প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব………..
সংস্কার ও কুসংস্কার পাশাপাশি চলে। কুসংস্কার হয় শয়তানের পক্ষ থেকে এবং সংস্কার হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। উভয় পক্ষে লোক থাকে। কুসংস্কার অত্যন্ত লোভনীয় ও চাকচিক্যপূর্ণ। ফলে সেখানে লোক বেশী থাকে। যাদের চাপে সংস্কার চাপা পড়ে যায়। আল্লাহর বিশেষ রহমতে যুগে যুগে একদল সাহসী সংস্কারবাদী মানুষ ঝুঁকি নিয়ে সংস্কার কার্যে আত্মনিয়োগ করেন। এই সংস্কার যাতে সঠিক পথে পরিচালিত হয়, সেজন্য আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। যারা তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের ভিত্তিতে সমাজ সংস্কারের পথ দেখিয়েছেন। শুরুতেই তাদের একদল নিষ্ঠাবান সহযোগী ছিলেন। নবী বা সংস্কারকের মৃত্যুর পর যথার্থ উত্তরসূরী না থাকায় সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই দুর্বল হয়ে যায়। ফলে কুসংস্কার পুনরায় বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সমাজ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। তখন প্রয়োজন দেখা দেয় সংস্কারকের। আল্লাহর রহমত হলে পুনরায় বিশুদ্ধ দ্বীনের সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটে। এভাবেই চলে অন্ধকার সমাজকে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলোকিত সমাজে পরিণত করার ঝুঁকিপূর্ণ প্রচেষ্টা। শুরুতে তাকে একাই ঝুঁকি নিতে হয়। পরে যখন লোকেরা তার কাছে জমা হ’তে থাকে, তখনই তাদের বিরুদ্ধে বিরোধীরা সংগঠিত হয় এবং সংস্কারবাদী আন্দোলনকে অংকুরে বিনাশ করতে চায়। এভাবেই সর্বদা সংখ্যাগুরু কুসংস্কারবাদীদের সঙ্গে বিশুদ্ধ ইসলামী সংস্কারবাদীদের সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে যুগ যুগ ধরে। আল্লাহর পথে কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে জিহাদকারী ব্যক্তি হবেন জান্নাতী। এর বিপরীতে শয়তানের পথে সংগ্রামকারীরা হবে জাহান্নামী। একই সাথে আল্লাহর পথে জিহাদের নামে কপট বিশ্বাসীরাও হবে জাহান্নামী। বরং তারা জাহান্নামের সর্ব নিম্নস্তরে থাকবে। ইসলামী সংস্কার আন্দোলনে এরাই হ’ল অন্তর্ঘাতী। প্রত্যেক নবী-রাসূলকে এদের অনিষ্টকারিতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। আর সেজন্যেই সমাজ সংস্কারের পথ কখনই কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
বালাকোট (৬ই মে ১৮৩১), বাঁশের কেল্লা (১১ই নভেম্বর ১৮৩১), ছাদেকপুর-পাটনার ইতিহাস (নভেম্বর ১৮৬৪) বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃংখল ভাঙার ইতিহাস এবং একই সাথে সমাজের পুঞ্জীভূত কুসংস্কার সমূহের বিরুদ্ধে আপোষহীন জিহাদের ইতিহাস। মানুষের সার্বভৌমত্বের উর্ধ্বে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। ধর্ম ও সমাজনেতাদের মনগড়া বিধান সমূহের বিরুদ্ধে অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। স্ব স্ব যুগের বাধার বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে তারা কুরআন ও সুন্নাহর অভ্রান্ত সত্যের ঝান্ডাকে উড্ডীন করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে ইয়াসির পরিবার, আম্মার, খাববাব, খোবায়েব, যায়েদ বিন দাছেনাহর ন্যায় অসংখ্য ছাহাবীর খুনরাঙা পথ বেয়ে এসেছিল জাহেলী আরবের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে অহি-র আলোয় উদ্ভাসিত স্বাধীন মানবীয় সমাজ।
