দুই. ক্রোধ রিপু
ক্রোধ শব্দের প্রতিশব্দ হলো রাগ বা রোষ। কেবল মানুষই নয় প্রাণী মাত্রই ক্রোধ আছে। ক্রোধ শক্তি একজন মানুষকে অন্যজন থেকে আলাদা হ’তে সহায়তা করে। তবে ক্রোধের রয়েছে বহুবিধ গতি, প্রকৃতি। ‘কুল লক্ষণ’ বা একই জাতীয় অনেকগুলো গুণ আছে। সৎকুলের নয়টি গুণ রয়েছে। গুণগুলো হলো-আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, আবৃত্তি, তপস্যা ও দান। আসলে ক্রোধান্ধ একজন মানুষের পক্ষে বোধকরি উপরে বর্ণিত নয়টি গুণের একটিতেও সফল হওয়া সম্ভব নয়। কারও মধ্যে এ গুণগুলো অনুপস্থিত থাকলে প্রকৃত প্রস্তাবেই সে আসল মানুষ থাকতে পারে না। ক্রোধান্ধ মানুষের বিবেক বুদ্ধি থাকলেও তা সে কাজে লাগাতে ব্যর্থ। কিন্তু ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তার মধ্যে শিষ্টাচার, ভদ্রতা, বিদ্যা, আত্মপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফলতা অর্জিত হ’তে পারে। তবে কথায় বলে-‘রাগ আছে যার বাগ আছে তার’। আসলে কথাটি বিশেষভাবে অর্থবহ। কারণ মানুষের রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক বা স্বভাবজাত বিষয়। তাই মানুষকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও রাখতে হবে। এ রাগ রাগান্ধ রাগ নয়। রাগান্ধ রাগ বা ক্রোধ মানব জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও কল্যাণে অপ্রতিদ্বন্দী শত্রু বলে বিবেচিত হয়।
ক্রোধ বা রাগ অত্যন্ত নিন্দনীয় আচরণ ও মানুষের খারাপ গুণের অন্যতম। রাগের কারণে মানুষ যে কোন অন্যায় করতে পারে। আর রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। কোন মানুষ যখন রাগান্বিত হয়ে উঠে, তখন তার আপাদমস্তক এমনকি শিরা-উপশিরায় এমন উত্তেজনা বিরাজ করে, যেন সে একটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। একারণে রাগান্বিত অবস্থায় সে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে এবং ন্যায়-নীতির সীমা অতিক্রম করে। এ কারণেই ইসলামী শরী‘আত ক্রোধকে মন্দ স্বভাব বলে আখ্যায়িত করেছে। সৃষ্টির উপাদানগত বৈশিষ্ট্যের কারণে পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে মানব শরীরে রাগ আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেহেতু রাগ একটি ক্ষতিকর অভ্যাস, তাই একে সংবরণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলল, আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, لاَ تَغْضَبْ فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ لاَ تَغْضَبْ. ‘তুমি রাগ করো না। সে লোকটি কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করল। তিনি প্রতিবারেই বললেন, ‘তুমি রাগ করো না’।[1]
ক্রোধ সংবরণের ক্ষেত্রে নিম্নের হাদীছটি সুস্পষ্ট। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ঐ ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় পরাভূত করে। বস্ত্তত সেই প্রকৃত বীর, যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করতে পারে’।[2]
আবু যার (রাঃ) বর্ণিত অপর এক হাদীছে ক্রোধ সংবরণের কৌশল হিসাবে বলা হয়েছে, إِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ وَهُوَ قَائِمٌ فَلْيَجْلِسْ فَإِنْ ذَهَبَ عَنْهُ الْغَضَبُ وإِلاَّ فَلْيَضْطَجِعْ. ‘যখন তোমাদের কেউ ক্রুদ্ধ হবে তখন দাঁড়িয়ে থাকলে সে যেন বসে যায়। এতেও যদি তার রাগ দূর না হয় তাহ’লে সে যেন শুয়ে পড়ে’।[3]
ক্রোধ সংবরণ করার ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ كَظَمَ غَيْظًا وَهُوَ قَادِرٌ أَنْ يُّنَفِّذَهُ، دَعَاهُ اللهُ عَلَى رُوُؤْسِ الْخَلاَئِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ فِىْ أَىِّ الْحُوْرِ شَاءَ. ‘যে ব্যক্তি বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রাগ চেপে রাখে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টজীবের সামনে তাকে আহবান করে যে কোন হূর নিজের জন্য পসন্দ করার অধিকার দিবেন’।[4]
