তি
নাশ, পারিবারিক শৃঙ্খলার বিলোপ, বেশ্যাবৃত্তির প্রসার, ইভটিজিং ও নানা
প্রকার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আজকের বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা যার বাস্তব
প্রমাণ।[35]
৬. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বর্জন:
মানুষ পাপের আস্তানার পাশ দিয়ে দৃষ্টি অবনত করে অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু
যেখানে গোটা সমাজকে ব্যভিচারের আঁখড়ায় পরিণত করা হয়েছে, সেখানে যে কোথায়
গিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করবে? নিজের নৈতিকতা ও কর্মের পরিমার্জনের জন্য কী
ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? বর্তমানে অবস্থা এই যে, কোনো ব্যক্তি সে বাজারের
দোকানদার হোক কিংবা কারখানার শ্রমিক, কলেজের ছাত্র হোক কিংবা অফিসের
কেরানি, সে কোনো হোটেলে বসে থাকুক বা পার্কে ভ্রমণরত হোক-প্রতিটি স্থানেই
বিপরীত লিঙ্গ তার সামনে পাপের পয়গাম নিয়ে হাজির আছে। জীবনের এমন কোনো অঙ্গন
নেই, বর্তমান সভ্যতা যেখানে নারী ও পুরুষের একসাথে কাজ-কর্ম অনিবার্য করে
দেয় নি। শুধু তাই নয়; বরং এই একত্রে মেলামেশাকে এতটা বৈচিত্র্যময় ও
আকর্ষণীয় করে দিয়েছে যে, সমাজের ওপরে যৌন ক্ষুধা ও যৌন উপবাসের মতো
পরিস্থিতি ছেয়ে আছে। মনে হয়, যেন যৌনতা সর্বত্র ভিক্ষাপাত্র হাতে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। নারী ও পুরুষের অভাদ মেলামেশা যতদিন উচ্ছেদ না করা যাবে, ততদিন এ
পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভ করা যাবে না।
ইসলাম সব সময় নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্র পুরোপুরি আলাদা করে রাখে। তাই
ইসলামের নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেলার সুযোগ
নিতান্ত কম। কোনো সময় নারী ও পুরুষের একই গন্ডির মধ্যে কাজ করার প্রয়োজন
হলেও ইসলাম তাদের পরস্পর মেলামেশা থেকে দূরে থাকতে কঠোরভাবে নির্দেশ
দেয়।[36]
একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী ও পুরুষদের পারস্পরিক মিশে যেতে দেখে নারীদের বললেন,
«اسْتَأْخِرْنَ فَإِنَّهُ لَيْسَ لَكُنَّ أَنْ تَحْقُقْنَ الطَّرِيقَ عَلَيْكُنَّ بِحَافَاتِ الطَّرِيقِ ».
“পেছনে চলে যাও। রাস্তার মাঝখান দিয়ে তোমাদের চলা উচিত নয়। তোমাদের রাস্তার একপাশ দিয়ে চলা উচিত।”[37]
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো পুরুষকে দুইজন স্ত্রীলোকের মাঝ দিয়ে
চলতে নিষেধ করেছেন।[38]
উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ ». فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ
الأَنْصَارِ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ « الْحَمْوُ
الْمَوْتُ »
“নারীদের সাথে অবাধে মেলামেশা থেকে সাবধান হও। একজন আনসারী বললেন, দেবরের
সাথে মেলামেশার ব্যাপারে আপনার মতামত কী? তিনি বললেন, দেবর তো সাক্ষাৎ
মৃত্যু”[39] (অর্থাৎ মৃত্যু যেমন দেহে পচন ধরায়, দেবরের কারণে
দাম্পত্যজীবনে তেমিন পচন ধরতে পারে)।
পুরুষের পর্দা:
নারীর পর্দার পাশাপাশি পুরুষের পর্দা করাও ফরয। পবিত্র কুরআনের পর্দার
বিধান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সূরা আন-নূরের আয়াত দুটিতে প্রথমেই পুরুষদের
পর্দার বিষয়ে নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿قُل لِّلۡمُؤۡمِنِينَ يَغُضُّواْ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِمۡ وَيَحۡفَظُواْ
فُرُوجَهُمۡۚ ذَٰلِكَ أَزۡكَىٰ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا
يَصۡنَعُونَ ٣٠ ﴾ [النور: ٣٠]
“মুমিনদেরকে বলনু, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের
হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ
তা অবহিত আছেন।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩০]
সুতরাং যেসব বস্তু মানবহৃদয়কে আল্লাহর স্মরণবিমুখ করে দেয় কিংবা যে দিকে
তাকাতে শরী‘আতে নিষেধাজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছে, সে দিক থেকে দৃষ্টিকে বিরত
রাখতে হবে। যেমন ঘরে বইরে, রাস্তা ঘাটে পরনারী ও আজনবী মহিলা, টেলিভিশন
কিংবা সিডি ভিডিও-র নাটক, ছায়াছবির অশ্লীল দৃশ্যাবলী কিংবা দেয়াল পোস্টারের
অশালীন ছবি ইত্যাদি। মূলতঃ অসংঘত দৃষ্টির কুপ্রভাব শুধু সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তির মন-মানসকেই কলুষিত করে না; বরং তা তার গোটা দেহের সমস্ত
কর্মকান্ডে সংক্রমিত হয়ে ক্রামন্বয়ে ব্যক্তি পর্যায় অতিক্রম করে এক সময় তা
সমূহবিপদ নিয়ে জাতীয় অস্তিত্ববিনাশী অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়ায়। আকাশ সংস্কৃতি,
পাশ্চাত্য থেকে আসা অশ্লীল ছবির কুপ্রভাবে আমাদের যুব সমাজের মধ্যে
বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয়ের যে ধস নেমেছে, তা এই নির্মম সত্যেরই কিছু
বাস্তবতা। এই অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস রোধ করতে যদি আমরা অক্ষমতার পরিচয় দেই
তাহলে আগামী দিনে ইসলামী আদর্শ-ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের জাতীয় স্বকীয়তা সংরক্ষণ
করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, আনতনয়ন বিশিষ্ট হওয়াই
নিষিদ্ধ দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার ও দৃষ্টির পবিত্রতা বিধানের প্রকৃষ্ট
পদ্ধতি-কৌশল। স্বয়ং চক্ষুদাতা মহান আল্লাহ তা‘আলাই আমাদের এ শিক্ষা
দিয়েছেন।
দৃষ্টির অবাধ বিচরণের নাম স্বাধীনতা নয়। যেমন অনেক নির্বোধ মুর্খ ধারণা করে
থাকে; বরং তা হচ্ছে কুপ্রবৃত্তির কাছে নিজের পরাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। একটি
ক্ষুধার্ত সিংহকে লোকালয়ে ছেড়ে দিলে সে যতটা হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে,
অনিয়ন্ত্রিত কুপ্রবৃত্তির ধ্বংসযজ্ঞ তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। কু-রিপুর
পূজারীরা মূলত যালিম ও সীমালঙ্ঘণকারী। ইসলামের দৃষ্টিতে, মানুষ তো তখনই
স্বাধীন হতে পারে, যখন সে কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে।[40]
এজন্যই কুরআনুল কারীমে কুপ্রবৃত্তি পূজাকারীদেরকে চরম ধিক্কার দেওয়া হয়েছে,
﴿ وَلَوۡ شِئۡنَالَرَفَعۡنَٰهُ بِهَا وَلَٰكِنَّهُۥٓ أَخۡلَدَ إِلَى
ٱلۡأَرۡضِ وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُۚ فَمَثَلُهُۥ كَمَثَلِ ٱلۡكَلۡبِ إِن
تَحۡمِلۡ عَلَيۡهِ يَلۡهَثۡ أَوۡ تَتۡرُكۡهُ يَلۡهَثۚ ﴾ [الاعراف: ١٧٦]
“অবশ্য আমরা ইচ্ছা করলে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিতাম সে সকল নিদর্শনসমূহের
বদৌলতে; কিন্তু সে যে অধ:পতিত এবং নিজের রিপুর অনুগামী হয়ে রইল। সুতরাং আর
অবস্থা হলো কুকুরের মতো; যদি তাকে তাড়া কর তবুও হাঁপাবে আর যদি ছেড়ে দাও
তবুও হাঁপাবে। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭৬]
অতএব, সুস্থ সমাজ গঠন করতে নর-নারীর চোখের পর্দার কোনো বিকল্প নেই। চোখের পর্দাই পারে ইভটিজিং থেকে আমাদের মা-বোনদের রক্ষা করতে।
উপসংহার
ইসলাম যে সকল অশান্তি, অন্যায়-অনাচার ও অপরাধকে দুর করে শাস্তি ও সুখী সমাজ
গঠন করতে পারে তা প্রমাণিত। চৌদ্দ শত বছর পূর্বে হযরত মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের জাহেলী সমাজকে পরিণত করেছিলেন সোনার
সমাজে। সমাজ থেকে সকল অপরাধ বিতাড়িত করতে হলে পারিবারিক শিক্ষা ও পর্দা
অনুশীলনের বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে ইসলামের দিক নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামের নির্দেশিত পথে চলার তাওফীক দিন। আমীন।
সমাপ্ত
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৩১৯, খন্ড ১, পৃ. ৪৬৫।
[2] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২০৭৯।
[3] মাজ্জাল্লাতুল বুহুস আল ইসলামিয়্যাহ, খন্ড, ২১, পৃ. ৪৫২।
[4] বুখারী, কিতাবুল আদব, বাবু রাহমাতিন ওয়ালাদ, হাদীস নং-৫৯৯৭।
[5] বুখারী, কিতাবুল জানায়েয, হাদীস নং-১৩০৩।
[6] বায়হাকী, ওয়াবুল ঈমান ৮৬৪৯।
[7] . সুনানু আবিদ দাউদ, কিতাবুল সালাত, হাদীস নং-৪৯৫।
[8] জালালুদ্দীন সুয়ুতী, জামেউল আহাদীস, হাদীস নং-৯৬১।