আধুনিক ইতিহাসে পৃথিবীর কোণে কোণে যেখানেই ইসলামের সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেখানেই জাহেলিয়াতের পুচ্ছধারীরা নানাবিধ মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে দমন করার কুট কৌশল অবলম্বন করেছে। বৃটিশ ভারতে যেভাবে মিথ্যা অপবাদ, ঘুষ ও ভেদনীতির মাধ্যমে জিহাদ আন্দোলন ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের সংস্কারবাদী নেতাদের বিরুদ্ধে জনমতকে ক্ষেপিয়ে আন্দোলনকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। অদ্যাবধি একই কৌশল সর্বত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তুরস্কের সমাজ সংস্কারক বদীউযযামান সাঈদ নূরসী (১৮৭৭-১৯৬০) যখন ১১টি মিথ্যা মামলায় সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হন, তখন সামরিক আদালতের সভাপতি তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি শরী‘আত চান? যদি চান তাহ’লে জানালা দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলানো ঐ ১৫টি ঝুলন্ত লাশ গুলির দিকে তাকান। জবাবে সাঈদ নূরসী বলেন, আমার যদি এক হাযার জীবন থাকত, তাহ’লে আমি তা বিসর্জন দিতে প্রস্ত্তত থাকতাম শরী‘আতের একেকটি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। আমি বিশ্বাস করি ইসলামী শরী‘আত ন্যায়বিচার, উন্নতি ও কল্যাণের উৎস। সেই শরী‘আত প্রতিষ্ঠার জন্য কোন মর্যাদাবান ও সাহসী ব্যক্তি ফাঁসির সামনে মাথা নত করে না। তিনি বলেন, ইসলামী শরী‘আত আমাদেরকে শাসকের প্রতি আনুগত্য বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু আল্লাহর অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই। আমাদের সকল বক্তব্য উপদেশমূলক, বিদ্রোহমূলক নয়। যদি আমাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়, তাহ’লে আমি দুই শহীদের পুরস্কার পাব’। ইসলামের পক্ষে তাঁর এরূপ আপোষহীন বক্তব্যের ফলে যালেমদের হৃদয় টলে যায় এবং আল্লাহর রহমতে তিনি বেকসুর খালাস পান।
ব্রিটিশ কলোনী সচিব ও পরবর্তীতে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন (১৮০৮-১৮৯৮) ৫২ লক্ষ বর্গ কি.মি. ব্যাপী তৎকালীন বিশ্বের ১ নম্বর দেশ, বরং মহাদেশ ওছমানীয় তুর্কী খেলাফতকে পদানত করার জন্য বলেছিলেন, ‘মুসলমানদের হাতে যদি কুরআন থাকে তবে তাদের পদানত করা যাবে না। তাদের উপর বিজয়ী হ’তে হলে হয় কুরআন তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে অথবা কুরআনের প্রতি তাদের ভালবাসার বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে’। এ কথার উত্তরে সাঈদ নূরসী বলেছিলেন ‘কুরআন অমর ও অনির্বাণ সূর্য, যা কখনও মুসলমান তথা কল্যাণকামী মানুষের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়া যাবে না’। অতঃপর তিনি কুরআনের আধুনিক ও মানবিক ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হন এবং সর্বসাকুল্যে প্রায় ৬০০০ পৃষ্ঠার বিশাল গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন। যার মাধ্যমে তিনি তুরস্ককে পাশ্চাত্যকরণ ও ধর্মনিরপেক্ষ করণের বিরুদ্ধে এবং ইসলামের পক্ষে বিশাল জনমত গড়ে তোলেন। ফলে পাশ্চাত্যের লেজুড় কামাল পাশার অনুগামী ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ১৯৩০-১৯৫০-এর মধ্যে তাঁকে কয়েকবার কারা নির্যাতন করে। অতঃপর তিনি ৮৩ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
মনে পড়ে দেড় হাযার বছর পূর্বে সা‘দ বিন খাওলা (রাঃ)-এর মা যেদিন তাকে কসম দিয়ে বলেন, আমি আদৌ খানাপিনা করবো না, যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদের সাথে কুফরী করবে’ (আহমাদ হা/১৬১৪)। ফলে তার গালের মধ্যে লাঠি ভরে ফাঁক করে তরল খাদ্য প্রবেশ করানো হয়। এভাবে তিন দিন পর যখন তার মৃত্যুর উপক্রম হয়, তখন মা বলেন, তুমি অবশ্যই মুহাম্মাদের দ্বীন ছাড়বে। নইলে আমি এভাবেই মরে যাব। তখন লোকেরা তোমাকে বলবে, ‘হে মায়ের হত্যাকারী’! জবাবে আমি বললাম, ‘হে মা! যদি তোমার একশ’টি জীবন হয়, আর এক একটি করে এভাবে বের হয়ে যায়, তবুও আমি আমার এই দ্বীন ছাড়ব না। এখন তুমি চাইলে খাও, না চাইলে না খাও! অতঃপর আমার এই দৃঢ়তা দেখে তিনি খেলেন। তখন আনকাবূত ৮ আয়াত নাযিল হ’ল (কুরতুবী; তিরমিযী হা/৩১৮৯)। বস্ত্তত এভাবেই সমাজের কুসংস্কার দূর হয়েছে। আজও হবে। প্রয়োজন কেবল হকপন্থী সংস্কারক ও আপোষহীন নেতা-কর্মী। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন! (স.স.)