অন্য হাদীছে এসেছে, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন ব্যক্তির রাগ দমন করার চেয়ে আল্লাহর নিকট বড় প্রতিদান আর নেই’।[5] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দু’ব্যক্তি ঝগড়া করার সময় একজনের রাগান্বিত হওয়া ও চেহারা লাল হয়ে যাওয়া দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنِّىْ لَأَعْرِفُ كَلِمَةً لَوْ قَالَهَا لَذَهَبَ عَنْهُ الَّذِىْ يَجِدُ: أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. ‘আমি এমন একটি বাক্য জানি, যদি সে তা বলে তাহ’লে তার রাগ দূর হয়ে যাবে। সেটি হ’ল- ‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম’- ‘আমি বিতাড়িত শয়তানের কাছ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি’।[6] অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَإِذَا غَضِبْتَ فَاسْكُتْ. ‘যখন তুমি ক্রুদ্ধ হবে তখন চুপ থাকবে’।[7]
মন্দকে মোকাবিলা করতে হবে উত্তম দ্বারা। ক্রোধকে মোকাবেলা করতে হবে বিনয় ও বিনম্রতার মাধ্যমে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُوْنَ ‘মন্দের মোকাবিলা কর যা উত্তম তা দ্বারা; তারা যা বলে আমরা সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত’ (মুমিনূন ২৩/৯৬)। একজন মুসলমানের উচিত রাগান্বিত অবস্থায় সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া। ক্রোধ দূর করতে হ’লে হ’তে হবে বিনয়ী ও নম্র। কারা বিনয়ী সে সম্পর্কে আবু যায়েদ বিসত্বামী (রহঃ) বলেন, هو أن لا يرى لنفسه مقامًا ولا حالاً، ولا يرى في الخلق شرًا منه ‘বিনয়ী হ’ল নিজের জন্য কোন অবস্থান মনে না করা এবং সৃষ্টি জগতে নিজের চেয়ে অন্যকে অবস্থান ও অবস্থায় নিকৃষ্ট মনে না করা’।
ইবনু আতা বলেন, هو قبول الحق ممن كان العز في التواضع، فمن طلبه في الكبر فهو كطلب الماء من النار ‘যে কোন ব্যক্তি থেকে সত্যকে গ্রহণ করা। সম্মান হ’ল নম্রতায়। যে ব্যক্তি অহংকারে তা তালাশ করবে, তা হবে আগুন থেকে পানি তালাশ তুল্য’।[8]
মানুষের সাথে আচার-আচরণে নম্রতা অবলম্বনের বিষয়ে মহান আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ. ‘আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে; যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হ’তে, তবে তারা তোমার আশ-পাশ হ’তে দূরে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর কোন সংকল্প করলে আল্লাহর উপর ভরসা কর। ভরসাকারীদের আল্লাহ ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
আল্লাহ রাববুল আলামীন ধীর-স্থিরতা ও নম্রতা অবলম্বন পূর্বক সংযত হয়ে চলাফেরা করার জন্য মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَاقْصِدْ فِيْ مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ- ‘সংযত হয়ে চলাফেরা করো এবং তোমার কণ্ঠস্বরকে সংযত রাখো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর’ (লোক্বমান ৩১/১৯)। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ. ‘তুমি তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হও’ (শু‘আরা ২৬/২১৫)।
ক্রোধকে সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং যা কিছু বলার তা বিনয়ের সাথে বলতে হবে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, ইহুদীরা নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, ‘আসসামু আলাইকা’ ‘আপনার মৃত্যু হোক’। উত্তরে তিনি বললেন, ওয়ালাইকুম। তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, তোমাদের মৃত্যু হোক, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ করুন এবং তোমাদের উপর রুষ্ট হোন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আয়েশা! থাম, নম্রতা অবলম্বন করো, কঠোরতা ও অশালীনতা পরিহার করো’।[9]
অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَإِنَّ اللهَ أَوْحَى إِلَىَّ أَنْ تَوَاضَعُوْا حَتَّى لاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلاَ يَبْغِىْ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ ‘আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি অহী করেছেন যে, তোমরা পরস্পর বিনয় প্রদর্শন করবে, যাতে কেউ কারো উপর বাড়াবাড়ি ও গর্ব না করে’।[10]
