সংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠান : কল্যাণকর

প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় প্রতিযোগীতা নয়, বরং মান-সম্মত  পরিবেশ ও শিক্ষা চাই।

সালাফী বা আহলুল হাদীছদের সমাজ সংস্কারমূলক যে কার্যক্রম ও বিশ্বাস তা হ’ল- ‘আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ হ’ল অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত মানদন্ড। উক্ত অহি-র সত্যকে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে প্রতিষ্ঠা করা ও সেই আলোকে সমাজের আমূল সংস্কার সাধন করা। আর সেই লক্ষ্যে শিক্ষা সংস্কার অতিব জরুরী। কেননা জান্নাতের সে-ই মানুষ হতে হলে নৈতিক তথা দ্বীনের তথা কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা অপরিহার্য।

প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যে কাজটির প্রতি বেশী জোর দেয়া উচিৎ তা হ’ল- উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন, যোগ্য, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক জনশক্তি তৈরী করাই হবে শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্য। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের প্রথম দায়িত্ব হ’ল : তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক জাতীয় শিক্ষানীতি নির্ধারণ করা।

উক্ত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের মৌলিক কর্মসূচী নিম্নরূপ :

(ক) দেশে প্রচলিত ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বিমুখী ধারাকে সমন্বিত করে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক একক ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা এবং সরকারী ও বেসরকারী তথা কিন্ডার গার্টেন, প্রি-ক্যাডেট, ও-লেভেল ইত্যাদি নামে পুঁজিবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে বৈষম্যহীন ও সহজলভ্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা।

(খ) ছেলে ও মেয়েদের পৃথক শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে উভয়ের জন্য উচ্চ শিক্ষা এবং পৃথক কর্মক্ষেত্র ও কর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণ করা।

(গ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবতীয় দলাদলি ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকান্ড নিষিদ্ধ করা এবং প্রয়োজনবোধে সেখানে বয়স, যোগ্যতা ও মেধাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

(ঘ) আক্বীদা বিনষ্টকারী সকলপ্রকার সাহিত্য ও সংস্কৃতি বর্জন করা এবং তদস্থলে ছহীহ আক্বীদা ও আমল ভিত্তিক সাহিত্য ও সংষ্কৃতি চালু করা।

আমার ব্যক্তিগত মতামত, শিক্ষা বিস্তারের জন্য যেমন মারকায বা মাদ্রাসা বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন অনুরূপ ভালো শিক্ষকও। শিক্ষক ব্যতীত ছাত্র গড়ে উঠেনা যেমন অনুরূপ ভাল পরিবেশ ব্যতীত ভাল শিক্ষার্থীও তৈরী হয় না। শিক্ষা বিস্তারের উভয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে হ্যা-

🛑 শিক্ষা যখন বিনিময়ের মাধ্যমে প্রদান করা হয়, তখন সেই শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ বিনিময় অর্জনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তা গ্রহণ করে। তখনই শিক্ষা আর শিক্ষা থাকে না। বাণিজ্যিক শিক্ষাতে পরিগণিত হয়। তাই বাধ্য হয়ে বলতে হয়, সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।

🛑 ইলম অর্জন করলেই সুশিক্ষিত হওয়া যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না বিবেক জাগ্রত হয়। তাই পণ্ডিত ব্যক্তি বলেন, বিবেক যেখানে উপস্থিত, সুখ সেখানে তিরোহিত। আর সুখ যেখানে উপস্থিত বিবেক সেখানে তিরোহিত।

🛑 আবার অধিক ইলম অর্জনের প্রতিযোগীতা কাম্য তবে তা হতে হবে তাক্বওয়া ও সঠিক বুঝের তথা সালাফে সালেহীনদের বুঝ অনুসারে দ্বীন তথা কুরআন-সুন্নাহ অনুধাবন করতে হবে।

🛑 করণীয় ও বর্জনীয়:

(১) প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় প্রতিযোগীতা নয়, বরং মান-সম্মত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন!

(২) প্রতিষ্ঠানে দ্বীনি পরিবেশ তৈরী করে অহী ভিত্তিক শিক্ষা প্রদান করুন!

(৩) শিক্ষার্থীদের মনে দ্বীনের আলোকে দুনিয়া ও আখেরাত অর্জনের মানসিকতা গড়ে তুলুন!

(৪) দুস্থ ও ইয়াতীম এবং অসহায়দের প্রতি সহায়ক হোন!

(৫) প্রতিষ্ঠান আয়ের উৎস মনে করে শিক্ষার্থীদের প্রতি যুলুম বন্ধ করুন!

