সমাজকে শুধু দোষ দিয়ে নয়, নিজেকে দোষারোপ করুন। নিজেদের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজ প্রতিস্থাপন হতে বাধ্য। ধোঁকাব্যঞ্জকের যুগে মানুষ আজ গুপ্ত শিরকে লিপ্ত এবং নানা রকম অপরাধে অভ্যস্ত। কেননা মানব জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত জীবনকে প্রতিনিয়ত যেমনি শোধরিয়ে দেয় তেমনি আবার কলুষিতও করে থাকে। পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রাণীর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পেছনে যে বিষয়গুলো সদা ক্রিয়াশীল তা হ’ল তার বিবেক, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা।
ক. বিবেক হ’ল মানুষের অন্তর্নিহীত শক্তি যার দ্বারা ন্যায়, অন্যায়, ভালমন্দ, ধর্মাধর্ম বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জিত হয়।
খ. বুদ্ধি হ’ল তার ধীশক্তি বা বোধশক্তি, যার দ্বারা জীবন ও জগতে সংঘটিত যাবতীয় ক্রিয়াকলাপে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার বিজ্ঞানময় দক্ষতা নির্ণীত হয়।
গ. বিচক্ষণতা হ’ল তার দূরদর্শীতা, যার মাধ্যমে মানুষ জীবনে আগত ও অনাগত বিষয়ে পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করে নিজেকে সর্বত্র সাবলীল ও সফল করে তুলতে সক্ষম হয়।
ঘ. নিয়ন্ত্রণ হ’ল সংযমন, যার দ্বারা মানুষ তার জীবনের সর্বত্র সংযত ও শৃংখলিত জীবনবেদ অনুধাবনে সক্ষম হয়।
সমাজ অধঃপতনের মূলে ষড় রিপুর আধিক্যতা কাজ করছে। লোভ-ললসা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, কামনা-বাসনা, ক্রোধ বা রাগ ও মোহ বা অধিক প্রীতি। এগুলোর সমন্বয় হলেই তবে সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। আর এগুলো সমন্বয় হবে প্রকৃত জ্ঞীনীদের কাছে। কিন্তু সাধারণ জ্ঞানীরা রিয়া বা আত্মপ্রচারে ব্যতিব্যস্ত। প্রকৃত জ্ঞানীরা সম্মান হারানোর ভয়ে আজ নিরব হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ আজ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত তবে তা দুনিয়া নিয়ে। আর আলেম সমাজর অনুরূপ ব্যস্ত। আমাদের অনুসরণীয় নেতা মুহাম্মাদ (ছা.) নিজে মিসকিন থাকার প্রতি উৎসাহিত হয়ে আল্লাহ নিকটে দোআ করেছেন যেন তাঁকে মিসকিন অবস্থান রাখা হয় এবং মিসকিনদের সাথে যেন হাশর-নাশরও হয়। বিদআতীরা যেমন মুখে বিকৃত দুরূদ পাঠ করে নানা অঙ্গ ভঙ্গিমায় রাসূল (ছা.)-এর প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধাদেখানোর নামে বিদআত করে। অনুরূপ বর্তমান সমাজে (ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে) আলেমগণ ইলম অর্জন করছে বক্তৃতা ব্যবসা ও সহজ সরল মানুষের আবেগের অবমূল্যায় করে টাকা খসিয়ে নিজে ধনী হওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছা.) দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে আখেরাত বিক্রয় করে দিয়ো না। আবার বলেছেন, এক শ্রেণীর ব্যক্তিরা বিক্রি করেদেবে।
