ইবাদত বেশী হলেই মানুষ শ্রেষ্ঠ্য নয়, দ্বীনের সঠিক বুঝ ও প্রজ্ঞার ফলেই মানুষ শ্রেষ্ঠ্য হয়। শ্রেষ্ঠ্যত্ব আল্লাহর ইচ্ছাধীন ও মনোনয়নের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষ সর্বপ্রথম জান্নাতে বসবাস শুরু করে এবং নিজেদের ভুলের কারণে দুনিয়াতে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরিত হয়। সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের সমারহ। কিন্তু এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ্য মানুষ নবী-রাসূলগণ। এর পরে ঐসকল ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ্যত্ব অর্জন করবে যারা একান্তভাবে জান্নাতের পৌছাতে পারবে। অর্থাৎ- মুমিন মুত্তকী যারা সদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে এবং তাঁর বিধি-নিষেধ পালন করে, সৎ কাজের আদেশ দেন এবং মন্দ থেকে বিরত হতে বলে বা যথাসাধ্য নিষেধ করেন। এই শ্রেষ্ঠ্যত্বের মনোনীত করার কারু কোন প্রকার এখতিয়ার নেই । আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ رَبُّکَ یَخۡلُقُ مَا یَشَآءُ وَ یَخۡتَارُ ؕ مَا کَانَ لَهُمُ الۡخِیَرَۃُ ؕ سُبۡحٰنَ اللّٰهِ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ‘তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন আর যাকে ইচ্ছে মনোনীত করেন। এতে তাদের কোন এখতিয়ার নেই, আল্লাহ পবিত্র, মহান। তারা যাকে শরীক করে তা থেকে তিনি বহু ঊর্ধ্বে’ (কাসাস ২৮/৬৮)।
ইমাম বাগাভী তার তাফসীরে এবং ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম বলেন, আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা সম্মান দানের জন্য মনোনীত করেন। বগভীর উক্তি অনুযায়ী এটা মুশরিকদের এই কথার জওয়াব (وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَٰذَا الْقُرْآنُ عَلَىٰ رَجُلٍ مِنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ) “আর তারা বলেঃ এ কুরআন কেন নাযিল করা হল না দুই জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উপর?” [আয-যুখরুফ ৩১] অর্থাৎ কাফেররা এটা বলে যে, এ কুরআন আরবের দু’টি বড় শহর মক্কা ও তায়েফের মধ্য থেকে কোন প্রধান ব্যক্তির প্রতি নাযিল করা হল না কেন? এরূপ করলে এর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হত।
একজন পিতৃহীন দরিদ্র লোকের প্রতি নাযিল করার রহস্য কি? এর জওয়াবে বলা হয়েছে যে, যে প্ৰভু সমগ্র সৃষ্টিজগতকে কোন অংশীদারের সাহায্য ব্যাতিরেকে সৃষ্টি করেছেন, কোন বান্দাকে বিশেষ সম্মান দানের জন্য মনোনিত করার ক্ষমতাও তাঁরই। এ ব্যাপারে তিনি তোমাদের এই প্রস্তাবের অনুসারী হবেন কেন যে, অমুক যোগ্য, অমুক যোগ্য নয়?
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রাহেমাহুল্লাহ এ আয়াত থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান উদ্ভাবন করেছেন। তা এই যে, দুনিয়াতে এক স্থানকে অন্য স্থানের উপর অথবা এক বস্তুকে অন্য বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। এই শেষ্ঠত্ব দান সংশ্লিষ্ট বস্তুর উপার্জন ও কর্মের ফল নয়; বরং এটা প্ৰত্যক্ষভাবে স্রষ্টার মনোনয়ন ও ইচ্ছার ফলশ্রুতি। তিনি সপ্ত-আকাশ সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে উর্ধ্ব আকাশকে অন্যগুলোর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তিনি জান্নাতুল ফেরদাউসকে অন্য সব জান্নাতের উপর, জিবরীল, মীকাঈল, ইসরাফীল প্রমুখ বিশেষ ফেরেশতাগণকে অন্য ফেরেশতাদের উপর, নবী-রাসূলগণকে সমগ্র আদম সন্তানের উপর, তাদের মধ্যে দৃঢ়চেতা নবী-রাসূলগণকে অন্য নবী-রাসূলদের উপর, ইবরাহীম ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিমা ওয়াসাল্লামকে অন্য দৃঢ়চেতা নবী-রাসূলগণের উপর, ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধরদের সমগ্ৰ মানবজাতির উপর, কুরাইশদেরকে আরবদের উপরে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বনী হাশেমের উপর এবং এমনিভাবে সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য মনীষীকে অন্য মুসলিমদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