মহান আল্লাহ বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষদের পসন্দ এবং তাদের প্রশংসা করে বলেন, وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْناً وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَقِيَاماً، وَالَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَاماً، إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرّاً وَمُقَاماً-‘দয়াময় আল্লাহর বান্দা তো তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’। আর যারা রাত্রি অতিবাহিত করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত থেকে ও দন্ডায়মান হয়ে এবং যারা বলে, হে আমার প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত কর, নিশ্চয়ই এর শাস্তি নিশ্চিত বিনাশ। নিশ্চয়ই তা অবস্থান ও আবাসস্থল হিসাবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩-৬৬)। বিনয় ও নম্রতা মুমিনের গুণাবলীর অন্যতম মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْمُؤْمِنُ غِرٌّ كَرِيْمٌ وَالْفَاجِرُ خِبٌّ لَئِيْمٌ ‘মুমিন ব্যক্তি নম্র ও ভদ্র হয়। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়’।[11]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ. ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকের সংবাদ দিব না? আর তারা হ’ল সরলতার দরুণ দুর্বল, যাদেরকে লোকেরা হীন, তুচ্ছ ও দুর্বল মনে করে। তারা কোন বিষয়ে কসম করলে আল্লাহ তা সত্যে পরিণত করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সংবাদ দিব না? আর তারা হ’ল প্রত্যেক অনর্থক কথা নিয়ে ঝগড়াকারী, বদমেযাজী ও অহংকারী’।[12]
বিনয়ী, কোমলতা ও নম্রতা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক গুণ বিশেষ। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। আর তিনি কোমলতার প্রতি যত অনুগ্রহ করেন, কঠোরতা বা অন্য কোন আচরণের প্রতি ততটা অনুগ্রহ করেন না’।[13] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে বলেছেন, ‘কোমলতা নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা হ’তে নিজেকে বাঁচাও। কারণ যাতে নম্রতা ও কোমলতা থাকে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়। আর যাতে কোমলতা থাকে না, তা দূষণীয় হয়ে পড়ে’।[14]
মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَلاَ تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلاَ السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ ‘ভাল ও মন্দ সমান হ’তে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يَسِّرُوْا وَلاَ تُعَسِّرُوْا، وَسَكِّنُوْا وَلاَ تُنَفِّرُوْا ‘তোমরা নম্র হও, কঠোর হয়ো না। শান্তি দান কর, বিদ্বেষ সৃষ্টি করো না’।[15]
বস্ত্ততঃ বিনয় ও নম্রতার উপকারিতা অনেক বেশী। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ. ‘হে আয়েশা! আল্লাহ তা‘আলা নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পসন্দ করেন। তিনি নম্রতার দরুন এমন কিছু দান করেন যা কঠোরতার দরুন দান করেন না; আর অন্য কোন কিছুর দরুনও তা দান করেন না’।[16] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ ‘যে বান্দাহ আল্লাহর জন্য বিনীত হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন’।[17] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,اللَّهُمَّ مَنْ وَلِىَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِى شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ فَاشْقُقْ عَلَيْهِ وَمَنْ وَلِىَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِى شَيْئًا فَرَفَقَ بِهِمْ فَارْفُقْ بِهِ. ‘হে আল্লাহ! যে আমার উম্মাতের কোনরূপ কর্তৃত্বভার লাভ করে এবং তাদের প্রতি রূঢ় আচরণ করে তুমি তার প্রতি রূঢ় হও, আর যে আমার উম্মাতের উপর কোনরূপ কর্তৃত্ব লাভ করে তাদের প্রতি নম্র আচরণ করে তুমি তার প্রতি নম্র ও সদয় হও’।[18]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ تَرَكَ اللِّبَاسِ تَوَاضُعًا لِلَّهِ وَهُوَ يَقْدِرُ عَلَيْهِ دَعَاهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى رُءُوسِ الْخَلاَئِقِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ مِنْ أَىِّ حُلَلِ الإِيْمَانِ شَاءَ يَلْبَسُهَا. ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিনয়বশত মূল্যবান পোশাক পরিধান ত্যাগ করবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সকল সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং ঈমানের পোশাকের মধ্যে যে কোন পোশাক পরার অধিকার দিবেন’।[19]