[9] আব্দুল্লাহ নাসির ওলওয়ান, তারবিয়াতুল আওলাদ ফিল ইসলাম, প্রথম খন্ড, পৃ. ৩১৮।
[10] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫০।
[11] ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তাস কারণ ও প্রতিকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৯।
[12] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২০৭৯।
[13]সুনানু ইবনি মাজাহ, হাদীস নং-৩৮০২।
[14] মাজমাউয যাওযায়েদ, হাদীস নং-১২৮২৯।
[15] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২০৭৮।
[16] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২০৭৬।
[17] সহীহ আল-বুখারী, হাদীস নং-২৪৬৫, খণ্ড, ৯, পৃ. ১৩৯।
[18] . মসনদে আহমদ, হাদীস নং-২২১০৪।
[19] সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬৬০।
[20] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬৭০৮।
[21] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২৬০১।
[22]সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩৮৬।
[23] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৭৫১।
[24] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪৯৩।
[25]সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৪৮৩।
[26] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬১১৭।
[27]সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং ২০৪৩।
[28] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০৩৫।
[29] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৫৩৪।
[30] ড. বি.এম. মফিজুর রহমান আল আযহারী, ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ককারণ ও
প্রতিকার (চট্টগ্রাম-ইউনিক লাইব্রেরী, প্রথম প্রকাশ, ২০০৬ ইং), পৃ. ২২৯।
[31] সহীহ বুখারী, কিতাবুন নিকাহ, হাদীস নং-৫২৩৩।
[32] সূনানুত তিরমিযী, কিতাবুর রিদা‘, হাদীস নং-১২০৪।
[33] সহীহ বুখারী, কিতাবুল লিবাস, হাদীস নং ৫৮৮৫।
[34] সহীহ মুসলিম, কিতাবুল লিবাস, হাদীস নং ৫৭০৪।
[35] ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস কারণ ও প্রতিকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৭।
[36] প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩০।
[37] সুনানু আবি দাউদ, আবওয়াবুস সালাম, হাদীস নং-৫৩৭৪।
[38] প্রাগুক্ত, হাদীস নং ৫২৭৫।
[39] সুনানুত তিরমিযী, কিতাবুর রিদা‘, হাদীস নং-১২০৪।
[40] ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস কারণ ও প্রতিকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২২।
______________________________________________________________________________________________
জন্মের পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পূর্বে ৪-৫ বছর পরিবারে বেড়ে ওঠে। এ
সময়টিতে তার মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠন হয়ে থাকে। শিশুর মায়ের কোল
তার শিক্ষার হাতে খড়ি। ফলে পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে।
পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। ছেলে-মেয়েদের জীবনে পারিবারিক
শিক্ষার মূল্য অনেক। সন্তানের মূল্যবোধ, আখলাক, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয়
পরিবার থেকেই। পিতা-মাতার সঠিক লালন-পালনে সন্তানরা সফল হতে পারে।
পিতা-মাতা যে আদর্শ লালন করেন তাদের সন্তানরাও তাই ধারণ করার চেষ্টা করে।
হাদীস শরীফে এসেছে,
«كل مولود يولد على الفطرة فأبواه يهودانه أو ينصراه أو يمجسانه».
“প্রত্যেক নবজাতক স্বভাবধর্মের (ইসলাম) ওপর জন্মগ্রহণ করে। অত:পর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজক বানান।”[1]
অন্য হাদীসে এসেছে,
«ما نحل والد ولدا من نحل أفضل من أدب حسن».
“উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষাদানের চেয়ে বড় দান কোনো পিতা তার সন্তানের জন্য করতে পারেনি।”[2]
আরবী কবি হাফেজ ইবরাহীম উত্তম জাতি গঠনে মায়ের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, মাতা
হলেন জ্ঞানালোকের প্রথম বাতি। তাকে যদি পড়তে পার, জন্ম নেবে সত্য জাতি।[3]
অতএব, অভিভাবকদের কর্তব্য হলো শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশ সাধনে ও নৈতিক চরিত্র গঠনে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পালন করা।
১. যত্নশীলতা, স্নেহ-মমতা, আদর-ভালোবাসা দেওয়া:
শিশুরা স্রষ্টার মহান আমানত। তারা নিষ্পাপ, অপ্রষ্ফুটিত পুষ্পকলির মতো
পবিত্র। পিতা-মাতা, অভিভাবকদের কাছে কোমলতা, মমতা, আদর সোহাগ পেলে তাদের
হৃদয় আনন্দে উচ্ছাসে ভরে ওঠে, যা শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য একটি অপরিহার্য
উপাদান। পক্ষান্তরে নিষ্ঠুরতা, অবহেলা ও সহিংসতাপূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশ ও
পারিপার্শ্বিকতা তাদের মধ্যে মানসিক জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
ক্রমান্বয়ে তাদের মানবিক গুণাবলী আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং পাশবিক চিন্তাধারা
সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরাই একদিন বড় হয়ে মানব সমাজের জন্য বিপজ্জনক ও ধ্বংসাত্মক
উপাদানে পরিণত হয়।
সন্তানের প্রতি মাতাপিতার হৃদয়জুড়ে অফুরন্ত ভালোবাসার যে ফাল্গুধারা আছে তা
একটি স্বতঃসিদ্ধ সহজাত সত্য হলেও আজকাল যান্ত্রিক সভ্যতা ও ভোগবাদী
বস্তুতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা মানুষকে হৃদয় মনহীন এমন এক যন্ত্রে রূপান্তরিত
করেছ যে, এক শ্রেণীর পিতা-মাতা অর্থ ও প্রাচুর্যের পাহাড় গড়তে গিয়ে
সন্তানের মানসিক ভবিষ্যৎ গড়ার কথা বে-মা‘লুম ভুলে যান। যে সময় সন্তানের
হৃদয় থাকে পিতা-মাতার স্নেহ মমতা ও আদর-সোহাগের প্রবল পিপাসা, তখন তারা
তাকে তুলে দেন কাজের মেয়ে কিংবা বেতনভোগী কর্মচারীদের হাতে।
ফলে পিতা-মাতার সান্নিধ্য সংস্পর্শ বঞ্চিত এসব শিশু মানসিক শূন্যতায়
ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এই শূন্যতা ঘোচানোর জন্য সে একসময় অসৎ, ভবঘুরে
বন্ধুদের সাহচর্য খুঁজে নেয়। সে জানে না যে, এরাই একদিন তাকে ধ্বংসের
দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে। এ জন্য আমরা দেখি যে, বখাটেদের মধ্যে এমন অনেকেই
রয়েছে, যারা মূলত ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। অর্থাভাব বা অন্য কিছু নয়,
শুধুমাত্র পিতা-মাতার উদাসীনতাই তাদের এই অধঃপতনের কারণ।
আসলে পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা একত্রিত করলেও পিতা-মাতার ভালোবাসা আত্মত্যাগ ও
উৎসর্গের কোনো বিকল্প খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্যই তো ইসলাম পারিবারিক
ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করেছে। যেন ভূমিষ্ঠ হওয়ার অব্যবহিত পরেই শিশু এমন
একটি জান্নাতী পরিমণ্ডলের আশ্রয় পায়, সেখানে সবাই তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
দিয়ে বরণ করে নেয়।
শিশু ও সন্তান-সন্ততির প্রতি দয়া-ভালোবাসা প্রদর্শনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে কত যত্নশীল ছিলেন, তা নিম্নোক্ত হাদীসগুলো থেকে
প্রমাণিত হয়। হাদীসে এসেছে,
«قبل رسول الله الحسن بن علي وعنده الأقرع بن حابس التميمي جالسا فقال
الأقرع إن لي عشرة من الولد ما قبلت منهم أحدا فنظر إليه رسول الله ثم قال
من لا يرحم لا يرحم».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাতি হাসান ইবন ‘আলীকে
চুমু দিচ্ছিলেন। তখন তাঁর কাছে আকরা ইবন হাবিছ আত-তাইমী নামে একজন সাহাবী
উপস্থিত ছিলেন। আকরা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম আমার দশটি সন্তান। আমি কোনো দিন তাদের কাউকে চুমু দেই নি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে (বিস্ময়ভরে) তাকালেন।
তারপর বললেন, যে ব্যক্তি দয়া প্রদর্শন করে না, সে দয়ার পাত্রও হতে পারে
না।”[4]
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের কান্না সহ্য করতে পারতেন
না। প্রয়োজনে সে কারণে সালাতকেও সংক্ষিপ্ত করতেন। হাদীসে এসেছে,
«إني لأقومُ في الصلاة أريدُ أن أطوِّل فيها ، فأسمعُ بكاءَ الصَّبيِّ فأتجوَّزُ في صلاتي ، كراهية أن أشقَّ على أُمِّه».