(৬) সালাফীদের মত শিক্ষক কেন্দ্রীক ক্লাস সিস্টেম গড়ে তুলুন।

জ্ঞানার্জনে প্রথমে কুরআন শিক্ষা করা :

কুরআন শিক্ষার করার মাধ্যমে একজন ইলম অর্জনকারীর শিক্ষাজীবন শুরু করা উচিৎ। কেননা অগ্রগণ্য ও অগ্রবর্তীতার ক্ষেত্রে এটা মহিমান্বিত জ্ঞান। তারপর আল্লাহ যদি তাকে কুরআন হিফয করার তাওফীক্ব দান করেন, তাহ’লে তার উচিত হবে না সাথে সাথেই হাদীছ অথবা এমন কোন জ্ঞান আহরণে মশগূল হয়ে পড়া, যা তাকে কুরআন ভুলে যাওয়ার দিকে ঠেলে দিবে। কুরআন মুখস্থের পর শিক্ষার্থী রাসূলের হাদীছের প্রতি মনোনিবেশ করবে। কারণ মানুষের কর্তব্য হ’ল হাদীছের জ্ঞান অর্জন করা। কেননা হাদীছ শরী‘আতের অন্যতম মৌলিক উৎস ও ভিত্তি। এ সম্পর্কে ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘শিক্ষাজীবনের শুরুতে সর্বপ্রথম কুরআন মুখস্থ করতে হয়। কেননা কুরআনই সর্বাধিক গুরুতবপূর্ণ জ্ঞান। সালাফগণ কেবলমাত্র তাদেরকেই হাদীছ ও ফিক্বহ শিক্ষা দিতেন, যাদের কুরআন মুখস্থ থাকত (আল-মাজমূ‘ ১/৬৯ পৃ.)।

হাফেয ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) বলেন, فَأَوَّلُ الْعِلْمِ حِفْظُ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘জ্ঞানের প্রথম ধাপই হ’ল মহান আল্লাহর কিতাব ‘আল-কুরআন’ মুখস্থ করা’।(জামি‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, ২/১১৩০ পৃ.)

প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বালেগ হওয়ার পূর্বেই কুরআন হিফয করা উচিৎ। অন্যত্র তিনি বলেন, وَتَفَهُّمُهُ وَكُلُّ مَا يُعِيْنُ عَلَى فَهْمِهِ فَوَاجِبٌ طَلَبُهُ مَعَهُ، ‘কুরআন বুঝা এবং অনুধাবনের জন্য সহায়ক সকল জ্ঞান অর্জন করাও আবশ্যক’।(জামি‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, ২/১১৩০ পৃ.)
ইবনুল মুফলিহ (রহঃ) বলেন, মায়মুনী বলেছেন, ‘আমি আবু আব্দুল্লাহ (ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, আমি আমার সন্তানকে আগে কুরআন শিক্ষা দিব নাকি হাদীছ শিক্ষা দিব? এই দুই পদ্ধতির মধ্যে কোনটা আপনার নিকট বেশী পসন্দনীয়? তখন তিনি বললেন, না, বরং আগে কুরআন শিখাও। আমি বললাম, পুরা কুরআনই কি শিখাব? তিনি বললেন, যদি কঠিন না হয়, তাহ’লে পুরা কুরআনই শিখাও, তাহ’লে সে কুরআন থেকে আস্তে আস্তে জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে। তারপর তিনি আমাকে বললেন, যদি সে প্রাথমিকভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে, তাহ’লে তাকে নিয়মিত তেলাওয়াতে অভ্যস্ত করবে। ইমাম আহমাদের অনুসারীরা আমাদের যুগ পর্যন্ত পাঠদানের ক্ষেত্রে এই নীতিমালাই অনুসরণ করে এসেছেন’।(আল-আদাবুশ শারঈয়্যাহ ২/৩৫ পৃ.।)
দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন। এর কোন বয়স বা সময়সীমা নেই। জীবনের দীর্ঘ সময় এ পথে ব্যয় করতে হবে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞানার্জন করতে হবে। তবেই জ্ঞানের সকল শাখায় বিচরণ করা সম্ভব হবে এবং পরিপক্ক জ্ঞানী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। হাসান বিন মানছূর আল-জাসসাস বলেন, আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত বছর পর্যন্ত একজন মানুষ লেখা পড়া শিখবে? তিনি বললেন, মৃত্যু পর্যন্ত’।(ত্বাবাকাতুল হানাবিলাহ ১/১৪০ পৃ.।)
আর সমাজে নেতৃত্ব দিতে হ’লে সর্বপ্রথম জ্ঞানার্জন করা আবশ্যক। ওমর (রাঃ) বলেন, تَفَقَّهُوْا قَبْلَ أَنْ تُسَوَّدُوْا ‘নেতৃত্ব দেওয়ার পূর্বে তোমরা বিদ্যা অর্জন কর’। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, ‘নেতা হওয়ার পরেও তোমরা বিদ্যা অর্জন করতে থাক। নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ তো বৃদ্ধ বয়সে বিদ্যা শিখেছেন’।(বুখারী তালীকান ১/৩৯ পৃ.।)

আল্লাহ আমাদের আকাংখাকে কবূল করুন এবং দ্বীনের সঠিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে প্রজ্ঞা ও হেকমাত দান করুন, আমীন। ‘আল্লাহুম্মা ফাক্বকীহহু ফীদ দ্বীন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top