বিনয় ও নম্রতার উপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ حُرِمَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ. ‘যাকে নম্রতার কিছু অংশ প্রদান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণের অংশ প্রদান করা হয়েছে। আর যাকে সেই নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত করা হয়েছে’।[20]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, إن الله إذا أحب أهل بيت أدخل عليهم الرفق ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোন গৃহবাসীকে ভালবাসেন, তখন তাদের মাঝে নম্রতা প্রবেশ করান’।[21]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ما أعطي أهل بيت الرفق إلا نفعهم ولا منعوه إلا ضرهم ‘আল্লাহ কোন গৃহবাসীকে নম্রতা দান করে তাদেরকে উপকৃতই করেন। আর কারো নিকট থেকে তা উঠিয়ে নিলে তারা ক্ষতিগ্রস্থই হয়’।[22]
তিনি আরো বলেন, إن الله عز وجل ليعطي على الرفق ما لا يعطي على الخرق، وإذا أحب الله عبدا أعطاه الرفق، ما من أهل بيت يحرمون الرفق إلا حرموا الخير ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নম্রতার মাধ্যমে যা দান করেন, কঠোরতার কারণে তা করেন না। আল্লাহ কোন বান্দাকে ভালবাসলে তাকে নম্রতা দান করেন। কোন গৃহবাসী নম্রতা পরিহার করলে, তারা কেবল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়’।[23]
মহান আল্লাহ বিনয়ীদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন। তিনি আরো বলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَلَى النَّارِ أَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّارُ عَلَى كُلِّ قَرِيْبٍ هَيِّنٍ لَيِّنٍ سَهْلٍ ‘আমি কি তোমাদেরকে জানাব না যে, কারা জাহান্নামের জন্য হারাম বা কার জন্য জাহান্নাম হারাম করা হয়েছে? জাহান্নাম হারাম আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী প্রত্যেক বিনয়ী নম্র লোকের জন্য’।[24]
তিনি আরো বলেন, إن الله عز وجل ليعطي على الرفق ما لا يعطي على الخرق، وإذا أحب الله عبدا أعطاه الرفق، ما من أهل بيت يحرمون الرفق إلا حرموا الخير ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নম্রতার মাধ্যমে যা দান করেন, কঠোরতার কারণে তা করেন না। আল্লাহ কোন বান্দাকে ভালবাসলে তাকে নম্রতা দান করেন। কোন গৃহবাসী নম্রতা পরিহার করলে, তারা কেবল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়’।[25]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিনয় ও নম্রতার অনুপম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, أَنَّ أَعْرَابِيًّا بَالَ فِى الْمَسْجِدِ، فَثَارَ إِلَيْهِ النَّاسُ لِيَقَعُوا بِهِ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم دَعُوهُ، وَأَهْرِيقُوا عَلَى بَوْلِهِ ذَنُوبًا مِنْ مَاءٍ أَوْ سَجْلاً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ، وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِينَ. ‘একবার এক আরব বেদুঈন মসজিদে প্রস্রাব করে দিল। তখন লোকজন তাকে শাসন করার জন্য উত্তেজিত হয়ে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, তাকে প্রস্রাব করতে দাও এবং তার প্রস্রাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কারণ তোমাদেরকে নম্র ব্যবহারকারী হিসাবে পাঠানো হয়েছে, কঠোর ব্যবহারকারী হিসাবে নয়’।[26]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অভূতপূর্ব বিনয়-নম্রতায় বেদুঈন এতটাই বিমুগ্ধ হ’ল যে, সে সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম কবুল করল এবং ছালাতে দাঁড়িয়ে দো‘আ করতে লাগল যে, اللَّهُمَّ ارْحَمْنِىْ وَمُحَمَّدًا، وَلاَ تَرْحَمْ مَعَنَا أَحَدًا ‘হে আল্লাহ! আমার ও মুহাম্মাদের প্রতি দয়া করো এবং আমাদের সঙ্গে আর কারো প্রতি দয়া করো না’। সালাম ফিরানোর পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, لَقَدْ حَجَّرْتَ وَاسِعًا ‘তুমি একটি প্রশস্ত বিষয় সংকুচিত করলে অর্থাৎ আল্লাহর অসীম অনুগ্রহকে সংকুচিত করে ফেললে’।[27]