“আমি সালাতকে দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছা নিয়ে সালাত পড়তে দাঁড়াই। তারপর শিশুর
কান্নার শব্দ শুনতে পাই এবং তা তার মাকে বিচলিত করতে পারে এ আশংকায় আমি
সালাত সংক্ষিপ্ত করি।”
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
«دَخَلْ وَإِبْرَاهِيمُ يَجُودُ بِنَفْسِهِ ، فَجَعَلَتْ عَيْنَا رَسُولِ
اللَّهِ صلى الله عليه وسلم تَذْرِفَانِ . فَقَالَ لَهُ عَبْدُ الرَّحْمَنِ
بْنُ عَوْفٍ رضى الله عنه وَأَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَقَالَ « يَا
ابْنَ عَوْفٍ إِنَّهَا رَحْمَةٌ . ثُمَّ أَتْبَعَهَا بِأُخْرَى فَقَالَ صلى
الله عليه وسلم إِنَّ الْعَيْنَ تَدْمَعُ ، وَالْقَلْبَ يَحْزَنُ ، وَلاَ
نَقُولُ إِلاَّ مَا يَرْضَى رَبُّنَا ، وَإِنَّا بِفِرَاقِكَ يَا
إِبْرَاهِيمُ لَمَحْزُونُونَ ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পুত্র ইবরাহীম-এর কাছে
গেলেন। তিনি তখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু’চোখে অশ্রু ঝরতে থাকে। আব্দুর রহমান
ইবন আওফ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম)! আপনিও (কাঁদছেন)! তিনি বললেন, হে আওফের পুত্র! এটা হচ্ছে
মায়া-মমতা। এরপর তাঁর চোখ থেকে আবারও অশ্রু ঝরতে লাগল। তারপর তিনি বললেন,
হে চোখ অশ্রু ঝরাও, হৃদয় শোকার্ত হও, তবে আমরা আমাদের মুখে এমন কথাই বলব,
যাতে আমাদের রব সন্তুষ্ট হন। হে ইবরাহীম তোমার বিচ্ছেদে আমরা শোকাহত।”[5]
২. শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ:
বয়োঃপ্রাপ্ত হওয়ার পরে ইসলামের দৃষ্টিতে মানবসন্তানের ওপর বহুমুখী দায়িত্ব
অর্পিত হয়, যাকে শরী‘আতের পরিভাষায় বলা হয় তাকলীফ। তাকলীফ পর্যায়ে উপনীত
হয়ে যেন সে যথাযথ আপন কর্তব্য পালন করতে পারে, এজন্য শিশুর মধ্যে যখন থেকেই
ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বোধোদয় সূচিত হবে, জ্ঞান প্রথম আলোর উন্মেষ
ঘটতে শুরু করবে, তখন থেকেই শুরু হবে তার শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ।
ক. ঈমানের বিষয়সমূহ শিক্ষা:
আল্লাহ তা‘আলা, ফিরিশতা, নবী-রাসূল, তাকদীর, পরকাল, জান্নাত-জাহান্নাম,
হিসাব-নিকাশ ও অন্যান্য অপরিহার্য অদৃশ্য বিষয়সংক্রান্ত বিশ্বাস। হাদীসে
রয়েছে,
«افتحوا على صبيانكم أول كلمة بلا إله إلا الله ».
“তোমাদের সন্তানদের প্রথম কথা শিক্ষা দাও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”[6]
খ. আরকানুল ইসলাম:
তথা সালাত, সাওম ইত্যাদির প্রশিক্ষণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مُرُوا أَوْلاَدَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ
وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرِ سِنِينَ وَفَرِّقُوا
بَيْنَهُمْ فِى الْمَضَاجِعِ ».
“সাত বছরে পর্দাপণ করলেই তোমরা তোমাদের সন্তানদের সালাত পড়ার নির্দেশ দাও,
দশ বছরে পর্দাপণ করলে (তখনও যদি সালাত পড়ার অভ্যাস না হয়ে থাকে তবে)
তাদেরকে সালাত করার জন্য দৈহিক শাস্তি দাও এবং তাদের বিছানা পৃথক করে
দাও।”[7]
সালাত সম্পর্কিত নির্দেশ অন্যান্য আরকানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
গ. শরী‘আতের বিধি-বিধান:
তথা আক্বীদাহ, ইবাদাত, আখলাক, সর্বাত্মক ব্যবস্থাপনা ও বিধি-বিধান। এক কথায়
ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন সম্পর্কে তাদের মধ্যে মৌলিক ধারণা রোপন করা।
ঘ. কুরআন, সুন্নাহ, সীরাত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দান:
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَدِّبُوا أَوْلاَدَكُمْ عَلَى خِصَالٍ ثَلاَثٍ : عَلَى حُبِّ نَبِيِّكُمْ
، وَحُبِّ أَهْلِ بَيْتِهِ ، وَعَلَى قِرَاءَةِ الْقُرْآنِ ، فَإِنَّ
حَمَلَةَ الْقُرْآنِ فِي ظِلِّ اللهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ مَعَ
أَنْبِيَائِهِ وَأَصْفِيَائِهِ».
“তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে তিনটি বিষয়ে শিক্ষা দাও। (ক) তোমাদের নবীর
প্রতি ভালোবাসা (খ) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা এবং (গ) কুরআন
তিলাওয়াত। কুরআনের ধারকরা নবী-রাসুল ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সাথে
আল্লাহর ‘আরশের ছায়াতলে থাকবে, যখন তাঁর ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া থাকবে
না।”[8]
একদা উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর কাছে এসে জনৈক ব্যক্তি নিজের সন্তানের
অবাধ্যাচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। ওমর অভিযুক্ত সন্তানকে পিতার সাথে
অসদাচরণের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। সন্তান তখন বলল, হে আমীরুল মু’মিনীন,
সন্তানের কি পিতার উপর কোনো হক আছে? উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন,
হ্যাঁ, অবশ্যই। সে বলল, তাহলে তা কী? উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, পিতা
তার জন্য সৎ আদর্শ নারীকে মাতা হিসেবে গ্রহণ করবে, তার জন্য একটা সুন্দর
নাম রাখবে এবং তাকে কুরআন শিক্ষা দেবে। তখন সন্তান বলল, হে আমীরুল
মু’মিনীন, আমার পিতা ওগুলোতে একটিও করে নি। আমার মা হচ্ছেন ক্রীতদাসী। এক
সময় মূর্তিপূজারী ছিলেন, আমার নাম রেখেছে জু‘লান (অর্থাৎ গোবরে পোকা) আর
আমার বাবা আমাকে কুরআনের একটি বর্ণও শিক্ষা দেন নি। উমার তখন পিতার দিকে
তাকিয়ে বললেন, তুমি এসেছ সন্তানের অসদাচরণের বিরুদ্ধে নালিশ করতে। আরে তুমি
তো তার প্রতি আগেই অবিচার ও অসদাচরণ করেছ।[9]
সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদের
রাসূলের যুদ্ধের ইতিহাস শিক্ষা দিতাম, যেমনিভাবে তাদেরকে আমরা কুরআনের সূরা
শিক্ষা দিতাম।[10]
ইমাম গাযালী রহ. তাঁর ইহইয়াউ উলুমিদ্দীনের মধ্যে শিশুকে কুরআনুল কারীম,
হাদীস শরীফ, পূণ্যবানদের জীবনকথা ও তারপর দীনের বিধি-বিধান শিক্ষা দেওয়ার
ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন।[11]
ঙ. তাকওয়া ও আল্লাহভীতির চেতনা সঞ্চার করা:
সন্তানের মধ্যে আল্লাহর ভয় প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই
বলতে হবে তুমি যা কর এবং বল প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে, দিনের আলোতে কিংবা
রাতের অন্ধকারে, জলে কিংবা স্থলে সকল জায়গায়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে
পর্যবেক্ষণ করেন। অতএব, আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো অপরাধ করলেও আল্লাহ
তোমার কৃতকর্মের হিসাব অবশ্যই নেবেন। তোমাকে তাই সব সময় আল্লাহকে ভয় করে
আল্লাহর পথে চলতে হবে। সন্তানের মধ্যে খোদাভীতির এই চেতনা সঞ্চারিত করতে
পারলে সে আর কুপথে পা বাড়াবে না।
চ. চারিত্রিক প্রশিক্ষণ:
চারিত্রিক প্রশিক্ষণের গুরুত্ব প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ما نحل والد ولدا أفضل من أدب حسن».
“উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষাদানের চেয়ে বড় দান কোনো পিতা তার সন্তানের জন্য করতে পারে নি।”[12]
«أكرموا أولادكم وأحسنوا آدابهم» .
“তোমরা তোমাদের সন্তানদের ভালোবাসা দাও এবং তাদেরকে সর্বোত্তম শিষ্টাচারিতা ও নৈতিকতা শিক্ষা দাও।”[13]
«أن يحسن اسمه ويحسن أدبه».
“পিতার ওপর সন্তানের হক হলো, তার জন্য সুন্দর একটা নাম রাখবে এবং তাকে সর্বোত্তম শিক্ষা ও চরিত্রগুণে গড়ে তুলবে।”[14]
«لأن يؤدب الرجل ولده خير له من أن يتصدق بصاع» .
“সন্তানকে একটা উত্তম শিষ্টাচারিতা শিক্ষা দেওয়া আল্লাহর পথে এক সা‘ পরিমাণ বস্তু সদকা করার চেয়েও উত্তম।”[15]
৩. সদুপদেশ প্রদান:
মাতাপিতার সদুপদেশ সন্তানের জীবনপথের পাথেয় ও অন্ধকারে আলোকরশ্মি। তা
নিষ্পাপ শিশুর উর্বর হৃদয়ে তা অঙ্কিত হয়ে থাকে সারাজীবন। জীবনের গতিপথ
নির্ধারণের ক্ষেত্রে এগুলোই তাকে দেয় সঠিক নির্দেশনা।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
«كنت خلفت رسول الله صلى الله عليه و سلم يوما فقال يا غلام إني أعلمك
كلمات احفظ الله يحفظك احفظ الله تجده تجاهك إذا سألت فاسأل الله وإذا
استعنت فاستعن بالله واعلم أن الأمة لو اجتمعت على أن ينفعوك بشيء لم
ينفعوك إلا بشيء قد كتبه الله لك ولو اجتمعواعلى أن يضروك بشيء لم يضروك
إلا بشيء قد كتبه الله عليك رفعت الأقلام وجفت الصحف».