এগুলো সব আল্লাহ্ তা’আলার মনোনয়ন ও ইচ্ছার ফলশ্রুতি। এমনিভাবে পৃথিবীর অনেক স্থানকে অন্য স্থানের উপর, অনেক দিন ও রাতকে অন্য দিন ও রাতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করাও আল্লাহ তা’আলার মনোনয়ন ও ইচ্ছার প্রভাব। মোটকথাঃ শ্রেষ্ঠত্ব ও অশ্রেষ্ঠত্বের আসল মাপকাঠি এই মনোনয়ন ইচ্ছাই। এখানে অন্য কিছুর হাত নেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ যখন কোন আদেশ দেন তখন আরাশ বহনকারী ফেরেশতাগণ তসবীহ পাঠ করতে থাকে। তাদের তসবীহ শুনে তাদের নিকটবর্তী আকাশের ফেরেশতাগণও তসবীহ পাঠ করে। অতঃপর তাদের তসবীহ শুনে তাদের নীচের আকাশের ফেরেশতাগণ তসবীহ পাঠ করে। এভাবে দুনিয়ার আকাশ তথা সর্বনিম্ন আকাশের ফেরেশতাগণও তসবীহ পাঠে আত্মনিয়োগ করে ফেলে। অতঃপর তারা আরশ বহনকারী ফেরেশতাগণের নিকটবর্তী ফেরেশতাগণকে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের পালনকর্তা কি আদেশ দিয়েছেন? তারা তা বলে দেয়। এভাবে তাদের নীচের আকাশের ফেরেশতারা উপরের ফেরেশতাগণকে একই প্রশ্ন করে। এভাবে দুনিয়ার আকাশ পর্যন্ত সওয়াল ও জওয়াব পৌছে যায়। [মুসলিম: ২২২৯]
কুরআনে মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদের স্মরণ করবো।” সূরা আল-বাকারাহ: ১৫২] কাজেই বান্দা যখন সালাতে আল্লাহকে স্মরণ করবে। তখন অবশ্যই আল্লাহও তাকে স্মরণ করবেন। আর বান্দার আল্লাহকে স্মরণ করার তুলনায় আল্লাহর বান্দাকে স্মরণ করা অনেক বেশী উচ্চমানের। বান্দা যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ ওয়াদা অনুযায়ী স্মরণকারী বান্দাকে ফেরেশতাদের সমাবেশেও স্মরণ করেন। আল্লাহর এ স্মরণ ইবাদতকারী বান্দার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এ স্থলে অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে এই অর্থই বর্ণিত আছে। এই অর্থের দিক দিয়ে এতে এদিকেও ইঙ্গিত আছে যে, সালাত পড়ার মধ্যে গোনাহ থেকে মুক্তির আসল কারণ হল আল্লাহ্ স্বয়ং সালাত আদায়কারীর দিকে অভিনিবেশ করেন এবং ফেরেশতাদের সমাবেশে তাকে স্মরণ করেন। [দেখুন: বাগভী] অর্থাৎ- আলেমগণ আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর স্মরণে নিজেকে সদা নিযেজিত রাখে আর এসকল বান্দা ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ্য। কেননা এ সকল বান্দাদের কথা ফেরেশতাদের মজলিশে স্মরণ করেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর একদল ফেরেশতা আছেন, যারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে আল্লাহর যিকরকারীদের অনুসন্ধান করেন। যখন তাঁরা কোন দলকে আল্লাহর স্মরণ করতে দেখেন, তখন তাঁরা একে অপরকে বলেন, আসো! তোমাদের কাম্য বস্তু এখানেই। রাসূল (ছাঃ) বলেন, অতঃপর ফেরেশতারা তাদেরকে নিজ নিজ ডানা দ্বারা দুনিয়ার আকাশ পর্যন্ত ঘিরে নেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন যদিও তিনি তাদের অবস্থা অধিক অবগত।
আল্লাহ ফেরেশতাগণকে বলেন, আমার বান্দারা কি বলছে? ফেরেশতাগণ বললেন, তারা আপনার পবিত্রতা, বড়ত্ব, প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা করছে। তখন আল্লাহ বলেন, তারা কি আমাকে দেখেছে? ফেরেশতাগণ বললেন, আপনার কসম, তারা কখনো আপনাকে দেখেনি। তখন আল্লাহ বলেন, যদি তারা আমাকে দেখত তবে কেমন হ’ত? তখন ফেরেশতাগণ বললেন, যদি তারা আপনাকে দেখত, তবে তারা আরো বেশী আপনার ইবাদত করত এবং বেশী বেশী আপনার মর্যাদা ও পবিত্রতা ঘোষণা করত।