মানুষ কেন অনুধাবন করে না যে, দুনিয়া দুঃখ-কষ্ট ও ক্লান্তি-ক্লেশের স্থান। এখানে সুখ-শান্তি খোঁজ করা বোকামী। অথচ প্রকৃত সুখ-শান্তি রয়েছে জান্নাতে। আমরা কেন এমনটা ভেবেছি যে, ঈমান এনেছি তাই জান্নাত আমার হবে? অথচ আল্লাহ জান্নাত প্রতানের নিমিত্তে বান্দার নিকট থেকে পরীক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। তিনি বলেন, তোমরা এমনটা কী করে ভাবলে যে, ঈমান আনয়নের পরে বিনা পরীক্ষায় জান্নাতে দাখিল হবে? আল্লাহ তাআলা মুমিনের জন্য দুটি জিনিস পসন্দ করেন (এক) দারিদ্রতা (দুই) মৃত্যু। আর বান্দারা এই দুটোকেই অপসন্দ করে থাকে। অথচ এই দুটির মধ্যে চরম কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
যা আলোচনা করা হচ্ছে তা মানুব জীবনে ষড়রিপু থেকে। মানুষ অনুধাবন না দুনিয়া একটি ধোঁকার সামগ্রী মাত্র। যারা ঈমান আনয়নের পরেও ষড়রিপুর অতিরিক্ত ব্যবহার করে চলেন তাদের জন্য অতিব দ্রুত সমন্বয় করে চলা উচিৎ। আর তা না করলে পরোকাল অধিক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা, যে ব্যক্তি যতটুকু দুনিয়াকে আঁকড়ে ধরবে, সে ব্যক্তি পরোকালকে ততটুকু হারাবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন- একজন ঈমানদার ব্যক্তি যাকাত দিতেন না। আখেরাতে সে জাহান্নামে যাবে এবং পঞ্চাশ হাজার বছর জাহান্নামে অবস্থান করবেন। এরপরে আল্লাহর ইচ্ছানুসারে সে জান্নাতে যেতেও পারে কিংবা আজীবন জাহান্নামে থাকতেও পারেন। যাকাত না প্রদানকারীকে শাস্তির মেয়াদ হাদীসে এসেছে, “তার এ শাস্তি চলতে থাকবে এমন এক দিনে যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছর, তারপর তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে হয়। জান্নাতের দিকে না হয় জাহান্নামের দিকে”। [মুসলিম: ৯৮৭, আবু দাউদ: ১৬৫৮, নাসায়ী: ২৪৪২, মুসনাদে আহমাদ: ২/৩৮৩] [কুরতুবী]
আমরা সমাজ, দেশ, জাতিকে সংশোন করতে ব্যতিব্যস্তও বটে। কিন্তু প্রথমে নিজেকে, পরিবারকে এরপরে জাতির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। আখেরাতে সবচেয়ে বড় অভাগা হবে সেই ব্যক্তি যে অন্যকে সংশোধ করেছে কিন্তু সে নিজেকে সংশোধনে ব্রতী হয়নি। অন্যকে উপদেশ দিয়েছে কিন্তু নিজেকে তা দেয়নি বা সে মানেনি। অন্যের আমনতকে নিজের মনে করে খেয়ানত করেছে কিন্তু সংশোধন হয়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা অন্যেল দোষ-গ্লানি নিয়ে গীবত তহমতে ব্যস্ত অথচ নিজের আমলের প্রতি কোন কর্ণপাত করি না। আমি ছাড়া সবায় সংশোধন হোক এটা আজকের বক্তাদের নীতিমালা। সারা দুনিয়ার মানুষকে সংশোধন না করে, প্রথমে নিজেকে সংশোধন করতে আজই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, শ্রেষ্ঠ্য মুজাহিদ ঐ ব্যক্তি যে নিজের নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। আবার সবচেয়ে সফল ঐ ব্যক্তি যে নিজেকে সংশোধন করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে’ (শামস ৯১/৯)। অন্যত্র বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি নিজের পরিশুদ্ধি অর্জন করে, সে নিজের জন্যই তা পরিশুদ্ধি অর্জন করে। আর এটা হ’ল আল্লাহর কাছেই প্রত্যাবর্তন’ (ফাতির ৩৫/১৮)। তাই আসুন! অনুতপ্ত হয়ে নিজের কর্মের জন্য অনুশোচনা করে আজই দুনিয়া প্রীতি থেকে নিজেকে মুক্ত করি এবং দ্বীনের উপর অবিচল থাকি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন আমীন।