“আমি একদা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পেছনে আরোহণ
করেছিলাম। তিনি বললেন, হে বালক, আমি তোমাকে কিছু (মুল্যবান) কথা শিক্ষা
দেব:
* তুমি আল্লাহ তা‘আলার হক আদায়ের ব্যাপারে যত্নশীল হও, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের অনিষ্ট থেকে হিফাযত করবেন।
* যখন কিছু প্রার্থনা করবে, আল্লাহর কাছেই করবে।
* যখন সাহায্যের আবেদন করবে, তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই করবে।
* জেনে রাখ, যদি গোটা জাতি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তাহলে তারা ততটুকুই
করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য বরাদ্দ করেছেন। আর তারা যদি
তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তাহলে ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার
নামে বরাদ্দ করেছেন। কলম তুলে নেওয়া হয়েছে আর নিবন্ধন বই শুকিয়ে গেছে
অর্থাৎ তাকদীরে যা বরাদ্দ হবার তা হয়ে গেছে।[16]
ইবরাহীম ও ইয়াকুব আলাইহিমাস সালাম নিজ সন্তানদের উপদেশ সম্পর্কে কুরআনে এসেছে,
﴿وَوَصَّىٰ بِهَآ إِبۡرَٰهِۧمُ بَنِيهِ وَيَعۡقُوبُ يَٰبَنِيَّ إِنَّ
ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰ لَكُمُ ٱلدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم
مُّسۡلِمُونَ ١٣٢ ﴾ [البقرة: ١٣٢]
“এরই অসিয়ত করেছে ইবরাহীম তাঁর সন্তানদের এবং ইয়াকুবও যে, হে আমার
সন্তানগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্যে এ দীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই
তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনও মারা যেও না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৩২]
লোকমান হাকীম প্রদত্ত উপদেশ:
﴿وَإِذۡ قَالَ لُقۡمَٰنُ لِٱبۡنِهِۦ وَهُوَ يَعِظُهُۥ يَٰبُنَيَّ لَا
تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣ وَوَصَّيۡنَا
ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ وَهۡنًا عَلَىٰ وَهۡنٖ
وَفِصَٰلُهُۥ فِي عَامَيۡنِ أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ
ٱلۡمَصِيرُ١٤ وَإِن جَٰهَدَاكَ عَلَىٰٓ أَن تُشۡرِكَ بِي مَا لَيۡسَ لَكَ
بِهِۦ عِلۡمٞ فَلَا تُطِعۡهُمَاۖ وَصَاحِبۡهُمَا فِي ٱلدُّنۡيَا
مَعۡرُوفٗاۖ وَٱتَّبِعۡ سَبِيلَ مَنۡ أَنَابَ إِلَيَّۚ ثُمَّ إِلَيَّ
مَرۡجِعُكُمۡ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ١٥ يَٰبُنَيَّ
إِنَّهَآ إِن تَكُ مِثۡقَالَ حَبَّةٖ مِّنۡ خَرۡدَلٖ فَتَكُن فِي صَخۡرَةٍ
أَوۡ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ أَوۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ يَأۡتِ بِهَا ٱللَّهُۚ إِنَّ
ٱللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٞ١٦ يَٰبُنَيَّ أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ وَأۡمُرۡ
بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَٱنۡهَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَٱصۡبِرۡ عَلَىٰ مَآ أَصَابَكَۖ
إِنَّ ذَٰلِكَ مِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ ١٧ وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ
لِلنَّاسِ وَلَا تَمۡشِ فِي ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ
كُلَّ مُخۡتَالٖ فَخُورٖ ١٨ وَٱقۡصِدۡ فِي مَشۡيِكَ وَٱغۡضُضۡ مِن
صَوۡتِكَۚ إِنَّ أَنكَرَ ٱلۡأَصۡوَٰتِ لَصَوۡتُ ٱلۡحَمِيرِ١٩﴾ [لقمان: ١٣،
١٩]
“যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল, হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরীক করো
না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়। আর আমি মানুষকে তার
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর
কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধছাড়ানো দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে,
আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে
আসতে হবে। পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে
পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং
দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ
অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি
সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করব। হে বৎস, কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা
পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তত গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে
আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপনভেদ জানেন, সবকিছুর খবর
রাখেন। হে বৎস, সালাত কায়েম করো, সৎকাজের আদেশ দাও, মন্দকাজে থেকে নিষেধ
করো এবং বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ। অহংকারবশে
তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয়ই
আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করে না। পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন
করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা
অপ্রীতিকর।” [সূরা লোকমান, আয়াত: ১৩-১৯]
৪. সন্তানের কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করা:
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দো‘আ করেছিলেন,
﴿رَبِّ ٱجۡعَلۡنِي مُقِيمَ ٱلصَّلَوٰةِ وَمِن ذُرِّيَّتِيۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلۡ دُعَآءِ ٤٠﴾ [ابراهيم: ٤٠]
“হে আমার পালনকর্তা, আমাকে সালাত কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে
থেকেও। হে আমার পালনকর্তা, এবং কবুল করুন আমাদের দো‘আ।” [সূরা ইবরাহীম,
আয়াত: ৪০]
ইসলামের এ সুমহান নির্দেশনাবলীর আলোকে যারা প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
হবে, তারাই হবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
তারা কখনোই কাউকে উত্ত্যক্ত করতে পারে না। পিতা-মাতাগণ যদি তাঁদের
সন্তানদেরকে নৈতিকতার অনুশীলন বাড়িতেই নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে
অনাচারমুক্ত সভ্য সমাজ গঠন অসম্ভব হবে না।
৫. রাস্তার হক আদায় করা:
ইসলাম মানুষকে সার্বক্ষণিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে রাস্তাঘাটে বসতে নিষেধ করেছেন। একান্ত বসতে হলে
রাস্তার হক আদায় করতে হবে। আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
«إياكم والجلوس في الطرقات فقالوا يا رسول الله ما لنا من مجالسنا بدٌّ
نتحدث فيها فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فإذا أبيتم إلا المجلس
فأعطوا الطريق حقه قالوا وما حق الطريق يا رسول الله قال غض البصر وكف
الأذى ورد السلام والأمر بالمعروف والنهي عن المنكر»
“সাবধান, তোমরা রাস্তায় বসবে না। তখন সাহাবীগণ বললেন, আমাদের এ ছাড়া কোনো
উপায় নেই। আমরা রাস্তায় বসে পরস্পর দীনী আলোচনা করি। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তোমরা একান্তই রাস্তায় বসতে চাও তাহলে
রাস্তার হক আদায় করবে। সাহাবীগণ বললেন, রাস্তার হকসমূহ কী? আল্লাহর রাসূল
বললেন, ১. চক্ষু অবনমিত করে রাখা ২. কাউকে কষ্ট না দেওয়া ৩. সালামের উত্তর
দেওয়া ৪. সৎ কাজের আদেশ করা এবং ৫. মন্দ কাজে নিষেধ করা।”[17]
আমরা যদি আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে রাস্তায় চলাফেরার ক্ষেত্রে ইসলামের
নির্দেশনাকে অনুসরণের তাগাদা দিতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই রাস্তাঘাটের
অনাকাঙ্খিত ঘটনা থেকে আমাদের সন্তানরা নিরাপদ থাকতে পারবে।
৬. আল্লাহভীতি:
যার মধ্যে তাকওয়া কাজ করে তিনি কখনো খারাপ কাজ করতে পারেন না। একজন
মুত্তাকী মানুষ তার সকল কাজে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করেন। তিনি জানেন,
তাকে দেখছেন, শুনছেন, পর্যবেক্ষণ করছেন। আল্লাহর কাছে বান্দার গোপনীয়তা
বলতে কিছুই থাকে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لِّلَّهِ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۗ وَإِن تُبۡدُواْ مَا
فِيٓ أَنفُسِكُمۡ أَوۡ تُخۡفُوهُ يُحَاسِبۡكُم بِهِ ٱللَّهُۖ فَيَغۡفِرُ
لِمَن يَشَآءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَآءُۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ
قَدِيرٌ ٢٨٤﴾ [البقرة: ٢٨٤]
“যা কিছু আকাশসমূহে এবং যা কিছু জমিনে আছে, সব আল্লাহরই। যদি তোমরা মনের
কথা প্রকাশ কর কিংবা গোপন কর, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন।
অতঃপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দিবেন।”
[সূরা আল-বাকারা: ২৮৪]
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَقُولُواْ قَوۡلٗا سَدِيدٗا ٧٠﴾ [الاحزاب: ٧٠]
“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৭০]
আবু যর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«قال عبد الرحمن قال قلت: يا رسول الله أوصني قال اتق الله حيثما كنت واتبع السيئة الحسنة تمحها وخالق الناس بخلق حسن».
“আবদুর রহমান বলেছেন, হে আল্লাহর রাসূল আমাকে উপদেশ দিন। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করো। খারাপ কাজের পরপরই
ভালো কাজ করো এবং মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার কর।”[18]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿قُلۡ يَٰعِبَادِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمۡۚ لِلَّذِينَ
أَحۡسَنُواْ فِي هَٰذِهِ ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٞۗ وَأَرۡضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةٌۗ
إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ ١٠ ﴾ [الزمر:
١٠]
“বলুন, হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন করো।
যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে পূণ্য। আল্লাহর পৃথিবী
প্রশস্ত। যারা ধৈর্য ধারণকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।” [সূরা
আয-যুমার, আয়াত: ১০]
তিনি আরো বলেন,
«سبعة يظلهم الله في ظله الإمام العادل وشاب نشأ في عبادة ربه ورجل قلبه
معلق في المساجد ورجلان تحابا في الله اجتمعا عليه وتفرقا عليه ورجل طلبته
امرأة ذات منصب وجمال فقال إني أخاف الله ورجل تصدق اخفى حتى لا تعلم شماله
ما تنفق يمينه ورجل ذكر الله خاليا ففاضت عيناه».
“যেদিন (কিয়ামতের দিন) ‘আরশের ছায়া ছাড়া আর অন্য কোনো ছায়া থাকবে না সেদিন
সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দিবেন।
ন্যায়পরায়ণ নেতা,
ঐ যুবক, যে তাঁর যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন,
এমন ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে লটকানো থাকে, একবার মসজিদ থেকে বের হলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ব্যাকুল থাকে,
এমন দু’ব্যক্তি, যারা কেবল আল্লাহর মহব্বতে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথক হয়,
যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর ভয়ে চোখের অশ্রু ফেলে,
যে ব্যক্তিকে কোনো সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী রমণী ব্যভিচারে লিপ্ত
হওয়ার আহবান জানায় আর ঐ ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়েই বিরত থাকে এবং
যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কী দান করল বাম হাতও তা জানল না।”[19]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
«إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ ».