আল্লাহ আবার জিজ্ঞেস করেন, তারা কি চায়? ফেরেশতাগণ বললেন, তারা আপনার নিকট জান্নাত চায়? তখন আল্লাহ বলেন, তারা কি জান্নাত দেখেছে? ফেরেশতাগণ বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার কসম, তারা কখনো জান্নাত দেখেনি। তখন আল্লাহ বলেন, যদি তারা জান্নাতকে দেখত তবে কেমন হ’ত? ফেরেশতাগণ উত্তর দেন, যদি তারা জান্নাত দেখত তবে প্রচন্ড লোভ করত, এটা পাওয়ার অধিক আগ্রহে বেশী বেশী প্রার্থনা করত।
এবার আল্লাহ বলেন, তারা কোন জিনিস হ’তে আশ্রয় চায়? ফেরেশতাগণ উত্তর দেন, জাহান্নাম হ’তে। তখন আল্লাহ জিজ্ঞেস করেন, তারা কি জাহান্নাম দেখেছে? ফেরেশতাগণ জওয়াবে বললেন, হে আমাদের রব! আপনার কসম, তারা জাহান্নাম দেখেনি। তখন আল্লাহ বলেন, কেমন হত, যদি তারা উহা দেখত? ফেরেশতাগণ বললেন, যদি তারা উহা দেখত তাহ’লে উহা হ’তে পলায়ন করত এবং বেশী বেশী ভয় পেত। তখন আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদেরকে সাক্ষী করছি, আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘এমন সময় ফেরেশতাগণের একজন বলে উঠেন, অমুক ব্যক্তি তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। সে শুধু তার নিজের কাজে এখানে এসেছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা এমন একদল লোক যাদের কেউই হতভাগ্য নয়’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২২৬৭)।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলা তার বান্দাদের অবস্থা সম্পর্কে সবিশেষ অবগত থাকা সত্ত্বেও আবার মালায়িকাহ্’র নিকট জিজ্ঞেস করলেন এর কারণ হলো, তিনি মালায়িকাহ্’র সামনে বানী আদামের ফাযীলাত সম্পর্কে আলোকপাত করতে ইচ্ছা করেছেন। যেহেতু এ বানী আদমকে সৃষ্টির সময় মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) বলেছিলেন,আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَجۡعَلُ فِیۡهَا مَنۡ یُّفۡسِدُ فِیۡهَا وَ یَسۡفِکُ الدِّمَآءَ ۚ وَ نَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِکَ وَ نُقَدِّسُ لَکَ ؕ قَالَ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ ‘নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান না’ (বাক্বারাহ ২/৩০)।
আয়াতে বর্ণিত ‘খলীফা’ শব্দের অর্থ নির্ণয়ে বিভিন্ন মত এসেছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বলেন, এর অর্থ স্থলাভিষিক্ত হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদের সম্বোধন করে বলছেন যে, আমি তোমাদের ছাড়া এমন কিছু সৃষ্টি করতে যাচ্ছি যারা যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। ইবনে জারীর বলেন, আয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমি যমীনে আমার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ করতে চাই, যে আমার সৃষ্টিকুলের মধ্যে ইনসাফের সাথে আমার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে। আর এ প্রতিনিধি হচ্ছে আদম এবং যারা আল্লাহর আনুগত্য ও আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে তার বিধান প্রতিষ্ঠায় আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত হবে।
কাতাদাহ বলেন, এর অর্থ আল্লাহর জ্ঞানে ছিল যে, এই খলীফার মধ্য হতে নবী-রাসূল, সৎকর্মশীল বান্দা ও জান্নাতী লোক সৃষ্টি হবে। [ইবনে কাসীর] সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ফেরেশতাগণ বান্দার আমল নিয়ে আসমানে আল্লাহর দরবারে পৌছেন, তখন আল্লাহ্ তা’আলা -সবকিছু জানা সত্বেও- প্রশ্ন করেন, আমার বান্দাদেরকে কোন অবস্থায় রেখে এসেছ? তারা সবাই জবাবে বলেন, আমরা গিয়ে তাদেরকে সালাত আদায়রত অবস্থায় পেয়েছি এবং আসার সময় সালাত আদায়রত অবস্থায় রেখে এসেছি। [বুখারী: ৫৫৫, মুসলিম: ৬৩২] কারণ তারা একদল ফজরে আসে এবং আসরে চলে যায় এবং আরেক দল আসরে আসে এবং ফজরে চলে যায়। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাটি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলার দরবারে রাতের আমল দিনের আগেই এবং দিনের আমল রাতের আগেই পৌছে থাকে ”[মুসলিম: হা/১৭৯]
জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে মানব জাতি সম্মানিত। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আ.)-কে শিক্ষা দিয়ে ফেরেশতা মণ্ডলীদের মাঝে শ্রেষ্ঠ্যত্ব তুলে ধরেন। আল্লাহ বলেন, وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ کُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِکَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ هٰۤؤُلَآءِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ‘আর তিনি আদমকে নামসমূহ সব শিক্ষা দিলেন তারপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। সুতরাং বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’ (বাক্বারাহ ২/৩১)। ইবনে আব্বাস, কাতাদাহ ও মুজাহিদ বলেন, যে সমস্ত বস্তুর নাম আদমকে শিখিয়ে দিলেন সে বস্তুগুলো ফেরেশতাদের কাছে পেশ করে তাদের কাছে এগুলোর নাম জানতে চাওয়া হলো। [ইবন কাসীর] জ্ঞান দ্বারা সম্মানিত হওয়ার পর আদম (আঃ) এই দ্বিতীয় সম্মান লাভ করেন। সিজদার অর্থঃ নম্রতা ও বিনয় প্রকাশ করা। আর তার সর্বশেষ পর্যায় হল, মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে দেওয়া। (ক্বুরতুবী) এই সিজদা ইসলামী শরীয়তে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য জায়েয নয়। নবী করীম (সাঃ)-এর প্রসিদ্ধ উক্তি হল, যদি (আল্লাহ ব্যতীত) অন্য কারো জন্য সিজদা করা জায়েয হত, তাহলে আমি মহিলাকে নির্দেশ দিতাম, সে যেন তার স্বামীকে সিজদা করে। তিরমিযী ১০৭৯নং) তবে ফিরিশ্তাগণ আল্লাহর নির্দেশে আদম (আঃ)-কে যে সিজদা করেছিলেন এবং যে সিজদা দ্বারা ফিরিশ্তাদের সামনে তাঁর (আদম)এর সম্মান ও ফযীলত প্রকাশ করা হয়েছিল, সে সিজদা ছিল সম্মান ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে; ইবাদতের ভিত্তিতে নয়।
আলেমগণ আল্লাহকে ভয় করেন এবং ইবাদতে মশগুল হোন। এই জন্য একজন আবেদেরে চেয়ে একজন আলেমের শ্রেষ্ঠ্যত্ব রযেছে। কারণ সাধারণ আবেদ ব্যক্তি দ্বীনের যথেষ্ট জ্ঞান রাখে না; কিন্তু আলেম দ্বীনের যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন এবং তা জীবনে প্রতিপালন করেন। রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِىْ عَلَى أَدْنَى مِنْ أُمَّتِىْ ‘আবেদের উপরে আলেমের মর্যাদা হচ্ছে তোমাদের মধ্যে নিম্নতমের উপরে যেমন আমার মর্যাদা’(তিরমিযী হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, ২১৪; ছহীহুল জামি‘ হা/৪২১৩।)।
কারণ আলেম সমাজ সবচেয়ে বেশী আল্ললাহকে ভয় করেন মর্মে আল্ললাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘নিশ্চয়ই আল্ললাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই তাঁকে বেশী ভয় করে’ (&ফাত্বির ৩৫/৮)। আবূ উমামাহ্ আল বাহিলী (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট দুই ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। এদের একজন ছিলেন ’আবিদ (’ইবাদাতকারী), আর দ্বিতীয়জন ছিলেন ’আলিম (জ্ঞান অনুসন্ধানকারী)। তিনি বললেন, ’আবিদের ওপর ’আলিমের মর্যাদা হলো যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির ওপর। অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তা’আলা, তাঁর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) এবং আকাশমণ্ডলী ও জমিনের অধিবাসীরা, এমনকি পিঁপড়া তার গর্তে ও মাছ পর্যন্ত ’ইলম শিক্ষাকারীর জন্য দু’আ করে।(মিশকাত হা/২১৩,)
বিদ্বান ব্যক্তি আল্লাহ ও আল্লাহর সম্মান এবং তাঁর বড়ত্ব সম্পর্কে বেশি জানার কারণে তার ঐ বিদ্যা অন্তরে ভয় সঞ্চার করে এবং ভয় তাক্বওয়ার জন্ম দেয়, পরিশেষে তাক্বওয়া ব্যক্তিকে মর্যাদাবান করে। হাদীস থেকে আরো বুঝা যায়, যে ব্যক্তির ‘আমল আল্লাহভীতিতে পূর্ণ হবে না সে মূর্খের ন্যায় বরং মূর্খই।