পরিশেষে বলতে হয় ক্রোধ রিপু মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটি মানুষের জীবনে অনেক বিপদ ডেকে আনে। যখন কোন অন্তরে ক্রোধ প্রবেশ করে, তখন তার অন্তর থেকে তাক্বওয়া দূর হয়ে যায়। মানুষ যখন ক্রুদ্ধ হয়, তখন সে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলে। ফলে তার মধ্যে পরহেযগারিতা অবশিষ্ট থাকে না।
সুতরাং ক্রোধ রিপু মানুষের জন্য চরম শত্রুও বটে। পারিপার্শ্বিক ও বহিঃজগতের যেকোন শত্রু এর কাছে হার মানতে বাধ্য। জাগতিক জীবনে প্রত্যেকের এ কাম শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বিনয় ও নম্রতা দিয়ে। তবেই অর্জিত হবে সুখী, সমৃদ্ধি ও আদর্শ সংসার জীবন।
ক্রোধ রিপু প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে থাকতে হবে কিন্তু তা হবে নিয়ন্ত্রিত। নিয়ন্ত্রিত রিপু ঔষুধের মত কাজ করে এবং তা যথাস্থানে প্রয়োগ করে থাকে। আর অনিয়ন্ত্রিত রিপু নিশা জাতীয় দ্রব্যের মত মাতাল করে এবং তা অপচয় করে ও অপাত্রে প্রয়োগের ফলে ক্রিয়া না করে প্রতিক্রিয়াতে পরিণত হয়। সুতরাং হে মানব সমাজ! রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করো, সুখী-সমৃদ্ধি জীবন গড়ো। (চলবে)
[ লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী]
[1]. বুখারী হা/৬১১৬; মুসলিম হা/২৪৪৯; মিশকাত হা/৫১০৪।।
[2]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা/৫১০৫।
[3]. আহমাদ, তিরমিযী, আবূদাঊদ হা/৪৭৮২, মিশকাত, হা/৫১১৪, হাদীছ ছহীহ।
[4]. ইবনু মাজাহ হা/৪১৮৬; তিরমিযী হা/২০২১; সিলসিলা ছহীহা হা/১৭৫০, হাদীছ ছহীহ।
[5]. ইবনু মাজাহ, হা/৪১৮৯, আহমাদ, মিশকাত হা/৫১১৬, হাদীছ ছহীহ।
[6]. বুখারী হা/৬১১৫; মুসলিম হা/২৬১০ ‘সদ্ব্যবহার ও শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করতে পারে তার ফযীলত ও কিসের দ্বারা রাগ দূরীভূত হয়’ অনুচ্ছেদ।
[7]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১৩২০; সিলসিলা ছহীহা হা/১৩৭৫, হাদীছ ছহীহ লি-গায়রিহি।
[8]. হাফিয ইবনুল ক্বাইয়িম জাওযিইয়া, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারম্নল কিতাবিল আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৪১৬ হিঃ/১৯৯৬ খ্রীঃ), ২/৩১৪ পৃঃ।
[9]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৪৩২ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়।
[10]. মুসলিম হা/২৮৬৫; আবুদাঊদ হা/৪৮৯৫; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭২৫; ছহীহাহ হা/৫৭০।
[11] . তিরমিযী হা/১৯৬৪; মিশকাত হা/৫০৮৫।
[12]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৬।
[13]. মুসলিম হা/২৫৯৩; মিশকাত হা/৫০৬৮।
[14]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫০৬৮।
[15]. বুখারী হা/৬১২৫।
[16]. মুসলিম হা/২৫৯৩; মিশকাত হা/৫০৬৮।
[17]. মুসলিম হা/২৫৮৮।
[18]. মুসলিম হা/১৮২৮; মিশকাত হা/৩৬৮৯।
[19]. তিরমিযী হা/২৪৮১; ছহীহাহ হা/৭১৮।
[20]. তিরমিযী হা/২০১৩; মিশকাত হা/৫০৭৬; ছহীহাহ হা/৫১৯।
[21]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৩, ১৭০৩; সিলসিলা ছহীহা ২/৫২৩।
[22]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৪২।
[23]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৬৬৬।
[24]. তিরমিযী হা/২৪৮৮; ছহীহাহ হা/৯৩৮।
[25]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৬৬৬।
[26]. বুখারী হা/৬১২৮, ৬০২৫; মুসলিম হা/১৮৪।
[27]. বুখারী হা/৬০১০।