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না; কিন্তু তিনি তোমাদের অন্তর ও কর্মের দিকে তাকান।”[20]
৭. আখিরাতের বিশ্বাস:
পরকালীন দিবসের ওপর বিশ্বাস মানুষকে পাপকর্ম থেকে বিরত রাখে। একজন মুমিন
ব্যক্তি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, এ দুনিয়া অস্থায়ী, পরকালীন জীবন
স্থায়ী। সেখানে দুনিয়ার সকল কর্মের হিসাব নেওয়া হবে। কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড়
দেওয়া হবে না। যিদি উত্তম কর্ম করেছেন, তিনি উত্তম প্রতিদান পাবেন আর যিনি
অন্যায় কর্ম করেছেন তিনি কঠিন শাস্তি ভোগ করবেন। এ বিশ্বাসই তাকে ভালো
কাজে প্রেরণা যোগায় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা
করেছেন,
﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ﴾ [الزلزلة: ٧، ٨]
“অত:পর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে। [সূরা আয-যিলযাল, আয়াত: ৭-৮]
﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَا كُفۡرَانَ لِسَعۡيِهِۦ وَإِنَّا لَهُۥ كَٰتِبُونَ ٩٤﴾ [الانبياء: ٩٤]
“অত:পর যে বিশ্বাসী অবস্থায় সৎকর্ম সম্পাদন করে, তার প্রচেষ্টা অস্বীকৃত
হবে না এবং আমি তা লিপিবদ্ধ করে রাখি।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৯৪]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تِلۡكَ ٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ نَجۡعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ
عُلُوّٗا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فَسَادٗاۚ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلۡمُتَّقِينَ ٨٣
مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ خَيۡرٞ مِّنۡهَاۖ وَمَن جَآءَ
بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَى ٱلَّذِينَ عَمِلُواْ ٱلسَّئَِّاتِ إِلَّا
مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٨٤ ﴾ [القصص: ٨٣، ٨٤]
“ঐ আখিরাতের ঘর তো আমি তাদের জন্য খাস করে দেব, যারা পৃথিবীতে নিজেদের
বড়ত্ব চায় না এবং ফাসাদও সৃষ্টি করতে চায় না। আর ভালো পরিণাম তো
মুত্তাকীদের জন্যই রয়েছে। যে ভালো ‘আমল নিয়ে আসে তার জন্য এর চেয়েও ভালো ফল
রয়েছে। আর যে মন্দ আমল নিয়ে আসে, তার জানা উচিত যে, মন্দ আমলকারীরা যেমন
কাজ করত তেমন ফলই পাবে।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮৩-৮৪]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا هَٰذِهِ ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا لَهۡوٞ وَلَعِبٞۚ وَإِنَّ
ٱلدَّارَ ٱلۡأٓخِرَةَ لَهِيَ ٱلۡحَيَوَانُۚ لَوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ٦٤﴾
[العنكبوت: ٦٤]
“এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া কৌতুক বৈ কিছু নয়। পরকালের গৃহই প্রকৃত জীবন; যদি তারা জানত।” [সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ৬৪]
তিনি আরো বলেন,
﴿وَلَدَارُ ٱلۡأٓخِرَةِ خَيۡرٞۚ وَلَنِعۡمَ دَارُ ٱلۡمُتَّقِينَ ٣٠ ﴾ [النحل: ٣٠]
“এবং পরকালের গৃহ আরও উত্তম। মুত্তাকীদের ঘর কী চমৎকার! [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩০]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ
حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ
شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ
أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ ».
“কিয়ামতের দিন আদম সন্তানের পা (স্বস্থান থেকে) একটুও নড়াতে পারবে না যতক্ষণ না পাঁচটি ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে:
তার জীবনকাল কী কাজে শেষ করেছে?
তার যৌবনকাল কী কাজে নিয়েজিত রেখেছে?
তার ধন-সম্পদ কোন উৎস থেকে উপার্জন করেছে?
কোন কাজে তা ব্যয় করেছে এবং
সে অর্জিত জ্ঞানানুযায়ী কতটা আমল করেছে?”[21]
৮. শালীন পোশাক পরিধান করা
পশুদের লজ্জা নেই, পোশাক নেই। ওরা উলঙ্গ থাকে, যা ইচ্ছা তাই করে। মানুষ পশু
নয়; মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। পোশাক মানুষের জন্য আল্লাহর অনন্য দান।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ قَدۡ أَنزَلۡنَا عَلَيۡكُمۡ لِبَاسٗا يُوَٰرِي
سَوۡءَٰتِكُمۡ وَرِيشٗاۖ وَلِبَاسُ ٱلتَّقۡوَىٰ ذَٰلِكَ خَيۡرٞۚ ذَٰلِكَ
مِنۡ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ لَعَلَّهُمۡ يَذَّكَّرُونَ ٢٦ يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ لَا
يَفۡتِنَنَّكُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ كَمَآ أَخۡرَجَ أَبَوَيۡكُم مِّنَ
ٱلۡجَنَّةِ يَنزِعُ عَنۡهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوۡءَٰتِهِمَآۚ
إِنَّهُۥ يَرَىٰكُمۡ هُوَ وَقَبِيلُهُۥ مِنۡ حَيۡثُ لَا تَرَوۡنَهُمۡۗ
إِنَّا جَعَلۡنَا ٱلشَّيَٰطِينَ أَوۡلِيَآءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ
٢٧ ﴾ [الاعراف: ٢٦، ٢٧]
“হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের প্রতি পোশাক নাযিল করেছি, যাতে তোমাদের শরীরের
লজ্জাস্থান ঢাকা যায় এবং শরীরের হিফাযত ও সাজসজ্জা হয়। আর তাকওয়ার পোশাকই
সবচেয়ে ভালো। এটা আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম নিদর্শন। হয়তো লোকেরা এ
থেকে উপদেশ নেবে। হে আদম সন্তান! শয়তান যেন তোমাদেরকে তেমনিভাবে ফিতনায় না
ফেলে, যেমনিভাবে সে তোমাদের (আদি) পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল
এবং তাদের শরীর থেকে তাদের পোশাক খুলিয়ে ফেলেছিল, যাতে তাদের লজ্জাস্থান
একে অপরের সামনে খুলে যায়। সে এবং তার সাথী তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখতে
পায়, যেখান থেকে তোমরা তাকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না তাদের জন্য
আমি এ শয়তানদেরকে অভিভাবক বানিয়ে দিয়েছি।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২৬]
যিনি শালীন পোশাক পরেন তিনি অশালীন কাজ করতে পারেন না। নারীরা শালীন পোশাক
পরলে শয়তানের কু-দৃষ্টি তাদের দিকে পড়ে না। আল্লাহ নারীদেরকে জাহেলী যুগের
মতো চলাফেরা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
﴿وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ ﴾ [الاحزاب: ٣٣]
“তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান কর এবং জাহেলিয়াত যুগের নারীদের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন করে চলাফেরা করো না।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৩]
৯. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ:
আমাদেরকে সব সময় সৎ কাজের আদেশ দিতে হবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করতে হবে। এ
কাজ থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ
وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ ١١٠ ﴾ [ال عمران:
١١٠]
“তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব
ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং
আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।”[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“তোমাদের মধ্যে কেউ অন্যায় কাজ দেখলে সে যেন তার হাত দিয়ে তা প্রতিহত করে,
যদি তা না করতে পারে, সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করে, যদি তাও না করতে পারে,
সে যেন অন্তত অন্তর দিয়ে হলেও প্রতিবাদ করে। আর সেটি হচ্ছে ঈমানের
দুর্বলতম অবস্থা।”[22]
মুসলিম সমাজের প্রত্যেক সদস্য একে অপরকে সৎ কাজের আদেশ দেবেন এবং খারাপ
কাজে বাঁধা দেবেন। আমরা যদি এ কাজটি করতে পারি তাহলে আমাদের সমাজ থেকে অনেক
অঘটন উঠে যাবে। আমাদেরকে যারা উত্ত্যোক্ততার শিকার হচ্ছেন তাদের পাশে
দাঁড়াতে হবে এবং উত্ত্যেক্তকারীকে প্রতিহত করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى
ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ
ٱلۡعِقَابِ ٢ ﴾ [المائدة: ٢]
“সৎকর্ম ও তাকওয়ার কাজে তোমরা একে অন্যের সাহায্য করো। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের
ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ২]
১০. সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«كلكم راعٍ وكلكم مسؤولٌ عن رعيته».
“তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন রাখাল এবং তোমরা প্রত্যেকেই তোমাদের অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”[23]
আমরা সবাই আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের অধীনদের সম্পর্কে
কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করবেন। একটি সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির অধীনে কেউ না
কেউ পরিচালিত হন। তিনি যদি তার অধীনদের খোঁজ-খবর রাখেন, মন্দ কাজে বাধা
দেন, তাহলে সমাজের কেউ অপরাধমূলক কর্মে জড়াতে পারে না। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
«مثل القائم في حدود الله والواقع فيها كمثل قوم استهموا على سفينة، فصار
بعضهم أعلاها، وبعضهم أسلفها، وكان الذين في أسفلها إذا استقوا من الماء
مروا على من فوقهم فقالوا: لو أنا خرقنا في نصيبنا خرقاً ولم نؤذ من فوقنا،
فإن تركوهم وما أرادوا هلكوا جميعاً، وإن أخذوا على أيديهم نجوا ونجوا
جميعاً».
“যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলেন এবং যারা মেনে চলে না, তাদের উদাহরণ হচ্ছে ঐ
কওমের মতো, যারা একটি নৌকা নিয়ে লটারী ধরেছে। অতঃপর তাদের একাংশ নৌকার
উপরের অংশে ভাগে পেয়েছে এবং অন্য অংশ পেয়েছে নৌকার নিচের অংশ। যারা নৌকার
নিচের তলায় থাকতেন তারা তাদের পানীয় পানির প্রয়োজন মেটাতে নৌকার
উপরতলাবাসীদের কাছে যেতেন। এক পর্যায়ে তারা বলল, আমরা আমাদের অংশে ছিদ্র
করে পানির প্রয়োজন মেটালে আর উপরতলাবাসীকে কষ্ট দিতে হয় না। এখন যদি
উপরতলার বাসিন্দারা নিচতলাবাসীদেরকে নৌকা ছিদ্র করার জন্য সুযোগ দেন, তাহলে
উপরতলা ও নিচতলার সবাই পানিতে ডুবে মারা যাবে। আর যদি তারা নিচতলাবাসীকে
তাদের এ কর্মে বাধা দেয় তাহলে নিচতলার বাসিন্দারাও বেঁচে যাবে এবং উপরতলার
বাসিন্দারাও বেঁচে যাবে।”[24]
আল্লাহর রাসূলের উক্ত হাদীসের আলোকে যদি সমাজের সকল মানুষ দায়িত্ববান হয় তাহলে অনেক অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগই কমে আসবে।
১১. সহশিক্ষা বর্জন করা:
সহশিক্ষা ইসলামী শরী‘আতের সরাসরি লঙ্ঘন। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইসলামে
হারাম। সহশিক্ষার কুফল অনেক। সহশিক্ষা পর্দার লঙ্ঘন হয়, লজ্জা কমে যায়,
পশুবৃত্তি জাগ্রত হয়, কু-চিন্তা, কু-বাসনায় পেয়ে বসে, যার পরিণতি ভালো নয়।
ইভটিজিং, যেনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা সবই সহশিক্ষার কুফল।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটের সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রীদের পর্নো-সিডি বাজারে বিভিন্ন সাংকেতিক নামে পাওয়া যায়। কোনো কোনো
মিনি পতিতালয়ে গড়ে উঠেছে নামী-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে।
সম্প্রতি ইডেন কলেজের কেলেঙ্কারি কারো অজানা নয়। এসবই সহশিক্ষার কুফল।
ইভটিজিংসহ নানারকম ফিতনা-ফাসাদ ও বালা-মুসিবত থেকে আমাদের সন্তাদের রক্ষা
করতে সহশিক্ষা বাদ দিতে হবে। নর ও নারীর জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে
তুলতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি
পরীক্ষার রেজাল্ট গবেষণা করে দেখা গেছে যে, সহশিক্ষাযুক্ত প্রতিষ্ঠানের
চেয়ে সহশিক্ষামুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছে।
১২. লজ্জা:
লজ্জা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূষণ। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ লজ্জাশীল পুরুষ ছিলেন। লজ্জাহীন মানুষ
পশুতুল্য। পশুর লজ্জা নেই। তাই ওরা যেখানে সেখানে যা ইচ্ছা তাই করে। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلَامِ النُّبُوَّةِ : إِذَا لَمْ تَسْتَحِ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ».
“মানুষের কাছে পৌঁছা নবুওয়াতের প্রথম বাণী হচ্ছে, তুমি লজ্জাহীন হলে যা ইচ্ছা তাই করতে পারো।”[25]
তিনি আরো বলেন,
«الْحَيَاءُ لاَ يَأْتِي إِلاَّ بِخَيْرٍ».
“লজ্জা কল্যাণ বৈ কিছুই বয়ে আনে না।”[26]
অতএব, আমাদেরকে লজ্জার গুণ অর্জন করতে হবে। সন্তানদেরকে লজ্জাশীলতা শেখাতে
হবে। যেসব অভিভাবক ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে একত্রে অশালীন সিনেমা, নাটক আর গান
দেখেন তাদেরকে বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।
১৩. ছোটদের স্নেহ ও বড়দের শ্রদ্ধা করা:
আমাদের সন্তানদেরকে বড়দের শ্রদ্ধা আর ছোটদেরকে স্নেহ করার আদর্শ শেখাতে
হবে। যারা এ গুণ অর্জন করবে তারা কখনোই রাস্তায় কোনো খারাপ কাজ করতে পারে
না। কেননা তার তখন স্মরণ হবে সব নারীই কারো না কারোর মা, বোন, স্ত্রী কিংবা
আত্মীয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ليس منا من لم يرحم صغيرنا ويوقر كبيرنا».
“সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে ছোটদের স্নেহ এবং বড়দের শ্রদ্ধা করে না।”[27]
১৪. সচ্চরিত্র:
সুশীলসমাজ গঠন করতে চাইলে সচ্চরিত্রের বিকল্প নেই। আমাদের সন্তানদেরকে সকল
প্রকার উত্তম চরিত্র শিক্ষা দিতে হবে। একজন বিনয়ী, নম্র, ভদ্র এবং
সচ্চরিত্রবান ছেলে কখনোই কোনো নারীকে উত্ত্যক্ত করতে পারে না। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إن من خياركم أحسنكم أخلاقا».
“নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে উত্তম ঐ ব্যক্তি যার চরিত্র উত্তম।”[28]
আমাদের সন্তানদের চরিত্র বদলাতে হবে। রাসূলের চরিত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ
يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١ ﴾
[الاحزاب: ٢١]
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের
জন্যে রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]
১৫. সৎসঙ্গ:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مثل الجليس الصالح والسوء كحامل المسك ونافخ الكير فحامل المسك إما أن
يحذيك وإما أن تبتاع منه وإما أن تجد منه ريحا طيبة ونافخ الكير إما أن
يحرق ثيابك وإما أن تجد ريحا خبيثة».
“সৎবন্ধু এবং অসৎ বন্ধুর তুলনা হচ্ছে, সুগন্ধী বহনকারী ও কামারের সাথে।
সুগন্ধি বহনকারী তোমাকে হয়তো সুগন্ধি উপহার দেবে; না হয় তুমি তার থেকে
সুগন্ধি কিনে নেবে আর না হয় তুমি তার থেকে সুবাস পাবে। আর কামারের কাছে
গেলে আগুনের ফুলকি তোমার বস্ত্রকে ছিদ্র করবে অথবা খারাপ গন্ধ পাবে।”[29]
১৭. মোবাইল, ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের অপব্যবহার রোধ:
মোবাইল, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান
সময়ে চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এগুলো
ব্যবহার হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সাইট আছে লক্ষ লক্ষ।
আমাদের যুবসমাজ ইন্টারনেটকে গবেষণামূলক কাজে ব্যবহার না করে বন্ধুত্ব
স্থাপন, চ্যাটিং, অশ্লীল দৃশ্য ও অপরাধের কাজেই বেশি ব্যবহার করছে। আধুনিক
প্রযুক্তির অবৈধ ব্যবহার বন্ধে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদেরকে তাই আমাদের সন্তানদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। তারা কাদের সাথে
বন্ধুত্ব করছে, খোঁজ রাখা উচিৎ। বাজে বন্ধুর খপ্পরে পড়ে আপনার আমার ছেলেরা
মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে। পরিণত হতে পারে মদখোর, জুয়াখোর, নেশাগ্রস্ত,
ইভটিজার, সন্ত্রাসী কিংবা চোর ডাকাতে।
১৮. পর্দার অনুশীলন:
পর্দার বিধান মেনে চলা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরয। ইসলামী শরী‘আতের এ বিধান
মেনে চলতে পারলেই দুনিয়ার বহু অনিষ্টতা থেকে সহজেই রেহাই পাওয়া সম্ভব।
১৯. নারীর পর্দা:
আল্লাহ তা‘আলা নারীদেরকে উত্ত্যেক্তকারীদের হাত থেকে রেহাই পেতে পর্দার
বিধান মেনে চলতে বলেছেন। পবিত্র কুরআনে নিম্নের এ আয়াতে বখাটেদের
উত্ত্যেক্ততা থেকে রেহাই পেতে নারীদের সরাসরি কৌশল বাতলে দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ
ٱلۡمُؤۡمِنِينَ يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ذَٰلِكَ
أَدۡنَىٰٓ أَن يُعۡرَفۡنَ فَلَا يُؤۡذَيۡنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا
رَّحِيمٗا ٥٩ ﴾ [الاحزاب: ٥٩]
“হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন,
তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে
(সম্ভ্রান্ত বলে) চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্ত্যেক্ত করা হবে না। আল্লাহ
ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৯]
পর্দার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা যদি নর-নারীরা পালন
করেন, তাহলে খারাপ কোনো চিত্র রাস্তা-ঘাটে দৃশ্যমান হবে না। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
﴿قُل لِّلۡمُؤۡمِنِينَ يَغُضُّواْ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِمۡ وَيَحۡفَظُواْ
فُرُوجَهُمۡۚ ذَٰلِكَ أَزۡكَىٰ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا
يَصۡنَعُونَ ٣٠ وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ
وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ
مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ ٣١ ﴾ [النور:
٣٠، ٣١]
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের
হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ
তা অবহিত আছেন। ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে
এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া
তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের ওড়না মাথার বক্ষদেশে
ফেলে রাখে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩০-৩১]
আল্লাহ তা‘আলা নারীদেরকে পর্দাহীন চলাফেরা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
﴿وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ﴾ [الاحزاب: ٣٣]
“তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান কর এবং জাহিলিয়াত যুগের নারীদের মতো সৌন্দর্য
প্রদর্শন করে ঘোরাফেরা করো না।’’ [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৩]
হিজাব নারীকে হেফাযত করে, রক্ষা করে তার ইজ্জত-অবরুকে। বাংলাদেশের যে
নারীরা রাস্তায় হিজাব পরে চলেন, পর্দার ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম মানেন, তারা
ইভটিজিং, এসিড সন্ত্রাস এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এ খবর সাধারণত পাওয়া যায়
না।
কোনো ফলের খোসা ছিড়ে খোলা জায়গায় ঢাকনাবিহীন রেখে দিলে তা মাছি ও জীবানু
থেকে যেমন রক্ষা করা যায় না, তেমনি পর্দাবিহীন কোনো নারী রাস্তায় নিরাপদ
নয়। শয়তান ও দুষ্টলোকের কুদৃষ্টি তার দিকে পড়বেই। তাই নারীকে বাঁচাতে,
ইভটিজিং থেকে রক্ষা করতে নারীকেই আল্লাহর নির্দেশ মেনে পর্দা করে চলতে হবে
-এর কোনো বিকল্প নেই।
নারীর পর্দার কতিপয় দিক
একজন মুসলিম নারী পর্দার বিধান মেনে চলতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে
চলবেন। না হয় তার পর্দার বিধান পুরোপুরি মেনে চলা হবে না। আল্লাহর বিধান
পরিপূর্ণভাবে না মানলে দুনিয়াবী ফিতনা ফাসাদ থেকে মুক্ত থাকাও সম্ভব নয়।
১. সতর ঢাকা:
নারীর দেহ আবৃত করে রাখাই পর্দার উদ্দেশ্য। কোনোভাবেই নারীদেহ প্রদর্শন করা যাবে না।
কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষ প্রয়োজনে তার শরীর থেকে এমন কিছু অংশ সতরের বহির্ভুত
হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা প্রকাশ না করলেই নয়। এ মর্মে কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ ﴾ [النور: ٣١]
“তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে
এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত:
৩১]
এখানে যা সাধারণত প্রকাশমান দ্বারা অধিকাংশ শরী‘আহ বিশেষজ্ঞের মতে, হাতের
তালু এবং বহিরাবরণকে বোঝানো হয়েছে। এগুলো সে আজনবীদের সামনে প্রকাশ করতে
পারবে।
২. পরপুরুষের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ না করা:
পরপুরুষের সামনে কোনো মুসলিম নারী তার সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ ﴾ [النور: ٣١]
“তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে
এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত:
৩১]
শুধু দৈহিক সৌন্দর্য প্রদর্শন থেকে বিরত থাকলেই চলবে না বরং কণ্ঠের সৌন্দর্যকেও পরপুরুষ থেকে দূরে রাখতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِنِ ٱتَّقَيۡتُنَّۚ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِٱلۡقَوۡلِ فَيَطۡمَعَ ٱلَّذِي
فِي قَلۡبِهِۦ مَرَضٞ وَقُلۡنَ قَوۡلٗا مَّعۡرُوفٗا ٣٢ ﴾ [الاحزاب: ٣٢]
“যদি তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয়
ভঙ্গিতে করা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি
রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কর্থাবার্তা বলবে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩২]
নারীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা নীরবে পথ চলতে বলেছেন, যাতে দুষ্ট লোকেরা তাদের পায়ের আওয়াজ শুনে ব্যাকুল হয়ে না ওঠে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلَا يَضۡرِبۡنَ بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّۚ ﴾ [النور: ٣١]
“তারা যেন পদযুগল এমনভাবে স্থাপন করে, যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য টের পাওয়া যায়।” [সূরা আন-নুর, আয়াত: ৩১]
বর্তমানে অধিকাংশ নারীগণ রাস্তায় বের হলে তাদের রূপ-সৌন্দর্যকে মানুষের
সামনে তুলে ধরতে প্রায় মরিয়া। নানা ধরনের পারফিউম, সাজগোজ, পায়ে ঝুমকা,
বাহারি ডিজাইনের পোশাক পরিধান করে তারা একদিকে যেমন আল্লাহর বিধানকে লঙ্ঘন
করছে, পাশাপাশি পুরুষদের যৌন ক্ষুধা বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে
আনছে।
বর্তমানে বোরকাও ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। নানা ডিজাইনের বোরকা আধুনিক নারীদের
সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলছে। বোরকা যদি পর্যার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন না করতে
পারে তাহলে তার পরিধান করা অর্থহীন। আমাদের মা বোনদের বোরকা এমন হওয়া উচিত,
যা তাদের সৌন্দর্যকে আবৃত করবে। বোরকার সৌন্দর্য যেন পুরুষদের আকর্ষণ না
করে।
৩. নর-নারীর নির্জন সাক্ষাৎ বর্জন:
ইসলামে নর-নারীর নির্জন সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ। এটি অত্যন্ত ভয়ানক। নারী-পুরুষের
নির্জনে সাক্ষাৎ কিংবা গোপন সম্পর্ক, যখন উভয়ের মধ্যে কোনো পর্দা বা আড়ালও
থাকে না। এরূপ পরিস্থিতিতে এমন কোনো বাহ্যিক চাপ থাকে না, যা মানুষকে আবেগ
উত্তেজনার কাছে পরাভূত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। নর-নারীর সম্পর্ক
ইসলামের দৃষ্টিতে নিছক দৈহিক লালসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর উপর আবর্তিত হয়
অনেক দায়-দায়িত্ব। তাই এ সম্পর্কের সাথে সামাজিক বন্ধন ও স্বীকৃতি থাকা
অত্যাবশ্যক, যেন এই দায়-দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমাজ ব্যক্তির সাহায্যে
এগিয়ে আসে। আর যদি ব্যক্তি তা পালন করতে অবহেলা করে বা পাশ কাটিয়ে যেতে চায়
তাহলে তাকে জবাবদিহির জন্য পাকড়াও করতে পারে। এই বন্ধন বা বাধ্য-বাধকতাই
তার বিপথগামিতার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে নর-নারী কারো অধিকার
বিনষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। মানুষের এই দুর্বলতার কথা বিবেচনা করে
বেগানা নারী-পুরুষের নির্জন দেখা সাক্ষাৎ ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।[30]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“তোমাদের কেউ যেন কোনো বেগানা নারীর সাথে একান্তে সাক্ষাৎ না করে, তবে তার সাথে তার কোনো মাহরাম পুরুষ আত্মীয় থাকলে ভিন্ন কথা।”[31]
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নর-নারীর নির্জন আড্ডা থেকে সর্তক করে বলেন,
«لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلاَّ كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ».
“একান্ত নির্জনে বেগানা নর-নারী যখন কথাবার্তা বলে, শয়তান তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে যায়।”[32]
আল্লাহ তা‘আলা বরেন,
﴿وَلَا مُتَّخِذَٰتِ أَخۡدَانٖۚ﴾ [النساء: ٢٥]
“মেয়েরা গোপনে বা চুপিসারে বন্ধুত্ব করবে না।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৫]
অনুরূপ ছেলেদেরকে বলা হয়েছে,
﴿وَلَا مُتَّخِذِيٓ أَخۡدَانٖ٥ ﴾ [المائدة: ٥]
“পুরুষেরাও গোপনে বা চুপিসারে বন্ধুত্ব করবে না।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৫]
৪. পুরুষদের মতো পোশাক পরিধান না করা:
নারীদের জন্য পুরুষের পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম সে সকল নারীদের অভিসম্পাত করেছেন, যারা পুরুষের পোশাক পরিধান
করে। হাদীসে এসেছে,
«لعن النبي صلى الله عليه وسلم المتشبهين من الرجال بالنساء والمتشبهات من النساء بالرجال».
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের অনুকরণকারী পুরুষদের এবং পুরুষদের অনুকরণকারী নারীদের অভিসম্পাত করেছেন।”[33]
৫. পাতলা স্কিন টাইট কিংবা পুরো দেহ আবৃত করে না এমন পোশাক পরিধান:
আবু হোরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ
كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ
عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ
الْمَائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ رِيحَهَا وَإِنَّ
رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا ».
“জাহান্নামীদের এমন দুটি দল রয়েছে, যাদের আমি দেখিনি। তাদের এক দলের হাতে
গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, যা দিয়ে তারা লোকদেরকে মারবে। আর একদল
নারীদেরকে। তারা পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা সত্ত্বেও উলঙ্গ, বিচুৎতকারিণী ও
স্বয়ং বিচ্যুত। বুখতী উটের উচু কুঁজের মতো তাদের চুলের খোপা। এসব নারী কখনো
জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ
জান্নাতের সুগন্ধি অনেক অনেক দূর থেকে পাওয়া যাবে।”[34]
ইসলাম নগ্নতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জ চালচলন নিষিদ্ধ করে অবাধ যৌনচর্চার
দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, অবাধ যৌনচর্চা মানবতার মহাসর্বনাশ সাধন করতে
পারে। এর ফলে যুবশক্তির ধ্বংস সাধনসহ মারাত্মক যৌনব্যাধি, শারীরিক শক্তি
নাশ, পারিবারিক শৃঙ্খলার বিলোপ, বেশ্যাবৃত্তির প্রসার, ইভটিজিং ও নানা
প্রকার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আজকের বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা যার বাস্তব
প্রমাণ।[35]
৬. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বর্জন:
মানুষ পাপের আস্তানার পাশ দিয়ে দৃষ্টি অবনত করে অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু
যেখানে গোটা সমাজকে ব্যভিচারের আঁখড়ায় পরিণত করা হয়েছে, সেখানে যে কোথায়
গিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করবে? নিজের নৈতিকতা ও কর্মের পরিমার্জনের জন্য কী
ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? বর্তমানে অবস্থা এই যে, কোনো ব্যক্তি সে বাজারের
দোকানদার হোক কিংবা কারখানার শ্রমিক, কলেজের ছাত্র হোক কিংবা অফিসের
কেরানি, সে কোনো হোটেলে বসে থাকুক বা পার্কে ভ্রমণরত হোক-প্রতিটি স্থানেই
বিপরীত লিঙ্গ তার সামনে পাপের পয়গাম নিয়ে হাজির আছে। জীবনের এমন কোনো অঙ্গন
নেই, বর্তমান সভ্যতা যেখানে নারী ও পুরুষের একসাথে কাজ-কর্ম অনিবার্য করে
দেয় নি। শুধু তাই নয়; বরং এই একত্রে মেলামেশাকে এতটা বৈচিত্র্যময় ও
আকর্ষণীয় করে দিয়েছে যে, সমাজের ওপরে যৌন ক্ষুধা ও যৌন উপবাসের মতো
পরিস্থিতি ছেয়ে আছে। মনে হয়, যেন যৌনতা সর্বত্র ভিক্ষাপাত্র হাতে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। নারী ও পুরুষের অভাদ মেলামেশা যতদিন উচ্ছেদ না করা যাবে, ততদিন এ
পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভ করা যাবে না।
ইসলাম সব সময় নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্র পুরোপুরি আলাদা করে রাখে। তাই
ইসলামের নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেলার সুযোগ
নিতান্ত কম। কোনো সময় নারী ও পুরুষের একই গন্ডির মধ্যে কাজ করার প্রয়োজন
হলেও ইসলাম তাদের পরস্পর মেলামেশা থেকে দূরে থাকতে কঠোরভাবে নির্দেশ
দেয়।[36]
একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী ও পুরুষদের পারস্পরিক মিশে যেতে দেখে নারীদের বললেন,
«اسْتَأْخِرْنَ فَإِنَّهُ لَيْسَ لَكُنَّ أَنْ تَحْقُقْنَ الطَّرِيقَ عَلَيْكُنَّ بِحَافَاتِ الطَّرِيقِ ».
“পেছনে চলে যাও। রাস্তার মাঝখান দিয়ে তোমাদের চলা উচিত নয়। তোমাদের রাস্তার একপাশ দিয়ে চলা উচিত।”[37]
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো পুরুষকে দুইজন স্ত্রীলোকের মাঝ দিয়ে
চলতে নিষেধ করেছেন।[38]
উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ ». فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ
الأَنْصَارِ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ « الْحَمْوُ
الْمَوْتُ »
“নারীদের সাথে অবাধে মেলামেশা থেকে সাবধান হও। একজন আনসারী বললেন, দেবরের
সাথে মেলামেশার ব্যাপারে আপনার মতামত কী? তিনি বললেন, দেবর তো সাক্ষাৎ
মৃত্যু”[39] (অর্থাৎ মৃত্যু যেমন দেহে পচন ধরায়, দেবরের কারণে
দাম্পত্যজীবনে তেমিন পচন ধরতে পারে)।
পুরুষের পর্দা:
নারীর পর্দার পাশাপাশি পুরুষের পর্দা করাও ফরয। পবিত্র কুরআনের পর্দার
বিধান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সূরা আন-নূরের আয়াত দুটিতে প্রথমেই পুরুষদের
পর্দার বিষয়ে নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿قُل لِّلۡمُؤۡمِنِينَ يَغُضُّواْ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِمۡ وَيَحۡفَظُواْ
فُرُوجَهُمۡۚ ذَٰلِكَ أَزۡكَىٰ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا
يَصۡنَعُونَ ٣٠ ﴾ [النور: ٣٠]
“মুমিনদেরকে বলনু, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের
হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ
তা অবহিত আছেন।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩০]
সুতরাং যেসব বস্তু মানবহৃদয়কে আল্লাহর স্মরণবিমুখ করে দেয় কিংবা যে দিকে
তাকাতে শরী‘আতে নিষেধাজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছে, সে দিক থেকে দৃষ্টিকে বিরত
রাখতে হবে। যেমন ঘরে বইরে, রাস্তা ঘাটে পরনারী ও আজনবী মহিলা, টেলিভিশন
কিংবা সিডি ভিডিও-র নাটক, ছায়াছবির অশ্লীল দৃশ্যাবলী কিংবা দেয়াল পোস্টারের
অশালীন ছবি ইত্যাদি। মূলতঃ অসংঘত দৃষ্টির কুপ্রভাব শুধু সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তির মন-মানসকেই কলুষিত করে না; বরং তা তার গোটা দেহের সমস্ত
কর্মকান্ডে সংক্রমিত হয়ে ক্রামন্বয়ে ব্যক্তি পর্যায় অতিক্রম করে এক সময় তা
সমূহবিপদ নিয়ে জাতীয় অস্তিত্ববিনাশী অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়ায়। আকাশ সংস্কৃতি,
পাশ্চাত্য থেকে আসা অশ্লীল ছবির কুপ্রভাবে আমাদের যুব সমাজের মধ্যে
বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয়ের যে ধস নেমেছে, তা এই নির্মম সত্যেরই কিছু
বাস্তবতা। এই অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস রোধ করতে যদি আমরা অক্ষমতার পরিচয় দেই
তাহলে আগামী দিনে ইসলামী আদর্শ-ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের জাতীয় স্বকীয়তা সংরক্ষণ
করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, আনতনয়ন বিশিষ্ট হওয়াই
নিষিদ্ধ দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার ও দৃষ্টির পবিত্রতা বিধানের প্রকৃষ্ট
পদ্ধতি-কৌশল। স্বয়ং চক্ষুদাতা মহান আল্লাহ তা‘আলাই আমাদের এ শিক্ষা
দিয়েছেন।
দৃষ্টির অবাধ বিচরণের নাম স্বাধীনতা নয়। যেমন অনেক নির্বোধ মুর্খ ধারণা করে
থাকে; বরং তা হচ্ছে কুপ্রবৃত্তির কাছে নিজের পরাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। একটি
ক্ষুধার্ত সিংহকে লোকালয়ে ছেড়ে দিলে সে যতটা হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে,
অনিয়ন্ত্রিত কুপ্রবৃত্তির ধ্বংসযজ্ঞ তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। কু-রিপুর
পূজারীরা মূলত যালিম ও সীমালঙ্ঘণকারী। ইসলামের দৃষ্টিতে, মানুষ তো তখনই
স্বাধীন হতে পারে, যখন সে কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে।[40]
এজন্যই কুরআনুল কারীমে কুপ্রবৃত্তি পূজাকারীদেরকে চরম ধিক্কার দেওয়া হয়েছে,
﴿ وَلَوۡ شِئۡنَالَرَفَعۡنَٰهُ بِهَا وَلَٰكِنَّهُۥٓ أَخۡلَدَ إِلَى
ٱلۡأَرۡضِ وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُۚ فَمَثَلُهُۥ كَمَثَلِ ٱلۡكَلۡبِ إِن
تَحۡمِلۡ عَلَيۡهِ يَلۡهَثۡ أَوۡ تَتۡرُكۡهُ يَلۡهَثۚ ﴾ [الاعراف: ١٧٦]
“অবশ্য আমরা ইচ্ছা করলে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিতাম সে সকল নিদর্শনসমূহের
বদৌলতে; কিন্তু সে যে অধ:পতিত এবং নিজের রিপুর অনুগামী হয়ে রইল। সুতরাং আর
অবস্থা হলো কুকুরের মতো; যদি তাকে তাড়া কর তবুও হাঁপাবে আর যদি ছেড়ে দাও
তবুও হাঁপাবে। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭৬]
অতএব, সুস্থ সমাজ গঠন করতে নর-নারীর চোখের পর্দার কোনো বিকল্প নেই। চোখের পর্দাই পারে ইভটিজিং থেকে আমাদের মা-বোনদের রক্ষা করতে।
উপসংহার
ইসলাম যে সকল অশান্তি, অন্যায়-অনাচার ও অপরাধকে দুর করে শাস্তি ও সুখী সমাজ
গঠন করতে পারে তা প্রমাণিত। চৌদ্দ শত বছর পূর্বে হযরত মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের জাহেলী সমাজকে পরিণত করেছিলেন সোনার
সমাজে। সমাজ থেকে সকল অপরাধ বিতাড়িত করতে হলে পারিবারিক শিক্ষা ও পর্দা
অনুশীলনের বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে ইসলামের দিক নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামের নির্দেশিত পথে চলার তাওফীক দিন। আমীন।
সমাপ্ত
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৩১৯, খন্ড ১, পৃ. ৪৬৫।
[2] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২০৭৯।
[3] মাজ্জাল্লাতুল বুহুস আল ইসলামিয়্যাহ, খন্ড, ২১, পৃ. ৪৫২।
[4] বুখারী, কিতাবুল আদব, বাবু রাহমাতিন ওয়ালাদ, হাদীস নং-৫৯৯৭।
[5] বুখারী, কিতাবুল জানায়েয, হাদীস নং-১৩০৩।
[6] বায়হাকী, ওয়াবুল ঈমান ৮৬৪৯।
[7] . সুনানু আবিদ দাউদ, কিতাবুল সালাত, হাদীস নং-৪৯৫।
[8] জালালুদ্দীন সুয়ুতী, জামেউল আহাদীস, হাদীস নং-৯৬১।
[9] আব্দুল্লাহ নাসির ওলওয়ান, তারবিয়াতুল আওলাদ ফিল ইসলাম, প্রথম খন্ড, পৃ. ৩১৮।
[10] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫০।
[11] ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তাস কারণ ও প্রতিকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৯।
[12] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২০৭৯।
[13]সুনানু ইবনি মাজাহ, হাদীস নং-৩৮০২।
[14] মাজমাউয যাওযায়েদ, হাদীস নং-১২৮২৯।
[15] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২০৭৮।
[16] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২০৭৬।
[17] সহীহ আল-বুখারী, হাদীস নং-২৪৬৫, খণ্ড, ৯, পৃ. ১৩৯।
[18] . মসনদে আহমদ, হাদীস নং-২২১০৪।
[19] সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬৬০।
[20] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬৭০৮।
[21] সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২৬০১।
[22]সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩৮৬।
[23] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৭৫১।
[24] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪৯৩।
[25]সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৪৮৩।
[26] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬১১৭।
[27]সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং ২০৪৩।
[28] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০৩৫।
[29] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৫৩৪।
[30] ড. বি.এম. মফিজুর রহমান আল আযহারী, ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ককারণ ও
প্রতিকার (চট্টগ্রাম-ইউনিক লাইব্রেরী, প্রথম প্রকাশ, ২০০৬ ইং), পৃ. ২২৯।
[31] সহীহ বুখারী, কিতাবুন নিকাহ, হাদীস নং-৫২৩৩।
[32] সূনানুত তিরমিযী, কিতাবুর রিদা‘, হাদীস নং-১২০৪।
[33] সহীহ বুখারী, কিতাবুল লিবাস, হাদীস নং ৫৮৮৫।
[34] সহীহ মুসলিম, কিতাবুল লিবাস, হাদীস নং ৫৭০৪।
[35] ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস কারণ ও প্রতিকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৭।
[36] প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩০।
[37] সুনানু আবি দাউদ, আবওয়াবুস সালাম, হাদীস নং-৫৩৭৪।
[38] প্রাগুক্ত, হাদীস নং ৫২৭৫।
[39] সুনানুত তিরমিযী, কিতাবুর রিদা‘, হাদীস নং-১২০৪।
[40] ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস কারণ ও প্রতিকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২২।
______________________________________________________________________________________________